শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৩। ভারত ভ্রমণ ২ - বরদাকান্ত সেনগুপ্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


            (আগের পর্বের পরে)


বরদাকান্ত সেনগুপ্ত এরপর আগ্রা থেকে রাজপুতানা এন্ড মালয়া স্টেট রেলওয়ের গাড়িতে ভরতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সঙ্গী 'শ--'কে নিয়ে। ভরতপুরে পৌঁছে লেখক বড় একটা সরাই-এ ঘর ও খাটিয়া ভাড়া নিলেন। ভরতপুরের মহারাজার একজন কর্মচারী এসে তাঁদের নাম, ধাম, সঙ্গে অস্ত্র আছে কিনা বা বিক্রি করার কোন জিনিস আছে কিনা এসব তথ্য নিয়ে গেল। এরপর ৫ পয়সার লুচি দিয়ে রাতের খাওয়া সারলেন। তাঁরা যত পশ্চিম দিকে যাচ্ছেন, তত লুচির দাম কমছে। সকালে এক্কা গাড়ি করে ভরতপুরের দুর্গ দেখতে চললেন। রাস্তার দু'ধারে বড় বড় গাছে অসংখ্য ময়ূর ময়ূরী বসে আছে। দুর্গের চারদিকে ডহর বা খাল রয়েছে। এরপরে একটি মাটির প্রাচীর। তারপর দুর্গের পরিখা। তারপর পাথরের কঠিন প্রাচীর। পরিখায় অজস্র কচ্ছপ দেখা গেল। পরিখার ওপর সেতু  পার হয়ে প্রকাণ্ড দুর্গদ্বার। ভরতপুরে দুর্গ দখলে ইংরেজরা বার বার ব্যর্থ হয়েছিল এবং এই দুর্গ অজেয় বলে খ্যাত। কিন্তু বর্তমানে দুর্গের ভিতরে ভগ্নদশা দেখে লেখক ব্যথিত হন। তাঁরা ভরতপুর রাজপ্রাসাদ দেখলেন, যেটির অবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। 

এরপর রেলপথে তাঁরা জয়পুর যাওয়ার পথে পর্বতসংকুল রাজপুতানার দৃশ্য দেখতে পেলেন। জয়পুর প্রাচীরে ঘেরা দুর্গ শহর। দ্বাররক্ষক পরীক্ষা করে তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দিল। পাথরে বাঁধানো পথের দুপাশে সুন্দর বাড়িগুলি ঠিক এক রকম ভাবে গঠিত ও চিত্রিত। এখানেও একটি বাঙালি বাবুর সাদরে তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন। লেখক জয়পুরের ইংরেজি কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, আর্ট স্কুল, মনুমেন্ট দেখলেন। পরের দিন রাজভবনে দরবার কক্ষ, হাওয়া মহল, যুগশালা, চন্দ্রমহল প্রভৃতি দেখলেন। কাশীর মতো এখানে জ্যোতিষ মন্দির আছে। মহারাজা সওয়াই মানসিং বহু অর্থ ব্যয় করে ইতালির কারিগর এনে একটি অসাধারণ নাট্যশালা নির্মাণ করিয়েছেন। পরদিন জয়পুরের বাজার, রেসিডেন্সি, রাম নিবাস বাগান দেখলেন যা মহারাজ রামসিং বাহাদুর প্রতিষ্ঠিত। রাম নিবাস বাগ কলকাতার ইডেন গার্ডেনের থেকে দেখতে সুন্দর। বাগানের কাছে ভূতপূর্ব গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়োর মূর্তি রয়েছে। তার একটি দিকে প্রাণী বিভাগ। নানারকম প্রাণীতে পূর্ণ। মিউজিয়াম দেখলেন, সেটি কলকাতার মতো বড় না হলেও অনেক জিনিস রয়েছে। তারপর মদনমোহনজি, গোবিন্দজি, গোপীনাথজি, রামচন্দ্রজি, গোকুলনাথজির মন্দির দেখলেন। ভারতবর্ষে স্বাধীন রাজ্যসমূহের মধ্যে জয়পুরের মতো সুন্দর শহর প্রায় নেই। মহারাজা রাম সিং জলের কল ও গ্যাসের আলোর প্রচলন করে জয়পুরকে সমৃদ্ধ করেছেন। 

জয়পুর থেকে ট্রেনে করে আজমিরে এলেন লেখক ও তাঁর সঙ্গী। রাস্তায় তিনি লক্ষ্য করলেন আজমির আরো বেশি পাহাড়ি এলাকা। এখানে এক স্বদেশী বাবুর বাড়িতে তাঁরা থাকলেন। আজমির দুর্গবদ্ধ শহর। পূর্ব ভাগে পরিখার চিহ্ন এখনো রয়েছে। পাঁচটি তোরণ আছে দিল্লি, আগ্রা, মাদার, উশ্রী ও ত্রিপোলি দরওয়াজা। শহরের উত্তর প্রান্তে আনা সাগর নামে হ্রদ রয়েছে, যেটি মহারাজা আনা খনন করিয়েছিলেন। এই সাগরের তীরে সম্রাট শাহজাহানের দেওয়ান খাস (বরাদরি) শ্রীহীন অবস্থায় রয়েছে। আজমিরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে তারাগড় উঁচু পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ চৌহান রাজ অজয় পালের অজয় দুর্গ নামে খ্যাত। এই স্থান স্বাস্থ্যকর বলে এখানে অসুস্থ ইউরোপীয় সৈন্যদের বাসস্থান নির্মিত হয়েছে। তারাগড়ের উপরের অংশে আকবরের সামন্ত জব্বর খান নির্মিত মিরান হোসেনের দরকার দরগা রয়েছে। উপর থেকে নীচের দৃশ্য খুব মনোরম। 

আজমির থেকে তাঁরা আড়াই দিনকা ঝোপড়া দেখতে গেলেন। এটি একটি অপূর্ব কারুকার্যময় বাড়ি, যার মাথায় ছাদ এখন প্রায় নেই। তবু এটি ভারতীয় স্থাপত্যের একটি বিশিষ্ট নমুনা বলা যায়। এটি কোন ধনী ব্যক্তি আড়াই দিনে তৈরি করিয়েছিলেন অথবা তাঁর আড়াই দিনের উপার্জনের ধনে এটি তৈরি হয়েছিল। খাজা সাহেবের অর্থাৎ মইনুদ্দিন চিশতির দরগা দেখলেন তাঁরা। দরগায় প্রবেশ করেই নহবতখানায় দুটি দামামা দেখা যায়। বাদশাহ আকবর চিতোর থেকে এনে এই দুটি খাজা সাহেবের সম্মানার্থে প্রদান করেছিলেন। এরপর শাজাহান নির্মিত পাথরের মসজিদ দর্শনীয়। খাজা সাহেব ও তাঁর স্ত্রী, কন্যা হাফিজ জামান ও চিমনি বেগমের এবং শাজাহানের এক কুমারী কন্যার সমাধি আছে। অনেকে বলে দরগার কোন নিভৃত স্থানে একটি শিব মূর্তি লুকানো আছে। এরপর লেখকের সঙ্গীকে তার বাড়ির লোক এসে নিয়ে গেল। ফলে লেখক একাকী হয়ে পড়লেন। আজমিরে লেখক নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটি সীসার খনি দেখলেন। সুড়ঙ্গের মুখ কপাট দ্বারা বন্ধ করা থাকে কারণ অনেকদিন আগে এক দর্শনার্থী খনি দেখতে ঢুকে সেখানে লুকিয়ে বাস করা এক বাঘের শিকার হয়েছিল। লণ্ঠনের আলোতে দুজন সঙ্গী নিয়ে তিনি ভিতরে যান। ভিতরে প্রায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না, কথা বললে চারিদিকে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। ভিতরে অনেক জলের প্রবাহ রয়েছে। অন্ধকারে, প্রতিধ্বনিতে, বাঘের ভয় মনে জেগে ওঠায় লেখক আর বেশি নীচে না গিয়ে ফিরে এলেন। একদিন লেখক পুরাতন আজমির দেখতে গেলেন। এর প্রাচীন নাম ইন্দ্রকোট। তারাগড়ের পশ্চিম প্রান্তে একটি উপত্যকার মধ্যে অবস্থিত দুর্গটিতে ভাঙ্গা মন্দির ছাড়া এখন আর কিছু নেই। আজমিরের পাহাড়ে লেখক শিকারে বেরিয়েছেন মাঝে মাঝে। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আজমিরে দৌলতাবাদ নামে এক সুন্দর উদ্যান নির্মাণ করে সেখানে থাকতেন, যা আজও একটি মনোরম স্থান। এবার আজমির থেকে ১৪ মাইল দূরে নসিবাবাদের ঘোড়দৌড় দেখতে গেলেন। 

এরপর তিনি ট্রেনে করে দিল্লি গেলেন ও এক বাঙালির বাড়িতে উঠলেন। তখন দুর্গাপূজা। সেখানে একমাত্র বাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়িতে পূজা হয়। সেখানে বাঙালিরা মিলিত হয়। সেখানে বাইজীর গান অনুষ্ঠিত হতে দেখলেন। 


দিল্লিতে লেখক যা যা দেখলেন তা হল - পুরানা কিলা, শের মঞ্জিল, লাল বাংলা, আরব কি সরাই, নিজামউদ্দিনের সমাধি, নীলভুজ, মকবারা খাঁ খান্না, চৌষট খাম্বা, নিজামউদ্দিনের সমাধির কাছের কূপ, খসরুর সমাধি, মির্জা জাহাঙ্গীরের সমাধি, জাহানারা বেগমের সমাধি, মোহাম্মদ সাহার সমাধি। এর মধ্যে ভোলানাথ চন্দ্রের লেখা থেকে অতিরিক্ত যা পাওয়া গেল সেটাই এখানে রাখা হল -

লাল বাংলা - পুরানা কিলার কাছে অবস্থিত লাল পাথরের দুটি সমাধি। বড়টি সম্রাট হুমায়ুন কর্তৃক তৈরি তাঁর এক স্ত্রীর সমাধি। অন্যটি বাদশাহ শাহ্ আলমের স্ত্রী লাল কাউরের। লাল কাউরের নাম থেকে লাল বাংলা নাম হয়েছে। (উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে সমাধি দুটি কাদের তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সেখানে বলছে শাহ আলমের মা জিনাত মহল ও বা লাল কুনওয়ার এবং মেয়ে বেগম জানের সমাধি)। 
আরব কি সরাই - পুরানা কিলার কাছে হুমায়ুন সমাধির কাছে অবস্থিত হুমায়ুন পত্নী হাজী বেগমের প্রতিষ্ঠিত আরব মোল্লাদের দ্বারা সংস্থাপিত বা মতান্তরে আরব মোল্লাদের থাকার জন্য তৈরি সরাই। এর দুটি সুন্দর ফটক দর্শনীয়। নীল ভুজ - আরব কি সরাই-এর কাছে অবস্থিত কোনো পাঠান সম্রাট কর্তৃক এক সৈয়দের সমাধির ওপর নির্মিত। আগে একটি নীল রঙের চিত্রিত ছিল কিন্তু এখন অল্পই অবশিষ্ট। 
৬৪ খাম্বা - এই শ্বেত পাথরের বাড়িটিতে ৬৪ টি স্তম্ভ ছিল বলে এই নাম। এটি তোগা খাঁ বা আতাগা খানের (আকবরের বিশিষ্ট সভাসদ) পুত্র মির্জা আজিজা বাকুলতুগ খান সমাধি। এইখানে শ্বেত পাথরের পর্দার কাজ রয়েছে। 

পুরনো দিল্লিতে তিনি লৌহস্তম্ভ, লাল কোট, কিলা-রাই পিথরা, ভূত খানা, কুতুবুল ইমাম মসজিদ, কুতুবুদ্দিনের কবর, কুতুব মিনার, আলতামাসের সমাধি, আলাই দরওয়াজা, যোগমায়া, মেটকাফ হল, মোহাম্মদাবাদ, তোগলাকাবাদ, জেহান পান্না, রৌশান চিরাগ, ভুলভুলিনজা বা গুমগাসটেজি, হাস খাস, কির্কি, সফদর জঙ্গের সমাধি, যন্ত্র মন্ত্র, ফিরোজাবাদ দেখলেন। লেখক ভোলানাথ চন্দ্রের লেখায় যে অংশগুলি আলোচনা করা হয়নি সেগুলো এখানে রাখা হল - 

ভূতখানা - কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত সাতটি হিন্দু মন্দিরের উপকরণের তৈরি গৃহ। হয়তো স্তম্ভের গায়ে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদিত আছে বলে মুসলমানরা এই নামকরণ করেছিলেন। 
যোগমায়া দেবী - এই মূর্তি কুতুব মিনারের উত্তর দিকে প্রতিষ্ঠিত। কোন সময়ে এই মন্দির নির্মিত হয় বলা সম্ভব নয়। লেখক মনে করেন মোগল রাজত্বে শেষ ভাগে রাজপুতানার কোন হিন্দু রাজা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। না হলে অন্য হিন্দু স্থাপত্যের মতো এখানে এই মন্দিরও বিনষ্ট হতো। 
রওশন চিরাগ - সিরির দক্ষিণ পূর্বভাগে অবস্থিত এটি একটি প্রাচীর বেষ্টিত দরগা। বাদশাহ ফিরোজ শাহ এটি শেখ নাসির উদ্দিন মোহাম্মদের সম্মানে তৈরি করিয়েছিলেন। এর কাছেই বহুলুল লোদীর সমাধি। 
ভুল ভলিঞ্জা বা ভুলভুলাইয়া - এটি আকবরের প্রসিদ্ধ সেনাপতি আদম খাঁ -র সমাধি, যিনি মান্ডুর রূপমতী-বাজ বাহাদুর কাহিনীর খলনায়ক। 
কির্কী - এটি কুতুবের উত্তর পূর্ব চার মাইল দূরে অবস্থিত একটি প্রাচীর বেষ্টিত ক্ষুদ্র শহর। ফিরোজ শাহের শাসনকালে খাঁ জাহান এটি তৈরি করেছিলেন। কিরকি নামে একটি মসজিদ এখানে বর্তমান। 

বর্তমান দিল্লিতে তিনি কেল্লা, চাঁদনী চক, জুম্মা মসজিদ, দিল্লি মিউজিয়াম ও কুইন্স গার্ডেন, শালিমার বাগ, কুমারী মসজিদ, রসিনারা বেগম সমাধি, সেলিম গড় দেখেছেন। 

এছাড়া তিনি সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতি জড়িত কাশ্মীর দরজার বাইরে লাডলো ক্যাসেল, বার্ন বুরুজের (burn bastion) কথা আলোচনা করেছেন। দিল্লির মিউজিয়ামের দরজায় লেখক বাহনশূন্য জয়মল ও পুত্তের মূর্তি দেখেন। লালকেল্লার দেওয়ানী খাসে যে দ্রষ্টব্যগুলি ছিল সেগুলো এখন এই মিউজিয়ামে এনে রাখা হয়েছে এবং এর নাম হয়েছে দিল্লি ইনস্টিটিউট। এর সংলগ্ন কুইন্স বাগ উদ্যানের এক পাশে তিনি জয়মলের মূর্তির বাহন হাতিটি ভাঙ্গা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। 

ভোলানাথ চন্দ্রের মত বরদাকান্ত সেনগুপ্ত এই বইতে সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। কিন্তু তার সঙ্গে ভ্রমণ কাহিনীর সম্পর্ক না থাকায় সেটি এখানে আলোচনা করা হল না।

২টি মন্তব্য:

  1. এখানে আগ্রার কতক স্থানের তারপর রাজস্থানের জয়পুর আজমের হয়ে আবার দিল্লির নানান দর্শনীয় স্থান কিছু আমার জানার মধ্যে কিছু নতুন স্থানের সম্বন্ধে নিজেকে অবগত করিয়ে সমৃদ্ধ করলাম।শিউলির ধন্যবাদ জ্ঞাপন লেখিকাকে🙏।

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...