সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
শ্রীমন্মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীর প্রথম সংস্করণ জে এন ব্যানার্জি এন্ড সন্স থেকে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) দার্শনিক ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি মাঘ উৎসব, নববর্ষ, দীক্ষা দিন প্রভৃতি ব্রাহ্ম উৎসবের প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালে বীরভূমের ভুবনডাঙ্গা নামক স্থানে বিশাল ভূমি কিনে তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের শান্তিনিকেতন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে মহর্ষি উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকে দেবেন্দ্রনাথ দুর্গাপূজাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবছর আশ্বিন মাসে কলকাতার বাইরে বেড়াতে যেতেন বলে নিজেই লিখেছেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীতে ভ্রমণ সংক্রান্ত উপাদান কিছু আছে, কিন্তু ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে যেহেতু এটি লিখিত হয়নি তাই খুব বেশি তথ্য এখানে পাওয়া যায় না। আত্মজীবনীটি অসমাপ্ত। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এটি লেখা হয়েছে, যখন তাঁর বয়স মাত্র ৪১ বছর। অর্থাৎ তাঁর জীবনের অর্ধেকের কম সময়ের কথা তিনি লিখে গেছেন। তাই তাঁর সমগ্র ভ্রমণকাহিনীও জানা যায় না।
১৭৬৯ শকের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৪৭-এর সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে তিনি কাশী যাত্রা করেন। তাঁর এই যাত্রার বাহন ছিল পালকির ডাক। কলকাতা থেকে কাশী যেতে তাঁর ১৪ দিন লাগে এবং যাতায়াত অতি কষ্টকর ছিল বলে তিনি লিখেছেন। কাশীতে তিনি বেদচর্চা করতে গেছিলেন। কাশীর মানমন্দিরে (রাজা জয় সিং নির্মিত) তিনি থাকতেন। বিশ্বেশ্বর মন্দিরের পান্ডা তাঁকে মন্দিরে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন যে তিনি তো বিশ্বেশ্বরের মন্দিরেই আছেন, আর কোথাও তাঁর যাওয়ার নেই। কাশীতে অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তাঁর নিকট আসেন। প্রচুর বেদ-চর্চা হয়।
এরপর কাশীর মহারাজের ভাই এসে তাঁকে জানান যে রাজা একবার সাক্ষাৎ চান, তাই মহর্ষিকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরদিন তিনি আবার এসে দেবেন্দ্রনাথকে অপর পাড়ে রামনগরের রাজবাড়ীতে নিয়ে যান। রাজপ্রাসাদের ঘরগুলি ছবি, আয়না, ঝাড় লণ্ঠন, গালিচা, দুলিচা, মেজ, কেদারায় দোকানের মতো ভরা। দুইজন বন্দী (বন্দনা করে যে) রাজার আগমনে যশোগান করলেন। রাজা এসে তাঁকে সমাদরে সভায় নিয়ে গেলেন। সেখানে নৃত্যগীত শুরু হল। রাজা তাঁকে একটি হীরের আংটি উপহার দিলেন। রাজা তাঁকে দশমীতে রামলীলা দর্শনের জন্য আবার আমন্ত্রণ জানালেন।
রামলীলার দিন রামনগরে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ দেখলেন কাশীর রাজা একটি বিশাল হাতিতে বসে আলবোলা টানছেন আর পিছনে একটি ছোট হাতিতে তাঁর হীরের আলবোলা ধরে বসে আছে তাঁর হুকাবরদার। আরেকটি হাতিতে রাজগুরু গেরুয়া কাপড় পরে বসে আছেন। রাজগুরু মৌন আছেন। পাছে কথা বলে ফেলেন তাই তাঁর জিভে একটি কাঠের খাপ দেওয়া আছে। চারদিকে কর্নেল, জেনারেল প্রভৃতি সেনারক্ষকরা এক একটি হাতিতে চড়ে রাজাকে ঘিরে আছে। দেবেন্দ্রনাথকেও একটি হাতি দেওয়া হল। সবাই মিলে রামলীলার রঙ্গভূমিতে যাওয়া হল। মেলায় গিয়ে দেখলেন সেখানে লোকে লোকারণ্য। সেই মেলার এক জায়গায় চন্দ্রাতপের নীচে একটি ফুলে সাজানো সিংহাসনে একটি বালক তীর ধনুক নিয়ে বসে আছে। সেই বালক রামচন্দ্র সেজেছে। রামকে গিয়ে লোকজন প্রণাম করছে। এরপর যুদ্ধ হলো। কয়েকটি সং রাক্ষস, তাদের মুখে ঘোড়া, উট, ছাগল প্রভৃতির মুখোশ; তারা যুদ্ধের পরামর্শ করছে। কিছু পরে সেখানে একটি বোমা পরল, তার চারদিকে আতশবাজি হতে থাকল। দেবেন্দ্রনাথ এই পর্যন্ত দেখে কাউকে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন। দেবেন্দ্রনাথের মনে এই বালখিল্য রামলীলা নিশ্চয়ই বিরক্তির সঞ্চার করেছিল।
পরে তিনি কাশী থেকে নৌকা পথে বিন্ধ্যাচল দেখে মির্জাপুর পর্যন্ত গেলেন। বিন্ধ্যাচলের ক্ষুদ্র পর্বত দেখে তিনি খুব আনন্দ পেলেন কারণ সেটি তাঁর প্রথম পর্বত দর্শন। বিন্ধ্যাচলে তিনি যোগমায়া দেখলেন। পাথরে খোদাই করা দশভূজা মূর্তি যোগমায়ার। সেখানে একটিও মানুষ নেই। এরপর দেখলেন ভোগমায়া। সেখানে প্রচন্ড ভিড়। সেখানে সমানে পাঁঠা বলি হচ্ছে। এরপর মির্জাপুর থেকে স্টিমারে কলকাতার বাড়িতে ফিরলেন।
দেবেন্দ্রনাথের পরবর্তী ভ্রমণ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। তিনি কয়েকজন বন্ধু নিয়ে দামোদর নদীতে বেড়াতে যান। দামোদরের বুকে ঘুরে একদিন একটি চড়ে যখন নৌকা লাগল তখন তিনি শুনলেন বর্ধমান সেখান থেকে মাত্র দুই ক্রোশ দূরে। তিনি বর্ধমান দেখতে উৎসাহী হলেন ও সেখানে পৌঁছলেন। সঙ্গে রাজনারায়ণ বসু ও আরো দু একজন ছিলেন। তাঁরা শহর ঘুরে দেখলেন, রাজবাড়িও দেখলেন। তারপর রাতে সেই চড়ে আবার ফিরে এলেন। পরদিন সেই চড়ে একটি সুন্দর ফিটন গাড়ি এসে উপস্থিত হোল। গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি নেমে তাঁকে বললেন বর্ধমানের মহারাজা (রাজা মহাতাব চাঁদ) তাঁর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথকে একটি সুসজ্জিত বাসস্থানে রাখা হলো। পরদিন মহাসমাদরে তাঁকে রাজবাড়ি নিয়ে আসা হলো। রাজার সঙ্গে পরিচয় ও মতবিনিময় হলো এবং পরে তিনি রাজবাড়ীর মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করলেন।
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় দেবেন্দ্রনাথ বাষ্পতরীতে (স্টীমারে) ঢাকায় গেলেন। সেখান থেকে মেঘনা পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে গৌহাটিতে পৌঁছালেন। কামাক্ষা যেতে মনস্থ করাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব হাতি পাঠিয়েছিলেন তাঁর জন্য। তিনি পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন, পিছনে মাহুত হাতি নিয়ে চলল। ক্রমে হাতি পিছিয়ে পড়লো এবং তিনি পদব্রজেই তিন ক্রোশ চলে কামাখ্যা পর্বতের পাদদেশে পৌঁছলেন। পর্বতের পথ পাথরে তৈরি। সেই সোজা উপরে উঠেছে। দুধারে ঘন জঙ্গল। তিনি নির্জন বনপথে একা উঠতে লাগলেন। তখনও সূর্য ওঠেনি, অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক উপরে ওঠার পরে ক্লান্ত হয়ে পাথরের উপর বসে পড়লে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলেন। চিন্তা হল জঙ্গল থেকে বাঘ ভালুক যদি আসে। এমন সময় মাহুত এসে উপস্থিত। হাতি আনতে না পেরে সে একাই ছুটতে ছুটতে এসেছে। দুজনে আবার পাহাড় চড়তে লাগলেন। পাহাড়ের উপরে একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি।। সেখানে অনেকগুলি চালাঘর আছে কিন্তু একটি লোকও চোখে পড়লো না। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দির যেন একটি পর্বত গহ্বর। সেখানে কোন মূর্তি নেই, কেবল যোনি মুদ্রা আছে। তিনি দর্শন করে ফিরে এসে ব্রহ্মপুত্রে স্নান করে ক্লান্তি দূর করলেন। তারপর দেখেন ৪০০-৫০০ লোক ভিড় করে পাড়ে দাঁড়িয়ে কোলাহল করছে। তারা জানালো তারা কামাখ্যার পান্ডা। অনেক রাত পর্যন্ত দেবীর পূজা করতে হয় তাদের। তাই সকালে উঠতে দেরি হয়। তিনি কামাখ্যা দর্শন করেছেন অথচ পান্ডারা কিছু পায়নি। দেবেন্দ্রনাথ তাদের বললেন তারা তাঁর নিকট থেকে কিছুই পাবে না, তারা যেন চলে যায়।
১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দেবেন্দ্রনাথ গঙ্গা তীরে বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা ভাড়া করতে গিয়ে একটি বড় স্টীমার দেখলেন, যেটি দু-তিন দিনের মধ্যে সমুদ্রে যাবে। দেখে তাঁর শখ হল সমুদ্রে যাওয়ার এবং তিনি স্টিমারে একটি ঘর ভাড়া করলেন। সমুদ্রের রূপ তিনি এর আগে দেখেননি। অখন্ড জলরাশির নীল রূপ আর দিন রাত্রির বিচিত্র শোভা তিনি মগ্ন হয়ে দেখতে লাগলেন। একদিন জাহাজ এক জায়গায় নোঙর করল। সামনে সাদা বালির চড়ায় একটি বসতি। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কয়েকজন চট্টগ্রামবাসী বাঙালিকে দেখলেন। লেখক জিজ্ঞাসা করে জানলেন তারা এখানে ব্যবসা করে। আশ্বিন মাসে তারা এখানে মা দুর্গার প্রতিমা এনেছে। লেখক এবার ব্রহ্মরাজ্যের খাএকফু নগরে (Kyaukpyu) দুর্গোৎসবের কথায় আশ্চর্য হলেন আর ভাবলেন দুর্গোৎসব এড়াতে এত দূরে এসেও সেই দুর্গোৎসবের কথা তাঁকে শুনতে হল।
এরপর জাহাজ মুলমীন ( Mawlamyine) অভিমুখে চলল। জাহাজ সমুদ্র ছেড়ে মুলমীনের নদীতে প্রবেশ করল। এই নদীর শোভা তেমন নেই। জল পঙ্কিল, কুমিরে পূর্ণ বলে কেউ নদীতে স্নান করে না। মুলমীনে একজন মাদ্রাজি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। লেখক তাঁর বাড়িতে কয়েক দিন কাটালেন। মুলমীন শহরের রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও প্রশস্ত। দুইধারে দোকানে স্ত্রীলোকেরাই বিক্রির কাজ করছে। তিনি প্যাটরা (বাক্স), উৎকৃষ্ট রেশম বস্ত্র ক্রয় করলেন। এরপর মাছের বাজারে গিয়ে দেখলেন কুমির কেটে বিক্রি হচ্ছে মাছের মতো। লেখক মন্তব্য করেছেন বার্মার মানুষের অহিংস বৌদ্ধধর্ম শুধু মুখে কিন্তু পেটে কুমির। মুলমীনের রাস্তায় একদিন সন্ধ্যায় বেড়ানোর সময় দেবেন্দ্রনাথ এক বাঙালিকে দেখে অবাক হলেন। তারপর ভাবলেন বাঙালির অগম্য স্থান নাই। জিজ্ঞাসা করে জানলেন ব্যক্তিটি দ্বীপান্তরিত হয়ে এসেছিল এখানে। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে আন্দামান দ্বীপে দ্বীপান্তরকরণ শুরু হওয়ার আগে মুলমীনে অন্তরীন করা হতো। এখন শাস্তির মেয়াদ ফুরিয়েছে, কিন্তু টাকার অভাবে দেশে যেতে পারছে না। লেখক তাকে পাথেয় দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বলল এখন সে বার্মায় ব্যবসা করছে, বিবাহ করেছে, সুখে আছে, সে আর দেশে ফিরবে না।
যে মাদ্রাজি ভদ্রলোকের বাড়িতে লেখক আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি তাঁকে এক দর্শনীয় পর্বত গুহা (Kha you gu বা Kayon Cave, Farm Cave) দেখাতে নিয়ে যান। এক অমাবস্যার রাতে একটি লম্বা ডিঙ্গি চড়ে তাঁরা রওনা দিলেন। নৌকায় জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রভৃতি সাত আট জন সঙ্গে চলল। রাতে ১২ ক্রোশ গিয়ে ভোরে নৌকা গন্তব্যে পৌঁছাল। সেখানে একটি ক্ষুদ্র কুটিরে, মুন্ডিত-মস্তক, গেরুয়া বসন পরা কয়েকজন সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। পরে জানলেন এরা ফুঙ্গি, বৌদ্ধদের গুরু ও পুরোহিত। একজন দেখতে পেয়ে লেখককে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে পা ধোয়ার জল দিলেন, বসতে আসন দিলেন। বৌদ্ধদের কাছে অতিথি সেবা পরম ধর্ম। এরপর লেখক ও সঙ্গীরা হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলের মধ্যে রওনা দিলেন সেই গুহার উদ্দেশ্যে। বেলা তিনটের সময় গুহার কাছে এসে পৌঁছে হাতির থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাঁরা গুহা মুখে এলেন। ছোট গুহা মুখে গুড়ি মেরে প্রবেশ করতে হয়। গুহার ভেতর পিচ্ছিল ও ঘোর অন্ধকার। লেখক ও সঙ্গীরা গুহার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পাথরের গায়ে গন্ধক চূর্ণ রেখে তাতে আগুন জ্বালালেন একসাথে। গুহার বিভিন্ন স্থান থেকে সেই গন্ধকের আলোয় এই গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। গুহার প্রকাণ্ডতা ও তার উপর থেকে বৃষ্টিধারার বেগে বিচিত্র কারুকার্য (stalagmite) দেখে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। এরপর জঙ্গলে বনভোজন সেরে তাঁরা ফিরে এলেন। কতগুলি বর্মাবাসীকে এক বাদ্যযন্ত্রের তালে নৃত্য করতে দেখলেন। স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত বার্মিজ পরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে তিনি আতিথ্য উপভোগ করেছিলেন।
১৮৫১ সালের মার্চে দেবেন্দ্রনাথ কটকে যান পালকির ডাকে। সেখানে জমিদারি সংক্রান্ত কাজের পর জগন্নাথ দর্শনের জন্য পুরীতে যান। রাতে পালকির ডাকে চললেন। সকালে পুরীর কাছে চন্দন যাত্রার পুষ্করিণী পৌঁছে স্নান করার সময় পুরীর জগন্নাথের একজন পান্ডা এসে তাঁকে ধরল। লেখক তার সঙ্গে চলতে থাকলেন। লেখকের পায়ে জুতো ছিল না বলে পান্ডা খুব খুশি হল। যখন তাঁরা পুরীতে পৌঁছলেন তখন জগন্নাথ দেবের মন্দিরের দ্বার বন্ধ ছিল। পান্ডা মন্দিরের দ্বার খুলে দিতে বহু মানুষ একসঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করল। ধাক্কাধাক্কিতে লেখকের চশমা খুলে পড়ে ভেঙ্গে গেল। ফলে চশমা ছাড়া লেখক নিরাকার জগন্নাথকেই দেখলেন। তাঁর মনে পড়ল যে একটি প্রবাদ আছে, যে যা মনে করে জগন্নাথ মন্দিরে যায় সে তাই দেখতে পায়। লেখক নিরাকারবাদে বিশ্বাসী বলে নিরাকার জগন্নাথ দেখতে পেয়েছেন এমনটি তিনি লিখেছেন। জগন্নাথের সামনে একটি বড় তাম্রকুণ্ড ভর্তি জল। সেখানে জগন্নাথের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়াকে পান্ডারা দন্তধাবন ও স্নান করাল। তারপর জগন্নাথের মূর্তিতে নতুন বসন ও আভরণ পরাল। এরপর তিনি বিমলা দেবী মন্দিরে গেলেন, কিন্তু দেবীকে প্রণাম করলেন না। তাতে যাত্রীরা অসন্তুষ্ট হল। এরপর জগন্নাথের মহাপ্রসাদ নিয়ে শোরগোল পড়ে গেল। লেখক দেখলেন এখানে মহাপ্রসাদ নিয়ে ব্রাহ্মণ, শূদ্রের ভেদাভেদ নেই। এদিক দিয়ে উড়িষ্যাবাসীরা ধন্য।
এরপর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাপূজার সময় ১০০ টাকায় কাশী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তিনি একটি নৌকা ভাড়া করলেন। নবদ্বীপ পৌঁছতে ছয় দিন লাগলো। মুঙ্গেরে পৌঁছে সীতাকুণ্ড দেখতে গেলেন তিন ক্রোশ হেঁটে। তারপর ফতুয়ায় যখন বিস্তীর্ণ গঙ্গার মধ্যে দিয়ে চলেছেন, প্রবল ঝড় উঠল। লেখকের সঙ্গের পানসি আহার্য দ্রব্যসহ জলে ডুবে গেল। পাটনা এসে তিনি নতুন আহারে সামগ্রী কিনলেন। কলকাতা থেকে কাশী পৌঁছতে প্রায় দেড় মাস লাগল। কাশীতে তিনি দশ দিন ছিলেন।
তারপর ডাকগাড়ি করে এলাহাবাদের অপর পাড়ে পৌঁছে নৌকায় গাড়ি সমেত পার হয়ে প্রয়াগ তীর্থের বেণী ঘাটে পৌঁছলেন। এই ঘাটে লোকে মস্তক মুন্ডন করে, শ্রাদ্ধ, তর্পণ, দান করে। একজন পান্ডা তাঁকে ধরে টানাটানি করতে থাকল।
কদিন এলাহাবাদের থেকে ডাকগাড়িতে আগ্রা পৌঁছান। আগ্রায় তাজ দেখলেন। তাজের একটা মিনারের ওপর উঠে দেখলেন পশ্চিম দিক লাল করে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, নীচে নীল যমুনা, তার মধ্যে শুভ্র স্বচ্ছ তাজ যেন সৌন্দর্যের ছটা নিয়ে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে খসে পড়েছে।
তারপর যমুনা নদীপথে দিল্লি যাত্রা করলেন। পৌষ মাসের প্রবল শীতে নৌকায় চলাকালীন কোন কোন দিন তিনি যমুনাতে স্নান করতেন, কখনো যমুনার ধারে শস্য ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতেন।
এগার দিনে যমুনা নদীপথে চলে মথুরায় উপস্থিত হলেন। সেখানে এক সন্ন্যাসী তাঁকে শাস্ত্রচর্চার জন্য ডাকেন। বিষ্মিত হয়ে তিনি দেখেন সন্ন্যাসীর কাছে সমস্ত রামমোহন রায়ের বইয়ের হিন্দি অনুবাদ রয়েছে। লেখক তারপর বৃন্দাবন গেলেন। সেখানে লালাবাবুর তৈরি গোবিন্দজীর মন্দির দেখলেন। নাট মন্দিরের চার পাঁচ জন বসে সেতার শুনছিল। লেখক গোবিন্দজিকে প্রণাম করলেন না দেখে তারা সচকিত হল।
আগ্রা থেকে এক মাস নৌকাযাত্রা করে তিনি দিল্লি এলেন। দেখলেন নদীর পারে খুব ভিড়। দিল্লির বাদশাহ সেখানে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। লেখক লিখেছে ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া বাদশাহর তখন আর কোন কাজ ছিল না। দিল্লি থেকে আট ক্রোশ দূরে কুতুব মিনার দেখতে গেলেন এবার। লেখক লিখেছেন এটি হিন্দুর পূর্ব কীর্তি। মুসলমানেরা এখন এটিকে কুতুবুদ্দিন বাদশাহের জয়স্তম্ভ বলে, এই জন্য এর নাম কুতুব মিনার। হিন্দুদের মুসলমানরা পরাজিত করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কীর্তিও লোপ করেছে। কুতুব মিনার প্রায় ১৬১ হাত উঁচু। তিনি সেই মিনারের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে পুলকিত হলেন।
এরপর তিনি ডাকগাড়ি করে অম্বালায় গেলেন ও সেখান থেকে ডুলি করে লাহোরে গেলেন। লাহোর থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসর পৌছালেন।
অমৃতসর পৌঁছে শিখদের উপাসনাস্থল অমৃতসর অর্থাৎ অমৃত সরোবরে পৌঁছানোর জন্য গুরুদোয়ারায় গেলেন। সেখানে দেখলেন একটি বৃহৎ পুষ্করনী, যেটি গুরুর রামদাস খনন করিয়েছিলেন। সরোবরের মধ্যে উপদ্বীপের ন্যায় পাথরের মন্দির। একটা সেতু দিয়ে সেই মন্দিরে প্রবেশ করলেন। একটি বিচিত্র রঙে রেশমের বস্ত্রে আবৃত স্তুপে গ্রন্থ (গ্রন্থসাহেব) রয়েছে। মন্দিরের একজন প্রধান শিখ তার ওপর চামর ব্যজন করছেন। গায়কেরা গ্রন্থের গান গাইছে। পাঞ্জাবি স্ত্রী পুরুষ মন্দির প্রদক্ষিণ করে কড়ি ও ফুল দিয়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। যেকোনো ধর্মের মানুষ এখানে আসতে পারে, শুধু জুতো খুলে আসতে হবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড লিটন জুতো খোলেননি বলে শিখরা খুব অপমানিত হয়েছিল। সন্ধ্যায় আবার সেখানে গিয়ে লেখক গ্রন্থের (গ্রন্থ সাহেবের) আরতি দেখলেন। আরতি শেষে সকলকে মোহন ভোগ দেওয়া হল। দোলের সময় এই মন্দিরে বড় উৎসব হয়।
অমৃতসরে রামবাগানের কাছে যে বাসায় তিনি থাকতেন তা ভাঙ্গা ও জঙ্গলময় ছিল। ভোরে বাগানে বেড়াতে ও দূর থেকে শিখদের সুমধুর সংগীত শুনতে তাঁর খুব ভালো লাগত। বাগানে মাঝে মাঝে ময়ূর আসত। একদিন আকাশে মেঘ দেখে ময়ূর নৃত্য করতে লাগল। লেখক তখন সেই নৃত্যের তালে তালে বীণা বাজালেন। ক্রমে এত গরম পড়ে গেল যে ঘরে আর থাকা যায় না। বাড়িওয়ালা তখন মাটির নীচের ঘরে থাকতে দিল লেখককে। সেই ঘরে পাশ দিয়ে আলো বাতাস আসে ও ঘর খুব শীতল থাকে। কিন্তু লেখক বুঝলেন তিনি মাটির নীচের ঘরে থাকতে পারবেন না। তিনি চান মুক্ত স্থান। তখন তিনি সিমলা যেতে মনস্থ করলেন।
২০ এপ্রিল ১৮৫৭ সিমলার উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করলেন। তিনদিনের পথ পেরিয়ে কালকা উপত্যকায় পৌঁছলেন। সামনে পাহাড় দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, এই ভেবে যে আগামীকাল তিনি সেই পাহাড়ের উপর উঠবেন, পৃথিবী ছেড়ে প্রথম স্বর্গের সিঁড়িতে আরোহন করতে। সেই শুরু হলো লেখকের হিমালয় দর্শন ও হিমালয় ভ্রমণ।
(চলছে)
মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের কাশী মথুরা দিল্লি আগ্রা আম্বালা লাহোর অমৃতসরের বিভিন্ন স্থানের সেকালের ভ্রমণ পর্বটি বেশ মনোরম লাগলো
উত্তরমুছুনশিউলি
ধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুন