------- সুমনা দাম
শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬ - ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ) -এর জীবনে যে ভ্রমণের একটি বড় অংশ আছে সে ব্যাপারটা প্রথম আমার নজরে আসে প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও সুলেখক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বাঙ্গালার ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড পড়ার সময়।
বৃন্দাবন দাস, গোবিন্দদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, জয়ানন্দ প্রমুখ চৈতন্য জীবনীকারদের রচিত কাব্যগ্রন্থ থেকে শ্রীচৈতন্যের বিভিন্ন যাত্রার পুঙ্খানপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে তিনি পায়ে হেঁটে এই তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেহেতু বহুদিন অতিক্রান্ত , তাই বহু স্থানে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে, বহু স্থানের নাম আমূল পরিবর্তিত হয়েছে, বেশ কিছু নদী বা খাল গতিপথ পাল্টেছে বা শুকিয়ে গেছে। তাই ওই গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত সব জায়গা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, তবু আমি প্রধানতঃ গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে বেশ কিছু জায়গা খুঁজে পেয়েছি, কিছু পাই নি, কিছু নিয়ে সন্দিহান থেকেছি। লেখার সময় ব্রাকেটের () মধ্যে আমি সেগুলি উল্লেখ করেছি। যেগুলি পাই নি, প্রশ্ন চিহ্ন (?) ব্যবহার করেছি।
বৃন্দাবনদাসের চৈতন্য ভাগবতে পাই যে পিতার মৃত্যুর পর তিনি গয়া গেছিলেন পিণ্ডদানের জন্য। পথে তিনি মন্দার পর্বতে (বিহারের বাঁকা জেলায় অবস্থিত) মধুসূদন দর্শন করেন। তিনি পুনপুনা তীর্থ, বহ্মকুণ্ড, প্রেতশীলা, রামগয়া, উত্তরমানস, দক্ষিণমানস, বিষ্ণুপদ, ভীমগয়া, শিবগয়া প্রভৃতি ষোড়শ গয়া দর্শন করেন। গয়াতে তিনি বিষ্ণুর শ্রীচরণস্থান দর্শন করে আবিষ্ট হন। (এই সময় থেকে মহাপন্ডিত ও সুতার্কিক বিশ্বম্ভরের মধ্যে ভক্তিরস প্রাধান্য পায়)। সেখানে তিনি ঈশ্বরপুরীর সাক্ষাৎ পান। পরে ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান কুমারহট্ট (হালিশহর) দর্শন করেন এবং তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। চব্বিশ বছর বয়সে (১৫০৯ খ্রিস্টাব্দ) গৃহত্যাগ করে শ্রীচৈতন্য (তৎকালীন নাম বিশ্বম্ভর ও নিমাই) কাটোয়ায় যান ও কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন।
পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির
কাটোয়া থেকে তিনি শান্তিপুরে আচার্য অদ্বৈতের গৃহে যান ও সেখান থেকে পুরুষোত্তম বা পুরী যাত্রা করেন।
