শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪

২৫। তীর্থ ভ্রমণ ১০ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী


    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

২৪ শে বৈশাখ,১২৬২ সালের ভোরবেলা লেখক সঙ্গীদের সঙ্গে ভীমগড়া থেকে চারক্রোশ পাহাড়ে উঠে কেদারনাথ পৌঁছানোর জন্য রওয়ানা হলেন। হরিদ্বার থেকে কেদারনাথ পৌঁছতে পায়ে হেঁটে ১৭ দিন লাগল। প্রথম এক ক্রোশ পথে কোথাও পাথর, কোথাও বরফ, কোথাও বরফ গলা জল, কোথাও ঘাস পাতা, তারপর তিন ক্রোশ বরফের উপর দিয়েই পথ। পর্বতের উচ্চতা গঙ্গাসাগর থেকে ৪০০ ক্রোশ। বরফে চলতে চলতে পা অসার হয়। বরফ কেটে পথ হয়েছে। এক এক পদক্ষেপ হতে পারে এই পরিসর পথ। যে যে স্থানে পথের উপর কোন পদচিহ্ন আছে তার উপর পদক্ষেপ করতে হয়। যদি সামনে থেকে কেউ আসে তাহলে একটু আশেপাশে পা ফেলতে হলে মহাবিপদ হয়। কোথাও বরফে কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়। আরো ভুল হলে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে বলা যায় না। কমবেশি ১০ হাজার হাত নীচে মন্দাকিনী বয়ে যাচ্ছে, তার ওপর বরফ আচ্ছাদিত আছে। মধ্যে মধ্যে কোথাও কোথাও বরফ গলে ফাঁক হয়েছে সেখানে বোঝা যায় মন্দাকিনীর স্রোত বইছে। তাই বরফে পা দিয়ে মন্দাকিনীতে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। লেখক দেখেন এক ব্যক্তি বেহিসাবি পা ফেলাতে অনেক নীচে বরফে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এক মাস আগে এই ঘটনা হলেও বরফের গুণে দেহ নষ্ট হয় নি। এই কঠিন পথে একটি পুল পার হয়ে কেদারনাথের মন্দির দেখা যায় এক ক্রোশ দূরে। শীতে মন্দির সহ সব কিছু বরফের তলায় চলে যায়। শুধু মন্দিরের উপর যে ত্রিশূল আছে তা ঢাকা পড়ে না। 


কেদারনাথ দর্শনের আগে পঞ্চ গঙ্গাতে স্নান, তর্পণ, হংসতীর্থে শ্রাদ্ধাদি করতে হয়। পঞ্চগঙ্গা হল অলকনন্দা, মন্দাকিনী, দুধগঙ্গা, ক্ষীরগঙ্গা ও মৌগঙ্গা। তারপর মন্দিরে কেদারেশ্বর দর্শন করা হলো। এখানে মহাদেবের মহিষ আকৃতির মূর্তি। এই মূর্তি দর্শন করে মন দেহ ও চক্ষু সফল হল। সমস্ত পথোশ্রমের শান্তি হল। মন্দির খুব অন্ধকার। শুধু ঘি এর প্রদীপ জ্বলে। আটদিকে আটটি স্তম্ভ আছে। পঞ্চগঙ্গার সঙ্গম জলে স্নান করে, বেলপাতা, চন্দন দিয়ে পুজো করে আটটি স্তম্ভ বেষ্টন করে প্রদক্ষিণ করে কেদারনাথকে কোল (আলিঙ্গন?) দিয়ে বারবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। কেদারের মন্দিরে সব বরফ তখনো গলেনি, সর্বদা জল পড়ছে। কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ বরফের কারণে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পর থেকে অক্ষয় তৃতীয়া পর্যন্ত ৬ মাস দ্বার রুদ্ধ থাকেন। অসীমঠ (উখী মঠ বা ঊষা মঠ) ও যোশীমঠ এই দুই স্থানে বাকি ছয় মাস পূজা হয় যথাক্রমে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের। মন্দির বন্ধ করে যাওয়ার সময় ঘি-এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। অক্ষয় তৃতীয়ায় মন্দির খোলা হলে প্রথমে টেরির রাজা, দর্শনের জন্য প্রবেশ মন্দিরে প্রবেশ করলে সেই প্রদীপ নেভে। নাট মন্দিরে পঞ্চপান্ডবের মূর্তি আছে। মন্দিরের ভিতরে ও বাইরে অজস্র দেব-দেবীর, মুনি ঋষির মূর্তি। নাট মন্দিরের মধ্যে শিবের বাহন নন্দীর মূর্তি। 


মন্দিরের উত্তর দিকে আছে মহাপন্থা (মহাপ্রস্থানের পথ)। এখান থেকে তিন ক্রোশ উত্তর মুখে যেতে পারলে হিমলিঙ্গেশ্বর শিব স্পর্শ করা যায়। স্পর্শমাত্র দেহ বজ্র সমান হয়ে স্বশরীরে স্বর্গে যাওয়া যায়। কিন্তু এই তিন ক্রোশ পথ যাওয়া অতি দুষ্কর। কারণ দিনরাত বরফ জলের মতো করে পড়ছে। কেউ কেউ যেতে চেষ্টা করেও পারেনি কারণ মানুষের পায়ের শব্দের কম্পনেও বরফ খসে পড়ে তারা প্রাণ হারায়। এই বরফকে খুনি বরফ বলে। যার গায়ে এই বরফের স্পর্শ লাগবে তার অঙ্গ খসে পড়বে। এইসব কারণে কোম্পানি বাহাদুর ও টেরির রাজার পক্ষ থেকে ৩৬ জন পাহাড়ি মানুষ রক্ষকের কাজ করে যাতে কেউ বিনা অনুমতিতে এই পথে যেতে পারে না। রক্ষকদের দুম্বা ভেড়ার লোমের ও চামড়ার জামা, ইজের, টুপি আছে, তার উপরে কম্বল। তারা আগুনের কুণ্ড সমেত এক ক্রোশ পর্যন্ত যেতে পারে, তার বেশি না। এক বাঙালি একবার দৌঁড়ে ওই পথের এক ক্রোশ পর্যন্ত চলে গেছিল। রক্ষকরা তাকে প্রথমে বুঝিয়ে তারপর মেরে ও বেঁধে বিচার স্থলে নিয়ে যায় এবং ভয় দেখিয়ে অন্যত্র পাঠায়। কেউ যদি ইচ্ছা করে তাঁকে আগে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে বহু জটিল সংযম ও ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত হতে হয় ও টেরির রাজার অনুমোদন নিয়ে যেতে হয়। এরকম ব্যক্তি এক ক্রোশ পর্যন্ত গেছেন দেখা গেছে কিন্তু তারপর তাঁদের কী হয়েছে জানা যায়নি। কেদারনাথের মন্দিরের উত্তরাংশ থেকে ঈশান কোণে সাদা যে পাহাড় দেখা যায় তা কৈলাস পর্বত (বাস্তবে কেদারনাথ থেকে কৈলাস পর্বত দেখা যায় না)। ওই স্থানে হরপার্বতীর মন্দির আছে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। পর্বতের ওপর শৃঙ্গের মতো কিছু দেখা যায়। লেখক বলেন যদি ওই বস্তু মন্দির হয়, তবে তাঁর তা দেখা হয়েছে। 


কেদারনাথের পাহাড় ও বদ্রীনারায়ণের পাহাড়ের দূরত্ব তিন ক্রোশ। পূর্বে একজন পূজারী দুই স্থানে পূজা করতো। দুই স্থানে পূজা সেরে বাড়ি ফিরে সে রোজ স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করত এই বলে যে সে যদি দুই পাহাড়ে পূজা করে ফিরতে পারে, তাহলে তার মধ্যে স্ত্রী কেন তার গৃহকর্ম শেষ করতে পারে না। এই ঝগড়া করে সে তার স্ত্রীকে মারতো। একদিন এই অত্যাচারের প্রতিবাদে স্ত্রী আকুল প্রার্থনা করেন শিবের কাছে এবং শিব এমন ব্যবস্থা করলেন যে ব্রাহ্মণ আর একদিনে দুই পাহাড়ে যেতে পারবে না। এই দুই স্থানের মধ্যে উঁচু পর্বত স্থাপন করে দিলেন। তাই কেদার ও বদ্রীর মধ্যে নয় দিনের পথ হয়েছে (এই পাহাড়ের নাম নরনারায়ন পর্বত)। সেদিনই বেলা আড়াইটার পরে কেদারনাথ থেকে ভীমগড়া যাওয়ার পালা। বরফের জন্য সূর্যের তেজ যেন ঢাকা পড়েছে। কাঁচের মতো, স্ফটিকের মত নানারকম বরফ দেখতে দেখতে বহু কষ্টে বেলা চারটেতে ভীমগড়ায় পৌঁছানো হলো। সেখানে তাঁরা তীর্থ উপবাস করলেন। ব্রাহ্মণ ভোজন, পান্ডা বিদায় করলেন এবং বিনিময়ে কেদারনাথের আশীর্বাদি পদ্মফুল পেলেন।

                      ( চলছে )


এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২৪ বৈশাখ ১২৬২ (৭ মে ১৮৫৫) থেকে ২৪ বৈশাখ ১২৬২ (৭ মার্চ ১৮৫৫)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

                       

২টি মন্তব্য:

  1. প্রথমত হরিদ্বার থেকে কেদারনাথ পায়ে হেঁটে সতেরো দিনের দুঃসাধ্য যাত্রা তার উপর দুর্গম পথ অতিক্রম করার এক অতি রোমহর্ষক ভ্রমণ বৃত্তান্তের গল্প জানলাম ।কেদারনাথ বদ্রীনাথ মন্দিরের অনেক অজানা গল্প মহাপ্রস্থানের পথ ,হিমলিঙ্গেশ্বর শিবের তথ্য হরপার্বতীর মন্দির, কৈলাস পর্বত কতো অজানা গল্প জানার মাঝে স্থান পেল।লেখিকাকে সাধুবাদ জানাই 🙏
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. সত্যি প্রায় ১৭০ বছর আগে যে দুর্গম পথ লেখক ভ্রমণ করেছেন তা ভাবলেও অবাক লাগে। এসব আশ্চর্য অভিজ্ঞতা পড়তে থাকুন 🙏

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...