মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৪

৫৪। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৮ ভোলানাথ চন্দ্র

 

   

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)

মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব শিল্প, সাহিত্য, গান, বাজনা, স্থাপত্য সবকিছুর প্রতি বিরূপ ছিলেন। এমনকি নিজের সমাধি তৈরিতেও তিনি অর্থ ব্যয় করতে চাননি। একমাত্র দিল্লি দুর্গের মতি মসজিদ তিনি তৈরি করেছিলেন। 


আওরঙ্গজেবের এক অবিবাহিতা কন্যা জিনাতউন্নেসা, জিনাত মসজিদ বা কুমারী মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন, যা দরিয়াগঞ্জের কাছে যমুনার তীরে অবস্থিত (এটি ঘাটা মসজিদ নামেও বর্তমানে খ্যাত)। শাহজাহানের কন্যা রোশেনারার তৈরি উদ্যান (রোশনারা উদ্যান) আরেকটি মুঘল রাজকন্যার তৈরি দর্শনীয় স্থান। শাহজাহানের পুত্র দারার প্রাসাদ দেখার মত ছিল। সেই প্রাসাদে পরে দিল্লির কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। 

দিল্লির রাজপুরুষ বা অভিজাতদের অনেকের সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ছিল দিল্লিতে। জয়পুরের রাজা জয় সিং যন্তর মন্তর তৈরি করেছিলেন দিল্লিতে, যা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার স্থান, যেরকম বেনারসের মান মন্দির আর লখনৌ-এর তারা কোঠি। দিল্লি আর আগ্রার মাঝামাঝি স্থানে, তাজমহলের ধাঁচে যে বিশাল সৌধটি রয়েছে সেটি সফদরজঙের মাজার বা সমাধি (সফদরজং ছিলেন অযোধ্যার নবাব)। শ্বেত পাথর ও লাল ও গোলাপি বেলে পাথরের তৈরি সৌধটি তাঁর পুত্র অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার তৈরি। এর পাশেই এক মুঘল অভিজাত ব্যক্তি গাজী উদ্দীন খানের সমাধি রয়েছে। গাজী উদ্দিন খানের নামাঙ্কিত একটি মাদ্রাসা আজমিরি গেটের কাছে বহু বছর ছিল। 


এর পরবর্তীকালে নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ঘটনা ঘটে। সেই লুণ্ঠন, ধ্বংসলীলা চলে ৫৮ দিন ধরে, ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে, যা কয়েক'শ বছরের সৃষ্টিকে তছনছ করে দিল। তারপর আহমদ শাহ দুরানি ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট আটবার ভারত আক্রমণ করেন। তারপর আফগান নেতা গোলাম কাদির ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাদশা শাহ আলমকে পদচ্যুত করে ও অন্ধ করে আড়াই মাস যাবত দিল্লি দখল করে রাখেন ও লুণ্ঠন চালান। ফলে মুঘল স্থাপত্য আর নতুন করে সৃষ্টিও হয় না, পুরনো কিছু স্থাপত্যও অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। 


এবার লেখক দিল্লি ইনস্টিটিউট (এই বাড়িটির বর্তমান নাম জানতে পারা যায় না বা আদৌ এটির অস্তিত্ব আছে কিনা তাও জানা যায়নি) দেখতে গেলেন। ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই বাড়িতে বহির্গাত্র লাল পাথরের গুঁড়ো দিয়ে সজ্জিত, যাতে পাথরের মতো দেখতে লাগে। দিল্লি ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে স্টেশন-লাইব্রেরি, গভর্নমেন্ট কলেজ ও মিউজিয়াম অবস্থিত। লাইব্রেরী রয়েছে বাড়িটির এক তলার পশ্চিম কোণে। সিপাহী বিদ্রোহের আগে এই লাইব্রেরীতে নয় হাজার বই ছিল। 


লেখকেরা এবার মিউজিয়ামে গেলেন, যেটি পাশের একটি হলে রয়েছে। হলে ঢোকার পথে দুটি লাল পাথরের ভাঙ্গা মূর্তি চোখে পড়ে। মূর্তি দুটির কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত রয়েছে। তার মধ্যে একটি মাথা নেই, অপরটির নাক ভাঙ্গা। লেখকের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই দুটি সেই জয়মল ও পুত্তের মূর্তি। জিজ্ঞাসা করে গাইডের কাছে জানলেন মূর্তি দুটি হাতির পিঠে বসানো ছিল। হিন্দু পোশাক ও রাজপুত পাগড়ী দেখেও মূর্তি দুটি কাদের অনুমান করা যাচ্ছিল। যে মূর্তির মাথা রয়েছে সেটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের। তাই লেখক বুঝতে পারেন সেটি জয়মলের। কারণ চিতোর দুর্গ অবরোধের সময় পুত্তের বয়স ছিল মাত্র ষোলো। (উইকিমিডিয়া থেকে পাওয়া যায় একটি ছবি যেটি এখানে দেওয়া হল। সেটি উনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে জোসেফ ডেভিড বেগলারের তোলা। ছবিটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কালেকশন থেকে পাওয়া। একটি অজ্ঞাত পরিচয় বাড়ির দরজার সামনে পাথরের মূর্তি দুটি রয়েছে। অর্থাৎ এই সেই দুটি মূর্তি যা লেখক দেখেছিলেন। লেখক যখন দেখেছিলেন তখন একটি মূর্তির মাথা শরীরে ছিল না। উইকিমিডিয়ায় পাওয়া ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে একটি মূর্তির মাথা পরবর্তীকালে লাগানো হয়, যেটি পুত্তের মূর্তি। তারপরে ওই দুটি মূর্তি কোথায় গেছে তা জানা যায়নি। হাতির মূর্তি দুটি লালকেল্লার দিল্লি দরওয়াজাতে লর্ড কার্জন বসিয়েছিলেন, সে দুটি সেখানেই আছে)। 



মিউজিয়ামের ভিতরের গ্যালারিতে ব্রিটিশ ভারতের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির ছবি রয়েছে। একজন হিন্দু রাজার ছবি ছিল যিনি সিপাহী বিদ্রোহের জন্য বিখ্যাত। সেই কালো মারাঠা রাজার মনি মুক্ত খচিত সাজ পোশাকে সজ্জিত ছবি রয়েছে গ্যালারিতে (এটি নিঃসন্দেহে নানা সাহেবের ছবি)। মিউজিয়ামে কৃষি, প্রাণিবিদ্যা, প্রত্নবিদ্যা, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিভাগ আছে। বিভিন্ন সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ আছে। অনেক আরবি ফারসি পাণ্ডুলিপিও দেখলেন। দু-একটি পান্ডুলিপিতে সোনার হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। দিল্লি ইনস্টিটিউটের পূর্ব দিকে সরকারি কলেজ অবস্থিত। লেখক এবার তাঁর অভিমত দেন যে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে, জনমত গঠনের দিক থেকে, জনসভা-বক্তৃতা-সংবাদপত্রে সামাজিক সংস্কারের যে প্রভাব কলকাতায় পড়েছে, তার থেকে দিল্লি অনেক পিছিয়ে আছে। এমনকি দিল্লির কলেজের অঙ্ক বিভাগের বাঙালি অধ্যাপককেই আগামী দরবারে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। 



ইনস্টিটিউট সংলগ্ন অংশে রয়েছে রানীর (ইংল্যান্ডের রানীর) উদ্যান। উদ্যান খুব বড় না হলেও তা ইউরোপীয় রুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দেয়। উদ্যানে মোগল যুগের একটি লম্বাটে শ্বেত পাথরের স্নানে চৌবাচ্চা দেখলেন যেখানে হাঁসের বাচ্চারা খেলা করে। এখানকার দরজার কাছে, জয়মলের হাতিটি রাখা আছে (যেটি পরবর্তী কালে দিল্লি গেটে বসানো হয় আর একটি সঙ্গে)। বাগানের মধ্যে দিয়ে আলীমর্দানের (এক মুঘল প্রাদেশিক শাসক) তৈরী খাল বয়ে গেছে। এই খাল থেকে দিল্লী বাসীরা, পানীয় ও বাগানে দেওয়ার জল পায়।


উইকিমিডিয়া থেকে নেওয়া জোসেফ ডেভিড বেগলারের তোলা ছবি



লেখকেরা ভালো সময় দিল্লি এসেছিলেন কারণ সামনে ছিল দেওয়ালি। ঝকমকে দোকানবাজার, লাল-নীল-সবুজ লন্ঠন, প্রদীপ, কাঁচের বাতিদান, মোম ইত্যাদির আলোতে সাজানো শহরে, নতুন পোশাকে সজ্জিত মানুষজন সবাই নাচে, গানে, আমোদে মেতে উঠল। দিল্লি শহরে দিল্লিকা লাড্ডু ছাড়াও নানা রকম মিষ্টি বিক্রি হতে থাকলো। মিষ্টির দোকানে মন্দির, মসজিদ এমনকি মিষ্টির তৈরি দুর্গ বিক্রি হচ্ছে দেখলেন লেখক। নানা রকম পুতুল আর খেলনাও বিক্রি হচ্ছিল। মুসলমানেরা হিন্দুদের উৎসব পুরো দমে উপভোগ করছিল। এখানকার হিন্দুরা লক্ষ্মী পূজা করে সেদিন বাংলার মতো। মহিলারা নিগমবোধ ঘাটে গঙ্গাস্থানে যায়। চাঁদনী চকের বাড়ির বারান্দায় উজ্জ্বল ভাবে সজ্জিত বাইজিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তাঁরা। 


এরপর এল তৎকালীন ভাইসরয়ের আগ্রা দরবার অনুষ্ঠান, যেটি আগ্রা দুর্গে অনুষ্ঠিত হবে। লেখক আগ্রাতে গিয়ে সেটি দর্শন করেন। মুঘল দরবারের অনুকরণে এটি সংঘটিত হবে। দরবার কক্ষ সাজানো হয়েছে দামি কানাত, পর্দা, চাকচিক্যময় সামিয়ানা, সাজসজ্জা, নরম পারস্যের গালিচা দিয়ে। লেখক ভাইসরয়ের দরবারের সঙ্গে প্রাচীন হিন্দু রাজাদের রাজসূয় যজ্ঞের তুলনা করেছেন। এখানে দেশীয় রাজারা, নবাবরা, প্রাদেশিক ইংরাজ শাসনকর্তারা, সামরিক ও অসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সাংবাদিকরা এবং জ্ঞানীগুণী মানুষজন নিমন্ত্রিত হয়েছেন। জয়পুরের রাজা, সিন্ধিয়ারাজ, ভরতপুরের রাজা, ভূপালের বেগম উপস্থিত ছিলেন। বৃত্তাকার জমিতে হাজার হাজার মানুষ, হাতি, ঘোড়া, উট, মহিষ, গাড়ি, এক্কা জমা হয়েছে। অস্থায়ী খাবারের দোকান হয়েছে প্রচুর। কুড়ি টাকা মাসিক ভাড়ার ঘরের এখন ভাড়া হয়েছে ৩০০ টাকা। একদিনে একটি ঘরের ভাড়া লাগছে পাঁচ টাকা করে। গাড়ি পাওয়াও দুষ্কর হয়েছে। 



ভাইসরয় লর্ড জন লরেন্সের আগমন দেখার মত। রাস্তার দু'পাশের বাড়িগুলির জানলা, বারান্দা, ছাদ দর্শকে ভরে গেছে। পুলিশ ভিড় সামলাচ্ছে। সেনাবাহিনী নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। গভর্নর জেনারেল ট্রেনে এসে দিল্লী পৌঁছলেন। সেখানে নৌকার পুল রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে পার হয়ে, তিনি ঘোড়ার পিঠে আগ্রায় এলেন। লেডি লরেন্স নৌকায় আগ্রায় গেলেন। ভাইসরয়-কে আগ্রা দুর্গের প্রাচীর থেকে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট দেওয়া হল। একপাশে একজন কমান্ডার-ইন-চিফ ও অন্য পাশে একজন মহারাজাকে নিয়ে তিনি দরবার প্রাঙ্গনে যান। 


সাত দিন ধরে দরবার সংক্রান্ত মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে ভাইসরয় নাইটহুড প্রদান করেন। বিভিন্ন রাজাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেন। এক সন্ধায় তাজে আলো দিয়ে সাজানো হয়। হাজার হাজার রঙবেরঙের লন্ঠনের আলোয় আর ফোয়ারায় সজ্জিত রাতের তাজ অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে। পাঁচ হাজারের বেশি বিশিষ্ট মানুষ উজ্জ্বল, সুরচিকর পোশাকে সজ্জিত হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যমুনা নদীর পাড় আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। দু-তিন মাইল ব্যাপী নদীর জলে আলোর প্রতিফলন পড়ে মনে হচ্ছিল সমুদ্রে তারার ছায়া পড়েছে। ২০ নভেম্বর, ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভাইসরয়ের আগ্রা দরবার অনুষ্ঠিত হয়। 



এই ঐতিহাসিক দরবার দর্শনের সঙ্গেই শেষ হয় লেখক ভোলানাথচন্দ্রের ভ্রমণ এবং শেষ হয় তাঁর দুই খন্ডে লেখা বই "দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ইন ভেরিয়াস পার্টস অফ বেঙ্গল এন্ড আপার ইন্ডিয়া"।

বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪

৫৩। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৭ ভোলানাথ চন্দ্র

 

  

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                  (আগের পর্বের পরে)

কুতুবমিনার প্রাঙ্গণ থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে লেখক সিরি বা আলাই দুর্গ দেখলেন। সুলতান আলাউদ্দিন দুর্গটি তৈরি করেছিলেন। এখানে হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ ছিল কিন্তু সিরি বর্তমানে ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। শেরশাহ এই দুর্গের প্রাচীর ভাঙ্গিয়ে এখানকার পাথর ব্যবহার করে শের-ই-গড় বা শের মন্ডল তৈরি করান। সিরির কাছে রয়েছে রওশন চিরাগ যা ফিরোজ শাহ কর্তৃক নির্মিত রওশন চিরাগ নামক মুসাফিরের সমাধি। 


পরবর্তী গন্তব্য তুঘলকাবাদ। ভারতে মুসলমান আমলে তৈরি দুর্গগুলির মধ্যে তুঘলকাবাদ শ্রেষ্ঠ। এটি ১৩২১ থেকে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়। লালকোট বা সিরি দুর্গের মত বিশালত্ব এখানে না থাকলেও এই দুর্গের নিরাপত্তার রক্ষার যে আয়োজন তা প্রশংসনীয়। এখানে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সমাধি রয়েছে, যা তাঁর পুত্র মোহম্মদ বিন তুঘলক তৈরি করিয়েছিলেন। তুঘলাকাবাদের কাছে অবস্থিত একটি ছোট দুর্গ মোহামুদাবাদ, যেটি মোঃ বিন তুঘলকের তৈরি সেটিও দেখলেন। 


তারপর তাঁরা দেখলেন জাহানপানাহ্, যা মুঘলদের ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য মোহম্মদ বিন তুঘলকের সৃষ্ট আরেকটি শহর। বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিণত এই শহরে একসময় সাতটি দুর্গ ও ৫২ টি দরজা ছিল। হুমায়ুনের সমাধির কাছে নীলাবুর্জ বা নীল সমাধি বলে একটি সুন্দর স্থাপত্য আছে। হয়ত কোন মুসলমান ধর্ম গুরুর সমাধি এটি। এর চকচকে নীল টালির কাজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর দুই তিন মাইল পশ্চিমে রয়েছে তীর বুর্জ নামে তিনটি সমাধি। ছোটা খান, কালা খান ও বড়া খানের সমাধিগুলি লাল বেলে পাথরের তৈরি। লোদী স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই সমাধিগুলি এখন ধ্বংসের পথে। 


এরকম শয়ে শয়ে স্থাপত্য ছড়িয়ে রয়েছে অবহেলিত ভাবে দিল্লির এখানে ওখানে। লেখক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি দেখলেন। গুরু নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশে তাঁর শিষ্য ও মহান কবি আমীর খুসরুর সমাধি রয়েছে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধি তথা দরগার কাছেই শাহজাহান কন্যা জাহানারা সমাধি। তাঁর সমাধিতে লেখা আছে শাহজাহানের কন্যা  ও পবিত্র মানব নিজামুদ্দিন চিস্তির শিষ্যা ফকিরা জাহানারা বেগমের সমাধি এটি। তাঁর শেষ ইচ্ছামত তাঁর সমাধির মাথা খোলা রাখা হয়েছে। তারপর দেখলেন জামাতখানা মসজিদ। এর মধ্যে উপরের ডোম থেকে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘন্টা ঝুলছে। তাঁরা নিজামুদ্দিনের কুয়ো দেখলেন, ১৩২১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। 


এরপর তাঁদের গন্তব্য ফিরোজাবাদ বা সুলতান ফিরোজ শাহের তৈরি শহর। ফিরোজ শাহের প্রাসাদ ও দুর্গকে ফিরোজ শাহ কোটলা বলা হয়। এখানের জামি মসজিদটি দিল্লির সবথেকে বড় মসজিদ ছিল কিন্তু এখন রয়েছে তার সামান্য ধ্বংসাবশেষ। বর্তমান মসজিদের পাশে একটি পাথরের স্তম্ভ আছে, যেটির সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত। কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিত জেমস প্রিন্সেপ এর গায়ের লিপির পাঠ করেছেন ও এটিকে অশোকের স্তম্ভ লিপি বলে পরিচয় দিয়েছেন। এটি ফিরোজ শাহ খিজরাবাদ থেকে এখানে আনিয়ে স্থাপন করান। সিরাত-ই-ফিরোজশাহী নামে ফিরোজ শাহের জীবনী গ্রন্থে এই স্তম্ভকে মিনার-ই-জারিন বা স্বর্ণস্তম্ভ বলা হয়েছে। এই স্তম্ভের গায়ে সম্রাট অশোকের ধর্ম প্রচারের বাণী ছাড়াও অন্যান্য কিছু লিপি খোদিত আছে। দ্বিতীয় লিপিটিতে চৌহান রাজা বিশাল দেবের হিমাদ্রি থেকে বিন্ধ্য পর্যন্ত জয়ের কথা লেখা, ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া গুপ্ত প্রভৃতি যুগের কিছু লিপিও আছে স্তম্ভের গায়ে। শেষ লিপি আছে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইব্রাহিম লোদীর নামে। ফিরোজ শাহ মিরাট থেকে আরেকটি অশোক স্তম্ভ আনিয়ে ছিলেন ও সেটি তার কুশক শিকার প্রাসাদ (এটি বর্তমান তিন মূর্তি ভবনের ভিতরে অবস্থিত) প্রাঙ্গনে স্থাপন করিয়েছিলেন। এটি ফারুকশিয়ার বাদশাহ থাকার সময় কামানের গোলায় ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। কালাম মসজিদ তুর্কমান গেটের কাছে অবস্থিত ১৩৮৭ তে তৈরি  মসজিদ। কালান বা বড় মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদটি ফিরোজ শাহ তুঘলকের আরেকটি স্থাপত্যের নিদর্শন। এই মসজিদে তাইমুর উপাসনা করতে এসেছিলেন দিল্লি আক্রমণ করে ফেরার দিন। ফিরোজ শাহের শাসনকালে খান-ই-জাহান (ফিরোজশাহের প্রধানমন্ত্রী) খিড়কি নামে মসজিদ, দুর্গ ও গ্রাম তৈরি করেছিলেন। মসজিদটি বিশালাকার জালির কাজ যুক্ত করা খিড়কি যুক্ত। এর নিকটে সাতটি খিলানযুক্ত সাতপুল্লা বাঁধ ফিরোজ শাহের নির্মিত (উইকিপিডিয়ায় বলা আছে এটি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের আমলে তৈরি)। ফিরোজ শাহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে সবথেকে মহান কাজ হল যমুনা উপত্যকার কাটা সেচের খালগুলি। ফিরোজশাহ কোটলা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত কিলা রাই পিথোরা বা তুঘলকাবাদেরই মত। কুতুব থেকে ৪-৫ মাইল দূরে হাউস খাস হলো ফিরোজ শাহের সমাধিস্থল। এই সুলতান এত পাঠান স্থাপত্য নিদর্শন রেখে গেছেন কিন্তু তাঁর সমাধি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে এখানে যে সমাধিটি রয়েছে তা হয়তো পরবর্তীকালে পুনর্গঠন করা হয়েছে সস্তা উপকরণ দিয়ে। 


ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের পর (১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দ) তেমন কোন স্থাপত্য হয়নি সুলতান তুঘলক সাম্রাজ্যকালে। এরপর তাইমুরের ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লির বহু স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে যায়। লোদী বংশের বহলুল লোদীর সমাধি, সিকান্দার লোদীর সমাধি (সফদরজাং -এ) ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। 


এরপর পরবর্তীতে দিল্লিতে স্থাপত্যের কাজ হয় মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের আমলে। তিনি পুরানা কিল্লার সংস্করণ করে তার নাম রাখেন দীন-পানাহ্। শেরশাহ দীন-পানাহের নাম পরিবর্তন করে রাখেন শের-ই-গড়। তারপর শেরশাহের পুত্র সেলিম শাহ সেলিম গড় প্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়ুন পুনরায় ক্ষমতায় এসে যার নাম দেন নূর গড়। সেলিম গড় ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। 


দিল্লিতে মোগল আমলের প্রথম কীর্তি আজও যা রয়েছে তা হুমায়ুনের সমাধি। এই সমাধি আকবরের মা হামিদা বানু বেগমের নির্দেশে তৈরি হয়েছে। সমাধিটির শ্বেত পাথরের ডোম দূর থেকে দেখা যায়। সমাধির চারদিকে ফুলে ভরা সুন্দর বাগানটি হেঁটে বেড়ানোর জন্য খুব মনোরম। এই সমাধির বাম পাশে তাঁর পত্নী হামিদা বানুর সমাধিও রয়েছে। সিপাহী যুদ্ধের শেষে ব্রিটিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাহাদুর শাহ জাফর (শেষ মুঘল বাদশাহ্) হুমায়ুনের সমাধিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়ার আগে। হুমায়ুনের সমাধি চত্বরে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। যেমন - মোবারক খান খানানের সমাধি (ইনি বাবরের জীবনী তুর্কি থেকে পারসিতে অনুবাদ করেন); ঈশা খানের মসজিদ (ইনি শেরশাহের এক অভিজাত সভাসদ ছিলেন); তাগাহ্ খানের সমাধি (আকবরের প্রধানমন্ত্রী)। মোগল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ৬৪ খাম্বা বা ৬৪ পিলার বিশিষ্ট হল। এটি তাগাহ খানের পুত্র খান-ই-আজিম তৈরি করিয়েছিলেন। পুরানা কিলার কাছে অবস্থিত লাল বাংলো ও কালা মহল দুটি মুঘল স্থাপত্যের নমুনা। 


আকবর রাজধানী দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার পরে শাহজাহান আবার রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে আনেন। যে নগর শাহজাহান তৈরি করেন, তার নাম দেন শাহাজানাবাদ। বর্তমানে এটি পুরাতন দিল্লি নামে খ্যাত। প্রাচীরে ঘেরা এই নগরে ঢোকার অনেকগুলি দরজা (কাশ্মীরি দরওয়াজা, কাবুল দরজা, তুর্কমান দরওয়াজা, দিল্লী দরওয়াজা, ফরাসখানা দরওয়াজা, রাজঘাট দরওয়াজা আর কলকাতা দরওয়াজা) ছিল। কলকাতা দরওয়াজা থেকে রাজপথ ও রেল স্টেশন যেতে হয়। 


দিল্লি গেট দিয়ে শহরে ঢুকলে প্রথমে চাঁদনী চক আসে। রাস্তার দু'ধারে এখানে অসম্ভব জাঁকজমকপূর্ণ দোকান রয়েছে। এখানে যা পাওয়া যায় কলকাতায় তা পাওয়া যায় না। চাঁদনী চকের কাছেই রয়েছে অবশ্য দর্শনীয় জুম্মা মসজিদ। তাজমহলের পরেই ভারতের সবচেয়ে চমৎকার মহল এটি। এটি দিল্লির উচ্চতম মহল ও দিল্লির সব জায়গা থেকে এই মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। জুজুলা পাহাড় নামক ৩০ ফুট উঁচু ঢিপির ওপর অবস্থিত এই জুম্মা মসজিদ। পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ এখানে একসঙ্গে প্রার্থনা করতে প্রার্থনা করতে পারে। 


পরবর্তী গন্তব্য দিল্লি দুর্গ যা শাহজাহানের কীর্তি। উঁচু লাল রঙের প্রাচীরে ঘেরা (যমুনা নদীর দিকে প্রাচীর নেই) দুর্গের দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে দেখলেন দেওয়ান-ই-আম বা জনসাধারণের সঙ্গে বাদশাহ্ -এর দেখা করার জায়গা। আগ্রা দুর্গের থেকে এই দুর্গের দেওয়ান-ই-আম আকারে বড়। লাল পাথরের পিলার ও কারুকার্যময় দেওয়ান-ই-আমের দেওয়াল এখন সাদা চুনকাম করা হয়েছে। এটি এখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আস্তানা। শ্বেত পাথরের যে সিংহাসনটি এখানে আছে বলে লেখক শুনেছিলেন, সেটি তাঁকে দেখতে দেওয়া হলো না। এরপর তাঁরা এলেন দেওয়ান-ই-খাসে। এটি ১৫০ ফুট লম্বা, ৪০ ফুট চওড়া, শ্বেত পাথরের স্তম্ভ বিশিষ্ট হল। এই ভবনের মূল্যবান যেসব কারুকার্য ছিল সেসব আর নেই। এখানে একসময় ছিল শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। অপূর্ব কারুকার্য করা, অগণিত মনি মানিক্য খচিত ময়ূর সিংহাসন, বার্নিয়েরের বর্ণনায় যার হদিশ পাওয়া যায়, সেটি নাদির শাহ লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে। লেখক দেখলেন বেগমদের মহল - রংমহল, মতি মহল। কিন্তু তাঁর মনে হলো সেগুলি বিশেষ কিছু নয়। আসলে বার্নিয়ের প্রমুখের বর্ণনা অনুসারে জানতে পারা সমস্ত প্রাচুর্য বিনষ্ট বা লুণ্ঠিত হয়েছে, সোনা রুপা মূল্যবান পাথর চুরি হয়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে ফোয়ারা, ভেলভেট মসলিন প্রভৃতির সাজ বিনষ্ট হয়েছে; পড়ে আছে শুধু পাথরের কাঠামোটুকু। এরপর লেখক বাদশাহের স্নানাগারে গেলেন, যেটি একটি শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মহল, যেখানে রঙিন কাঁচের জালনা, ফোয়ারা, গরম জল-ঠান্ডা জল আসার নানা রকম ব্যবস্থা, বড় স্নানের চৌবাচ্চা প্রভৃতি রয়েছে। এবার দ্রষ্টব্য তসবীর মহল বা ছবির গ্যালারি। কিন্তু সেখানে কোন ছবি তখন ছিল না। দেওয়ালে সাদা চুল কাম করা হয়েছে। মতি মসজিদ, বাদশাহের উপাসনাগার, এখন অবহেলিত ও হতশ্রী অবস্থায় আছে। এটি বাদসাহ আওরঙ্গজেব তৈরি করিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের কামানের গোলায় মসজিদের ক্ষতি হয়েছে, সারাইয়ের কাজ চলছে। শাহবাগ বা রাজকীয় উদ্যান যা একসময় অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল, তা এখন নোংরা, ভগ্ন প্রায় ও পরিত্যক্ত মনে হলো লেখকের। দিওয়ানখানা ও হারেমের কাঠামো ছাড়া আর কিছু এখানে চোখে পড়ে না।  ফোয়ারাগুলি শুকিয়ে গেছে। 


আগে দিল্লি দরওয়াজা-তে দুটি হাতির পিঠে যোদ্ধার মূর্তি ছিল। এই মূর্তি দুটি রাজপুত বীর জয়মল ও পুত্তের স্মৃতিতে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন এবং আগ্রা দুর্গের দরজায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শাহজাহান এই দুটি মূর্তি আগ্রা থেকে এনে দিল্লী দুর্গে রাখেন। আওরঙ্গজেব এটিকে পৌত্তলিকতা ভেবে অন্যত্র সরিয়ে দেন। এখন মূর্তি দুটি অন্যত্র বসানো হবে বলে লেখক শোনেন। (পরে শুধু হাতির মূর্তি দুটি দিল্লি গেটে বসানো হয়। জয়মল ও পুত্তের মূর্তি-দুটি কোথায় আছে তা জানা যায় না)।


                      (চলছে)

৫২। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৬ ভোলানাথ চন্দ্র

 

   

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)


লেখক ভোলানাথ চন্দ্রের মতে খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইন্দ্রপ্রস্থ রূপে জন্ম নিয়েছিল দিল্লি শহর। মহাভারতের যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যে পাঁচটি গ্রাম বা প্রস্থ বা পাট চেয়েছিলেন সেগুলি হল পানিপথ, ইন্দ্রপাট, তিলপাট বাঘপাট ও সোনপাট (সোনিপাট)। এর মধ্যে ইন্দ্রপ্রস্থ বা ইন্দ্রপাটে যুধিষ্ঠির তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। 


পুরানা কেল্লা বা লালকোট যুধিষ্ঠিরের তৈরি রাজধানী শহরের ধ্বংসস্তূপে বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠা ও ধ্বংস হওয়া প্রাসাদ, ঘরবাড়ির বর্তমান ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে পুরানা কেল্লায় মুসলমান যুগের স্থাপত্যই চোখে পড়ে, যুধিষ্ঠিরের আমলের কোন স্থাপত্যের চিহ্ন এখন নেই। (উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে, খনন কার্যের ফলে পুরনো কেল্লাতে খ্রীষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের বসবাসের চিহ্ন মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। এখানে ক্রমান্বয়ে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত, রাজপুত, সুলতান, মুঘল যুগের বসবাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে)। ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রথমে কেল্লাটিকে যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ বলেছিলেন। যদিও তিনি বলেন বর্তমান প্রাসাদ মুসলমান শাসকদের তৈরি। 


বর্তমানে পুরানা কেল্লায় দর্শন দর্শনীয় স্থান এবার দেখলেন লেখক। প্রথমে কিলা কোনা মসজিদ যার নির্মাণ হুমায়ুন শুরু করেছিলেন আর শেরশাহ শেষ করেন। খিলান, নীল টালি, মার্বেল ইত্যাদি আফগান বৈশিষ্ট্য সম্বলিত মসজিদ এটি। কিন্তু মসজিদটি এখন ভগ্নপ্রায়। শের-ই-মন্ডল আরেকটি দর্শনীয় স্থান। এই তিনতলা, আটটি কোণা বিশিষ্ট, লাল পাথরের বিশাল প্রাসাদটি শেরশাহ তৈরি করেছিলেন। সিংহাসন পুনর্বার অধিকার করার পর হুমায়ুন এটি পাঠাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। এর ভিতরে সুন্দর কারুকার্য ছিল, যার সামান্যই এখন অবশিষ্ট আছে। এই ভবনেই হুমায়ুন সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে হুমায়ুন প্রাণ হারান। 


দিল্লি ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে মাইল পাঁচেক দূরে অবস্থিত। দিল্লির প্রাচীনতম স্থাপত্য অশোক স্তম্ভ। তারপর প্রাচীনতার দিক থেকে আসে লৌহ স্তম্ভ। মিশ্র ধাতুর তৈরি ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ও ৬০ ফুট উচ্চতার লৌহ স্তম্ভটির ২২ ফুট মাটির উপরে আছে আর বাকী অংশ মাটির তলায় অবস্থিত। এত প্রাচীনকালে এত বড় ধাতুর স্তম্ভটি ঢালাই এর কাজ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তাছাড়া স্তম্ভে কোন মরচে ধরে নি এখনও। স্তম্ভটির গায়ে সংস্কৃত লিপিতে লেখা আছে। এটি রাজা ধবের (উইকিপিডিয়ার মতে রাজা চন্দ্র) কীর্তি স্তম্ভ, তিনি বিষ্ণুর উপাসক, যিনি সিন্ধুর বাহ্লিক দমন করেছেন ও সমগ্র পৃথিবী শাসন করেছেন। রাজা ধবের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। লিপির বৈশিষ্ট্য দেখে গুপ্ত যুগের লিপি বলে মনে হয়। হয়তো গুপ্ত পরবর্তী যুগে লেখা এটি। স্তম্ভের গায়ে আরেকটি লিপিতে লেখা আছে ১১০৯ সম্বত অর্থাৎ ১২৫২ খ্রিস্টাব্দে অনঙ্গ পাল দিল্লি শাসন করেছেন (তোমারা সাম্রাজ্যের বংশের প্রতিষ্ঠাতা অনঙ্গ পাল)। হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত আছে এই লৌহ স্তম্ভ পান্ডবদের তৈরি। স্তম্ভ মাটির তলায় এত গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত যে তা বাসুকি নাগের মাথায় বসানো আছে। এক তোমারা রাজা পরবর্তীকালে স্তম্ভটি তুলতে গেলে ভূগর্ভ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে এবং স্তম্ভটি আলগা বা ঢিল্লি হয়ে যায়। সেই ঘটনায় ঢিল্লি থেকে জায়গার নাম হয়েছে দিল্লি। অন্য মতে এক তোমারা রাজার জন্য ঋষি ব্যাস এই লোহার দণ্ডটি মাটিতে পুঁতে দেন। তিনি বলেন বাসুকির মাথায় এটি স্থাপিত হল। কিন্তু কৌতুহলী রাজা যখন এটি তোলার চেষ্টা করেন তিনি দেখেন দন্ড তোলার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বাসুকিনাগের রক্ত দেখা যায় রাজা আবার মাটিতে রোপন করতে চান কিন্তু পুরোটি পারেন না। ঋষি ব্যাস রাজাকে জানান যেমন তোমার জন্য দন্ড মাটিতে আলগা ভাবে বসে রইল তেমনি তোমার রাজত্ব ঢিলে বা অস্থায়ী হবে এবং ঊনবিংশ বংশ পরে প্রথমে চৌহান, পরে তুর্কিদের হাতে দিল্লি চলে যাবে। তৃতীয় মতে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান ব্রাহ্মণদের সাহায্যে লোহার দন্ড সর্পরাজ শেষনাগের মাথায় রাখেন, যাতে তাঁর সাম্রাজ্য চিরজীবী হয়। কৌতূহলের বসে তিনি সত্যি শেষ নাগের মাথায় দন্ডটি বসানো হয়েছে কিনা দেখার জন্য সেটি তুলে ফেলেন। দন্ডের শেষে রক্ত দেখা যায় এবং রাজা জানতে পারেন তাঁর রাজত্বের মেয়াদ খুব স্বল্পকাল। তারপর থেকে হিন্দু রাজ্যেরও অবসান হবে। অনঙ্গ পাল ২ দিল্লিতে রাজত্ব স্থাপন করে লালকোট দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন লৌহ স্তম্ভটিকে কেন্দ্রে রেখে, ১১১৭ সম্বত বা ১৬০ খ্রিস্টাব্দে। 


লালকোট নাম থেকে অনুমান হয় যে দুর্গটি লাল পাথরের তৈরি। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় এটি ধূসর পাথরে তৈরি। এটির পরিসীমা আড়াই মাইল। দুর্গের চারপাশের পরিখা আছে। দুর্গের তিনটি দরজার অবস্থান এখনো দেখা যায়, চতুর্থ দরজাটি বোঝা যায় না প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার কারণে। প্রাচীরের ভেতর যেসব ঘরবাড়ি বা মন্দির ছিল সেগুলির এখন পৃথক অস্তিত্ব নেই, শুধুই ভগ্নস্তূপ। এখান থেকে কিছু দূরে এখনো অনঙ্গ তাল নামে একটি সরোবর আছে। সেটি ১৯ ফুট লম্বা ও ১৫২ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর। নিশ্চয়ই দুর্গের লোকেদের জল সরবরাহ করার জন্য সরোবরটি খনন করা হয়েছিল। পৃথ্বীরাজ চৌহানের সময় লালকোট কেল্লার বাইরেও শহর বিস্তীর্ণ হয়েছিল। বৃহত্তর শহরের সুরক্ষার জন্য বাইরে চার মাইলের বেশি পরিসীমার প্রাচীর দেওয়া হয়েছিল লালকোট দুর্গকে কেন্দ্র করে। লালকোট কেল্লার নাম সেই সময় হয় কিলা রাই পিথোরা অর্থাৎ রাজা পৃথ্বীরাজের কেল্লা। এই প্রাচীরে নটি ফটক ছিল, যার মধ্যে চারটির চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়। লাল কোটের উত্তর দিকে রঞ্জিত গেট দিয়ে মোহাম্মদ ঘোরীর বিধ্বংসী বাহিনী লালকোটে প্রবেশ করেছিল। 


ভারতের মাটিতে প্রথম মুসলমান মসজিদ কুতুবউদ্দিন-এর তৈরি মসজিদ হল মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলাম। কুতুব মিনার চত্বরে অবস্থিত এই মসজিদের ১৬৫ ফুট লম্বা ও ৩১ ফুট চওড়া। প্রার্থনা গৃহটি ৫ সারি সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত হিন্দুস্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি একটি ১৪৫ ফুট লম্বা ও ৯৬ ফুট চওড়া প্রাঙ্গণের প্রান্তে অবস্থিত। প্রাঙ্গণের মাঝখানে রয়েছে সেই বিখ্যাত লৌহ স্তম্ভ। এই প্রাঙ্গণটিতে অন্তত ১২০০ হিন্দুস্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু মন্ভদিরের ভগ্নাংশ ব্যবহার করে তিন বছরের মধ্যে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল। 


কুতুব মিনার মানুষের তৈরি (লেখকের সময় পর্যন্ত) পৃথিবী সবচেয়ে উঁচু স্তম্ভ। এটি ২৩৮ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা ভূমি পৃষ্ঠ থেকে। নীচের দিকে এই মিনারের চব্বিশটি পৃষ্ঠতল আছে ১৪৭ ফুট পরিধি যুক্ত। উপরের দিকে এটি বৃত্তাকার। এর মোট পাঁচ তলা আছে। প্রতিটিতে ঝুল বারান্দা আছে। তিন তলা পর্যন্ত মিনারটি লাল বেলে পাথরের ও তার উপরের শ্বেত পাথরের তৈরি। ভেতরের দিক ধূসর পাথরের তৈরি। মিনারের ভিতরে সিঁড়ি আছে, ভিতরে আলো হাওয়া পূর্ণ পরিবেশ। বারান্দা ও মিনারের বহির্গাত্রে কোরআনের বাণী আরবিতে লেখা আছে। মিনারের গায়ের লিপি থেকে জানা যায় সুলতান আলতামাস বা ইলতুৎমিস মিনারের কাজ শেষ করিয়েছিলেন। মিনারের গায়ে ফিরোজ শাহ তুঘলকের নামও আছে। বাজ পড়ে একবার মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফিরোজ শাহ তুঘলক সেটি সারাই করান ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে মিনারে আবার সারাইয়ের কাজ করতে হয়। তৎকালীন সুলতান সিকান্দার লোদী সেই কাজ করান। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে এক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুতুবমিনার। ব্রিটিশ সরকার তখন মেরামত করেন। ১৮৪৭ এ আবার কিছু সংস্কার করান ব্রিটিশ সরকার। 


কুতুব মিনার হিন্দু রাজাদের কীর্তি কিনা তাই নিয়ে বিতর্ক আছে। হিন্দুরা বিশ্বাস করে হিন্দু এক রাজা তাঁর কন্যার সূর্যের উপাসনা ও যমুনা দর্শনের জন্য এই মিনার তৈরি করিয়েছিলেন। হিন্দুদের স্বপক্ষে আরো যুক্তি এই যে মিনারের প্রবেশপথ উত্তরমুখী, যা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। মুসলমানদের প্রচলিত প্রবেশপথ পূর্বমুখী। বারান্দাগুলিতে যে ঘন্টা সাজানো আছে তা হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত। অন্যদিকে মুঘল বাদশাহ আকবর শাহ ২ -এর মুন্সি সৈয়দ আহমেদ লিখে গেছে কুতুব মিনার আসলে মসজিদ-ই-কুতুব-উল-ইসলামের মজিনাহ্ বা আজান দেওয়ার স্থান। কুতুব মিনারের আরবি লিপিতে মোহম্মদ ঘোরীর প্রশস্তি ও কুতুবুদ্দিনের নাম পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে মিনার তৈরির কাজ শুরু করেন কুতুবউদ্দিন এবং আলতামস বা ইলতুৎমিস সেই কাজ শেষ করেন। কবি চাঁদ বরদোই, যিনি পৃথ্বীরাজ চৌহানের জীবনী লিখে গেছেন, তাঁর লেখায় এই মিনারের কোন উল্লেখ নেই। তাই এটি সুলতানি আমলে তৈরি হয়েছে এই যুক্তিটি বেশি গ্রহণযোগ্য। তবে হিন্দু স্থপতিদের দ্বারা কুতুব মিনার তৈরি বলে এই স্থাপত্যে কিছু কিছু হিন্দু প্রভাব পড়েছে। লেখক যখন কুতুব মিনারে গেছিলেন তখন তার চূড়া পর্যন্ত দর্শনার্থীদের যাওয়ার অধিকার ছিল। 


লেখক এবং সঙ্গীরা এবার কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত অসমাপ্ত মিনারটি দেখলেন। এটি কুতুব মিনারের থেকে দ্বিগুণ বড় করে তৈরি করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। হিন্দুদের মতে এই মিনার থেকে রাজকন্যার গঙ্গা দেখার ব্যবস্থা করার জন্য সেটি তৈরি হচ্ছিল কিন্তু মুসলমান আক্রমণের ফলে কাজটি শেষ হয়নি। অন্য মতে আলাউদ্দিন খিলজি এই মিনারটি তৈরি করেছিলেন কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও পরে মারা যাওয়ায় এই কাজ শেষ হয়নি। 


প্রাঙ্গণের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে সুলতান আলতামসের সমাধি। সমাধির ভিতর দিকে দেওয়াল খুব সুন্দর করে তৈরি। সমাধিটি ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। এর মাথার ওপর খোলা, যেন স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর মধ্যে কোন বাধা রাখা হয়নি। 


এবার তাঁরা মেহেরৌলির প্রাচীন কুঁয়া দেখলেন, যেটি নাকি অনঙ্গপাল ২ -এর তৈরি (মেহেরৌলির বাউলি)। পরবর্তী দর্শনীয় স্থান আদম খানের সমাধি (আদম খান আকবরের একজন সেনাপতি ছিলেন)। 


সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী নির্মিত আলাই দরওয়াজার বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। এর গায়ে আরবি অক্ষরে লেখা আছে ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দে এর তৈরি কথা। দেখলেন হুমায়ুনের ধর্মগুরু ইমাম জামিনের সমাধি, আকবরের অন্যতম ভ্রাতৃসম মোহম্মদ কুলি খানের সমাধি, মোহম্মদ কুলি খানের সমাধির বাড়িটি এখন মেটকাফ হাউস নামে পরিচিত হয়েছে (চার্লস মেটকাফ তখন দিল্লির বাদশাহের দরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ছিলেন)।



                           (চলছে)


রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

৫১। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৫ ভোলানাথ চন্দ্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                       (আগের পর্বের পরে)

লেখক ভোলানাথ চন্দ্র এরপর বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সাধকদের জন্য প্রসিদ্ধ কিছু স্থান দর্শন করলেন। বৈষ্ণব সাধক হরিদাস গোস্বামীর সমাধি বা সমাজ প্রথম দর্শনীয় স্থান। চৈতন্যদেব হিন্দু দাহ-প্রথার বদলে বৈষ্ণবদের মধ্যে সমাধি-প্রথা প্রচলন করেন। হরিদাস তখন শেষ জীবনে হরিনামগান করে দিনাতিপাত করছেন বৃন্দাবনে। বাদশাহ আকবর যমুনা নদীপথে যেতে যেতে একবার হরিদাস গোস্বামীর গান শোনেন এবং সেই গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন তাঁকে রাজসভায় গিয়ে প্রধান গায়কের আসন অলংকৃত করতে। হরিদাস গোস্বামী স্বাভাবিক কারণেই অসম্মত হন। বারংবার অনুরোধে তিনি তাঁর তরুন শিষ্য তানসেন-কে আকবরকে দেয়। তানসেন এরপর আকবরের সভা অলংকৃত করেন এবং কালক্রমে কিংবদন্তি গায়ক হন। বৃন্দাবনে হরিদাস গোস্বামীর অতি সাধারণ দেখতে সমাধি হিন্দুদের দর্শনীয় স্থান। 


কার্তিক মাসে বৃন্দাবনে রাস উৎসব পালিত হয়। রাস মন্ডল একটি অঙ্গন যেখানে শ্রীকৃষ্ণের নাম কীর্তন নাচ হয়। সারা শহর জুড়ে রাসমণ্ডল হয় এই সময়। 


বৃন্দাবনে লালাবাবুর মতো খ্যাতি আর কারো নেই।ওয়ারেন হেস্টিংস এর দেওয়ান গঙ্গা গোবিন্দ সিংহের নাতি ছিলেন লালা বাবু (লালাবাবুর প্রকৃত নাম কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ)। এই বিশাল ঐশ্বর্যবান মানুষটি যৌবনে সংসার ত্যাগ করে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর হয়ে বৃন্দাবনে চলে আসে। এখানে একটি অসাধারণ মন্দির তৈরি করান এবং সেই মন্দিরের দরিদ্র সেবায় প্রতিদিন ১০০ টাকা করে খরচ করতেন। প্রতিদিন ৫০০ মানুষ এখানে ঠাকুরের প্রসাদ পেত। মন্দিরের চত্বর প্রতিদিন লালাবাবু নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন এবং নিজে ভিক্ষা করে আনা রুটি মাত্র খেতেন। এই সর্বত্যাগী মানুষটি পরে বৃন্দাবন ছেড়ে গিরি গোবর্ধনের গুহায় ধ্যান করার জন্য চলে যান। 


পরবর্তী গন্তব্য রূপ গোস্বামীর আশ্রম স্থল। এই আশ্রম এখন আর জঙ্গলের মধ্যে নির্জনে নেই। এটি এখন পাকা রাস্তায় অবস্থিত। সেখানে ভরতপুরের রাজার তৈরি একটি উৎকৃষ্ট মানের মন্দির আছে। 


তাঁরা এবার গেলেন নিধুবন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ রোজ বাঁশি বাজাতেন আর গোপিনীদের সঙ্গে লীলা খেলা করতেন। এটি বর্তমানে শহরের মধ্যে অবস্থিত নীচু প্রাচীর দেওয়া এক স্থান, যেখানে জঙ্গল ঝোপঝাড় আছে। ললিতা কুন্ড বলে একটি জলাশয় আছে এখানে। 


তারপর তাঁরা গেলেন মদনমোহনজি দর্শনে। এই মন্দির রানী কুব্জার প্রতিষ্ঠিত। মথুরার পতনের সময় মদনমোহনজি অদৃশ্য হয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দী অদৃশ্য থাকার পর তিনি এক চৌবে মহিলার বাড়িতে প্রকট হন, যিনি তাঁকে তাঁর শিশু পুত্রের সঙ্গী হিসেবে রাখেন। পরে মদনমোহন সনাতন গোস্বামীর কাছে আসেন। সনাতন গোস্বামীর দেওয়া অতি সাধারণ প্রসাদে অরুচি হওয়ায় মদনমোহন রাজকীয় খাদ্য অভিলাষ করেন কিন্তু তা সনাতনের সাধ্যাতীত ছিল। তখন এক বণিকের মালবাহী নৌকা বালির চড়ায় আটকা পড়ে। সওদাগর সাহায্যের আশায় ঘুরতে ঘুরতে মদনমোহনের মন্দিরে আসেন ও মানত করেন যদি এই যাত্রা তাঁর নৌকার জিনিসপত্র বেঁচে যায় তবে মদনমোহনের সেবায় সেই অর্থ ব্যায়িত করবেন। অলৌকিকভাবে নৌকা উদ্ধার হয় ও বণিকের আশাতীত লাভ হয়। তিনি দেবতার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন। সেই মন্দিরের দেবতা বৃন্দাবনের প্রধান তিন দেবতার একজন হন। সনাতন গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত সেই মূর্তি এখন জয়পুরে আর প্রাচীন মন্দিরটি পরিতক্ত ও ভগ্নপ্রায়। সনাতনের সমাজ বা সমাধি সেখানে আছে। এখানে চৈতন্যদেব এসেছিলেন। তাঁর পায়ের ছাপ, খড়ম আর যে তেঁতুল গাছের যে ছায়ায় তিনি বসেছিলেন তা রয়েছে। যদিও গাছটি এত পুরনো বলে লেখকের মনে হয় নি আর চরণচিহ্ন খুব ছোট মাপের বলে লেখকের সন্দেহ হয়। 


নিকুঞ্জবন যা রাধা কৃষ্ণের অভিসারের উদ্যান সেটি লেখকের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান। কথিত আছে নিকুঞ্জ বনে কোন মানুষ রাত কাটাতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এই বন একটি নীচু পাঁচিল ঘেরা, ঝোপ ঝাড় ঘাসে ঢাকা জমি, যেখানে অনেক হনুমানের বাস। এরমধ্যে লেখক বৃন্দাবন শহর ও তার চারপাশে হনুমানের অত্যাচারের কাহিনী বলেছেন। একটিমাত্র গাছ রয়েছে নিকুঞ্জবনে, যেটি তার প্রাচীনত্ব প্রদর্শন করছে। 


বাঁকাবিহারী বৃন্দাবনের সবচেয়ে বড় শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি। তাঁর পাশে কোন রাধা মূর্তি নেই। রাধারমন হলেন গোপাল ভট্ট গোঁসাই-এর প্রতিষ্ঠা একটি শিলা থেকে উদ্গত মূর্তি। 


বৃন্দাবনে লেখক নাটক দেখলেন। একটি বড় মন্দিরের উঠানে বা প্রাঙ্গনে সামিয়ানা টাঙিয়ে শয়ে শ়য়ে বাতির আলোতে উজ্জ্বল মঞ্চে নাটক অনুষ্ঠিত হল। রঙিন পাগড়ী শোভিত ব্রজবাসীরা পা মুড়ে মাটিতে বসে সেই নাটক দেখল। ব্রজনারীরা রঙিন পোশাক পড়ে, ঘেরা জায়গায় বসে দেখল। প্রাঙ্গণের মাঝখানে উঁচু মঞ্চের প্রতি প্রান্তে ২টি ছেলে দুটি করে মশাল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল নিধুবনে রাধা কৃষ্ণ। একটি সুন্দর অল্পবয়সী ছেলে মাথায় মুকুট ও নারীদের সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করল। ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণকে কথা বলতে শুনে খুব ভালো লাগছিল লেখকের। 


বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রীরা আরও বেশ কিছু স্থানে তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেমন - মধুবন বা তাল বন, যেখানে কৃষ্ণ বলরামের বাল্যলীলা হয়েছিল। রাধাকুন্ড, শ্যামকুন্ড, ললিতাকুন্ড (লালাবাবু রাধাকুন্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যাম কুন্ডের জলের রং নীলাভ আর ললিতা কুন্ডের জল দুধের মতো সাদা। শ্যাম কুন্ডের পাশে বসে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্য চরিতামৃত কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন)। 


রাধাকুণ্ড থেকে চার মাইল দূরে গোবর্ধন পর্বত যা বৈষ্ণবদের কাছে কৈলাস পর্বতের মতো পবিত্র। এই পর্বত কৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙ্গুলে তুলে ধরে ছাতার মতো ব্যবহার করে অতিবৃষ্টিতে সমগ্র বৃন্দাবনকে রক্ষা করেছিলেন। লেখক গিরি গোবর্ধনকে নিয়ে আরো একটি কাহিনী লিখেছেন। লঙ্কায় যুদ্ধকালে লক্ষণ রাবণের বানে আহত হলে চিকিৎসক (সুষেণ) বলেছিলেন হিমালয়ের একটি নির্দিষ্ট পাহাড় থেকে (গন্ধমাদন) নির্দিষ্ট একটি গাছ (বিশল্যকরনী) আনতে পারলেই তাঁকে সুস্থ করা যাবে। হনুমান সেই গাছ আনতে যান কিন্তু কার্যকালে গাছের নাম ভুলে যাওয়াতে সম্পূর্ণ পাহাড়টি পিঠে তুলে লঙ্কা যাত্রা করেন। বর্তমানে যেখানে গোবর্ধন পর্বত রয়েছে সেই স্থানের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় রামের ভাই ভরত সেখানে ছিলেন। তিনি হনুমানকে ভাবেন লঙ্কার রাক্ষস। তাই তিনি তীর ছোঁড়েন হনুমানের পায়ে তীর লাগায় তিনি রাম রাম বলে ওঠেন এবং তাঁর পিঠ থেকে গন্ধমাদন পর্বতের একটি ছোট অংশ পড়ে যায় মাটিতে। ভরত রাম নাম শুনে তাঁর ভুল বোঝেন। তারপর হনুমানের কাছে সব শুনে তাঁকে বলেন তাঁর তীরের ডগায় গন্ধমাদন-সহ বসতে যাতে তীর ছুঁড়ে ভরত তাঁকে আরও তাড়াতাড়ি লঙ্কায় পৌঁছে দিতে পারেন অসুস্থ ভাই লক্ষণের ঔষধ নিয়ে। হনুমান অবশ্য নিজের অলৌকিক শক্তি বলেই লঙ্কায় পৌঁছান। গন্ধমাদনের যে টুকরো ওই স্থানে পড়েছিল তা গোবর্ধন পর্বত নামে খ্যাত হয়। 


গোবর্ধন পর্বতে এখন অনেক মন্দির আছে, যার মধ্যে প্রধান মন্দিরে কৃষ্ণের শিশুরূপ গোপাল হিসেবে পূজা হয়। বল্লভাচার্য গোপাল রূপে কৃষ্ণের পূজার প্রথম প্রচলন করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্রজ অঞ্চলের বৈষ্ণব ধর্মের সাধক ও দার্শনিক ছিলেন বল্লভাচার্য। প্রতিবছর কার্তিক মাসে অন্নকূট উৎসব বল্লভাচার্য শুরু করেছিলেন, এখনো সেটি এখানে পালিত হয়। 


বৃন্দাবন শহরের মাঝখানে রঞ্জিত সিংহের (ভরতপুরের মহারাজা) সুন্দর সমাধি অবস্থিত। এই সমাধির একদিকে একটি জলপূর্ণ পুকুর ও অপরদিকে একটি জলশূন্য পুকুর রয়েছে। এর কারণ শ্রীকৃষ্ণ নাকি একবার তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি পুকুরের সমস্ত জল নিঃশেষে পান করে নিয়েছিলেন। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া যখন ভরতপুর আক্রমণ করেছিলেন তখন তিন মাস যাবত দূর্গ অবরোধ করে রেখেছিলেন। সেই সময় রঞ্জিত সিংহ  সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছিলেন। শূন্য পুকুর সেই অবরোধকে প্রতীকী ভাবে দেখায়। 


চরণ পাহাড়ি নামক স্থানে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর গরুর পালের পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। এই পাহাড়ের লুকালুকি নামক স্থান ছিল তাঁর লুকোচুরি খেলার স্থান গোপিনীদের সঙ্গে। 


কাম্যবন নামক স্থানে পাণ্ডবদের বনপর্বে থাকার সময় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখানে তাঁদের মূর্তি, যজ্ঞশালা প্রভৃতি যাত্রীদের দেখানো হয়। 


বারসানার রাজা বৃষভানুর কন্যা রাধার জন্মস্থল; নন্দগাঁও যা কৃষ্ণের শৈশবের লীলাভূমি; বস্ত্রহরণ ঘাট, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের বস্ত্রহরণ করেন প্রভৃতি দর্শন করেন। 


লেখক এরপর দেখেন মহাবন যেখানকার প্রধান দেবতা বলদেও বা বলদেব, যিনি কৃষ্ণের দাদা বলরাম। 


গোকূল, যমুনার মধ্যে একটি দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থিত। এটি বৃন্দাবনের সুন্দরতম স্থান বলা যায়। এই স্থান এখনও অনেকটা কৃষ্ণের সময়ের গোকূলের মত পরিবেশ বজায় রেখেছে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এখানকার মূল বিগ্রহ গোকূলনাথ জঙ্গলে লুকানো ছিলেন মুসলমান আক্রমণের কারণে। বল্লভাচার্য তাঁকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন। আওরঙ্গজেবের সময় আবার মূল মূর্তি অন্যত্র (জয়পুরে) পাঠানো হয়। এখানে আছেন প্রতিমূর্তি। গোকূলে পুতনা-খাল দেখলেন লেখক, যেখানে কংস-প্রেরিত রাক্ষসী পুতনাকে মেরে যমুনায় ভাসিয়ে দেন কৃষ্ণ।  

এভাবে শেষ হল লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের বৃন্দাবন দর্শন। 


লেখকের এর পরবর্তী ভ্রমণকাহিনী এর চার বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৬, ৫ নভেম্বর শুরু হল। এবার কাহিনী শুরু হলো টুন্ডলা জংশন থেকে। এই সময়ের মধ্যে দিল্লি পর্যন্ত রাজপথ নতুন করে তৈরি হয়েছে। ফলে ঘোড়ার গাড়ির গতি অনেক বেড়ে গেছে। 


প্রথম উল্লেখযোগ্য স্থান যেটি পথে পড়ল সেটি হলো হাতরাস। ডাকাত, ঠগীর আস্তানা থেকে এখন এটি ব্যস্ত তুলো আর নীলের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 


তারপর এলো আলিগড়, এর প্রাচীন নাম কোল বা কোয়েল। লেখক স্থানটিকে কোয়েল আলিগড় লিখেছেন। এই কোল অতি প্রাচীনকাল থেকে ছিল বলেছেন লেখক। কৃষ্ণ কংসকে বধ করার পর জরাসন্ধ, যিনি কংসের জামাই ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে আক্রমণ করতে যাওয়ার সময় এখানে বিশ্রাম করেছিলেন। সিন্ধিয়ার সেনানায়ক মসিয়ে পেরোন-এর মাটির দূর্গের জন্য আলিগড় স্মরণীয়। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে (দ্বিতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধে, ১৮০৩ থেকে ১৮০৫) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি লর্ড লেক এই দূর্গটি আক্রমণ করে ধ্বংস করেন, এক প্রবল প্রতিরোধ প্রতিহত করে। এখন শুধু দূর্গটির ধ্বংসাবশেষ আছে জঙ্গলময় পরিবেশে। সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব আলিগড়ে ভালোই পড়েছিল। এখন ধীরে ধীরে জায়গাটি শ্রী ফিরে পাচ্ছে। 


আলিগড় থেকে দিল্লি যাওয়ার ট্রেনে করে লেখক রওনা দিলেন পরদিন। খুরজা, বুলন্দশহর, সিকান্দ্রাবাদ, দাদরি, গাজিয়াবাদ হয়ে এল দিল্লি। দূর থেকে চোখে পড়ল কুতুব। ক্রমে ক্রমে হুমায়ুনের সমাধি, যমুনা, আর নানা রকম মিনার-স্তম্ভ-প্রাসাদ-মসজিদ সম্বলিত, বহু প্রতীক্ষিত দিল্লি শহর চোখের সামনে উন্মোচিত হলো।


                              (চলছে)

শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪

৫০। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৪ ভোলানাথ চন্দ্র

 


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                      (আগের পর্বের পরে)

দি ট্রাভেলস অফ হিন্দু, ভলিউম টু'র শুরুতে লেখক ভোলানাথ চন্দ্র ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে এবার উটের গাড়িতে পয়লা নভেম্বর, ১৮৬০ আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। 


পথে তিনি আকবরের বেগম যোধাবাইয়ের সমাধি দেখলেন। কিন্তু সমাধির সুন্দর দরজা, দেওয়াল সরকার ভেঙে বিক্রি করে দিয়েছে। সমাধির মাটি খুঁড়ে খনি বিদ্যার হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ফলে সমাধিটি আর নেই। 


আগ্রা থেকে ফতেপুর সিক্রি ২৪ মাইল। গাড়িতে ছয় ঘন্টা লাগে যেতে। পথে সমাধি, মসজিদ, ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের প্রাসাদ তৈরির আগে সেটি এক জনশূন্য পাহাড়ি জায়গা ছিল। এক মুসলমান পীর (যাঁর বয়স ৯৬ বছর) শেখ সেলিম সেখানে নির্জনে বসবাস করতেন। বাদশাহ আকবর নিঃসন্তান ছিলেন পুত্রের আকাঙ্খায় তিনি ও তাঁর পত্নী যোধাবাই পায়ে হেঁটে আজমিরের মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় যান। রাতে স্বপ্নে মইনুদ্দিন চিশতী আকবরকে আদেশ দেন ফতেপুর সিক্রিতে বৃদ্ধ সেলিম এর কাছে যেতে। শেখ সেলিমের কৃপায় আকবরের পুত্র সেলিম বা জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। আকবর তাঁর রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে নিয়ে আসেন, এখানে একটি অপূর্ব নগরী তৈরি করে। 


ফতেপুর সিক্রির সবথেকে নজরকাড়া জিনিসটি হল ১২০ ফুট উঁচু, ১২০ ফুট চওড়া রাজকীয় দরজা (বুলন্দ দরওয়াজা)। শেখ সেলিমের শ্বেত পাথরের ছোট সুন্দর সমাধি, শ্বেত পাথরের ডোম বিশিষ্ট বড় মসজিদ-ও দর্শনীয়। আকবরের প্রাসাদ ভগ্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। বিশাল বড় হাতি দরজার সামনে দুটি প্রমাণ মাপের পাথরের হাতির মূর্তি দেখা যায়। বিস্ময়কর একটি বিষয় হল ফতেপুর সিক্রিতে সাদা কালো মার্বেল পাথরের দাবার ছকের মেছে। সেই দাবার ছকে জেনানার ৩২ জন মহিলা দাবার গুটির বদলে বসত। বাদশাহ ছিলেন নির্ণায়ক, অভিজাতরা দর্শক এবং দুজন মনসবদার সাদা ও কালোর পক্ষে দাবা খেলতেন। যে জয়ী হত সে ওই ৩২ জন রমণীকে পেত। ফতেপুর সিক্রিতে বীরবলের ছোট কিন্তু কারুকার্যযুক্ত বাড়ি দেখা যায়। 


পরদিন লেখকের ও তাঁর সঙ্গীরা সিকান্দ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পথে কিছু বাদশাহী ক্রোশ মিনার বা মাইলফলক দেখা গেল যেগুলি বৃত্তাকার এবং এখানকার মাইলফলক থেকে আকারে বড়। এগুলি মোগল আমলে ভারতের রাজপথে দুই মাইল অন্তর লাগানো ছিল। কোশ মিনার বা ক্রোশ মিনার-এর কাছে একটি করে নজর বুরুজ থাকত পথিকদের সুবিধার জন্য। রাজপথের দু'ধারে ছাওয়া দেওয়া গাছ লাগানো ছিল। 


সিকান্দ্রা নাম সম্ভবত সিকান্দার লোদীর নামে হয়েছিল। সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি রয়েছে, ফুল ফলের বাগিচায় ঘেরা। আকবরের সমাধির বাইরের বারান্দায় দুটি ছোট সমাধি আছে, আকবরের শৈশবে মৃত দুই নাতির। বাইরে রয়েছে তাঁর অনুগত কিছু আমির ওমরাহের কবর। 


মুনী বেগম নামে আকবরের এক ইউরোপীয় বেগম ছিলেন, যিনি সম্ভবত গোয়া থেকে এসেছিলেন তিনি খ্রিস্টান ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর আকবর সিকান্দ্রায় একটি সুন্দর সমাধি তৈরি করেছিলেন। পরে অনেক বছর ধরে চার্চ মিশন সোসাইটি সেখানে ছাপাখানা চালায় এবং দুর্ভিক্ষের সময় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০০ জন অনাথকে সেখানে রাখে। (উইকিপিডিয়া আকবরের খ্রিস্টান ও ইউরোপীয় বেগমের বিষয়টি অস্বীকার করছে। সেখানকার মতে, যোধাবাই এর অপর নাম ছিল মারিয়াম উজ জামানি। তাঁকে খ্রিস্টান বলে ভুল করা হয়। কিন্তু লেখকের লেখা পড়ে ধারণা হয় যে তিনি ঠিক তথ্যই দিয়েছেন কারণ লেখক যোধাবাই  ও মুনী বেগম দুজনেরই সমাধি প্রত্যক্ষ করেছেন)। 


লেখকের পরবর্তী গন্তব্য মথুরা। পথে একদল মথুরার চৌবে পান্ডা লেখকদের গাড়ির পাশে পাশে ছুটতে থাকল তাঁদের তীর্থযাত্রী হিসেবে নেওয়ার জন্য। লেখকেরা নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিয়ে শেষে ছাড়া পেলেন। এবার তাঁরা মোগল প্রাচীনত্ব থেকে হিন্দু প্রাচীনত্বে প্রবেশ করলেন। 


মথুরা হল বাল্মিকী আর মনুর সুরসেনা, স্ট্রাবো আর আরিয়ানের (প্রাচীন গ্রীক লেখক ও ঐতিহাসিক) মেথোরা, হিউয়েন সাং-এর মো-থৌ-লো। সুপ্রাচীন কালে এখানে সুর নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন, যিনি কুন্তি ও বাসুদেবের পিতা। তাঁর নামে রাজ্যের নাম হয় সুরসেনা বা সুরসেনী। মথুরার পরবর্তী খ্যাতি কৃষ্ণ ও কংসের কাহিনী ঘিরে। একসময় মথুরা সম্পূর্ণভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে এসেছিল। ফাহিয়েন এখানে সাতটি বৌদ্ধস্তূপ ও তিন হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সম্বলিত কুড়িটি বৌদ্ধ-মঠ দেখেছেন। ফা হিয়েন মথুরায় একমাস ব্যাপী ছিলেন ও বৌদ্ধধর্ম মহাসম্মেলনে অংশ নেন। হিউয়েন সাং-এর সময় এখানে বছরে তিনটি ধর্মানুষ্ঠান পালিত হতো। লেখক বলেন বর্তমানে কংস টিলা নামে খ্যাত ধিবিটি সম্ভবত কোন বৌদ্ধস্তূপ যা কালের প্রভাবে মাটি চাপা পড়েছে। 


যমুনা নদীর ধারে কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরায় বিশ্রাম ঘাট দর্শনীয়, যেখানে কৃষ্ণ ও বলরাম কংসকে বধ করার পর স্নান ও বিশ্রাম করেছিলেন। এই ঘাটের জলে অনেক কচ্ছপ আছে। ঘাটের উপর বেশ কিছু সুন্দর মন্দির আছে। প্রতিদিন সকালে  যমুনার আরতি হয়। এই ঘাটে প্রতিবছর মহাস্নান মেলা হয়, যার নাম যমনা কা বুরকী। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে লাখের উপর মানুষ আসেন এই মেলাতে। নভেম্বর মাসের কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় দিন এই মেলা হয়। ভিড়ের ফলে কোন দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশের বন্দোবস্ত করা হয়। 


মথুরা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কাটরা বা বাজার অবস্থিত। এর মাঝখানে আওরঙ্গজেবের নির্মিত জুম্মা মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদটি একটি ত্রিশ ফুট উঁচু ঢিবির ওপর রয়েছে। স্তম্ভ, মূর্তি, লিপি ইত্যাদি যা যা ওই অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি সম্রাট অশোকের সময় সন্ন্যাসী উপগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধমঠ ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা ক্ষমতায় এসে বৌদ্ধমঠের উপকরণ ব্যবহার করে মন্দির তৈরি করেছিল। গজনীর সুলতান মাহমুদ অনেক মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেছিলেন। আওরঙ্গজেব মথুরায় হিন্দু মন্দিরের উপরে মসজিদ গঠন করেছিলেন। মসজিদটিতে অনেক ফাটল দেখা দেওয়ায় এটি এখন ব্যবহার করা হয় না। 


রাজা জয়সিং নির্মিত দূর্গের সামান্য ধ্বংসাশেষ ছাড়া কিছুই এখন পাওয়া যায় না। মানমন্দিরটিও ভগ্নপ্রায়। আহমদ শাহ দূরানীর (আফগানিস্থানের শাসক, ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বারবার ভারত আক্রমণ করেন) ধ্বংসলীলার ফলে দূর্গ ও মানমন্দির সম্ভবত নষ্ট হয়েছে। 


মথুরায় চৌবে সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা একচেটিয়াভাবে পান্ডার কাজ করে। লেখকেরা অত্যন্ত ধৈর্য ও চালাকির সঙ্গে তাদের উৎপাতের মোকাবিলা করেন। চৌবে মহিলাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন লেখক। মথুরায় মাড়োয়ারি, মারাঠা, চৌবেদের বাজার বেশ জমজমাট। রাস্তার দু'পাশে অবস্থিত সুসজ্জিত দোকানে সব রকম জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। উৎসবের মরশুম ছিল সেটি। লেখকের দুজন বন্ধু নাচ দেখার জন্য মথুরায় রয়ে গেলেন। 


লেখক বাকি সঙ্গীদের সঙ্গে চললেন বৃন্দাবন। এবার তাঁদের যাত্রার বাহন রথ। নামে রথ হলেও এই রথ শ্রীকৃষ্ণের আমলের রথ নয়। এই রথটি লাল পর্দার ঘেরাটোপে সাজানো, দুই চাকাযুক্ত যান যা টেনে নিয়ে যায় দুটি বলদ। মথুরা থেকে বৃন্দাবন তিন গো ক্রোশ। গো ক্রোশ সেই দূরত্ব যতদূর একটি গরুর আওয়াজ পৌঁছতে পারে। সেই প্রাচীন মাপ যুক্ত রাস্তায়, প্রাচীনকালের রথে, পৌরাণিক যমুনার কুল হয়ে লেখকেরা বৃন্দাবন যেতে যেতে অনেক ময়ূর দেখতে পেলেন, যে ময়ূরের পাখা মাথায় পরেন শ্রীকৃষ্ণ। পরদিন তাঁরা বৃন্দাবন পৌঁছলেন। 


লেখকের পিতামহ, প্রপিতামহরা তাঁদের পরম আকাঙ্ক্ষিত তীর্থস্থানে বেরোনোর আগে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে যেতেন। কারণ স্থলপথে হিংস্র পশু, ডাকাত, ঠগী, মারাঠা দস্যুর ভয় ছিল। জলপথে ঝড়, জলদস্যু, জল পুলিশের ভয় ছিল। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই তীর্থ ভ্রমণের। বৃন্দাবনে লেখক একজন পান্ডা নিলেন ও তার খাতায় পূর্বপুরুষদের নাম খুঁজতে গিয়ে এক কাকা-দাদু ১৮২৫ তে এসেছিলেন সেই প্রমাণ পেলেন। 


মথুরাকে কেন্দ্র করে ৮৪ মাইল ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট চক্রাকার পথে ভ্রমণ করে তীর্থস্থান দর্শন করলে প্রাচীন ব্রজভূমি বা ব্রিজ দেখা যায়। ব্রজভূমির সর্বোত্তম স্থান হলো বৃন্দাবন। বৈদেশিক মুসলমান আক্রমণে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিপত্তি বৃন্দাবন থেকে লোপ পায়। চৈতন্যদেবের মথুরা, বৃন্দাবন আগমনের সময় থেকে সেখানে বৈষ্ণব ধর্মের পুনর্জাগরণ হয় বলা যায়। 


বৃন্দাবনে পৌঁছেই গোঁড়া হিন্দুরা ধুলোপায়ে গোবিন্দজিকে দর্শন করতে যান। কাশীর বিশ্বের মন্দির দেখে লেখক যেমন হতাশ হয়েছিলেন বৃন্দাবনের গোবিন্দজির মন্দির দেখেও সে রকম অনুভূতি হল তাঁর। মন্দিরের গঠন সাধারণ, সাজসজ্জা তেমন নেই। সজ্জার মধ্যে আছে কিছু লাল পর্দা আর বড় পেতলের দীপাধার। কিন্তু একপাশে রাধা ও অন্যপাশে ললিতাকে নিয়ে গোবিন্দজি-কে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। তার পরণে সকালের পোশাক। মাথায় পাগড়ি বাঁধা হিন্দু রাজবেশ। অন্য সময় অন্যান্য পোশাকে পোশাকে তাঁকে সজ্জিত করা হয়। তিনি সর্বদা বাঁশি নিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র বাঁশি ছাড়েন যখন কংস বধ করার জন্য তীর ধনুক হাতে যোদ্ধার বেশে থাকেন। এই মূর্তিটি প্রতিমূর্তি। আসল মূর্তি আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মেবারের রানা রাজ সিং রাজপুতানায় নিয়ে যান। মূর্তিটি নাথদোয়ারায় বিদ্যমান (শ্রীনাথজি রূপে)। (প্রকৃত পক্ষে, গোবিন্দজির মূর্তি রাজা সওয়াই জয় সিং জয়পুরে তাঁর রাজপ্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্যদিকে মেবারের রানা রাজ সিং গোবর্ধনজির মূর্তি বৃন্দাবন থেকে নিয়ে গিয়ে নাথদোয়ারায় শ্রীনাথজি নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন)।


বৃন্দাবনে মন্দিরের সংখ্যা অগণিত। প্রতিটি মন্দিরে  রাধা, কৃষ্ণ ও সখি ললিতা বিরাজিত (এখন কিন্তু প্রায় সব মন্দিরে ললিতা অনুপস্থিত)। জয়পুরের রাজা, ভরতপুরের রাজা, সিন্ধীয়ার রানী, হোলকরের রানী, দিনাজপুরের রাজা, বর্ধমানের রাজা প্রমুখ বহু রাজা-রানী প্রতিষ্ঠিত মন্দির এখানে আছে। মন্দির গুলির দৈনন্দিন খরচা এক একটিতে ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। 


গোবিন্দজির পরেই দ্রষ্টব্য গোপীনাথজি। এই মূর্তিটিও প্রতিমূর্তি আওরঙ্গজেবের আক্রমণের কারণে। সিপাহী বিদ্রোহের জন্য তিন বছর যাবত যাত্রী সমাগম খুব কমে যাওয়ার ফলে গোবিন্দজির মন্দির দেনায় ডুবে গেছে ও বন্ধক রাখতে হয়েছে। 


কাশীঘাট অন্যতম বিখ্যাত ঘাট কারণ এখানে শিশু কৃষ্ণ কংসের প্রেরিত কাশী দৈত্যকে বধ করেছিলেন। বস্ত্রহরণ বৃক্ষ হল সেই গাছ যেখানে যমুনায় স্নানরত গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করে কৃষ্ণ কৌতুক ছলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। রয়েছে অক্রুরঘাট যেখানে কৃষ্ণ-বলরামকে মথুরায় আনার সময় অক্রুর রথ থামিয়েছিলেন। কালিয়াদহ আরেকটি বিখ্যাত ঘাট যেখানে কৃষ্ণ কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন। কৃষ্ণর এই বিজয়কে স্মরণ করতে কালিয়াদহতে প্রতিবছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রহ্মকুন্ড হল সেই পবিত্র কুন্ড যেখানে ব্রহ্মাকে বিষ্ণু পরাজিত করেছিলেন। 


বেনারসে বিষ্ণু শিবের উপাসনা করেন আর এখানে তার বিপরীত। শৈব ও বৈষ্ণবদের নিজ নিজ বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রয়াস এটি। যমুনার ধারে একটি বটগাছকে অক্ষয় বট বলে দেখানো হয়। বলা হয় এর একটি শেকড় এখানে, অপর দুটি এলাহাবাদে ও পুরীতে আছে। এখানে গোপেশ্বর নামে এক শিব মন্দির আছে। কথায় বলে, গোপিনী পরিবেষ্টিত কৃষ্ণকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে শিব ব্রজতে এসেছিলেন আনন্দে কাটাতে। কেউ যাতে তাঁকে চিনতে না পারে তাই তিনি সুন্দরী তরুণীর ছদ্মরূপে এসেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁকে দেখে চিনে ফেলেন। কিন্তু কৃষ্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে শিবকে অভ্যর্থনা করে এবং শিব আনন্দোৎসবে কৃষ্ণ ও গোপিনীদের সঙ্গে যোগ দেন।


                                    

                        (চলছে)

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

৪৯। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১৩ ভোলানাথ চন্দ্র

   

     

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                   (আগের পর্বের পরে)

দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আগ্রার রাতের মায়াময় রূপের পরিবর্তে বাস্তব রূপ প্রকট হল। সবমিলিয়ে আগ্রার ক্ষয়িষ্ণু চেহারা লেখকের চোখে পড়ল। 


বাদশা আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল-এর জন্মস্থান এখানে। আকবরের নবরত্নের অন্যতম ফৈজির সমাধি এখানে কোন অজ্ঞাতস্থানে ছিল (ফৈজি প্রথমে মুসলমান যিনি হিন্দু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন ও তাঁর নিজের গ্রন্থাগার ছিল) সেসব লেখক খুঁজতে থাকলেন। বাবরের বিখ্যাত উদ্যান যেখানে তিনি দোয়াব এর মত জায়গায় আনারস আর চন্দন গাছ লাগানোর প্রচেষ্টা করেছিলেন। লেখক আকবরের রামবাগ (যা সম্ভবত বাবরের চারবাগ) খুঁজছিলেন, যেখানে রাজপুরুষরা যমুনার তীরে শীতল ও শান্ত পরিবেশে থাকতে ভালোবাসতেন। 


লেখক এবার দেখলেন এতমাদ-উদ-দৌলার অপূর্ব সমাধি। এই সৌধের গা থেকে দামি পাথর আর মোজাইকের কাজ খুলে চুরি করে নেওয়া হয়েছে। (এটি নূরজাহানের তৈরি তাঁর বাবার সমাধি, ১৬২২ থেকে ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি)। 


শহরে ঢুকলেই আশি ফুট উঁচু মিনার যুক্ত আগ্রা দূর্গ চোখে পড়ে। দূর্গের প্রাঙ্গণে বাদশাহদের পশুর লড়াই দেখার ব্যবস্থা ছিল। ইংরেজ বণিক উইলিয়াম ফিঞ্চের লেখা থেকে জানা যায় যে এই দূর্গের প্রাঙ্গণে রবিবার ছাড়া রোজ দুপুরে বাদশা জাহাঙ্গীর এখান থেকে হাতি, সিংহ, মোষের লড়াই, চিতার হরিণ শিকার, এমনকি জন্তুর মানুষ মারা ইত্যাদি দেখতেন। বাদশা উপরের বারান্দা থেকে এই লড়াই দেখতেন। সেখানকার দরজার নাম দর্শন দরজা এই দরজার উপরে দুটো হাতির পিঠে চড়া, জয়মল ও পত্তের মূর্তি আছে, যা ওই দুই রাজপুত বীরের স্মৃতিতে আকবর তৈরি করিয়েছিলেন। ৩০০ বছর আগে তৈরি হলেও আগ্রা দূর্গের পরিস্থিতি বেশ ভালো। দূর্গের চারদিক বেষ্টন করা প্রাচীর ও পরিখা অন্তর্হিত হয়েছে। ভিতরে ৩০ ফুট চওড়া নুড়ি দিয়ে বাঁধানো পরিখা এখনো আছে। ভিতরের সুউচ্চ প্রাচীর কোনোভাবেই গোপনে পার হওয়া সম্ভব নয়। 


দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করার দুটি দরজা। একটি দরজার নাম বোখারা গেট, যার অপর নাম উমরা সিং কা ফটক (অমর সিং দরজা)। উমরা সিং মারোয়ারের যুবরাজ ছিলেন কিন্তু তাঁর পিতা তাঁকে সিংহাসনের দাবিদার মনোনীত না করায় তিনি শাহজাহানের সেনাবাহিনীর মনসবদারের পদে যোগ দেন। তিনি একবার একপক্ষ কাল বাদশাহের রাজসভায় উপস্থিত না থেকে শিকার খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। বাদশাহ এই অনুপস্থিতির জন্য তাঁকে ভৎসনা করেন ও অর্থদণ্ড দেন। এই অর্থদণ্ড নাজিরকে দিতে উমরা অস্বীকার করেন। তখন তাঁকে সভায় ডেকে পাঠানো হয়। ভরা রাজসভায় ক্রুদ্ধ উমরা নাজিরের বুকে ছোরা বসানো ও তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য ছিলেন বাদশাহ। বাদশাহ কোনোমতে অন্দরে আশ্রয় নেন। উমরা তাঁর হত্যালীলা চালিয়ে যান। অনেক মুঘল বীর, অভিজাত মারা যান। উমরা সিং পরে নিহত হলেও তাঁর অনুচরেরা হত্যালীলা চালায়। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যে বুখারা দরজা অর্থাৎ যেখান দিয়ে উমরা ও তাঁর অনুচরেরা রাজসভায় প্রবেশ করেছিল তার নাম হয় উমরা সিং দরজা। এই দরজা ১৭৫ বছর ধরে বন্ধ ছিল এবং এক বৃহৎ সর্প সেটি পাহারা দিত। অবশেষে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে এই দরজা আবার খোলা হয়, এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারা। তিনি বলেন এই দরজা খোলার মুহূর্তে একটা বড় শঙ্খচূড় সাপ তাঁর পায়ের ফাঁক দিয়ে চলে যায়। 


দূর্গের ভিতরটা একটি শহরের মতো বড়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ৫৮৪৫ জন ইংরাজ এই দূর্গের ভিতর আশ্রয় নিয়েছিল। দূর্গ থেকে নীচে শহরের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়। জঙ্গল, মাঠ, শস্য ক্ষেত্র, ঘরবাড়ি, আর সবথেকে আকর্ষণীয় তাজমহল। 


দেওয়ানি খাস যা আকবরের মন্ত্রিসভা, তার চত্বর থেকে যমুনা নদীর শোভা দেখার মত। দেওয়ানি খাস গঠনের দিক থেকে উৎকর্ষের ছাপ বহন করে। শ্বেত পাথরের স্তম্ভ, খিলান নানারকম খোদাইয়ের কাজ করা, শ্বেত পাথরের মেঝে, (স্তম্ভে সোনার গিল্টির এখনো কিছু কিছু দেখতে পাওয়া যায়) নিয়ে অসাধারণ স্থাপত্য। এখানেই আকবর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখানেই আবুল ফজল আইন প্রণয়ন করেছেন। খোলা চত্বরে কালো পাথরের বারো ফুট চওড়া, দুই ফুট উঁচু তখৎ বা সিংহাসন রয়েছে, যেখানে বসে বাদশাহ নদীর শীতল বায়ু সেবন করতেন, তানসেনের গান শুনতেন, ধর্মীয় আলোচনা করতেন বা বীরবলের চাতুর্য উপভোগ করতেন। 


মোগল অন্তঃপুরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গৃহটি হলো সীসা মহল বা আয়না ঘর, যার দেওয়াল আয়নায় মোড়া ছিল। কৃত্রিম উপায়ে স্থাপত্যের সাহায্যে ঘর ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা ছিল। শ্বেত পাথরের জালির কাজের মধ্যে দিয়ে হারেমের মহিলারা যমুনা দর্শন করতেন। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনার আক্রমণের সময় এই ঝরোখার একটি অংশ কামানের গোলায় ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে, আয়নার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেছে, কিছু কাচ ভেঙ্গে গেছে, ফোয়ারাগুলি শুধুমাত্র দর্শক এলে চালু করা হয়। বাদশা আকবরের সময় পাঁচ হাজার রমণী ছিল হারেমে। কিন্তু হারেমের আকার এত বড় নয় যে প্রত্যেককে আলাদা ঘর দেওয়া সম্ভব হত। 


জেনানা থেকে বেরিয়ে একটি বড় চত্বরে এলেন লেখক। সেখান থেকে কিছু সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে একটি দরজা, দরজার ওপারে অন্ধকার সিঁড়ি পৌঁছায় তাইখানা বা সুড়ঙ্গ পথে। এই সুড়ঙ্গগুলি নদী পর্যন্ত গেছে। টর্চের আলোর সাহায্যে তার ভিতরে যান লেখক। দেখেন সরু আঁকাবাঁকা পথ, বাদুড় আর পাখির ডানা ঝাপটানো শব্দ শোনেন, ফাঁসি ঘর দেখেন। সেখানে হারেমের অবাধ্য নারীদের হয়তো এই তাইখানার পথে মেরে যমুনায় ফেলে দেওয়া হতো বলে লেখক বলেন। 


জনসাধারণের জন্য খোলা দরবার দেওয়ানি আম, যেখানে মোগল বাদশাহরা আম আদমীর সঙ্গে দেখা করতেন। এটি ভারতের একটা অন্যতম বৃহত্তম হল, যা ১৮০ ফুট লম্বা ও ৬০ ফুট চওড়া। যথেষ্ট আলো হাওয়াযুক্ত এই সরল অথচ অভিজাত গঠনের হলটি সুন্দর শ্বেত পাথরের স্তম্ভ, পিলার দিয়ে সজ্জিত। এখানে এখনো বাদশাহের সিংহাসন রয়েছে। যে শ্বেতপাথরের খন্ডের উপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রীরা ভাষণ দিতেন সেটিও রয়েছে। টমাস রো ও টেরি (ইংল্যান্ডের দূত) রাজসভার স্বর্ণরৌপ্য খচিত যে রকম সাজসজ্জা কথা বলেছেন, সেই রাজকীয় সাজসজ্জা এখন আর নেই। হলের এক কোণে ১১ ফুট লম্বা, ৯ ফুট চওড়া সোমনাথ দরজা রাখা আছে। এই দরজা সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করে গজনীর সুলতান মামুদ গজনীতে নিয়ে যান। ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড এলেনবরো সেটি ভারতে আনান ও আগ্রা দূর্গে সেটি রাখা হয় (১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে কাবুল যুদ্ধের সময়)। 


দেওয়ানি আমের কাছে মিস্টার জন রাসেল কোলভিনের সমাধি আছে, যিনি উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের লেফট্যানেন্ট গভর্নর ছিলেন ও সিপাহী বিদ্রোহের সময় দূর্গের মধ্যে কলেরায় মারা যান। 


মতি মসজিদ পুরো শ্বেত পাথরে তৈরি বলে মুক্তা বা মোতির সঙ্গে তুলনীয়। এই অভিজাত সুন্দর মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এর গায়ের লেখা থেকে জানা যায় ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান হারেমের মহিলাদের উপাসনা করার জন্য এটি তৈরি করে দিয়েছিলেন ৬০ লাখ টাকা খরচ করে। মসজিদের সামনে আছে অযু করার জল, মাঝে ফোয়ারা। সেই ফোয়ারা এখন জল-শূন্য। 


শাহজাহানের একটি ৪০ ফুট ব্যাসের একটিমাত্র শ্বেত পাথরকে খোদাই করে তৈরি স্নানের চৌবাচ্চা ছিল, যেটি আর এখন নেই। লর্ড হেস্টিংস এটি ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রাজার জন্য। কিন্তু ওজনের কারণে সম্ভব হয়নি। চৌবাচ্চাটির শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল জানা নেই। 


আগ্রা দূর্গ ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এই দূর্গের স্থানে পূর্বে কোন দূর্গ ছিল তা হিন্দুদের না পাঠানদের সেটা জানা নেই। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দূর্গে একটি বিরাট কামান ছিল, সেটি যে কত পুরনো তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। এটির গায়ে অনেক পুরনো দিনের লেখা ছিল। আকবরের নামও তার মধ্যে পরবর্তীকালে খোদিত হয়েছিল। ব্রিটিশরা এটিকে প্রথমে কলকাতা ও পরে ইংল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওজনের কারণে সম্ভব হয়নি। সেটি যমুনার পাড়ে কিছুদিন পড়ে থাকার পর গোলা দিয়ে সেটিকে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা হয়। যদি সেটি থাকতো তবে গবেষণা করে হয়তো জানা যেত তার গায়ে কোন যুগের লিপি ছিল। 


আগ্রা দূর্গ থেকে তাজমহল পর্যন্ত সুন্দর রাস্তা ও নদীতীর রয়েছে, যা ইংরেজরা তৈরি করেছে, ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দরিদ্রদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে। এই রাস্তা তৈরি সময় কিছু পুরনো ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছিল। 


তাজমহলের অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা বিস্তারিতভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন। সেগুলি বিস্তারিত ভাবে না বলে নতুন তথ্য যা পাওয়া গেছে এই লেখা থেকে সেগুলি বিবৃত হল। 


মমতাজ বেগমের কবরের উপর একটি শ্বেত পাথরের ফলকে একটি ১০০ রকম পাথরের কাজ করা ফুলের নকশা আছে। আরবিতে তাঁর নানা গুণের কথা লিখে তাতে নানারকম অতি দুর্মূল্য রত্ন খচিত করা আছে, যেগুলি কোন অপবিত্র হাত চুরি করতে পারেনি। (তাহলে কি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে এই মূল্যবান রত্ন গুলি যথাস্থানে ছিল?)। 


১৬৩১ এ মৃতা মমতাজের পাশের কবরে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহানের মৃত্যু হলে আওরঙ্গজেবের উদ্যোগে তাঁকে শায়িত করা হয়। 


একদিন মমতাজ শাহজাহানের সঙ্গে তাস খেলছিলেন মমতাজ সেদিন স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি মারা গেলে কি করা হবে। শাহজাহান বলেন এমন একটি সমাধি তৈরি করবেন চিরদিন সবাই তাঁকে মনে রাখবে। মমতাজের মৃত্যু হয় এক কন্যা সন্তানের জন্মের সময়, যে সন্তানের কান্না তিনি ও তাঁর কন্যারা শিশুটির জন্মের আগেই শুনতে পেতেন। এই ঘটনার জন্য তাঁর ধারণা ছিল যে তিনি শীঘ্র মারা যাবেন। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাদশা চিকিৎসক, ধাত্রী প্রভৃতির যথেষ্ট ব্যবস্থা করেছিলেন প্রসবের সময়। কিন্তু সন্তান জন্মের দুই ঘন্টা পরে মমতাজ মারা যান। মৃত্যুশয্যায় মমতাজ শাহজাহানকে তাঁর সমাধি সংক্রান্ত প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়েছিলেন। 


তেভারনিয়ের (ফরাসি পর্যটক) লিখেছেন তাজ তৈরি হতে কুড়ি হাজার কর্মীর বাইশ বছর লেগেছিল। জয়পুরের রাজা শ্বেতপাথর উপহার দেন, যা ১৪০ মাইল দূর থেকে আনতে হয়। বারনিয়ের (ফরাসি পর্যটক) বলেছেন মমতাজের মৃত্যুতে শাহজাহান অত্যন্ত মর্মাহত হন। 


ইউরোপীয়রা কোন ভারতীয়কে তাজমহল নির্মাণের কৃতিত্ব দিতে রাজি নন। তারা বিশ্বাস করেন ফরাসী স্থপতি অস্টিন ডি বরডিউক্স  তাজমহলের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেছিলেন। এই ব্যক্তি শাহজাহানের সভায় ছিলেন প্রধান স্থপতি হিসেবে ও প্রতি মাসে এক হাজার টাকা ও নানা  উপঢৌকন পেতেন। দেশীয়রা তাঁকে উস্টান ইসন নামে জানতো। শাহজাহানের সভায় অনেক ইউরোপীয় ছিলেন হকিংস (ব্রিটিশ দূত একজন মনসবদার), তেভার্নিয়ার (একজন রত্নকার), বারনিয়ার (একজন চিকিৎসক)। তাই অস্টিনের একজন স্থপতি হিসেবে থাকাটা আশ্চর্যের বিষয় নয়। (ওস্তাদ আহমেদ লাহোরী তাজের প্রধান স্থপতি ছিলেন বলে সভার ঘটনাপঞ্জি লেখক আব্দুল হামিদ লাহোরী তার বাদশাহানামা বইয়ে লিখে গেছেন)। তেভারনিয়ের তাজ তৈরি হতে দেখেছেন, কিন্তু তিনি অস্টিনের বিষয়ে কিছু লেখেন নি। 


১৮১৪ তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাজমহলের সারানোর কাজে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। 


তাজের বিপরীতে যমুনার অপর পাড়ে একটি অসমাপ্ত সৌধ আছে। যেটিতে শাহজাহান নিজের সমাধি হিসেবে তৈরি করছিলেন কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কারণে (আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শেষ জীবনে বন্দি করে রাখেন) তা শেষ করতে পারেননি। 


উনবিংশ শতাব্দীর আগ্রা চার মাইল দৈর্ঘ্যে ও তিন মাইল প্রস্থের শহর। এর বাইরের প্রাচীর আর নেই। ভিতরের প্রাচীরের কিছু কিছু চিহ্ন পাওয়া যায়। পূর্বের জনসাধারণের স্নানাগার, কুস্তির আখড়া প্রভৃতি এখন আর নেই। রাজা মান, রাজা বীরবল প্রমুখ অভিজাতদের প্রাসাদের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরনো স্থাপত্যের ইঁট দিয়ে এখনকার ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। মোগলদের সময়কার ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি শুধুমাত্র এখনো আগ্রায় রয়ে গেছে।



এখানে বইটির প্রথম খণ্ড শেষ হল। এবার শুরু হবে 'দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু' বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড।
 
                         (চলছে)
  

শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪

৪৮। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১২ ভোলানাথ চন্দ্র

 

  

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                     (আগের পর্বের পরে)

কানপুর সম্পর্কে আগ্রহ যে মানুষের মনে থাকে বাস্তবে কানপুর দেখলে তার আশা ভঙ্গ হওয়াটাই স্বাভাবিক, লিখেছে লেখক ভোলানাথ চন্দ্র। গঙ্গার ধারে অবস্থিত হলেও কানপুরের বালুকাময়, রুক্ষ সমতলভূমি, ধুলোবালি আর লু বা ধূলি ঝড় কানপুরকে আকর্ষণহীন করে তোলে। কানপুরে কোন পুরনো স্থাপত্য নেই। কানপুরের কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। হিন্দুদের কোন পৌরাণিক কাহিনী, বাবরের আত্মজীবনী, আইন-ই-আকবরী - কোথাও কানপুরের উল্লেখ নেই। কানপুর ইংরেজদের সৃষ্ট নগরী। যখন থেকে ইংরেজদের লক্ষ্ণৌয়ের নবাবদের উপর নজরদারি দরকার হয়ে পড়ে, তখন থেকে কানপুরের বিকাশ হয়। 


কানপুর এখন বাণিজ্য নগরী। এখানে সেখানে তুলোর গাঁঠরি, বিশাল বিশাল শস্যের স্তুপ চোখে পড়ে। সেগুলি গাড়িতে আসা-যাওয়া করে। হাজার হাজার ঘোড়া, উট, বলদ, গাধার পায়ের আঘাতে ধুলো উড়ে দমবন্ধ-কর অবস্থা তৈরি হয়েছে। 


ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় চিত্রটি অন্যরকম। প্রতিদিন সকালে, বিকালে রাস্তা জল দিয়ে ধোয়া হয়। ভারতের কোন রাস্তা এখানকার রাস্তার মতো চওড়া নয়। রাস্তার দু'ধারে গাছের সারি। খোলা ময়দানগুলি শহরে স্বাস্থ্য রক্ষা করছে। সাইনবোর্ড লাগানো ছোটখাটো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দোকান, সুন্দর বাংলো, সেনা ছাউনি, বাজার, বাগান ছিল; যখন কানপুরের সুদিন ছিল। ইউরোপীয়রা পিকনিক, ডিনার পার্টি, বলডান্স প্রভৃতিতে আনন্দে দিন কাটাতো। কিন্তু সে সব দিন চলে গেছে। রয়ে গেছে শুধু রাস্তাগুলি। এখন শুধু পরিত্যক্ত বাড়ি দরজা-জানলা কি ছাদহীন ইউরোপীয় বাংলো চোখে পড়ে। সব কিছু সিপাহী বিদ্রোহে ধ্বংস হয়ে গেছে। 


শাহ বিহারীলাল ঘাটে যেখানে একগুচ্ছ সুন্দর মন্দির আর পঞ্চাশ সিঁড়িযুক্ত ঘাট ছিল। এখন সেগুলি আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে। নৌকার পুল উড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে বন্দুকগুলি ব্যবহার করার জন্য সিপাইরা এনেছিল সেগুলি ওই মন্দিরগুলিতে লুকানো ছিল। তাই স্যার কলিং-কে সেই গুলি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিতে হয়েছিল। নৌকার ব্রিজের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মন্দিরগুলিকে ধ্বংস করা হয়। (স্যার কলিং ক্যাম্বেল সিপাহী বিদ্রোহের সময় কমান্ডার ইন ইন্ডিয়া ছিলেন)। 


সিপাহী বিদ্রোহে যে ঝড় উঠেছিল তার মধ্যে কানপুর সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল নানা সাহেবের জন্য। লেখক এবার সিপাহী বিদ্রোহের নানা কথা ও কানপুরের নানা ধ্বংসলীলা বর্ণনা করেন। কিন্তু ভ্রমণ বিষয়ক লেখাতে সেগুলি অপ্রয়োজনীয় বলে বর্জন করা হলো। 


লেখক সতীচৌরা ঘাট দেখলেন, যেখানে সতীদাহ হত ও সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের হত্যা করা হয়েছিল।


কানপুর শহরে ঘুরতে ঘুরতে এক বাঙালি বাবুর প্রতিষ্ঠিত দুর্গামূর্তি দেখলেন লেখক। এ ছাড়া আর কোন মূর্তি দেখতে পাননি শহরে। লেখকের ধারণা হিন্দুস্তানিদের থেকে বাঙালিরা মূর্তি পূজায় অনেক বেশি আগ্রহী। বাঙালি বাবুটি নিশ্চয়ই বাংলা থেকে কারিগর এনে দুর্গা মূর্তি বানিয়েছেন কারণ হিন্দুস্তানিরা সিংহের পিঠে বসা দশ হাতের এই দেবী মূর্তি তৈরি করতে পারবে না। 


এবার তাঁরা কানপুর থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ডাক গাড়িতে। দোয়াব অঞ্চল বাংলার মতো সমতল আর দোআঁশ মাটির জায়গা, কিন্তু দোয়াবের মাটি বাংলার মাটির মতো উর্বর নয়। এখানকার জলবায়ু শুষ্ক, বাংলার মতো স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ এখানে নেই। জলবায়ুর কারণে বাংলায় রোগের প্রকোপ বেশি। এখানকার মানুষকে কষ্ট করে জীবনযাত্রা চালাতে হয় বলে এরা খুব পরিশ্রমী, বাংলার মানুষের মতো কর্মবিমুখ নয়। 


চৌবেপুর হয়ে মীরা কা সরাই (মীরা সরাই) এলেন। মীরা কা সরাই এক মুসলমান ব্যক্তির নিজস্ব দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এখানে অভিজাত পরিবেশে হিন্দু ও মুসলমান পথিক ও ব্যবসায়ীরা থাকতে পারে। 


এরপর তিন মাইল পথ পেরিয়ে এল কনৌজ। (একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর) রাঠোর সাম্রাজ্যের প্রাসাদ, মিনার সমন্বিত স্থান এখন আগের গৌরব হারিয়েছে। মনুসংহিতায় প্রথম কনৌজের উল্লেখ পাওয়া যায় কাণ্যকুব্জ নামে, যা পাঞ্চাল রাজ্যের রাজধানী ছিল। ভগবান বুদ্ধ এখানে এসেছিলেন ও বাণী প্রচার করেছিলেন। সেই স্মৃতিকে অক্ষয় করে রাখতে সম্রাট অশোক এখানে ২০০ ফুট উঁচু স্তূপ স্থাপন করেছিলেন। টলেমি তাঁর বইতে এই স্থানের উল্লেখ করেছেন। ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং এই স্থান দর্শন করেছেন যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম শতাব্দীতে। হিউয়েন সাং-এর সময় এখানকার রাজা ছিলেন হর্ষবর্ধন। আবু জাইদ (নবম শতাব্দীর পারস্যের পর্যটক) এই শহরকে প্রশংসা করেছেন তাঁর লেখায়। ৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মাসৌদি (আরবের পর্যটক আল মাসুদি) এই স্থানের উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। মোহাম্মদ ঘোরীর আক্রমণে কানৌজে হিন্দু রাজত্বের অবসান হয়। ক্রমে শ্রী হারিয়ে ইবন বতুতার সময় এটি একটি ছোট শহরে পরিণত হয়। 


ব্রিটিশ প্রত্নতাত্বিক আলেকজান্ডার কানিংহাম সম্রাট অশোকের নির্মিত বৌদ্ধস্তূপ, হিন্দু রাজাদের প্রাসাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। মাটির নীচ থেকে খনন করে সেসব উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কনৌজের জুম্মা মসজিদে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অংশ পাওয়া যায়। মাটির তলা থেকে প্রাচীন মুদ্রা, হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। 


কনৌজ থেকে বাংলায় পাঁচ জন ব্রাহ্মণকে সেন রাজা এনেছিলেন যাদের বংশধরেরা বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি কুলিন ব্রাহ্মণ ও তাদের সঙ্গে আসা পাঁচ শূদ্রদের বংশ থেকে ঘোষ,বসু প্রভৃতি কুলীন কায়স্থর উদ্ভব হয়েছিল। এই কৌলিন্য প্রথায় বৃদ্ধ বয়সে ও মৃত্যু শয্যাতেও কুলীন ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণ কন্যাদের বিবাহ করত। 


কনৌজ থেকে আবার যাত্রা শুরু হল। নানা অখ্যাত গ্রাম, আমবাগান পেরিয়ে পথ। এখানে লেখক বলদে টানা ট্রেন দেখলেন। ৫০-৬০ টি ওয়াগন নিয়ে তৈরি ট্রেন জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যায়। ট্রেনের সামনে তিনটি বলদ থাকে, তারা ট্রেনটি টানে। পিছনে আর একটি বলদ থাকে, বদলি হিসাবে। কয়েকশো মাইল এই বলদের ট্রেন যায়। রাতে কোথাও বিশ্রাম নেয়, সারাদিন চলে। কখনো কখনো উটের সারি, গাধার দলও মাল বয়ে নিয়ে চলে পাশ দিয়ে রাস্তার ধুলো উড়িয়ে। 


বৃষ্টি খুব কম হচ্ছে। চার পাশে খরা শুরু হয়েছে। কুয়োর জল ষাট সত্তর ফুট নীচে নেমে গেছে। খাদ্যশস্যের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। চিরদিনই মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ হয়ে আসছে। এখন সরকার দয়ালু, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ইত্যাদি কারণে কিছুকাল দুর্ভিক্ষ হয়নি। কিন্তু শুধু খাল ও কূপের জল সেচ দিয়ে অনাবৃষ্টির মোকাবিলা করা যায় না। 


রাস্তায় মাঝে মাঝে সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ঘরবাড়ি, বাংলোর ধ্বংসাবশেষ, এমন কি জনশূন্য গ্রামও চোখে পড়ে। তবে সাধারণভাবে গ্রামজীবনে শান্তি ও স্বাভাবিকত্ব ফিরে এসেছে। 


চার পাশে শুধু জোয়ারের ক্ষেত আমবাগান ছাড়া বেশিরভাগ সময় কিছুই চোখে পড়ে না। ভোগাওনের কাছে রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে প্রধান রাস্তা দিল্লির দিকে ও অপর রাস্তা আগ্রার দিকে গেছে। 


এবার এলো মাইনপুর। এখানে এখনো একটি পুরনো হিন্দু রাজার দূর্গ রয়েছে। এখানে মূলত রাজপুরদের বাস। দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা শিশুকন্যা হত্যা এখন ইংরেজ শাসনে বন্ধ করা হয়েছে। 


পরদিন সকালে লেখকের ডাকগাড়ি এসে পৌঁছালো শিকোহাবাদে, এটি মুসলমান প্রধান এলাকা। বড় শহর থেকে শিকোহাবাদ এখন এক সামান্য গ্রামে পরিণত হয়েছে। 


দোয়াব অঞ্চলে এখন এমন কোন জমি নেই যেখানে চাষ হয় না। বাংলায় শহর গড়ে উঠেছে একমাত্র ভাগীরথী নদীর তীরে, কিন্তু দোয়াবে মাঝে মাঝে ফতেপুর, কানপুর, মাইনপুরের মতো শহর আছে। বাংলার গ্রামের তুলনায় দোয়াবের গ্রামের দোকানে অনেক বেশি রকম জিনিসপত্র কিনতে পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দোয়াবের গ্রামে না থাকলেও রোগের প্রাদুর্ভাব এখানে অনেক কম বাংলার থেকে। বাংলার গরিবদের থেকে দোয়াবের গরিবরা ভালো খাবার খায়, ভালো পোষাক পরে। বলদ ছাড়াও উট, মোষ, গাধা, ঘোড়াকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শ্রম কমায় এখনকার মানুষ কিন্তু বাংলার মানুষ শুধু বলদের ওপর নির্ভরশীল। লেখক এমনকি মেয়েদের সাজের ব্যাপারেও বাংলা ও দোয়াবের তুলনা করে দোয়াবের নারীদের রুচি শ্রেষ্ঠতর এ কথা বলেন। পঞ্চাশ বছর আগে দোয়াাবের মানুষ ঢাল, তরোয়াল, গাদা বন্দুক নিয়ে পথ চলত। এখন আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির ফলে সেই রীতি আর নেই। মুঘল আমলের তামার পয়সা এখনো দোয়াব অঞ্চলে প্রচলিত, যেমন বাংলায় কড়ির ব্যবহার রয়ে গেছে। মূর্তি পূজার চল বাংলার থেকে এই অঞ্চলে কম। বাংলার প্রতিটি গ্রামের মতো এখানকার গ্রামে শিব বা ষষ্ঠীর মন্দির নেই। 


রাস্তায় একটি ইউরোপীয় ডাকগাড়িতে দুজন ইউরোপীয়কে তাঁদের ছাড়িয়ে সামনে চলে যেতে দেখলেন লেখক। সাহেবদের গাড়ির গতি আবার দেশীয়দের সব কিছুতে পিছিয়ে পড়া প্রমাণ করলো। 


ফিরোজাবাদে ঢোকার সময় বোর্ডে 'আগ্রা পুলিশ থানা' লেখা রয়েছে লেখক দেখলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর চান্দওয়ার এখন ফিরোজাবাদ। এখানেই চান্দেলা বীর অলহা ও উদল পৃথ্বীরাজ চৌহান-এর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোরীর কাছে জয়চাঁদের পরাজয়ের ফলে এখানেই দেশ থেকে হিন্দু রাজত্বের অবসান হয়েছিল। জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাস্ত করে, তাঁর  কন্যা হরণের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মহম্মদ ঘোরীর সাহায্য নিয়েছিলেন, তাই জয়চাঁদকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়। এখন ফিরোজাবাদের কোন গুরুত্ব নেই। শহরের চারপাশে যে প্রাচীর ছিল তারও কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষজন ছোট কুঁড়ে ঘরে থাকে। 


ফিরোজাবাদের পর থেকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের দুই দিকে নিম গাছ রয়েছে ছায়া বিছিয়ে। পথে এক ঝাঁক হরিণ দেখা গেল রাস্তার পাশে। 


মহমেদাবাদের কাছে একটি সুন্দর কারুকার্যযুক্ত কিন্তু অচেনা সমাধি দেখলেন। এই কারুকার্য দেখে বোঝা গেল আগ্রা আর দূরে নেই। রাতে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে চারদিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দূরের মানুষজন, বাজার দেখতে দেখতে তাঁরা একটা উঁচু নীচু জমির নির্জন উপত্যকায় এসে পৌঁছালেন, সেটা নেকড়ে থাকার জন্য আদর্শ স্থান। তার একটু পরেই যমুনা নদীর দেখা মিলল। নদীর ওপর আলোকোজ্জ্বল নৌকার পুল দেখা গেল। এই পুল পুলিশ পাহারা দেয়। প্রতিদিন মালবাহী নৌকা যাওয়ার সময় এই পুল খোলা ও তারপর লাগানো হয়। লেখকেরা যখন পৌঁছলেন তখন পুল খোলা ছিল। তাই সে রাতে তাঁরা নদী পেরিয়ে আগ্রায় পৌঁছতে পারলেন না। গাড়িতেই রাত্রি কাটাতে হলো। জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর শোভা দেখতে দেখতে তাঁদের সময় কাটল।

                            (চলছে)

মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

৪৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১১ ভোলানাথ চন্দ্র




সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                      (আগের পর্বের পরে)

সারারাত ধরে ডাকগাড়ি চলল। সকালবেলা গঙ্গার ওপারে দেখা গেল পান্ডবদের পূর্বপুরুষ পুরোরবার রাজধানী (যার নাম ছিল 'প্রতিষ্ঠান'), পুরানের প্রয়াগ আর আকবরের এলাহাবাদ। 


গঙ্গায় ভাসমান নৌকার পুল তখন মাঝখানে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাই নৌকায় গঙ্গা পার হলেন লেখক ও সঙ্গীরা। প্রথমেই প্রয়াগ অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমস্থল দেখতে গেলেন তাঁরা। সঙ্গমের দৃশ্য অতি সুন্দর। হিন্দুদের প্রয়াগে এলেই চুল দাড়ি এমনকি ভুরু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়। এই ক্ষৌরকর্মে যতগুলি চুল বিসর্জন দেওয়া হবে তত বছর নাকি স্বর্গবাস হবে। নারীরাও কেশকর্তনে সমান উৎসাহী এখানে। 


এমনিতে প্রতিদিন এলাহাবাদের গঙ্গার ঘাটগুলি পূজা-তর্পণরত মানুষের ভিড়ে ভর্তি থাকে, তবে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের পূর্ণিমাতে মাঘী প্রয়াগী নামে এক মহামেলা বসে। সেই বিশাল জনসমাগমের মেলা প্রায় দু মাস ব্যাপী চলে। দূরদুরান্ত থেকে এসে তাঁবুতে থাকে, অস্থায়ী দোকান বসায়। পুণ্যার্থী, ভিক্ষুক, ব্যবসায়ী ভ্রমণার্থীতে স্থানটি ভরে যায়। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে দূর্গের প্রাচীরের সংলগ্ন স্থানে এই মেলা হতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে প্রায় ১৫০০ পান্ডার পরিবার এখানে ছিল। তারা কেউ কেউ এই বিদ্রোহে সাহেবদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বিদ্রোহের পর তারা হয় পালিয়ে গেছে অন্য শহরে বা জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছে। তীর্থযাত্রীদের অবশ্য এতে সুবিধা হয়েছে। 


বেনারসের পরে এলাহাবাদ দেখলে সবকিছু সামান্য ও দীনহীন মনে হয় এবং বোঝা যায় এলাহাবাদের ডাকনাম ফকিরাবাদ কেন হয়েছে। কিন্তু ক্রমে শহরটি ভালো লেগে যায়। এখানকার বাড়ির সংখ্যা কম ও সেগুলি অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। রাস্তা চওড়া আর পুরনো বড় বড় গাছের ছায়াযুক্ত। 


হিন্দু পুরাণ অনুসারে এই স্থানে ত্রিবেণী সঙ্গম অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম হয়েছে। কিন্তু  সরস্বতী নদী দৃশ্যমান নয়। বলা হয় তিনি আসার পথে দানবদের হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দিল্লির উত্তর পূর্বে বালির তলায় অন্তর্হিত হয়েছেন। তারপরের পথ তিনি অন্তঃসলিলা অর্থাৎ মাটির তলা দিয়ে বহমান হয়ে প্রয়াগ এসে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে মিশেছেন। সম্ভবত সরস্বতী বা ঘাগ্গার নদী এক প্রচন্ড ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভে চলে যায়। সেই ভূকম্পের শব্দকে দানবের হুংকার বলে বলা হয়েছে। 


এলাহাবাদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় স্নান হল দূর্গ, যা গঙ্গা যমুনার জল থেকে উপরে উঠে গেছে। এই দুর্গ কবে তৈরি হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে হিন্দু যুগের এই দুর্গ বহু শক্তির উত্থান পতনের সাক্ষী। বাদশাহ আকবর মুসলমান শাসনকালে এই দুর্গে সংস্কার করেন ও এই স্থানের নাম দেন এলাহাবাদ। হিন্দুরা একটি কাহিনীতে বিশ্বাস করে। আকবর আগের জন্মে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন তার নাম ছিল মুকুন্দ। মুকুন্দের বাসনা ছিল ভারতের সম্রাট হওয়ার। মুকুন্দ দেবতার কৃপায় বর লাভ করেন যে পরের জীবনে তাঁর এই স্বাদ পূর্ণ হবে। সেই জীবনে যা কিছু তিনি পরের জীবনে মনে রাখতে চান তা তাম্রলিপিতে লিখে একস্থানে তিনি পুঁতে রাখেন। মুকুন্দ প্রয়াগে সেই তাম্রলিপি মাটিতে পুঁতে আগুনে আত্মাহুতি দেন। এরপর তিনি আকবর হিসেবে জন্ম নিয়ে সেই স্থানটি খুঁজে তাম্রলিপিটি পাঠ করেন। মুসলমানদের থেকে এখন দূর্গটি ইংরেজদের অধীনস্থ হয়েছে। উন্নত অস্ত্র ও যুদ্ধনীতির কারণে এই সময় দূর্গ নতুন ভাবে সজ্জিত হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দূর্গটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি সুন্দর ময়দান পেরিয়ে দূর্গে ঢোকার তোরণ দ্বার। সেখানে সিপাহীরা, কালো চামড়ার মানুষদের দুর্গে প্রবেশের কাগজ দেখাতে না পারলে আটকে দেয়। ভিতরে আকবর তৈরি ২৭২ ফুট লম্বা রাজকীয় হল রয়েছে। হিন্দু রাজাদের আমলে স্থাপত্য চারিদিকে বিদ্যমান। দূর্গের ঠিক নীচ দিয়ে যমুনা বয়ে চলেছে। একটা খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা পাথরের সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে, সেখান দিয়ে মোগল রাজপরিবারের মহিলারা যমুনার ঘাটে স্নান করতে যেত। 


দূর্গের মধ্যে একটা সুড়ঙ্গের মতো স্থান আছে মাটির নীচে, যেটিতে এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্রিটিশ সৈন্যরা সেটি গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছে। আগে যারা এখানে এসেছে তারা ভিতরে ঢুকেছে। ভেতরটা ভিজে, ঠান্ডা, অদ্ভুত গন্ধযুক্ত। সুড়ঙ্গের শেষে একটা চাতাল আছে। তার উপর একটা ৭ ফুট উঁচু মন্দির আছে। মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে, শিবের চারপাশে আরও দেব দেবীর মূর্তি আছে। একটি মৃত গাছের গুঁড়ি আছে, যেটি কয়েকশো বছরের পুরনো। একে অক্ষয় বট বলে, এর নাকি মৃত্যু নেই। আরো বহু আগে নাকি এই সুড়ঙ্গ পথের অন্যদিক সঙ্গম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লেখক বলেন গুহা মন্দির তৈরিতে যেহেতু বৌদ্ধরা পারদর্শী ছিল হয়তো এই গুহা মন্দির একসময় বৌদ্ধদের ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা তার দখল নেয়। হয়তো এককালে এই মন্দিরটি মাটির উপরে ছিল গঙ্গা-যমুনার পলি সঞ্চারের ফলে কোনভাবে এটি এখন পাতালপুরীতে পরিণত হয়েছে। দূর্গে সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো ভীমের গদা বা লাট বা দন্ড। এটি এক পাথরে তৈরি মাটি থেকে ৩৫ ফুট উঁচু বহু প্রাচীন একটি স্তম্ভ। বস্তুতঃ এটি সম্রাট অশোকের অনুশাসনের প্রচারের স্তম্ভ (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি)। এই স্তম্ভটিতে পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্রগুপ্তের কীর্তি খোদিত হয়। শেষে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এই স্তম্ভে জাহাঙ্গীরের নাম বংশ পরিচয় ইত্যাদি খোদিত হয়েছে। 


এলাহাবাদ শহর ঘুরে দেখার সময় লেখক যমুনা নদীর দরিয়া ঘাট দেখলেন। এটি একটি পুণ্যস্থান। শোনা যায় বনবাসে যাওয়ার সময় সীতা ও লক্ষণসহ রাম এখানে নদী পার হয়ে বন্ধু গুহক চন্ডালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর নিকটে বেনারসের রাজার প্রাসাদ আছে। যমুনার ওপর ব্রিজ তৈরির কাজ চলছে দুই বছর ধরে। জলের তলায় ডুবে কাজ করতে গিয়ে তিন চারজন প্রাণ হারিয়েছে (১৮৬৬ তে এই ব্রিজ সম্পন্ন হয়)। লেখক জুম্মা মসজিদ, ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম, বরাহ মন্দির (লক্ষীবরাহ মন্দির) দেখলেন। 


এবার লেখক এলেন মোগলদের তৈরি বাগান খসরু বাগে রয়েছে খুব সুন্দর ফুল-ফল-সবজি বাগান আর গাছপালা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট গোলক ধাঁধা। বাগানের মধ্যস্থলে খসরু, পারভেজ ও জাহাঙ্গীরের মারোয়ারি বেগমের সুন্দর কারুকার্য করার সমাধি দেখলেন। (খসরু জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে, পারভেজ জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র ও জাহাঙ্গীরের মারওয়ারি বেগমের নাম শাহ বেগম)। বাগানের সংলগ্ন অংশে একটি বড় সরাই আছে, যা মোগলদের জনস্বার্থমূলক কাজের একটা উদাহরণ। সরাইতে একটা সুগভীর কূপ আছে, যার মধ্যে নামার জন্য সিঁড়ি আছে। 


এলাহাবাদ স্টেশন হাওড়া স্টেশনের অর্ধেকের থেকেও ছোট। এখানে ট্রেন চালাতে কয়লার বদলে কাঠ ব্যবহার করা হয়। এই জ্বলন্ত কাঠের টুকরো হাওয়ায় উড়ে কামরায় ঢুকে কখনো কখনো অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। গাড়ির হিন্দু যাত্রীরা অনেকে রঙিন পাগড়ী পড়ে থাকায় গাড়ির ভেতরটা বেশ উজ্জ্বল দেখতে লাগে। ট্রেনে এলাহাবাদ থেকে কানপুর যাওয়ার পথে ট্রেনে জানালা দিয়ে ঐতিহাসিক ও সুন্দর দোয়াব উপত্যকা দেখতে দেখতে যান লেখক। বেরহামপুর (এখানে এই নামে কোন স্টেশন এখন নেই), ফতেপুর স্টেশন হয়ে ট্রেন এসে পৌঁছায় কানপুর

                       
                         (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...