গোবিন্দদাসের কড়চার রচয়িতা গোবিন্দদাস, যিনি এই যাত্রায় শ্রীচৈতন্যের সঙ্গী ছিলেন তিনি লিখেছেন চৈতন্যদেব বর্ধমান হয়ে দামোদর পার হয়ে কাশীপুর (কেশপুর?), হাজীপুর (পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের হাজীপুর), মেদিনীপুর, নারায়নগড় (এখানে ধলেশ্বর শিব দর্শন করেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের কসবা নারায়ণগড়) হয়ে যাত্রা করেন। জলেশ্বর গিয়ে বিলেশ্বর শিব দর্শন করে হরিহরপুর (উড়িষ্যা), বালেশ্বর, নীলগড় হয়ে বৈতরণী ও মহানদী পার হয়ে ভুবনেশ্বর এসে লিঙ্গরাজ মন্দির দেখেন। তাঁর সঙ্গীরা ছিলেন ঈশান, প্রতাপ, গঙ্গাদাস, গদাধর, বাণেশ্বর প্রমুখ।
পুরীতে চৈতন্যদেবের আবাসস্থল
চৈতন্য মঙ্গলের রচয়িতা জয়ানন্দ পথের বর্ণনা একটু অন্যরকম লিখেছেন। চৈতন্যদেব শান্তিপুর থেকে আম্বুয়া (সম্ভবত অম্বিকা কালনা, পূর্ব বর্ধমান), কাচমনি, বেতড়া (মেমারির অন্তর্গত বিতড়া অঞ্চল) হয়ে কুলীন গ্রামে (পূর্ব বর্ধমান) যান। তিনি দেবনদ (দামোদর নদী), সেয়াখালা (হুগলির সেয়াখলা কি?) দিয়ে তমলিপ্ত (তমলুক) যান। মন্ত্রেশ্বরে (?) বিষ্ণুদর্শন করে, সুবর্ণরেখা পার হয়ে বারাসাতে (?) পৌঁছান। তারপর দাঁতন ও জলেশ্বর (বর্তমান উড়িষ্যা) হয়ে অমরদাতে (গোপীবল্লভপুরের অন্তর্গত গ্রাম) পৌঁছান। বাঁশদা (পূর্ব মেদিনীপুর) রামচন্দ্রপুর (পূর্ব মেদিনীপুর) হয়ে রেমুণাতে ( উড়িষ্যা) পৌঁছে গোপীনাথ এবং সরোনগরে সিদ্ধেশ্বর দর্শন করেন। তারপর বাঙালপুর (উড়িষ্যা) হয়ে অসুরগড়ের (উড়িষ্যা) পাশ দিয়ে ভদ্রকে পৌঁছান। ভদ্রক থেকে তুঙ্গদা হয়ে জাজপুরে পৌঁছান এবং বিরজা, নাভিগয়া প্রভৃতি দর্শন করে একাম্রবন (ভুবনেশ্বর) যান। পথে পুরুষোত্তমপুর (উড়িষ্যা), পাটনা (উড়িষ্যার কেন্দুঝাড় জেলার পাটনা), আমরাল হয়ে কটকে এসে রাজরাজেশ্বর দর্শন করে ভুবনেশ্বর যান। ভুবনেশ্বর থেকে কপিলেশ্বর, কাঁঠতিপাড়া, কমল, আঠারনালা (পুরী ঢোকার মুখের সেতু) হয়ে পুরুষোত্তম বা পুরীতে এলেন।
জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গল অনুযায়ী পুরীতে চৈতন্যদেবের সঙ্গে ছিলেন কৃষ্ণদাস, হরিদাস, শ্যামদাস, প্রেমদাস, মোহান্ত ব্রাহ্মণ, গোপীদাস, রঘুনাথদাস, নরহরি, দামোদর স্বামী, গদাধর, কাশীমিশ্র, শঙ্কর ভারতী, পরমানন্দপুরী, সার্বভৌম ভট্টাচার্য প্রমুখ।
বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত অনুযায়ী তিনি ছত্রভোগে অম্বুলিঙ্গ (দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর?) ঘাটে গেছিলেন। সেখান থেকে নৌকায় উড়িষ্যার প্রয়াগ ঘাটে (সম্ভবতঃ বিরূপা নদীর তীরে অবস্থিত ত্রিবেণীশ্বর?) এসেছিলেন। এই নৌযাত্রার ভয়াবহতা প্রকাশ পায় তাঁর এই লেখায় "কুলেতে উঠিলে বাঘে লইয়া পলায়। জলেতে পড়িলে কুম্ভীরেতে ধরি খায়।। নিরন্তর এ পাণিতে ডাকাইত ফিরে। পাললেই ধন প্রান দুই নাশ করে।।" সুবর্ণরেখা পার হয়ে জলেশ্বর, বাঁসধা (ভদ্রক-এর বানসাধা গ্রাম), রেমুণা (রেমুনা), জাজপুর, কটক (এখানে সাক্ষীগোপাল দর্শন করেছিলেন) হয়ে ভুবনেশ্বরে আসেন। চৈতন্য ভাগবত অনুযায়ী নিত্যানন্দ, গদাধর, মুকুন্দ, গোবিন্দ, জগদানন্দ, ব্রহ্মানন্দ চৈতন্যদেবের সহযাত্রী ছিলেন।
বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত মতে কিছুকাল পুরুষোত্তমে থেকে শ্রীচৈতন্য গৌড়ে ফিরে আসেন। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল অনুসারে তিনি এরপর দক্ষিণাপথ (দক্ষিণ ভারত) যাত্রা করেন। গোবিন্দদাসের কড়চা অনুসারে তিনি দক্ষিণাপথযাত্রা করেন এবং কড়চার লেখক গোবিন্দদাস ছাড়া আর কাউকে সঙ্গে নেন নি।
জয়ানন্দের মতে চৈতন্য মহানৈ (মহানদী) পার হয়ে কাটাতিপাড়া (?) বাঁয়ে রেখে জিঅড় পর্বতে (?) যান ও নৃসিংহ দর্শন করেন। এরপর গোদাবরী পার হয়ে পঞ্চবটী (পঞ্চবটী,মহারাষ্ট্র) হয়ে কাবেরী নদীতে স্নান করে ত্রিমন্দ্রনাথে (তিরুমালা গিরি, তেলেঙ্গানা) যান। কিন্তু এই অঞ্চলে কাবেরী নদী নেই, তাই এই তথ্যে কিছু ত্রুটি আছে বলে মনে হচ্ছে।
গোবিন্দদাসের কড়চা অনুসারে পুরী থেকে চৈতন্যদেব গোদাবরী তীরে যান। তারপর ত্রিমন্দ্রনগরে (তিরুমালাগিরি) যান। সেখানে তিনি বৌদ্ধ পণ্ডিতদের তর্কে পরাজিত করেন। তারপর যান পন্থগুহা (পাণ্ডগভুলা গুহা, অন্ধ্রপ্রদেশ)। তারপর সিদ্ধ বটেশ্বর (বর্তমান কড়পা, অন্ধ্রপ্রদেশ) তীর্থে যান। এরপর তিনি মুন্নানগর (অন্ধপ্রদেশ) হয়ে বেঙ্কটনগরে (ভেঙ্কটনগর, পন্ডিচেরি) যান। তারপর বগুলা (?) অরণ্য হয়ে গিরিশ্বর নামের মন্দির দর্শন করে ত্রিপদী নগরে (?) যান ও রামের মূর্তিদর্শন করেন।
সেখান থেকে পানানরসিংহ (মঙ্গলগিরি, অন্ধ্রপ্রদেশ) দর্শন করে বিষ্ণুকাঞ্চি (কাঞ্চিপুরম) যান। সেখানে ত্রিকালেশ্বর শিব ও কালতীর্থে বরাহমূর্তি দর্শন করেন (ভূবরাহ স্বামী মন্দির, তামিলনাড়ু সম্ভবত)। চৈতন্যদেব নন্দা ও ভদ্রা নদীর সঙ্গমে স্নান করেন, যাকে সন্ধিতীর্থ বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা কোথায় অবস্থিত? তবে কি তা বর্তমানে লুপ্ত? তারপর তিনি গেলেন চাঁইপল্লীতীর্থতে (ত্রিচিনাপল্লী)। গেলেন নাগর (নাগর, তামিলনাড়ু)। সেখান থেকে তাঞ্জোরনগরে (তাঞ্জোর)। সেখানে চন্ডালু নামে এক পাহাড় দেখলেন যার মধ্যে অনেক গুহা আছে এবং সেই গুহায় অনেক সন্ন্যাসী থেকে তপস্যা করেন। সেখান থেকে চৈতন্য পদ্মকোটে (?) যান ও দেবী অষ্টভূজা দর্শন করেন। এবার তিনি যান ত্রিপাত্রনগরে ও চন্ন্ডেশ্বর শিব (ত্রিপত্র নগর বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু তামিলনাড়ুর হসুরে চন্দ্রচূড়েশ্বর শিব মন্দির আছে) দর্শন করেন।
শ্রীচৈতন্য যেখানেই যান সেখানেই আবালবৃদ্ধবণিতা উপস্থিত হয় ও হরিনামে মেতে ওঠে। অনেকে বৈষ্ণব হয়। প্রতিটি স্থানেই চৈতন্যের লীলাকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এই রচনার উদ্দেশ্য ধর্ম নয়, ভ্রমণ। তাই শুধু ভ্রমণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই চৈতন্য জীবনী গুলি দেখা হয়েছে।
এবার এলো ঝারিবন নামে প্রকাণ্ড জঙ্গল। তার মধ্যে দিয়ে একপক্ষকাল যাত্রা করে এল রঙ্গধাম ( শ্রীরঙ্গম, তামিলনাড়ু), নরসিংহ মূর্তি দর্শন করে এবার তিনি গেলেন ঋষভ পর্বতে (মলয় পর্বত বা মলায়াদ্রী)। তারপর রামনাথ নগরে (?) এলেন ও শ্রীরামের পাদপদ্ম স্পর্শ করলেন। গেলেন তত্ত্বকুন্ডি তীর্থ (?), তাম্রপর্ণী (থামিরাবারানি নদী, তামিলনাড়ু) নদীতে স্নান করলেন। এবার এলেন কন্যাকুমারী সেখানে সমুদ্র দর্শন করলেন ও স্নান করলেন।
