রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০২৪

১৬। তীর্থ ভ্রমণ ১ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

     

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                     ---- সুমনা দাম


তীর্থমঙ্গলের পরে বাংলা ভাষায় পাওয়া ভ্রমণ সাহিত্যটি গদ্যে লেখা এবং ডাইরি বা রোজনামচার আকারে লেখা। তীর্থ ভ্রমণের লেখক যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী (১৮০৫ -১৮৭১) এই ভ্রমণটি শুরু করেন ২৬০ সনের (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪  খ্রিস্টাব্দ) ১১ই ফাল্গুন তাঁর বর্তমান খানাকুলে অবস্থিত রাধানগরের বাড়ি থেকে। ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরেন ৯ ই অগ্রহায়ণ, ১২৬৪ সনে (২৪ ভেম্বর ১৮৫৭)। এই সময়ে ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে ছিল। এই ভ্রমণটি ভারতের রেল পূর্ববর্তী কালের ভ্রমণ। ভারতীয় রেল ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে থেকে থানে ও কল্যান অব্দি এবং হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত প্রথম শুরু হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় তখন কোনো রেলের সংযোগ ছিল না। তীর্থমঙ্গলের কবি বিজয়রাম, জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের যে সহায় সম্বল পেয়েছিলেন বর্তমান গ্রন্থের লেখকের সেরকম কিছু ছিল না। তিনি মূলতঃ পদব্রজে, নিজের চেষ্টায়, নিজের সামান্য অর্থে এই ভ্রমণ করেছেন। তিনি আত্মীয়-স্বজনকে শোনানোর জন্য নিজের দিনলিপি লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক নগেন্দ্র নাথ বসুর সম্পাদনায় তীর্থ ভ্রমণ নাম নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
 



  রাধানগর থেকে গয়া (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)


লেখক তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে অম্বল রোগে অত্যন্ত পীড়িত হয়েছিলেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের উদ্ধারের জন্য তিনি পশ্চিম দেশে যেতে অভিপ্রায় করেন। চিকিৎসকও তাকে পদব্রজে পশ্চিম বা উত্তর দেশে ভ্রমণের পরামর্শ দেন। তিনি প্রথমে বৃন্দাবন পর্যন্ত যেতে আগ্রহী ছিলেন। ভ্রমণের শুরুতে ৩০ টাকা সঙ্গে নিয়েছিলেন। বাড়ির অনেকেই তাঁকে এই ভ্রমণে যেতে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল। তীর্থ ভ্রমণের পূর্বে ব্রাহ্মণ- কায়স্থ ভোজন, শ্রাদ্ধ, সংযম পালন করে তিনি খানাকুলের নিকটস্থ রাধাবল্লভপুরের ঈশ্বরচন্দ্র কওড়ি, নকুড়চন্দ্র বসু, রামধন সিংহ এবং মুটে হিসাবে বিশ্বনাথ তাঁতিকে নিয়ে রওনা হলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের দাদা গোরাচাঁদ কওড়ি এর তিন বছর আগে যাত্রী নিয়ে গয়া তীর্থে গেছিলেন। প্রথমদিকেই বিশ্বনাথ তাঁতি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 
যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় রাধাবল্লভপুর থেকে জাহানাবাদের (বর্তমান আরামবাগ) অপর পাড়ে কালিপুর (দ্বারকেশ্বরের অপর পাড়ে) হয়ে গৌরহাটি (গৌরহাটি, খানাকুল) পৌঁছান। পরদিন কোতলপুর (কোতুলপুর, বাঁকুড়া) নামক সমৃদ্ধস্থানে থাকা হয়। কোতুলপুর থেকে বালসী (বালসী, বাঁকুড়া) গিয়ে লক্ষীনারায়ণশীলা দর্শন করা হয়। লেখক এই স্থানের আর্থ-সামাজিক নানা কথা লিখেছেন। তীর্থস্থানের পুরোহিতদের লোক ঠকানোর কথাও লিখেছেন। তারপর পাত্রসায়ের হয়ে সোনামুখী গ্রামে (বর্তমান সোনামুখী, বাঁকুড়া) যান বনের ভিতর দিয়ে। সেখানে তখন নানা হিংস্র জন্তু যেমন ভাল্লুক ছিল। বর্ধমান রাজার শ্রীমদ ভগবতদের বিখ্যাত কথক গদাধর শিরোমনির বাসস্থান এই সোনামুখী। তাঁর অর্থানুকুল্যে জঙ্গলের মধ্যে এই বসতি গড়ে উঠেছে। তাঁর গৃহে গোবর্ধন পর্বতের মন্দিরাকৃতি দেবালয় আছে। সোনামুখী থেকে বেরিয়ে ইচলার খাল (অধুনা লুপ্ত?)। তারও কিছু পরে দামোদর নদীর শ্রীরামপুর ঘাট (?)। আরো গেলে গোপালপুরের (বিষ্ণুপুরের নিকট) পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। যে রাস্তা বর্ধমান থেকে দিল্লী পর্যন্ত যায় (বর্তমানে বর্ধমান-বিষ্ণুপুর রোড)। 


