(আগের পর্বের পরে)
কুতুবমিনার প্রাঙ্গণ থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে লেখক সিরি বা আলাই দুর্গ দেখলেন। সুলতান আলাউদ্দিন দুর্গটি তৈরি করেছিলেন। এখানে হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ ছিল কিন্তু সিরি বর্তমানে ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। শেরশাহ এই দুর্গের প্রাচীর ভাঙ্গিয়ে এখানকার পাথর ব্যবহার করে শের-ই-গড় বা শের মন্ডল তৈরি করান। সিরির কাছে রয়েছে রওশন চিরাগ যা ফিরোজ শাহ কর্তৃক নির্মিত রওশন চিরাগ নামক মুসাফিরের সমাধি।
পরবর্তী গন্তব্য তুঘলকাবাদ। ভারতে মুসলমান আমলে তৈরি দুর্গগুলির মধ্যে তুঘলকাবাদ শ্রেষ্ঠ। এটি ১৩২১ থেকে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। লালকোট বা সিরি দুর্গের মত বিশালত্ব এখানে না থাকলেও এই দুর্গের নিরাপত্তার রক্ষার যে আয়োজন তা প্রশংসনীয়। এখানে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সমাধি রয়েছে, যা তাঁর পুত্র মোহম্মদ বিন তুঘলক তৈরি করিয়েছিলেন। তুঘলাকাবাদের কাছে অবস্থিত একটি ছোট দুর্গ মোহামুদাবাদ, যেটি মোঃ বিন তুঘলকের তৈরি সেটিও দেখলেন।
তারপর তাঁরা দেখলেন জাহানপানাহ্, যা মুঘলদের ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য মোহম্মদ বিন তুঘলকের সৃষ্ট আরেকটি শহর। বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত এই শহরে একসময় সাতটি দুর্গ ও ৫২ টি দরজা ছিল। হুমায়ুনের সমাধির কাছে নীলাবুর্জ বা নীল সমাধি বলে একটি সুন্দর স্থাপত্য আছে। হয়ত কোন মুসলমান ধর্ম গুরুর সমাধি এটি। এর চকচকে নীল টালির কাজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর দুই তিন মাইল পশ্চিমে রয়েছে তীর বুর্জ নামে তিনটি সমাধি। ছোটা খান, কালা খান ও বড়া খানের সমাধিগুলি লাল বেলে পাথরের তৈরি। লোদী স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই সমাধিগুলি এখন ধ্বংসের পথে।
এরকম শয়ে শয়ে স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে অবহেলিত ভাবে দিল্লির এখানে ওখানে। লেখক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি দেখলেন। গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশে তাঁর শিষ্য ও মহান কবি আমীর খুসরুর সমাধি রয়েছে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি তথা দরগার কাছেই শাহজাহান কন্যা জাহানারা সমাধি। তাঁর সমাধিতে লেখা আছে শাহজাহানের কন্যা ও পবিত্র মানব নিজামুদ্দিন চিস্তির শিষ্যা ফকিরা জাহানারা বেগমের সমাধি এটি। তাঁর শেষ ইচ্ছামত তাঁর সমাধির মাথা খোলা রাখা হয়েছে। তারপর দেখলেন জামাতখানা মসজিদ। এর মধ্যে উপরের ডোম থেকে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘন্টা ঝুলছে। তাঁরা নিজামুদ্দিনের কুয়ো দেখলেন, ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি।
এরপর তাঁদের গন্তব্য ফিরোজাবাদ বা সুলতান ফিরোজ শাহের তৈরি শহর। ফিরোজ শাহের প্রাসাদ ও দুর্গকে ফিরোজ শাহ কোটলা বলা হয়। এখানের জামি মসজিদটি দিল্লির সবথেকে বড় মসজিদ ছিল কিন্তু এখন রয়েছে তার সামান্য ধ্বংসাবশেষ। বর্তমান মসজিদের পাশে একটি পাথরের স্তম্ভ আছে, যেটির সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত। কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিত জেমস প্রিন্সেপ এর গায়ের লিপির পাঠ করেছেন ও এটিকে অশোকের স্তম্ভ লিপি বলে পরিচয় দিয়েছেন। এটি ফিরোজ শাহ খিজরাবাদ থেকে এখানে আনিয়ে স্থাপন করান। সিরাত-ই-ফিরোজশাহী নামে ফিরোজ শাহের জীবনী গ্রন্থে এই স্তম্ভকে মিনার-ই-জারিন বা স্বর্ণস্তম্ভ বলা হয়েছে। এই স্তম্ভের গায়ে সম্রাট অশোকের ধর্ম প্রচারের বাণী ছাড়াও অন্যান্য কিছু লিপি খোদিত আছে। দ্বিতীয় লিপিটিতে চৌহান রাজা বিশাল দেবের হিমাদ্রি থেকে বিন্ধ্য পর্যন্ত জয়ের কথা লেখা, ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া গুপ্ত প্রভৃতি যুগের কিছু লিপিও আছে স্তম্ভের গায়ে। শেষ লিপি আছে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইব্রাহিম লোদীর নামে। ফিরোজ শাহ মিরাট থেকে আরেকটি অশোক স্তম্ভ আনিয়ে ছিলেন ও সেটি তার কুশক শিকার প্রাসাদ (এটি বর্তমান তিন মূর্তি ভবনের ভিতরে অবস্থিত) প্রাঙ্গনে স্থাপন করিয়েছিলেন। এটি ফারুকশিয়ার বাদশাহ থাকার সময় কামানের গোলায় ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। কালাম মসজিদ তুর্কমান গেটের কাছে অবস্থিত ১৩৮৭ তে তৈরি মসজিদ। কালান বা বড় মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদটি ফিরোজ শাহ তুঘলকের আরেকটি স্থাপত্যের নিদর্শন। এই মসজিদে তাইমুর উপাসনা করতে এসেছিলেন দিল্লি আক্রমণ করে ফেরার দিন। ফিরোজ শাহের শাসনকালে খান-ই-জাহান (ফিরোজশাহের প্রধানমন্ত্রী) খিড়কি নামে মসজিদ, দুর্গ ও গ্রাম তৈরি করেছিলেন। মসজিদটি বিশালাকার জালির কাজ যুক্ত করা খিড়কি যুক্ত। এর নিকটে সাতটি খিলানযুক্ত সাতপুল্লা বাঁধ ফিরোজ শাহের নির্মিত (উইকিপিডিয়ায় বলা আছে এটি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে তৈরি)। ফিরোজ শাহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সবথেকে মহান কাজ হল যমুনা উপত্যকার কাটা সেচের খালগুলি। ফিরোজশাহ কোটলা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত কিলা রাই পিথোরা বা তুঘলকাবাদেরই মত। কুতুব থেকে ৪-৫ মাইল দূরে হাউস খাস হলো ফিরোজ শাহের সমাধিস্থল। এই সুলতান এত পাঠান স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন কিন্তু তাঁর সমাধি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে এখানে যে সমাধিটি রয়েছে তা হয়তো পরবর্তীকালে পুনর্গঠন করা হয়েছে সস্তা উপকরণ দিয়ে।
ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের পর (১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) তেমন কোন স্থাপত্য হয়নি সুলতান তুঘলক সাম্রাজ্যকালে। এরপর তাইমুরের ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লির বহু স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে যায়। লোদী বংশের বহলুল লোদীর সমাধি, সিকান্দার লোদীর সমাধি (সফদরজাং -এ) ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না।
এরপর পরবর্তীতে দিল্লিতে স্থাপত্যের কাজ হয় মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের আমলে। তিনি পুরানা কিল্লার সংস্করণ করে তার নাম রাখেন দীন-পানাহ্। শেরশাহ দীন-পানাহের নাম পরিবর্তন করে রাখেন শের-ই-গড়। তারপর শেরশাহের পুত্র সেলিম শাহ সেলিম গড় প্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুন পুনরায় ক্ষমতায় এসে যার নাম দেন নূর গড়। সেলিম গড় ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে।
দিল্লিতে মোগল আমলের প্রথম কীর্তি আজও যা রয়েছে তা হুমায়ুনের সমাধি। এই সমাধি আকবরের মা হামিদা বানু বেগমের নির্দেশে তৈরি হয়েছে। সমাধিটির শ্বেত পাথরের ডোম দূর থেকে দেখা যায়। সমাধির চারদিকে ফুলে ভরা সুন্দর বাগানটি হেঁটে বেড়ানোর জন্য খুব মনোরম। এই সমাধির বাম পাশে তাঁর পত্নী হামিদা বানুর সমাধিও রয়েছে। সিপাহী যুদ্ধের শেষে ব্রিটিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাহাদুর শাহ জাফর (শেষ মুঘল বাদশাহ্) হুমায়ুনের সমাধিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়ার আগে। হুমায়ুনের সমাধি চত্বরে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। যেমন - মোবারক খান খানানের সমাধি (ইনি বাবরের জীবনী তুর্কি থেকে পারসিতে অনুবাদ করেন); ঈশা খানের মসজিদ (ইনি শেরশাহের এক অভিজাত সভাসদ ছিলেন); তাগাহ্ খানের সমাধি (আকবরের প্রধানমন্ত্রী)। মোগল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ৬৪ খাম্বা বা ৬৪ পিলার বিশিষ্ট হল। এটি তাগাহ খানের পুত্র খান-ই-আজিম তৈরি করিয়েছিলেন। পুরানা কিলার কাছে অবস্থিত লাল বাংলো ও কালা মহল দুটি মুঘল স্থাপত্যের নমুনা।
আকবর রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার পরে শাহজাহান আবার রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে আনেন। যে নগর শাহজাহান তৈরি করেন, তার নাম দেন শাহাজানাবাদ। বর্তমানে এটি পুরাতন দিল্লি নামে খ্যাত। প্রাচীরে ঘেরা এই নগরে ঢোকার অনেকগুলি দরজা (কাশ্মীরি দরওয়াজা, কাবুল দরজা, তুর্কমান দরওয়াজা, দিল্লী দরওয়াজা, ফরাসখানা দরওয়াজা, রাজঘাট দরওয়াজা আর কলকাতা দরওয়াজা) ছিল। কলকাতা দরওয়াজা থেকে রাজপথ ও রেল স্টেশন যেতে হয়।
দিল্লি গেট দিয়ে শহরে ঢুকলে প্রথমে চাঁদনী চক আসে। রাস্তার দু'ধারে এখানে অসম্ভব জাঁকজমকপূর্ণ দোকান রয়েছে। এখানে যা পাওয়া যায় কলকাতায় তা পাওয়া যায় না। চাঁদনী চকের কাছেই রয়েছে অবশ্য দর্শনীয় জুম্মা মসজিদ। তাজমহলের পরেই ভারতের সবচেয়ে চমৎকার মহল এটি। এটি দিল্লির উচ্চতম মহল ও দিল্লির সব জায়গা থেকে এই মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। জুজুলা পাহাড় নামক ৩০ ফুট উঁচু ঢিপির ওপর অবস্থিত এই জুম্মা মসজিদ। পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ এখানে একসঙ্গে প্রার্থনা করতে প্রার্থনা করতে পারে।
পরবর্তী গন্তব্য দিল্লি দুর্গ যা শাহজাহানের কীর্তি। উঁচু লাল রঙের প্রাচীরে ঘেরা (যমুনা নদীর দিকে প্রাচীর নেই) দুর্গের দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে দেখলেন দেওয়ান-ই-আম বা জনসাধারণের সঙ্গে বাদশাহ্ -এর দেখা করার জায়গা। আগ্রা দুর্গের থেকে এই দুর্গের দেওয়ান-ই-আম আকারে বড়। লাল পাথরের পিলার ও কারুকার্যময় দেওয়ান-ই-আমের দেওয়াল এখন সাদা চুনকাম করা হয়েছে। এটি এখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আস্তানা। শ্বেত পাথরের যে সিংহাসনটি এখানে আছে বলে লেখক শুনেছিলেন, সেটি তাঁকে দেখতে দেওয়া হলো না। এরপর তাঁরা এলেন দেওয়ান-ই-খাসে। এটি ১৫০ ফুট লম্বা, ৪০ ফুট চওড়া, শ্বেত পাথরের স্তম্ভ বিশিষ্ট হল। এই ভবনের মূল্যবান যেসব কারুকার্য ছিল সেসব আর নেই। এখানে একসময় ছিল শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। অপূর্ব কারুকার্য করা, অগণিত মনি মানিক্য খচিত ময়ূর সিংহাসন, বার্নিয়েরের বর্ণনায় যার হদিশ পাওয়া যায়, সেটি নাদির শাহ লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। লেখক দেখলেন বেগমদের মহল - রংমহল, মতি মহল। কিন্তু তাঁর মনে হলো সেগুলি বিশেষ কিছু নয়। আসলে বার্নিয়ের প্রমুখের বর্ণনা অনুসারে জানতে পারা সমস্ত প্রাচুর্য বিনষ্ট বা লুণ্ঠিত হয়েছে, সোনা রুপা মূল্যবান পাথর চুরি হয়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে ফোয়ারা, ভেলভেট মসলিন প্রভৃতির সাজ বিনষ্ট হয়েছে; পড়ে আছে শুধু পাথরের কাঠামোটুকু। এরপর লেখক বাদশাহের স্নানাগারে গেলেন, যেটি একটি শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মহল, যেখানে রঙিন কাঁচের জালনা, ফোয়ারা, গরম জল-ঠান্ডা জল আসার নানা রকম ব্যবস্থা, বড় স্নানের চৌবাচ্চা প্রভৃতি রয়েছে। এবার দ্রষ্টব্য তসবীর মহল বা ছবির গ্যালারি। কিন্তু সেখানে কোন ছবি তখন ছিল না। দেওয়ালে সাদা চুল কাম করা হয়েছে। মতি মসজিদ, বাদশাহের উপাসনাগার, এখন অবহেলিত ও হতশ্রী অবস্থায় আছে। এটি বাদসাহ আওরঙ্গজেব তৈরি করিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের কামানের গোলায় মসজিদের ক্ষতি হয়েছে, সারাইয়ের কাজ চলছে। শাহবাগ বা রাজকীয় উদ্যান যা একসময় অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল, তা এখন নোংরা, ভগ্ন প্রায় ও পরিত্যক্ত মনে হলো লেখকের। দিওয়ানখানা ও হারেমের কাঠামো ছাড়া আর কিছু এখানে চোখে পড়ে না। ফোয়ারাগুলি শুকিয়ে গেছে।
আগে দিল্লি দরওয়াজা-তে দুটি হাতির পিঠে যোদ্ধার মূর্তি ছিল। এই মূর্তি দুটি রাজপুত বীর জয়মল ও পুত্তের স্মৃতিতে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন এবং আগ্রা দুর্গের দরজায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শাহজাহান এই দুটি মূর্তি আগ্রা থেকে এনে দিল্লী দুর্গে রাখেন। আওরঙ্গজেব এটিকে পৌত্তলিকতা ভেবে অন্যত্র সরিয়ে দেন। এখন মূর্তি দুটি অন্যত্র বসানো হবে বলে লেখক শোনেন। (পরে শুধু হাতির মূর্তি দুটি দিল্লি গেটে বসানো হয়। জয়মল ও পুত্তের মূর্তি-দুটি কোথায় আছে তা জানা যায় না)।
(চলছে)
(আগের পর্বের পরে)
লেখক ভোলানাথ চন্দ্রের মতে খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইন্দ্রপ্রস্থ রূপে জন্ম নিয়েছিল দিল্লি শহর। মহাভারতের যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যে পাঁচটি গ্রাম বা প্রস্থ বা পাট চেয়েছিলেন সেগুলি হল পানিপথ, ইন্দ্রপাট, তিলপাট বাঘপাট ও সোনপাট (সোনিপাট)। এর মধ্যে ইন্দ্রপ্রস্থ বা ইন্দ্রপাটে যুধিষ্ঠির তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
পুরানা কেল্লা বা লালকোট যুধিষ্ঠিরের তৈরি রাজধানী শহরের ধ্বংসস্তূপে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠা ও ধ্বংস হওয়া প্রাসাদ, ঘরবাড়ির বর্তমান ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে পুরানা কেল্লায় মুসলমান যুগের স্থাপত্যই চোখে পড়ে, যুধিষ্ঠিরের আমলের কোন স্থাপত্যের চিহ্ন এখন নেই। (উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে, খনন কার্যের ফলে পুরনো কেল্লাতে খ্রীষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের বসবাসের চিহ্ন মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। এখানে ক্রমান্বয়ে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, রাজপুত, সুলতান, মুঘল যুগের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে)। ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথমে কেল্লাটিকে যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ বলেছিলেন। যদিও তিনি বলেন বর্তমান প্রাসাদ মুসলমান শাসকদের তৈরি।
বর্তমানে পুরানা কেল্লায় দর্শন দর্শনীয় স্থান এবার দেখলেন লেখক। প্রথমে কিলা কোনা মসজিদ যার নির্মাণ হুমায়ুন শুরু করেছিলেন আর শেরশাহ শেষ করেন। খিলান, নীল টালি, মার্বেল ইত্যাদি আফগান বৈশিষ্ট্য সম্বলিত মসজিদ এটি। কিন্তু মসজিদটি এখন ভগ্নপ্রায়। শের-ই-মন্ডল আরেকটি দর্শনীয় স্থান। এই তিনতলা, আটটি কোণা বিশিষ্ট, লাল পাথরের বিশাল প্রাসাদটি শেরশাহ তৈরি করেছিলেন। সিংহাসন পুনর্বার অধিকার করার পর হুমায়ুন এটি পাঠাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। এর ভিতরে সুন্দর কারুকার্য ছিল, যার সামান্যই এখন অবশিষ্ট আছে। এই ভবনেই হুমায়ুন সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে হুমায়ুন প্রাণ হারান।
দিল্লি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে মাইল পাঁচেক দূরে অবস্থিত। দিল্লির প্রাচীনতম স্থাপত্য অশোক স্তম্ভ। তারপর প্রাচীনতার দিক থেকে আসে লৌহ স্তম্ভ। মিশ্র ধাতুর তৈরি ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ও ৬০ ফুট উচ্চতার লৌহ স্তম্ভটির ২২ ফুট মাটির উপরে আছে আর বাকী অংশ মাটির তলায় অবস্থিত। এত প্রাচীনকালে এত বড় ধাতুর স্তম্ভটি ঢালাই এর কাজ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাছাড়া স্তম্ভে কোন মরচে ধরে নি এখনও। স্তম্ভটির গায়ে সংস্কৃত লিপিতে লেখা আছে। এটি রাজা ধবের (উইকিপিডিয়ার মতে রাজা চন্দ্র) কীর্তি স্তম্ভ, তিনি বিষ্ণুর উপাসক, যিনি সিন্ধুর বাহ্লিক দমন করেছেন ও সমগ্র পৃথিবী শাসন করেছেন। রাজা ধবের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। লিপির বৈশিষ্ট্য দেখে গুপ্ত যুগের লিপি বলে মনে হয়। হয়তো গুপ্ত পরবর্তী যুগে লেখা এটি। স্তম্ভের গায়ে আরেকটি লিপিতে লেখা আছে ১১০৯ সম্বত অর্থাৎ ১২৫২ খ্রিস্টাব্দে অনঙ্গ পাল দিল্লি শাসন করেছেন (তোমারা সাম্রাজ্যের বংশের প্রতিষ্ঠাতা অনঙ্গ পাল)। হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত আছে এই লৌহ স্তম্ভ পান্ডবদের তৈরি। স্তম্ভ মাটির তলায় এত গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত যে তা বাসুকি নাগের মাথায় বসানো আছে। এক তোমারা রাজা পরবর্তীকালে স্তম্ভটি তুলতে গেলে ভূগর্ভ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে এবং স্তম্ভটি আলগা বা ঢিল্লি হয়ে যায়। সেই ঘটনায় ঢিল্লি থেকে জায়গার নাম হয়েছে দিল্লি। অন্য মতে এক তোমারা রাজার জন্য ঋষি ব্যাস এই লোহার দণ্ডটি মাটিতে পুঁতে দেন। তিনি বলেন বাসুকির মাথায় এটি স্থাপিত হল। কিন্তু কৌতুহলী রাজা যখন এটি তোলার চেষ্টা করেন তিনি দেখেন দন্ড তোলার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বাসুকিনাগের রক্ত দেখা যায় রাজা আবার মাটিতে রোপন করতে চান কিন্তু পুরোটি পারেন না। ঋষি ব্যাস রাজাকে জানান যেমন তোমার জন্য দন্ড মাটিতে আলগা ভাবে বসে রইল তেমনি তোমার রাজত্ব ঢিলে বা অস্থায়ী হবে এবং ঊনবিংশ বংশ পরে প্রথমে চৌহান, পরে তুর্কিদের হাতে দিল্লি চলে যাবে। তৃতীয় মতে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান ব্রাহ্মণদের সাহায্যে লোহার দন্ড সর্পরাজ শেষনাগের মাথায় রাখেন, যাতে তাঁর সাম্রাজ্য চিরজীবী হয়। কৌতূহলের বসে তিনি সত্যি শেষ নাগের মাথায় দন্ডটি বসানো হয়েছে কিনা দেখার জন্য সেটি তুলে ফেলেন। দন্ডের শেষে রক্ত দেখা যায় এবং রাজা জানতে পারেন তাঁর রাজত্বের মেয়াদ খুব স্বল্পকাল। তারপর থেকে হিন্দু রাজ্যেরও অবসান হবে। অনঙ্গ পাল ২ দিল্লিতে রাজত্ব স্থাপন করে লালকোট দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন লৌহ স্তম্ভটিকে কেন্দ্রে রেখে, ১১১৭ সম্বত বা ১৬০ খ্রিস্টাব্দে।
লালকোট নাম থেকে অনুমান হয় যে দুর্গটি লাল পাথরের তৈরি। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় এটি ধূসর পাথরে তৈরি। এটির পরিসীমা আড়াই মাইল। দুর্গের চারপাশের পরিখা আছে। দুর্গের তিনটি দরজার অবস্থান এখনো দেখা যায়, চতুর্থ দরজাটি বোঝা যায় না প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার কারণে। প্রাচীরের ভেতর যেসব ঘরবাড়ি বা মন্দির ছিল সেগুলির এখন পৃথক অস্তিত্ব নেই, শুধুই ভগ্নস্তূপ। এখান থেকে কিছু দূরে এখনো অনঙ্গ তাল নামে একটি সরোবর আছে। সেটি ১৯ ফুট লম্বা ও ১৫২ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর। নিশ্চয়ই দুর্গের লোকেদের জল সরবরাহ করার জন্য সরোবরটি খনন করা হয়েছিল। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সময় লালকোট কেল্লার বাইরেও শহর বিস্তীর্ণ হয়েছিল। বৃহত্তর শহরের সুরক্ষার জন্য বাইরে চার মাইলের বেশি পরিসীমার প্রাচীর দেওয়া হয়েছিল লালকোট দুর্গকে কেন্দ্র করে। লালকোট কেল্লার নাম সেই সময় হয় কিলা রাই পিথোরা অর্থাৎ রাজা পৃথ্বীরাজের কেল্লা। এই প্রাচীরে নটি ফটক ছিল, যার মধ্যে চারটির চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়। লাল কোটের উত্তর দিকে রঞ্জিত গেট দিয়ে মোহাম্মদ ঘোরীর বিধ্বংসী বাহিনী লালকোটে প্রবেশ করেছিল।
ভারতের মাটিতে প্রথম মুসলমান মসজিদ কুতুবউদ্দিন-এর তৈরি মসজিদ হল মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলাম। কুতুব মিনার চত্বরে অবস্থিত এই মসজিদের ১৬৫ ফুট লম্বা ও ৩১ ফুট চওড়া। প্রার্থনা গৃহটি ৫ সারি সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত হিন্দুস্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি একটি ১৪৫ ফুট লম্বা ও ৯৬ ফুট চওড়া প্রাঙ্গণের প্রান্তে অবস্থিত। প্রাঙ্গণের মাঝখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত লৌহ স্তম্ভ। এই প্রাঙ্গণটিতে অন্তত ১২০০ হিন্দুস্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু মন্ভদিরের ভগ্নাংশ ব্যবহার করে তিন বছরের মধ্যে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল।
কুতুব মিনার মানুষের তৈরি (লেখকের সময় পর্যন্ত) পৃথিবী সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ। এটি ২৩৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ভূমি পৃষ্ঠ থেকে। নীচের দিকে এই মিনারের চব্বিশটি পৃষ্ঠতল আছে ১৪৭ ফুট পরিধি যুক্ত। উপরের দিকে এটি বৃত্তাকার। এর মোট পাঁচ তলা আছে। প্রতিটিতে ঝুল বারান্দা আছে। তিন তলা পর্যন্ত মিনারটি লাল বেলে পাথরের ও তার উপরের শ্বেত পাথরের তৈরি। ভেতরের দিক ধূসর পাথরের তৈরি। মিনারের ভিতরে সিঁড়ি আছে, ভিতরে আলো হাওয়া পূর্ণ পরিবেশ। বারান্দা ও মিনারের বহির্গাত্রে কোরআনের বাণী আরবিতে লেখা আছে। মিনারের গায়ের লিপি থেকে জানা যায় সুলতান আলতামাস বা ইলতুৎমিস মিনারের কাজ শেষ করিয়েছিলেন। মিনারের গায়ে ফিরোজ শাহ তুঘলকের নামও আছে। বাজ পড়ে একবার মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফিরোজ শাহ তুঘলক সেটি সারাই করান ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে মিনারে আবার সারাইয়ের কাজ করতে হয়। তৎকালীন সুলতান সিকান্দার লোদী সেই কাজ করান। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে এক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবমিনার। ব্রিটিশ সরকার তখন মেরামত করেন। ১৮৪৭ এ আবার কিছু সংস্কার করান ব্রিটিশ সরকার।
কুতুব মিনার হিন্দু রাজাদের কীর্তি কিনা তাই নিয়ে বিতর্ক আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে হিন্দু এক রাজা তাঁর কন্যার সূর্যের উপাসনা ও যমুনা দর্শনের জন্য এই মিনার তৈরি করিয়েছিলেন। হিন্দুদের স্বপক্ষে আরো যুক্তি এই যে মিনারের প্রবেশপথ উত্তরমুখী, যা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। মুসলমানদের প্রচলিত প্রবেশপথ পূর্বমুখী। বারান্দাগুলিতে যে ঘন্টা সাজানো আছে তা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। অন্যদিকে মুঘল বাদশাহ আকবর শাহ ২ -এর মুন্সি সৈয়দ আহমেদ লিখে গেছে কুতুব মিনার আসলে মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলামের মজিনাহ্ বা আজান দেওয়ার স্থান। কুতুব মিনারের আরবি লিপিতে মোহম্মদ ঘোরীর প্রশস্তি ও কুতুবুদ্দিনের নাম পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে মিনার তৈরির কাজ শুরু করেন কুতুবউদ্দিন এবং আলতামস বা ইলতুৎমিস সেই কাজ শেষ করেন। কবি চাঁদ বরদোই, যিনি পৃথ্বীরাজ চৌহানের জীবনী লিখে গেছেন, তাঁর লেখায় এই মিনারের কোন উল্লেখ নেই। তাই এটি সুলতানি আমলে তৈরি হয়েছে এই যুক্তিটি বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে হিন্দু স্থপতিদের দ্বারা কুতুব মিনার তৈরি বলে এই স্থাপত্যে কিছু কিছু হিন্দু প্রভাব পড়েছে। লেখক যখন কুতুব মিনারে গেছিলেন তখন তার চূড়া পর্যন্ত দর্শনার্থীদের যাওয়ার অধিকার ছিল।
লেখক এবং সঙ্গীরা এবার কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত অসমাপ্ত মিনারটি দেখলেন। এটি কুতুব মিনারের থেকে দ্বিগুণ বড় করে তৈরি করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। হিন্দুদের মতে এই মিনার থেকে রাজকন্যার গঙ্গা দেখার ব্যবস্থা করার জন্য সেটি তৈরি হচ্ছিল কিন্তু মুসলমান আক্রমণের ফলে কাজটি শেষ হয়নি। অন্য মতে আলাউদ্দিন খিলজি এই মিনারটি তৈরি করেছিলেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও পরে মারা যাওয়ায় এই কাজ শেষ হয়নি।
প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে সুলতান আলতামসের সমাধি। সমাধির ভিতর দিকে দেওয়াল খুব সুন্দর করে তৈরি। সমাধিটি ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। এর মাথার ওপর খোলা, যেন স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর মধ্যে কোন বাধা রাখা হয়নি।
এবার তাঁরা মেহেরৌলির প্রাচীন কুঁয়া দেখলেন, যেটি নাকি অনঙ্গপাল ২ -এর তৈরি (মেহেরৌলির বাউলি)। পরবর্তী দর্শনীয় স্থান আদম খানের সমাধি (আদম খান আকবরের একজন সেনাপতি ছিলেন)।
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী নির্মিত আলাই দরওয়াজার বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। এর গায়ে আরবি অক্ষরে লেখা আছে ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দে এর তৈরি কথা। দেখলেন হুমায়ুনের ধর্মগুরু ইমাম জামিনের সমাধি, আকবরের অন্যতম ভ্রাতৃসম মোহম্মদ কুলি খানের সমাধি, মোহম্মদ কুলি খানের সমাধির বাড়িটি এখন মেটকাফ হাউস নামে পরিচিত হয়েছে (চার্লস মেটকাফ তখন দিল্লির বাদশাহের দরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ছিলেন)।
(চলছে)
(আগের পর্বের পরে)
লেখক ভোলানাথ চন্দ্র এরপর বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সাধকদের জন্য প্রসিদ্ধ কিছু স্থান দর্শন করলেন। বৈষ্ণব সাধক হরিদাস গোস্বামীর সমাধি বা সমাজ প্রথম দর্শনীয় স্থান। চৈতন্যদেব হিন্দু দাহ-প্রথার বদলে বৈষ্ণবদের মধ্যে সমাধি-প্রথা প্রচলন করেন। হরিদাস তখন শেষ জীবনে হরিনামগান করে দিনাতিপাত করছেন বৃন্দাবনে। বাদশাহ আকবর যমুনা নদীপথে যেতে যেতে একবার হরিদাস গোস্বামীর গান শোনেন এবং সেই গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন তাঁকে রাজসভায় গিয়ে প্রধান গায়কের আসন অলংকৃত করতে। হরিদাস গোস্বামী স্বাভাবিক কারণেই অসম্মত হন। বারংবার অনুরোধে তিনি তাঁর তরুন শিষ্য তানসেন-কে আকবরকে দেয়। তানসেন এরপর আকবরের সভা অলংকৃত করেন এবং কালক্রমে কিংবদন্তি গায়ক হন। বৃন্দাবনে হরিদাস গোস্বামীর অতি সাধারণ দেখতে সমাধি হিন্দুদের দর্শনীয় স্থান।
কার্তিক মাসে বৃন্দাবনে রাস উৎসব পালিত হয়। রাস মন্ডল একটি অঙ্গন যেখানে শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন নাচ হয়। সারা শহর জুড়ে রাসমণ্ডল হয় এই সময়।
বৃন্দাবনে লালাবাবুর মতো খ্যাতি আর কারো নেই।ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহের নাতি ছিলেন লালা বাবু (লালাবাবুর প্রকৃত নাম কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ)। এই বিশাল ঐশ্বর্যবান মানুষটি যৌবনে সংসার ত্যাগ করে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে বৃন্দাবনে চলে আসে। এখানে একটি অসাধারণ মন্দির তৈরি করান এবং সেই মন্দিরের দরিদ্র সেবায় প্রতিদিন ১০০ টাকা করে খরচ করতেন। প্রতিদিন ৫০০ মানুষ এখানে ঠাকুরের প্রসাদ পেত। মন্দিরের চত্বর প্রতিদিন লালাবাবু নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন এবং নিজে ভিক্ষা করে আনা রুটি মাত্র খেতেন। এই সর্বত্যাগী মানুষটি পরে বৃন্দাবন ছেড়ে গিরি গোবর্ধনের গুহায় ধ্যান করার জন্য চলে যান।
পরবর্তী গন্তব্য রূপ গোস্বামীর আশ্রম স্থল। এই আশ্রম এখন আর জঙ্গলের মধ্যে নির্জনে নেই। এটি এখন পাকা রাস্তায় অবস্থিত। সেখানে ভরতপুরের রাজার তৈরি একটি উৎকৃষ্ট মানের মন্দির আছে।
তাঁরা এবার গেলেন নিধুবন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ রোজ বাঁশি বাজাতেন আর গোপিনীদের সঙ্গে লীলা খেলা করতেন। এটি বর্তমানে শহরের মধ্যে অবস্থিত নীচু প্রাচীর দেওয়া এক স্থান, যেখানে জঙ্গল ঝোপঝাড় আছে। ললিতা কুন্ড বলে একটি জলাশয় আছে এখানে।
তারপর তাঁরা গেলেন মদনমোহনজি দর্শনে। এই মন্দির রানী কুব্জার প্রতিষ্ঠিত। মথুরার পতনের সময় মদনমোহনজি অদৃশ্য হয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দী অদৃশ্য থাকার পর তিনি এক চৌবে মহিলার বাড়িতে প্রকট হন, যিনি তাঁকে তাঁর শিশু পুত্রের সঙ্গী হিসেবে রাখেন। পরে মদনমোহন সনাতন গোস্বামীর কাছে আসেন। সনাতন গোস্বামীর দেওয়া অতি সাধারণ প্রসাদে অরুচি হওয়ায় মদনমোহন রাজকীয় খাদ্য অভিলাষ করেন কিন্তু তা সনাতনের সাধ্যাতীত ছিল। তখন এক বণিকের মালবাহী নৌকা বালির চড়ায় আটকা পড়ে। সওদাগর সাহায্যের আশায় ঘুরতে ঘুরতে মদনমোহনের মন্দিরে আসেন ও মানত করেন যদি এই যাত্রা তাঁর নৌকার জিনিসপত্র বেঁচে যায় তবে মদনমোহনের সেবায় সেই অর্থ ব্যায়িত করবেন। অলৌকিকভাবে নৌকা উদ্ধার হয় ও বণিকের আশাতীত লাভ হয়। তিনি দেবতার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন। সেই মন্দিরের দেবতা বৃন্দাবনের প্রধান তিন দেবতার একজন হন। সনাতন গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত সেই মূর্তি এখন জয়পুরে আর প্রাচীন মন্দিরটি পরিতক্ত ও ভগ্নপ্রায়। সনাতনের সমাজ বা সমাধি সেখানে আছে। এখানে চৈতন্যদেব এসেছিলেন। তাঁর পায়ের ছাপ, খড়ম আর যে তেঁতুল গাছের যে ছায়ায় তিনি বসেছিলেন তা রয়েছে। যদিও গাছটি এত পুরনো বলে লেখকের মনে হয় নি আর চরণচিহ্ন খুব ছোট মাপের বলে লেখকের সন্দেহ হয়।
নিকুঞ্জবন যা রাধা কৃষ্ণের অভিসারের উদ্যান সেটি লেখকের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান। কথিত আছে নিকুঞ্জ বনে কোন মানুষ রাত কাটাতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এই বন একটি নীচু পাঁচিল ঘেরা, ঝোপ ঝাড় ঘাসে ঢাকা জমি, যেখানে অনেক হনুমানের বাস। এরমধ্যে লেখক বৃন্দাবন শহর ও তার চারপাশে হনুমানের অত্যাচারের কাহিনী বলেছেন। একটিমাত্র গাছ রয়েছে নিকুঞ্জবনে, যেটি তার প্রাচীনত্ব প্রদর্শন করছে।
বাঁকাবিহারী বৃন্দাবনের সবচেয়ে বড় শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি। তাঁর পাশে কোন রাধা মূর্তি নেই। রাধারমন হলেন গোপাল ভট্ট গোঁসাই-এর প্রতিষ্ঠা একটি শিলা থেকে উদ্গত মূর্তি।
বৃন্দাবনে লেখক নাটক দেখলেন। একটি বড় মন্দিরের উঠানে বা প্রাঙ্গনে সামিয়ানা টাঙিয়ে শয়ে শ়য়ে বাতির আলোতে উজ্জ্বল মঞ্চে নাটক অনুষ্ঠিত হল। রঙিন পাগড়ী শোভিত ব্রজবাসীরা পা মুড়ে মাটিতে বসে সেই নাটক দেখল। ব্রজনারীরা রঙিন পোশাক পড়ে, ঘেরা জায়গায় বসে দেখল। প্রাঙ্গণের মাঝখানে উঁচু মঞ্চের প্রতি প্রান্তে ২টি ছেলে দুটি করে মশাল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল নিধুবনে রাধা কৃষ্ণ। একটি সুন্দর অল্পবয়সী ছেলে মাথায় মুকুট ও নারীদের সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করল। ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণকে কথা বলতে শুনে খুব ভালো লাগছিল লেখকের।
বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রীরা আরও বেশ কিছু স্থানে তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেমন - মধুবন বা তাল বন, যেখানে কৃষ্ণ বলরামের বাল্যলীলা হয়েছিল। রাধাকুন্ড, শ্যামকুন্ড, ললিতাকুন্ড (লালাবাবু রাধাকুন্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যাম কুন্ডের জলের রং নীলাভ আর ললিতা কুন্ডের জল দুধের মতো সাদা। শ্যাম কুন্ডের পাশে বসে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্য চরিতামৃত কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন)।
রাধাকুণ্ড থেকে চার মাইল দূরে গোবর্ধন পর্বত যা বৈষ্ণবদের কাছে কৈলাস পর্বতের মতো পবিত্র। এই পর্বত কৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুলে তুলে ধরে ছাতার মতো ব্যবহার করে অতিবৃষ্টিতে সমগ্র বৃন্দাবনকে রক্ষা করেছিলেন। লেখক গিরি গোবর্ধনকে নিয়ে আরো একটি কাহিনী লিখেছেন। লঙ্কায় যুদ্ধকালে লক্ষণ রাবণের বানে আহত হলে চিকিৎসক (সুষেণ) বলেছিলেন হিমালয়ের একটি নির্দিষ্ট পাহাড় থেকে (গন্ধমাদন) নির্দিষ্ট একটি গাছ (বিশল্যকরনী) আনতে পারলেই তাঁকে সুস্থ করা যাবে। হনুমান সেই গাছ আনতে যান কিন্তু কার্যকালে গাছের নাম ভুলে যাওয়াতে সম্পূর্ণ পাহাড়টি পিঠে তুলে লঙ্কা যাত্রা করেন। বর্তমানে যেখানে গোবর্ধন পর্বত রয়েছে সেই স্থানের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রামের ভাই ভরত সেখানে ছিলেন। তিনি হনুমানকে ভাবেন লঙ্কার রাক্ষস। তাই তিনি তীর ছোঁড়েন হনুমানের পায়ে তীর লাগায় তিনি রাম রাম বলে ওঠেন এবং তাঁর পিঠ থেকে গন্ধমাদন পর্বতের একটি ছোট অংশ পড়ে যায় মাটিতে। ভরত রাম নাম শুনে তাঁর ভুল বোঝেন। তারপর হনুমানের কাছে সব শুনে তাঁকে বলেন তাঁর তীরের ডগায় গন্ধমাদন-সহ বসতে যাতে তীর ছুঁড়ে ভরত তাঁকে আরও তাড়াতাড়ি লঙ্কায় পৌঁছে দিতে পারেন অসুস্থ ভাই লক্ষণের ঔষধ নিয়ে। হনুমান অবশ্য নিজের অলৌকিক শক্তি বলেই লঙ্কায় পৌঁছান। গন্ধমাদনের যে টুকরো ওই স্থানে পড়েছিল তা গোবর্ধন পর্বত নামে খ্যাত হয়।
গোবর্ধন পর্বতে এখন অনেক মন্দির আছে, যার মধ্যে প্রধান মন্দিরে কৃষ্ণের শিশুরূপ গোপাল হিসেবে পূজা হয়। বল্লভাচার্য গোপাল রূপে কৃষ্ণের পূজার প্রথম প্রচলন করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্রজ অঞ্চলের বৈষ্ণব ধর্মের সাধক ও দার্শনিক ছিলেন বল্লভাচার্য। প্রতিবছর কার্তিক মাসে অন্নকূট উৎসব বল্লভাচার্য শুরু করেছিলেন, এখনো সেটি এখানে পালিত হয়।
বৃন্দাবন শহরের মাঝখানে রঞ্জিত সিংহের (ভরতপুরের মহারাজা) সুন্দর সমাধি অবস্থিত। এই সমাধির একদিকে একটি জলপূর্ণ পুকুর ও অপরদিকে একটি জলশূন্য পুকুর রয়েছে। এর কারণ শ্রীকৃষ্ণ নাকি একবার তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি পুকুরের সমস্ত জল নিঃশেষে পান করে নিয়েছিলেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া যখন ভরতপুর আক্রমণ করেছিলেন তখন তিন মাস যাবত দূর্গ অবরোধ করে রেখেছিলেন। সেই সময় রঞ্জিত সিংহ সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছিলেন। শূন্য পুকুর সেই অবরোধকে প্রতীকী ভাবে দেখায়।
চরণ পাহাড়ি নামক স্থানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর গরুর পালের পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। এই পাহাড়ের লুকালুকি নামক স্থান ছিল তাঁর লুকোচুরি খেলার স্থান গোপিনীদের সঙ্গে।
কাম্যবন নামক স্থানে পাণ্ডবদের বনপর্বে থাকার সময় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখানে তাঁদের মূর্তি, যজ্ঞশালা প্রভৃতি যাত্রীদের দেখানো হয়।
বারসানার রাজা বৃষভানুর কন্যা রাধার জন্মস্থল; নন্দগাঁও যা কৃষ্ণের শৈশবের লীলাভূমি; বস্ত্রহরণ ঘাট, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করেন প্রভৃতি দর্শন করেন।
লেখক এরপর দেখেন মহাবন যেখানকার প্রধান দেবতা বলদেও বা বলদেব, যিনি কৃষ্ণের দাদা বলরাম।
গোকূল, যমুনার মধ্যে একটি দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থিত। এটি বৃন্দাবনের সুন্দরতম স্থান বলা যায়। এই স্থান এখনও অনেকটা কৃষ্ণের সময়ের গোকূলের মত পরিবেশ বজায় রেখেছে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এখানকার মূল বিগ্রহ গোকূলনাথ জঙ্গলে লুকানো ছিলেন মুসলমান আক্রমণের কারণে। বল্লভাচার্য তাঁকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওরঙ্গজেবের সময় আবার মূল মূর্তি অন্যত্র (জয়পুরে) পাঠানো হয়। এখানে আছেন প্রতিমূর্তি। গোকূলে পুতনা-খাল দেখলেন লেখক, যেখানে কংস-প্রেরিত রাক্ষসী পুতনাকে মেরে যমুনায় ভাসিয়ে দেন কৃষ্ণ।
এভাবে শেষ হল লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের বৃন্দাবন দর্শন।
লেখকের এর পরবর্তী ভ্রমণকাহিনী এর চার বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৬, ৫ নভেম্বর শুরু হল। এবার কাহিনী শুরু হলো টুন্ডলা জংশন থেকে। এই সময়ের মধ্যে দিল্লি পর্যন্ত রাজপথ নতুন করে তৈরি হয়েছে। ফলে ঘোড়ার গাড়ির গতি অনেক বেড়ে গেছে।
প্রথম উল্লেখযোগ্য স্থান যেটি পথে পড়ল সেটি হলো হাতরাস। ডাকাত, ঠগীর আস্তানা থেকে এখন এটি ব্যস্ত তুলো আর নীলের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
তারপর এলো আলিগড়, এর প্রাচীন নাম কোল বা কোয়েল। লেখক স্থানটিকে কোয়েল আলিগড় লিখেছেন। এই কোল অতি প্রাচীনকাল থেকে ছিল বলেছেন লেখক। কৃষ্ণ কংসকে বধ করার পর জরাসন্ধ, যিনি কংসের জামাই ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে আক্রমণ করতে যাওয়ার সময় এখানে বিশ্রাম করেছিলেন। সিন্ধিয়ার সেনানায়ক মসিয়ে পেরোন-এর মাটির দূর্গের জন্য আলিগড় স্মরণীয়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে (দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধে, ১৮০৩ থেকে ১৮০৫) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি লর্ড লেক এই দূর্গটি আক্রমণ করে ধ্বংস করেন, এক প্রবল প্রতিরোধ প্রতিহত করে। এখন শুধু দূর্গটির ধ্বংসাবশেষ আছে জঙ্গলময় পরিবেশে। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব আলিগড়ে ভালোই পড়েছিল। এখন ধীরে ধীরে জায়গাটি শ্রী ফিরে পাচ্ছে।
আলিগড় থেকে দিল্লি যাওয়ার ট্রেনে করে লেখক রওনা দিলেন পরদিন। খুরজা, বুলন্দশহর, সিকান্দ্রাবাদ, দাদরি, গাজিয়াবাদ হয়ে এল দিল্লি। দূর থেকে চোখে পড়ল কুতুব। ক্রমে ক্রমে হুমায়ুনের সমাধি, যমুনা, আর নানা রকম মিনার-স্তম্ভ-প্রাসাদ-মসজিদ সম্বলিত, বহু প্রতীক্ষিত দিল্লি শহর চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।
(চলছে)
(আগের পর্বের পরে)
দি ট্রাভেলস অফ হিন্দু, ভলিউম টু'র শুরুতে লেখক ভোলানাথ চন্দ্র ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে এবার উটের গাড়িতে পয়লা নভেম্বর, ১৮৬০ আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
পথে তিনি আকবরের বেগম যোধাবাইয়ের সমাধি দেখলেন। কিন্তু সমাধির সুন্দর দরজা, দেওয়াল সরকার ভেঙে বিক্রি করে দিয়েছে। সমাধির মাটি খুঁড়ে খনি বিদ্যার হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ফলে সমাধিটি আর নেই।
আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রি ২৪ মাইল। গাড়িতে ছয় ঘন্টা লাগে যেতে। পথে সমাধি, মসজিদ, ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের প্রাসাদ তৈরির আগে সেটি এক জনশূন্য পাহাড়ি জায়গা ছিল। এক মুসলমান পীর (যাঁর বয়স ৯৬ বছর) শেখ সেলিম সেখানে নির্জনে বসবাস করতেন। বাদশাহ আকবর নিঃসন্তান ছিলেন পুত্রের আকাঙ্খায় তিনি ও তাঁর পত্নী যোধাবাই পায়ে হেঁটে আজমিরের মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় যান। রাতে স্বপ্নে মইনুদ্দিন চিশতী আকবরকে আদেশ দেন ফতেপুর সিক্রিতে বৃদ্ধ সেলিম এর কাছে যেতে। শেখ সেলিমের কৃপায় আকবরের পুত্র সেলিম বা জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। আকবর তাঁর রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে নিয়ে আসেন, এখানে একটি অপূর্ব নগরী তৈরি করে।
ফতেপুর সিক্রির সবথেকে নজরকাড়া জিনিসটি হল ১২০ ফুট উঁচু, ১২০ ফুট চওড়া রাজকীয় দরজা (বুলন্দ দরওয়াজা)। শেখ সেলিমের শ্বেত পাথরের ছোট সুন্দর সমাধি, শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মসজিদ-ও দর্শনীয়। আকবরের প্রাসাদ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। বিশাল বড় হাতি দরজার সামনে দুটি প্রমাণ মাপের পাথরের হাতির মূর্তি দেখা যায়। বিস্ময়কর একটি বিষয় হল ফতেপুর সিক্রিতে সাদা কালো মার্বেল পাথরের দাবার ছকের মেছে। সেই দাবার ছকে জেনানার ৩২ জন মহিলা দাবার গুটির বদলে বসত। বাদশাহ ছিলেন নির্ণায়ক, অভিজাতরা দর্শক এবং দুজন মনসবদার সাদা ও কালোর পক্ষে দাবা খেলতেন। যে জয়ী হত সে ওই ৩২ জন রমণীকে পেত। ফতেপুর সিক্রিতে বীরবলের ছোট কিন্তু কারুকার্যযুক্ত বাড়ি দেখা যায়।
পরদিন লেখকের ও তাঁর সঙ্গীরা সিকান্দ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে কিছু বাদশাহী ক্রোশ মিনার বা মাইলফলক দেখা গেল যেগুলি বৃত্তাকার এবং এখানকার মাইলফলক থেকে আকারে বড়। এগুলি মোগল আমলে ভারতের রাজপথে দুই মাইল অন্তর লাগানো ছিল। কোশ মিনার বা ক্রোশ মিনার-এর কাছে একটি করে নজর বুরুজ থাকত পথিকদের সুবিধার জন্য। রাজপথের দু'ধারে ছাওয়া দেওয়া গাছ লাগানো ছিল।
সিকান্দ্রা নাম সম্ভবত সিকান্দার লোদীর নামে হয়েছিল। সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি রয়েছে, ফুল ফলের বাগিচায় ঘেরা। আকবরের সমাধির বাইরের বারান্দায় দুটি ছোট সমাধি আছে, আকবরের শৈশবে মৃত দুই নাতির। বাইরে রয়েছে তাঁর অনুগত কিছু আমির ওমরাহের কবর।
মুনী বেগম নামে আকবরের এক ইউরোপীয় বেগম ছিলেন, যিনি সম্ভবত গোয়া থেকে এসেছিলেন তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আকবর সিকান্দ্রায় একটি সুন্দর সমাধি তৈরি করেছিলেন। পরে অনেক বছর ধরে চার্চ মিশন সোসাইটি সেখানে ছাপাখানা চালায় এবং দুর্ভিক্ষের সময় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০০ জন অনাথকে সেখানে রাখে। (উইকিপিডিয়া আকবরের খ্রিস্টান ও ইউরোপীয় বেগমের বিষয়টি অস্বীকার করছে। সেখানকার মতে, যোধাবাই এর অপর নাম ছিল মারিয়াম উজ জামানি। তাঁকে খ্রিস্টান বলে ভুল করা হয়। কিন্তু লেখকের লেখা পড়ে ধারণা হয় যে তিনি ঠিক তথ্যই দিয়েছেন কারণ লেখক যোধাবাই ও মুনী বেগম দুজনেরই সমাধি প্রত্যক্ষ করেছেন)।
লেখকের পরবর্তী গন্তব্য মথুরা। পথে একদল মথুরার চৌবে পান্ডা লেখকদের গাড়ির পাশে পাশে ছুটতে থাকল তাঁদের তীর্থযাত্রী হিসেবে নেওয়ার জন্য। লেখকেরা নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিয়ে শেষে ছাড়া পেলেন। এবার তাঁরা মোগল প্রাচীনত্ব থেকে হিন্দু প্রাচীনত্বে প্রবেশ করলেন।
মথুরা হল বাল্মিকী আর মনুর সুরসেনা, স্ট্রাবো আর আরিয়ানের (প্রাচীন গ্রীক লেখক ও ঐতিহাসিক) মেথোরা, হিউয়েন সাং-এর মো-থৌ-লো। সুপ্রাচীন কালে এখানে সুর নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন, যিনি কুন্তি ও বাসুদেবের পিতা। তাঁর নামে রাজ্যের নাম হয় সুরসেনা বা সুরসেনী। মথুরার পরবর্তী খ্যাতি কৃষ্ণ ও কংসের কাহিনী ঘিরে। একসময় মথুরা সম্পূর্ণভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে এসেছিল। ফাহিয়েন এখানে সাতটি বৌদ্ধস্তূপ ও তিন হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সম্বলিত কুড়িটি বৌদ্ধ-মঠ দেখেছেন। ফা হিয়েন মথুরায় একমাস ব্যাপী ছিলেন ও বৌদ্ধধর্ম মহাসম্মেলনে অংশ নেন। হিউয়েন সাং-এর সময় এখানে বছরে তিনটি ধর্মানুষ্ঠান পালিত হতো। লেখক বলেন বর্তমানে কংস টিলা নামে খ্যাত ধিবিটি সম্ভবত কোন বৌদ্ধস্তূপ যা কালের প্রভাবে মাটি চাপা পড়েছে।
যমুনা নদীর ধারে কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় বিশ্রাম ঘাট দর্শনীয়, যেখানে কৃষ্ণ ও বলরাম কংসকে বধ করার পর স্নান ও বিশ্রাম করেছিলেন। এই ঘাটের জলে অনেক কচ্ছপ আছে। ঘাটের উপর বেশ কিছু সুন্দর মন্দির আছে। প্রতিদিন সকালে যমুনার আরতি হয়। এই ঘাটে প্রতিবছর মহাস্নান মেলা হয়, যার নাম যমনা কা বুরকী। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে লাখের উপর মানুষ আসেন এই মেলাতে। নভেম্বর মাসের কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় দিন এই মেলা হয়। ভিড়ের ফলে কোন দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশের বন্দোবস্ত করা হয়।
মথুরা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কাটরা বা বাজার অবস্থিত। এর মাঝখানে আওরঙ্গজেবের নির্মিত জুম্মা মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদটি একটি ত্রিশ ফুট উঁচু ঢিবির ওপর রয়েছে। স্তম্ভ, মূর্তি, লিপি ইত্যাদি যা যা ওই অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি সম্রাট অশোকের সময় সন্ন্যাসী উপগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধমঠ ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা ক্ষমতায় এসে বৌদ্ধমঠের উপকরণ ব্যবহার করে মন্দির তৈরি করেছিল। গজনীর সুলতান মাহমুদ অনেক মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেছিলেন। আওরঙ্গজেব মথুরায় হিন্দু মন্দিরের উপরে মসজিদ গঠন করেছিলেন। মসজিদটিতে অনেক ফাটল দেখা দেওয়ায় এটি এখন ব্যবহার করা হয় না।
রাজা জয়সিং নির্মিত দূর্গের সামান্য ধ্বংসাশেষ ছাড়া কিছুই এখন পাওয়া যায় না। মানমন্দিরটিও ভগ্নপ্রায়। আহমদ শাহ দূরানীর (আফগানিস্থানের শাসক, ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বারবার ভারত আক্রমণ করেন) ধ্বংসলীলার ফলে দূর্গ ও মানমন্দির সম্ভবত নষ্ট হয়েছে।
মথুরায় চৌবে সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা একচেটিয়াভাবে পান্ডার কাজ করে। লেখকেরা অত্যন্ত ধৈর্য ও চালাকির সঙ্গে তাদের উৎপাতের মোকাবিলা করেন। চৌবে মহিলাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন লেখক। মথুরায় মাড়োয়ারি, মারাঠা, চৌবেদের বাজার বেশ জমজমাট। রাস্তার দু'পাশে অবস্থিত সুসজ্জিত দোকানে সব রকম জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। উৎসবের মরশুম ছিল সেটি। লেখকের দুজন বন্ধু নাচ দেখার জন্য মথুরায় রয়ে গেলেন।
লেখক বাকি সঙ্গীদের সঙ্গে চললেন বৃন্দাবন। এবার তাঁদের যাত্রার বাহন রথ। নামে রথ হলেও এই রথ শ্রীকৃষ্ণের আমলের রথ নয়। এই রথটি লাল পর্দার ঘেরাটোপে সাজানো, দুই চাকাযুক্ত যান যা টেনে নিয়ে যায় দুটি বলদ। মথুরা থেকে বৃন্দাবন তিন গো ক্রোশ। গো ক্রোশ সেই দূরত্ব যতদূর একটি গরুর আওয়াজ পৌঁছতে পারে। সেই প্রাচীন মাপ যুক্ত রাস্তায়, প্রাচীনকালের রথে, পৌরাণিক যমুনার কুল হয়ে লেখকেরা বৃন্দাবন যেতে যেতে অনেক ময়ূর দেখতে পেলেন, যে ময়ূরের পাখা মাথায় পরেন শ্রীকৃষ্ণ। পরদিন তাঁরা বৃন্দাবন পৌঁছলেন।
লেখকের পিতামহ, প্রপিতামহরা তাঁদের পরম আকাঙ্ক্ষিত তীর্থস্থানে বেরোনোর আগে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে যেতেন। কারণ স্থলপথে হিংস্র পশু, ডাকাত, ঠগী, মারাঠা দস্যুর ভয় ছিল। জলপথে ঝড়, জলদস্যু, জল পুলিশের ভয় ছিল। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই তীর্থ ভ্রমণের। বৃন্দাবনে লেখক একজন পান্ডা নিলেন ও তার খাতায় পূর্বপুরুষদের নাম খুঁজতে গিয়ে এক কাকা-দাদু ১৮২৫ তে এসেছিলেন সেই প্রমাণ পেলেন।
মথুরাকে কেন্দ্র করে ৮৪ মাইল ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট চক্রাকার পথে ভ্রমণ করে তীর্থস্থান দর্শন করলে প্রাচীন ব্রজভূমি বা ব্রিজ দেখা যায়। ব্রজভূমির সর্বোত্তম স্থান হলো বৃন্দাবন। বৈদেশিক মুসলমান আক্রমণে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিপত্তি বৃন্দাবন থেকে লোপ পায়। চৈতন্যদেবের মথুরা, বৃন্দাবন আগমনের সময় থেকে সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের পুনর্জাগরণ হয় বলা যায়।
বৃন্দাবনে পৌঁছেই গোঁড়া হিন্দুরা ধুলোপায়ে গোবিন্দজিকে দর্শন করতে যান। কাশীর বিশ্বের মন্দির দেখে লেখক যেমন হতাশ হয়েছিলেন বৃন্দাবনের গোবিন্দজির মন্দির দেখেও সে রকম অনুভূতি হল তাঁর। মন্দিরের গঠন সাধারণ, সাজসজ্জা তেমন নেই। সজ্জার মধ্যে আছে কিছু লাল পর্দা আর বড় পেতলের দীপাধার। কিন্তু একপাশে রাধা ও অন্যপাশে ললিতাকে নিয়ে গোবিন্দজি-কে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। তার পরণে সকালের পোশাক। মাথায় পাগড়ি বাঁধা হিন্দু রাজবেশ। অন্য সময় অন্যান্য পোশাকে পোশাকে তাঁকে সজ্জিত করা হয়। তিনি সর্বদা বাঁশি নিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র বাঁশি ছাড়েন যখন কংস বধ করার জন্য তীর ধনুক হাতে যোদ্ধার বেশে থাকেন। এই মূর্তিটি প্রতিমূর্তি। আসল মূর্তি আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মেবারের রানা রাজ সিং রাজপুতানায় নিয়ে যান। মূর্তিটি নাথদোয়ারায় বিদ্যমান (শ্রীনাথজি রূপে)। (প্রকৃত পক্ষে, গোবিন্দজির মূর্তি রাজা সওয়াই জয় সিং জয়পুরে তাঁর রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্যদিকে মেবারের রানা রাজ সিং গোবর্ধনজির মূর্তি বৃন্দাবন থেকে নিয়ে গিয়ে নাথদোয়ারায় শ্রীনাথজি নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন)।
বৃন্দাবনে মন্দিরের সংখ্যা অগণিত। প্রতিটি মন্দিরে রাধা, কৃষ্ণ ও সখি ললিতা বিরাজিত (এখন কিন্তু প্রায় সব মন্দিরে ললিতা অনুপস্থিত)। জয়পুরের রাজা, ভরতপুরের রাজা, সিন্ধীয়ার রানী, হোলকরের রানী, দিনাজপুরের রাজা, বর্ধমানের রাজা প্রমুখ বহু রাজা-রানী প্রতিষ্ঠিত মন্দির এখানে আছে। মন্দির গুলির দৈনন্দিন খরচা এক একটিতে ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
গোবিন্দজির পরেই দ্রষ্টব্য গোপীনাথজি। এই মূর্তিটিও প্রতিমূর্তি আওরঙ্গজেবের আক্রমণের কারণে। সিপাহী বিদ্রোহের জন্য তিন বছর যাবত যাত্রী সমাগম খুব কমে যাওয়ার ফলে গোবিন্দজির মন্দির দেনায় ডুবে গেছে ও বন্ধক রাখতে হয়েছে।
কাশীঘাট অন্যতম বিখ্যাত ঘাট কারণ এখানে শিশু কৃষ্ণ কংসের প্রেরিত কাশী দৈত্যকে বধ করেছিলেন। বস্ত্রহরণ বৃক্ষ হল সেই গাছ যেখানে যমুনায় স্নানরত গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করে কৃষ্ণ কৌতুক ছলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। রয়েছে অক্রুরঘাট যেখানে কৃষ্ণ-বলরামকে মথুরায় আনার সময় অক্রুর রথ থামিয়েছিলেন। কালিয়াদহ আরেকটি বিখ্যাত ঘাট যেখানে কৃষ্ণ কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন। কৃষ্ণর এই বিজয়কে স্মরণ করতে কালিয়াদহতে প্রতিবছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রহ্মকুন্ড হল সেই পবিত্র কুন্ড যেখানে ব্রহ্মাকে বিষ্ণু পরাজিত করেছিলেন।
বেনারসে বিষ্ণু শিবের উপাসনা করেন আর এখানে তার বিপরীত। শৈব ও বৈষ্ণবদের নিজ নিজ বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রয়াস এটি। যমুনার ধারে একটি বটগাছকে অক্ষয় বট বলে দেখানো হয়। বলা হয় এর একটি শেকড় এখানে, অপর দুটি এলাহাবাদে ও পুরীতে আছে। এখানে গোপেশ্বর নামে এক শিব মন্দির আছে। কথায় বলে, গোপিনী পরিবেষ্টিত কৃষ্ণকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে শিব ব্রজতে এসেছিলেন আনন্দে কাটাতে। কেউ যাতে তাঁকে চিনতে না পারে তাই তিনি সুন্দরী তরুণীর ছদ্মরূপে এসেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁকে দেখে চিনে ফেলেন। কিন্তু কৃষ্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে শিবকে অভ্যর্থনা করে এবং শিব আনন্দোৎসবে কৃষ্ণ ও গোপিনীদের সঙ্গে যোগ দেন।
(চলছে)
সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক ---- সুমনা দাম বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...