এরপর এক সন্ন্যাসীদের দলের সঙ্গে চললেন সাঁতল পাহাড় (?) ডিঙিয়ে গেলেন ত্রিবঙ্কুদেশে (ত্রিবাঙ্কুর)। সেখানকার রাজা রুদ্রপতি নিজে এসে চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর রামগিরি (রামগিরি, কর্ণাটক) যান। পাহাড়ের উপরে তারপর পয়ষ্ণী নগরে (?) শিব নারায়ণের দর্শন করেন শিংগারির মঠে (শৃঙ্গেরী মঠ, শঙ্করাচার্যের মঠ, কর্ণাটক) গেলেন। ঈশ্বর ভারতীকে শুষ্ক বিদ্যা অপেক্ষা কৃষ্ণপ্রেমের সারময়তা উপলব্ধি করালেন। এরপর পর্বত জঙ্গল বেষ্টিত দুর্গম পথে চলতে চলতে বাঘ দেখে কবি ভয় পেলেও শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণনামে বিভোর হয়ে পেরিয়ে গেলেন সে পথ। এরপর কান্ডার দেশের (কন্নড় দেশ বা কর্ণাটক) কাছে নীলগিরি পর্বত দর্শন। এবার এলেন গুর্জরী নগরে। এখানে অগস্তকুন্ডে (বাদামি, কর্ণাটক) স্নান করলেন। বহু মহারাষ্ট্রী নামগান শুনতে আসেন। কুলনারীরাও আসেন। কখনও তামিল বুলি বলেন শ্রীচৈতন্য, কখনো সংস্কৃত।
এবার বিজাপুরে (মহারাষ্ট্র) পাহাড়ের শিখরে উঠলেন ও হরগৌরী দর্শন করলেন। আগে মহেন্দ্র মলয়গিরি বা মলায়াদ্রী দেখেছেন এবার সহ্যগিরি বা সহ্যাদ্রী দেখে আনন্দিত হন। ক্রমে পূর্ণনগরে (পুণা) এসে পাহাড়ের ওপর ভোলেশ্বর, দেবলেশ্বর দেখে জিজুরী (জেজুরী) নগরে গিয়ে খাণ্ডবা দেব দর্শন করেন। এখানে তিনি বহু পতিতা নারীদের কৃষ্ণ নামে পাপ মুক্তি ঘটান। তারপর যান চোরানন্দী বন (?)। সেখানে ডাকাতদের বাস। হরি ভক্তি দিয়ে ডাকাতদের ডাকাতি ছাড়িয়ে পাপ মুক্তি ঘটান। ডাকাতের সর্দার নারোজী এরপর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে চললেন। নাসিকে গেলেন, যেখানে সূর্পনখার নাসিকা ছেদন হয়েছিল। ত্রিমুকের (ত্রিমক, মহারাষ্ট্র) কাছে রামের কুটিরক্ষেত্র দর্শন করেন ও জঙ্গলে রামের চরণচিহ্ন দর্শন করেন তারপর পঞ্চবটি বনে (পঞ্চবটি, নাসিক, মহারাষ্ট্র) গেলেন ও লক্ষণের প্রতিষ্ঠিত গণেশ দেখলেন (অধুনালুক্ত?)।
এরপর গেলেন দমন নগরে (দমন)। সুরতের রাজ্যে (সুরাট, গুজরাট) যান ও অষ্টভূজা ভগবতী দেখেন। তারপর তাপতী (তাপ্তি) নদীতে স্নান করে বামন দেবের (?) দর্শন করেন। তারপর নর্মদা নদীর তীরে ভরোচ নগরে (ব্রোচ, গুজরাট) যান ও বলিরাজার কুন্ড দর্শন করেন। মহাতীর্থ নর্মদা স্নান করে বরোদা নগরে যান ও ডাকোরজী (?) দর্শন করেন। বরোদার রাজা চৈতন্যদেবের দর্শনে এসেছিলেন। এবার এলেন আমেদাবাদ, যা অত্যন্ত সুসজ্জিত নগর। অনেক অট্টালিকা ও উদ্যান আছে। শুভ্রামতী নদী (সবরমতী নদী) দেখার পরে দ্বারকাগামী দুজন বাঙালির সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। অর্থাৎ আরো বাঙালি তীর্থ ভ্রমণে যেতো তখনও। তাঁরা সোমনাথ গেলেন, জাফেরাবাদ (জাফরাবাদ) হয়ে। সোমনাথ মন্দিরের ঢিবি আর ভাঙ্গা চিহ্ন ছাড়া কিছু অবশিষ্ট ছিল না যবনের অত্যাচারে। তারপর জুনাগড় নগর, যা বহু অট্টালিকা শোভিত। রণছোড়জীর (ডাকোর, গুজরাট) মন্দির দর্শন করেন। চৈতন্যদেব এবার চললেন গৃণার পাহাড়ে (গিরনার পাহাড়) এবং কৃষ্ণের পদচিহ্ন দর্শন করলেন। দীর্ঘ জঙ্গলময় পথ পেরিয়ে আসেন প্রভাস তীর্থ (প্রভাস, গুজরাট)। এবার দ্বারকা নগরী, যা সমুদ্রের ধারে অবস্হিত। রইবতক পাহাড় ( গিরনার পাহাড়?) দেখতে পেলেন মন্দির দর্শন করলেন।
