বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৪

২৪। তীর্থ ভ্রমণ ৯ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ    ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

৮ ই বৈশাখ ১২৬২ (এপ্রিল ১৮৫৫) যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী হরিদ্বার থেকে বদরীনারায়ণ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। ১০ জন পুরুষ, ১২ জন মহিলা ও একটি ছয় বছরের শিশুসহ মোট ২৩ জনের দল। এর মধ্যে একটি দম্পতি ঝাপানে ও বাকিরা পদব্রজে রওনা দিলেন। সঙ্গে রয়েছে তিনটি কান্ডি, যার মধ্যে জিনিসপত্র বহন করা হচ্ছে। লেখক ঝাপান ও কান্ডির গঠন সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক একটি ঝাপানে চারজন বাহক থাকে, ঝাপানে একজন মানুষ বসতে পারে। কান্ডি একজন পিঠে করে বহন করে। ঝাপান ও কান্ডিওয়ালাদের হাতে একটি করে বড় লাঠি থাকে যার ওপর আশ্রয় করে তারা শ্রম দূর করে কাঁধ বদল করে। ঋষিকেশ থেকে কেদার বদরীনারায়ণ দর্শন করে মেলচৌকিতে পৌঁছানোর ঝাপান ভাড়া ৭৫ টাকা করে। কান্ডিতে যত জিনিস নেবে তার প্রতি মন কুড়ি টাকা এই হিসেব। প্রথম দিন তাঁরা ঋষিকেশ পৌঁছলেন এবং লাহোরের রাজা রায় রণজিত সিংহের ধর্মশালায় আশ্রয় পেলেন। 


পরদিন সবাই মিলে লছমন ঝোলায় যাওয়া হলো। লক্ষণজীর মূর্তি দর্শন করে ঝোলার কাছে পৌঁছে সবার জ্ঞান হারানোর দশা হল। ঝোলার আকার ভয়ঙ্কর। এপারে পাহাড়ের ওপর থেকে গঙ্গার ওপারে পাহাড়ের উপরের গাছে তিনটি পাঁচশ হাত দড়ি বাঁধা আছে। সেই দড়িতে আধ হাত অন্তর একটা করে কাঠের টুকরো বাঁধা। দুপাশে দুটি দড়ি বাঁধা কোমর পর্যন্ত উচ্চতায়। দুপাশের দড়ি ধরে ওই কাঠের টুকরোয় পা ফেলে ফেলে হেঁটে ঝোলা পার হতে হয়। যদি অপর পার থেকে সেই সময় কেউ আসে তাহলে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়। ঝোলার মাঝে অংশ নীচুতে ঝুলে আছে, সেখানে পৌঁছে প্রাণ আরো শঙ্কিত হয়। নীচে গঙ্গার যেরকম স্রোত, তা বিশাল পাথর আর বৃহৎ বৃক্ষকে অনায়াসে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। জলের এমন শব্দ যে ঝোলার হাজার হাত নীচে গঙ্গার জল থাকলেও সেই শব্দে কানে তালা লেগে যা। পাশে আছে এমন লোকের সঙ্গেও চেচিয়ে কথা বলতে হয়। তার ওপর চলতে শুরু করলে ঝোলা হেলতে দুলতে থাকে, মাঝখানে এলে এক পাশ উঁচু অন্য পাশ নিচু হয়ে যায়। তখন সবার প্রাণ যাই যাই অবস্থা হয়। সঙ্গীরা কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলেন। বাকিরা ইষ্ট নাম জপ করতে করতে পার হলেন সেই ঝোলা। 


তারপর ছয় ক্রোশ পাড়ি দিয়ে ফুলাড়ি তে পৌঁছানো হলো। এই ফুলাড়ি পর্যন্ত লক্ষণের তপোবন, এর মধ্যে অনেক সাধু তপস্যা করেন। এখানে একটি মোকামে রাতে থাকা হল বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আগুনের ধুনি জ্বালিয়ে, তার চারপাশে শুয়ে বসে। পরদিন গঙ্গায় স্নান তর্পণ করে ৬ ক্রোশ অত্যন্ত খাড়াই পথ পেরিয়ে বিজলীতে পৌঁছানো হলো। পাহাড়ে চড়ার ক্লেশ স্থানে স্থানে ঝরনা, বৃক্ষের ছায়া আর চতুর্দিকের শোভা অনেকটা নিরাময় করে। রাতে একটি দোকানে ডাল রুটি খেয়ে সেখানেই থাকা হলো। পরদিন আট ক্রোশ পেরিয়ে মহাদেবকী চটিতে রাত্রি বাস পরদিন ব্যাসকী চটি এলো। সেখানে লছমন ঝোলার মতো কিন্তু ছোট। ব্যাসঝোলা পার হয়ে ব্যাস আশ্রম দর্শন করে রাত্রি বাস করা হলো। ব্যাস আশ্রম থেকে পরদিন ছয় ক্রোশ পাহাড়ি পথ হেঁটে ঝোলা পার হয়ে এলো দেবপ্রয়াগ। দেবপ্রয়াগে প্রায় ২০০ বদরীনারায়ণের পান্ডা আছেন। লেখকদের নির্দিষ্ট পান্ডার বাড়িতে রাত্রি বাস করা হলো। দেবপ্রয়াগে ভাগীরথী আর মন্দাকিনীর সঙ্গম। সঙ্গমে অত্যন্ত ভয়ানক জলের শব্দে কানে তালা লাগে। খাবার দিয়ে মাছের জলকেলি উপভোগ করলেন তারা। এখানে বাজার আছে তবে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। মোটা পুরি, দই, চিনি, জিলিপি, তরকারির মধ্যে বিলাতি কুমড়ো। 


এই স্থান থেকে গঙ্গোত্তরী, যমুনোত্তরী যাওয়ার আলাদা পথ। অত্যন্ত কঠিন সেই পথ। খাবারের জিনিস সঙ্গে নিতে হয়, পথে মেলে না। ছয় দিন কষ্ট করে টেরিতে (তেহরি) পৌঁছলে সেখানে রাজার বাড়ি ও ধর্মশালা আছে।সেখানে ধর্মশীল রাজা বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রেখেছেন। পূর্বে টেরির রাজার রাজ্য দেব প্রয়াগ ও কেদার বদরীনারায়ণ পর্যন্ত ছিল। ইংরাজ যখন সকল রাজ্য অধিকার করেন তখন টেরির রাজা টেরি, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী নিজের অধিকারে রেখে বাকি সব অংশ ইংরাজকে ছেড়ে দেন। গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী যেতে হলে ওই রাজার কাছে পাস নিয়ে যেতে হয়। ওই স্থানে যেতে কয়েক বার ছিকাতে পার হতে হয়। নদীর দুই পাড়ে দুই পাহাড়, একটা মোটা দড়ি দুপাশের পাহাড়ের কোনো গাছে বাঁধা আছে। একজন বসতে পারে এমন ছোট একটি মেচের চার কোণে দড়ি বাঁধা। ওই দড়ি শিকার মতো আংটায় ঝোলানো। ওই আংটা উপরের মোটা দড়িতে ঝুলানো। যে পার থেকে পার হবে সেই পারের লোক ছিকা দুলিয়ে ঠেলে দেবে, অন্য যে পারে যখন আসবে সেই পারের লোক রশি ধরে টেনে নেবে। নীচে ভয়ানক নদী, তার মধ্যে অনেক কষ্টে নিজের কোমর ও হাতের ঠেলায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পার হতে হয়। লেখক অবশ্য গঙ্গোত্রী যমুনোত্রী যাননি। সম্ভবত দেবপ্রয়াগে শোনা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। 


দুদিন পর দেবপ্রয়াগ থেকে ৬ ক্রোশ দূরে রানীবাগ যাওয়া হল এবং গৌতম মুনির মূর্তি দর্শন করে সেখানে থাকা হল। পরবর্তী গন্তব্য শ্রীনগর। সেখানে টেরির কেল্লা আছে, যা এখন কোম্পানির জেলখানা। যারা কেদারনাথ দর্শনে যাচ্ছেন এখানে তাদের সুমার বা গণনা হয়। কেদার ও বদরীনাথের পূজার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়, আর উপরের কোন স্থানে পাওয়া যায় না। এরপর শিরবগার আর পানচাকি চটিতে থেকে ঝোলা পার হয়ে রুদ্রপ্রয়াগে আসা হলো। রুদ্রপ্রয়াগের স্নান ও তর্পণ করার জন্য প্রয়াগ স্থলে নামার পথ অতি দুর্গম। ১০০ ধাপ নামার পরে একটি লোহার শিকল ধরে দশ হাত নীচে গেলে জল পাওয়া যায়। এখানে মন্দাকিনী ও অলকানন্দার সংগম। জলের স্রোত ভয়ংকর ও জল অতি শীতল। স্নান করে শিকল ধরে ওঠার সময় প্রাণ বিয়োগের মতো কষ্ট হয়। এরপর রুদ্র নারায়ণ দর্শন করে ছয় ক্রোশ গিয়ে পাহাড়ের উপরে কম্বল আচ্ছাদনে থাকা হল। 


এরপর আরো ছয় ক্রোশ পথ গিয়ে এলো গুপ্তকাশী, এখানে গঙ্গা ও যমুনা মিলিত হয়েছে। বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণার মন্দির আছে। মন্দিরের সামনে এক বড় কুণ্ড। গঙ্গার জল গোমুখ দিয়ে আর যমুনার জল সিংহ মুখ দিয়ে সেই কুন্ডে পড়ছে। কেদারনাথের পান্ডারা গুপ্তকাশীতে থাকেন। গুপ্তকাশী থেকে পাহাড়ে ৮ ক্রোশ উচ্চ চড়াই পথে  তুম্বনাথের (তুঙ্গনাথ) মন্দিরে পৌঁছে সেখানে ধর্মশালায় রাতে থাকা হলো। 


পরদিন অত্যন্ত খাড়াই পথে কষ্ট করে নেমে পাটন চটিতে পৌঁছে সে রাতে থাকা হলো। পাটন চটি থেকে ছয় ক্রোশ চড়াই উঠে ত্রিযুগনারায়ণ (ত্রিযুগীনারায়ণ) পাহাড়। এই পাহাড়ে কতক চড়াই তারপর কতক সমতল, তাই এই পাহাড়ে ওঠা অনেকটা সুবিধাজনক। গাছের ছায়া, সমতল অংশ এবং ঝর্ণা থাকায় মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়া যায়। এখানে চতুর্ভুজ নারায়ণ মূর্তি আছে। আর সামনের নাট মন্দিরে মহাদেবের ধুনি জ্বলছে। বাইরে পাঁচকুণ্ড ও অনেক দেব দেবীর মূর্তি আছে। এখানে লেখক বলেন যে পাহাড়ি মানুষের উল বা পশমের পোশাক ছাড়া সুতি বস্ত্র পায় না। কেউ ছুঁচ ও সুতি বস্ত্র দিলে তারা খুব খুশি হয়। পর্বত থেকে নেমে কাঠের পুলে গঙ্গা পার হয়ে ঝিলমিল চটি এলো সেখানে রাত্রিবাস। যদিও থাকা খাওয়ার খুব অসুবিধা। ঝিলমিল চটি থেকে মুড়াকাটা অর্থাৎ যেখানে গণেশের মুন্ড কাটা হয়েছিল শনির দৃষ্টির কারণে। 


আরো ছয় ক্রোশ গিয়ে গৌরী কুন্ড। সেখানে কুন্ডের জলে স্নান করে হর গৌরী দর্শন, লক্ষীনারায়ন দর্শন করা হলো। এখানে থাকার ভালো ভালো ঘর আছে। সেখান থেকে চার ক্রোশ গিয়ে ভীমগড়া পৌঁছলেন। সেখানে যাত্রীদের থাকার জন্য পাণ্ডাদের ঘর আছে। এখানে স্বর্গারোহন কালে ভীম পতিত হন। সেদিন বৈশাখ মাসেও সেখানে এত বরফ পড়েছিল প্রচন্ড কষ্ট হয় রাতে। ভীমগড়া থেকে কেদারনাথ চারক্রোশ পথ। খুব ভোরে উঠে গায়ে তুলো ভরা জামা, লুই , বনাত ও কম্বল মুড়ি দিয়ে, হাতে লাঠি, কাঁধে পূজার সরঞ্জাম (পাহাড়ি পথে সংগ্রহ করা বেলপাতা, মধু, চিনি, মেওয়া) নিয়ে "বম কেদার" বলে যাত্রীরা কেদারনাথ দর্শনে যাত্রা করলেন।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ৮ বৈশাখ ১২৬২ (২১ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ২৩ বৈশাখ ১২৬২ (৬ মে ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৬টি মন্তব্য:

  1. লক্ষ্মণ ঝুলা পার হওয়ার বিবরণে শরীরে শিহরণ খেলে গেল। কি ভয়ানক ছিল সেসময় কেদারনাথ বদ্রীনাথ যাত্রা।গুপ্তকাশীতে গঙ্গা যমুনার মিলন আর গঙ্গার জল গোমুখ আর যমুনার জল সিংহ মুখ থেকে বেরিয়ে কুন্ডতে পড়ার বিবরণ মনমোহক। অনেক অজানার সাথে সাক্ষাত হয়ে জানাতে পরিণত হলো।শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. রুদ্র প্রয়াগের দুর্গম পথ অতিক্রম করে মন্দাকিনি ও অলকানন্দার সংগমে স্নান সেরে রুদ্র নারায়ণের দর্শনের যে বর্ননা লেখিকা করেছেন তা পড়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ভয়ে।বাঙালির ভ্রমণ পিপাসা সত্যিই চমৎকার

    উত্তরমুছুন
  3. সত্যি কতদিন আগে কত কষ্ট সহ্য করেও বাঙালি কত দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণ করত ভাবতে অবাক লাগে!

    উত্তরমুছুন
  4. এখনকার লছমনঝুলা দেখে তখনকার কথা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য।

    উত্তরমুছুন
  5. সত্যিই বলেছেন। এখানে লছমনঝুলার বর্ননার সাথে আজকের লছমনঝুলার সত্যিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সত্যিই অবাক হচ্ছি সেই সময়ের যাত্রার বর্ননা পড়ে

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...