এই রাস্তার কিছু দূর অন্তর চটী বা পথিকদের রাত্রিবাসের স্থান। রাস্তার দুই ধারে দোকান। দোকানগুলি খোলার ঘর, পথিকদের থাকার স্থান বড় বড় ঘর। সকল ঘরের ভাড়া দিতে হয় না। হাঁড়ি, কাঠ বাবদ পয়সা দিতে হয়। চাল, ডাল ওই দোকান থেকে নিতে হয় আর তরকারি, মাছ, তেল, দুধ, দই বিক্রি করতে বিক্রেতা আসে। ধোপা, নাপিত ইত্যাদি সবই চটীতে পাওয়া যায়। ইঁদাড়া বা কুয়োতে পথিকের জন্য ভালো পানীয় জল আছে। পুলিশের চৌকি থানা আছে। এরপর এল অন্ডাল (পশ্চিম বর্ধমান)। অন্ডাল থেকে এক ক্রোশ দূরে মধুবন। খুব ঘন মহুয়া গাছের জঙ্গল। 
তারপর ফয়েদপুর, তারপর বোগড়া  (বর্তমান রানীগঞ্জ স্টেশন-এর কাছে)। এখানকার গোবিন্দ পন্ডিত ২৪ পরগনা জেলায় ডেপুটি কালেক্টর -এর কাজ করেন। পথিকদের সুবিধার্থে রাস্তার ধারে সুন্দর ফুল, ফলের বাগান, তার মধ্যে দশ বিঘা পুকুর ও জলসত্রের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন গোবিন্দ পন্ডিত মহাশয়। বগোড়া থেকে নিয়ামতপুর (নেয়ামতপুর, পশ্চিম বর্ধমান) হয়ে যাত্রা করেন। এই পথে অশ্বারোহী প্রহরীরা পাহারা দেয় বলে নিরাপদ। 


এবার এলো এক লাল মাটির পাহাড়, মেটে সিঁদরে পাহাড়, যার পশ্চিমে বরাকর নদী। পূর্ব তীরে রাজা হরিশচন্দ্রের দুটি শিব মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের সামনে ও পেছনে পাথরের তৈরি গরু ও শুকরের মূর্তি। এই হরিশচন্দ্র পঞ্চকোট বংশের রাজা ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। নিয়ামতপুর রাজা হরিশচন্দ্রের রাজধানী, গড় পঞ্চকোট থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। বরাকর নদ পায়ে হেঁটে পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে নৃসেচটী। সেখানে প্রায় ৪০ টি বড় ঘর আছে পথিকদের জন্য। এই চটী পার হয়ে চাস চটী (চাস,ঝাড়খন্ড)। তারপর গোবিন্দপুর-এর চটী (গোবিন্দপুর, ঝাড়খন্ড)। 


'এই চটি পর্যন্ত মগঘ রাজ্য। মৎস্য দেশ, বরাকর অবধি বিরাট রাজ্য। তাহার পর জরাসন্ধাধিকার মগধ' - এটি লেখক বলেছেন। তবে এই বক্তব্য মহাভারত অনুসরণে হলেও এটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের মতবাদ। এখানকার মানুষ আধা হিন্দিভাষী আধা বাংলাভাষী। 
এবারে পাহাড়ি পথ গিয়ে রাজগঞ্জ (ঝাড়খন্ড)। এখানে সাহেবদের থাকার একটা বাংলো আছে। এরপর চড়াই উত্তরায় পেরিয়ে তোপচাঁচির চটী। জরাসন্ধের গড় এটি দেখেই সম্ভবত তাঁর মনে হয় মগধের জরাসন্ধের কথা।


লেখক  পরেশনাথ পাহাড় দেখেন এ পথে। সব থেকে বড় পাহাড়। সেই পাহাড় ফল ফুল লতা বৃক্ষ হিংস্র জন্তু পূর্ণ। পাহাড় চূড়ায় সরাবগি বণিকদের কুলদেবতা (জৈনদের সরাবগি অর্থাৎ শ্রাবক বলা হয় হত) অর্থাৎ জৈনদের তীর্থস্থান পরেশনাথের মন্দির আছে। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় পাহাড়ের নিচে মহুয়া বনে পরেশনাথের মেলা বসে। সেখানে আগরওয়ালা ধর্মশালা আছে। পাহাড়ের ওপরে পুস্করিণী ও পুষ্পদ্দান আছে। পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে জরাসন্ধের কেল্লার পাশ দিয়ে ডুমরিচটী (ডুমরি, ঝাড়খন্ড)। চারদিকে পাহাড় বেষ্টিত। সেখানে ঝরনার জলে স্নান করে থাকা হলো। তারপর বগোদরের চটী (বগোদর,ঝাড়খন্ড), বরকাট্টা চটী, আটকা চটী। এখানে চিঠি দেওয়ার ডাকঘর আছে। লেখক কলকাতায় পত্র দিলেন।


তারপর বরশোত (ঝাড়খন্ড), বরহি (ঝাড়খন্ড), চোপারন (চৌপারন) প্রভৃতি পার্বত্য চটী পেরিয়ে এল ভয়ানক জঙ্গলের ভেলুয়া (ভেলওয়া, ঝাড়খন্ড)। এখানে পর্বতে দস্যু আছে যারা পথিকদের আক্রমণ করে সব হরণ করে নেয়। এই পথে ঘোড়া বদল করার অশ্বশাল আছে। তারপর বারা চটী (বারা, ঝাড়খন্ড)। কুশলা নদী (?) পেরিয়ে বোধগয়া (বর্তমানে বিহার) এলেন। লেখক এখানে গয়াসুর বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন বলে লিখেছেন। এখানে ধর্মারণ্যে রাজার মন্দির আছে। (আলেকজান্ডার কানিংহাম, ডিরেক্টর জেনারেল, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ১৮৭৮ এর মহাবোধি মন্দির করেন। তার আগে বৌদ্ধ স্থাপত্য সব মাটির তলায় ছিল। তাই যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় এখানে বৌদ্ধ কোন ধর্ম স্থানের উল্লেখ করেননি)। লেখক বলেন যে বোধগয়াতে তখন এক মোহন্ত ছিলেন, অনেক রাজা তাঁর শিষ্য। তাঁদের দেওয়া ধন, ভূসম্পত্তি, বিশাল বাগান রয়েছে। যারা তীর্থ শ্রাদ্ধ করে আসে না তারা গয়া ধাম যাওয়ার আগে বোধগয়াতে শ্রাদ্ধ করে। গয়াল অর্থাৎ গয়ার পান্ডার লোকেরা এসে এখানে নিজের নিজের যাত্রী নিয়ে যায়। ব্রহ্মযোনি পাহাড়ে পৌঁছে বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বজা দেখিয়ে সেতুয়ারা প্রতি ব্যক্তির থেকে এক টাকা করে নেয় ধ্বজা দক্ষিনা স্বরূপ। 


গয়াতে পৌঁছে ক্ষৌর কর্ম, ফল্গু নদীতে স্নান, তর্পণ, বিষ্ণুপদ দর্শন, গয়েশ্বরী দেবী দর্শন, অহল্যাবাই প্রতিষ্ঠিত মন্দির দর্শন এবং বিষ্ণুপদে পিন্ডদান করা হল। এখানে তিনি বিভিন্ন প্রকার শ্রাদ্ধ , গয়াক্ষেত্রের মহিমা, পিন্ডদানের বিভিন্ন বেদী (ষোল বেদী), অষ্টতীর্থ এসব বর্ণনা করেছেন। তারপর প্রেতশিলা, রামশিলা, রামগয়া, সীতাকুণ্ড, গয়া কুপ, ধৌতপদ, ভীমগয়ার কথা লিখেছেন। ফল্গু নদীতে জলে স্রোতের প্রকাশ নেই কিন্তু খনন করলে জল ওঠে। ওই জল সুপেয়। বালি খনন করলে যে জল পাওয়া যায় তার মধ্যে ছোট ছোট মাছ খেলা করতে দেখা যায় বলে লিখেছেন। গয়া ক্ষেত্রের বিষ্ণুমন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী প্রবেশ করতে পারে না বলে জানিয়েছেন। গয়ার পান্ডা সম্প্রদায় ও গয়ালদের ব্যাপারে বলেছেন যে তারা ধনী দুষ্কর্মা আর লোভী। গয়াতে পুত্রের পাঠানো টাকা দিয়ে দেনা শোধ করে কাশী যাত্রার চেষ্টায় রইলেন। শম্ভু কওড়ি ছাড়া বাকি দুই সঙ্গী স্বদেশে ফিরে গেলেন। 


গয়া শহরে তখন প্রায় দশ হাজার ঘর ছিল। মুসলমানরা শহরের বাইরে থাকতো। শহরের উত্তর দিকে সাহেবগঞ্জ। সেখানে বাজারে পিতল কাঁসার জিনিস, কম্বল, শতরঞ্চি, গালিচা, কাপড়, মনোহারী জিনিস, বাঁশের জিনিস, লাঠি, লোহার জিনিস, জুতা ইত্যাদির দোকান ছিল। তারপর কারাগার, যার প্রাচীর ছিল ১১ হাত উঁচু। ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সদর আলা, সদর আমিন, মুন্সেফ, জজদের কাছারি, ডাকঘর, আফিমের কুঠি (সেখান থেকে কোটি টাকার বেশি দাদনে আফিমের আমদানি হয়)। সরকারি ডাক্তার এক বাঙালি বাবু। তারপরে সেনা ছাউনি। শহরে পুলিশের প্রহরা ছিল। সব বাজারে পুরি, কচুরি, লাড্ডু, প্যাড়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। গয়েশ্বরী পাহাড় থেকে আনা খুব ভালো পাথরের বাসন বিক্রি হয়।
                 
                     ( চলছে )
 
এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১১ ফাল্গুন ১২৬০ (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪) থেকে ৬ চৈত্র ১২৬০ (২০ মার্চ ১৮৫৪)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. যদুনাথ সবর্বাধিকারী মহাশয়ের পদব্রজে ভ্রমণ কাহিনী থেকে অজানা কত জায়গা সম্পর্কে জ্ঞাত হলাম। পরবর্তি অংশ টির আগ্রহ রইল।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. সত্যি এই বই থেকে যে কত কিছু জানা যায়! পরবর্তী অংশগুলো পড়ার সময়ও এটাই বারবার মনে হবে।

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...