এবার চৈতন্যদেব পুরীতে ফিরতে মনস্থ করলেন। বরোদা হয়ে নর্মদার তীর ধরে দোহদ নগর (দোহদ, গুজরাট), কুক্ষিনগর (কুক্ষি, মধ্যপ্রদেশ), আমঝোরা নগর (আমঝর, মধ্যপ্রদেশ), বিন্ধ্যগিরির উপরে মন্দুরা নগর (মন্ডলা মধ্যপ্রদেশ?), বিন্ধ্যের নীচে মন্ডল নগরী (মন্ডলা?), দেবঘর (দেওঘর, মধ্যপ্রদেশ), শিবানী নগর (সিওনি, মধ্যপ্রদেশ?), মহল পর্বত (?), চণ্ডীপুর নগর (?,এখানে চন্ডী দেবী দর্শন) হল। এবার এল রায়পুর (ছত্রিশগড়), বিদ্যানগর (ছত্রিশগড়), রত্নপুর (রতনপুর, ছত্রিশগড়)। সেসব পেরিয়ে পৌঁছলেন স্বর্ণগড় (সরনগড়, ছত্রিশগড়)। সেখানকার রাজা এসে দেখা করলেন। এরপর একে একে এল সম্বলপুর (উড়িষ্যা), ভ্রমরানগর (ভানগড়, উড়িষ্যা), প্রতাপনগরী ভুবনেশ্বরে নিকটে প্রতাপনগরী, দাসপাল নগর ( দশপাল্লা, উড়িষ্যা), রসাল কুণ্ড। রসাল কুন্ডে (চম্পেশ্বরের চম্পানাথ মন্দিরের সংলগ্ন দীঘিতে এখনও কচ্ছপ আছে অনেক) কূর্মদেবের ( মন্দিরের পোষা কচ্ছপ সম্ভবত) দেখা পেলেন। এবারে ঋষিকূল্যা ধাম (ঋষিকূল্যা নদীতীরে তারাতারিণী মন্দির সম্ভবত তখনও তৈরি হয় নি, তাহলে কোন ধাম?) হয়ে পুরী ফিরলেন শ্রীচৈতন্যদেব।
পরবর্তীকালে শ্রী চৈতন্যদেব বৃন্দাবন ধাম যাত্রা করেছিলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত "শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত" গ্রন্থে সেই বর্ণনা পাওয়া যায়। সঙ্গী ছিলেন শুধু বলভদ্র ভট্টাচার্য ও তাঁর এক ভৃত্য। পুরী থেকে তিনি প্রধানপথে না গিয়ে উপপথ ধরে চললেন। কটকের কাছে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন। বাঘ ও হাতিসঙ্কুল সেই পথে নির্দ্বিধায় কৃষ্ণ নাম করতে করতে তিনি চললেন। ঝারিগ্রাম (?) হয়ে ক্রমে কাশীতে আসেন। কাশীতে কিছুদিন বাস করার পর প্রয়াগ হয়ে মথুরায় যান। মধুপুরী বা মথুরার ২৪ ঘাটে প্রভু স্নান করেন ও নানা তীর্থস্থান দর্শন করেন। বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ড দর্শন, গোবর্ধন পরিক্রমা গোবিন্দ কুঞ্জে স্নান, নন্দীশ্বর, কাম্যবন প্রভৃতি সব দর্শনীয় স্থান দর্শন করেন। মথুরা, বৃন্দাবনে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে মহাপ্রভু প্রয়াগ ও কাশী হয় হয়ে পুরী বা নীলাচলে প্রত্যাবর্তন করেন।
প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!


কতো অজানা তথ্য কতো অজানা তীর্থ আর মহাপ্রভুর ভারত ভ্রমণ প্রসঙ্গে অনেক তথ্য জানার সৌভাগ্য হলো এই উদ্যোগের কারণে ।ধন্যবাদ লেখিকাকে 🙏
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুন