সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
ময়ূরভঞ্জ ব্রিটিশ সরকারের একটি করদ রাজ্য। ময়ূরভঞ্জে থাকাকালীন লেখক দেখলেন সপার্ষদ ব্রিটিশ কমিশনার সাহেবের আগমন উপলক্ষে রাজার করা ধুমধাম, আপ্যায়ন ও শিকারের আয়োজন। শেষে বৃটিশ কমিশনার ময়ূরভঞ্জের নাবালক রাজাকে তাঁর অভিভাবক ও প্রজাদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জোর করে কটকে নিয়ে গেলেন ইংরেজি মতে শিক্ষাদানের জন্য। {মহারাজা শ্রী রামচন্দ্র ভঞ্জ দত্ত (১৮৭০ থেকে ১৯০২) হলেন এই নাবালক রাজা।} ময়ূরভঞ্জ একটি পর্বত ও জঙ্গলময় রাজ্য। প্রচলিত আছে ময়ূরভঞ্জ রাজ্য কীচকের (মহাভারতের বিরাট রাজার শ্যালক) শাসনাধীন ছিল। এখানে কিচকেশ্বরী নামে এক দেবীর মন্দির আছে (খিচিং-এ অবস্থিত মন্দির)। ময়ূরভঞ্জে পুরীর অনুকরণে এক জগন্নাথ মন্দির আছে। এখানে রথযাত্রা সমারোহে পালিত হয়। এই মন্দিরে একটি বটগাছ আছে যার পাতা গোকর্ণ অর্থাৎ গরুর কানের মত। তাই একে গোকর্ণ বট বলে। (হরি বলদেব জীউ বিজে নামে জগন্নাথ মন্দির, বারিপদা)।
এরপর লেখক বালেশ্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বারিপদা থেকে দক্ষিণে ৩২ মাইল জঙ্গলময় রাস্তায় গিয়ে বুড়িবালাম নদী পায়ে হেঁটে পার হলেন। এই রাস্তায় ৮ থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পানীয় জল পাওয়া যায় না। কটক রোড ধরে এক মাইল গেলে বালেশ্বর শহর এল। বালেশ্বর জেলার সীমানায় বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। কলকাতা থেকে জলযান যাত্রী ও বাণিজ্য দ্রব্য নিয়ে প্রতি আট ঘণ্টা অন্তর এখান থেকে যাতায়াত করে। এই জলপথে যাত্রীরা অল্প সময় যাতায়াত করে কিন্তু জলযানের কর্মচারীদের অভদ্রতার জন্য যাত্রীরা অনেক কষ্ট ভোগ করে।
বালেশ্বর থেকে চাঁদবালি নামক সমুদ্র-তীরস্থ বন্দরে (কিন্তু এটি বৈতরণী নদীর বন্দর) যাওয়ার প্রশস্ত রাজপথ আছে। পশ্চিমে একটি রাস্তা, রেবুনা (রেমুনা এখন বন্দর নয়) নামক বন্দরে গেছে। রেমুনায় ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির প্রসিদ্ধ। প্রবাদ আছে গোপীনাথ এক ব্রাহ্মণের থেকে ক্ষীর চুরি করে খেয়েছিলেন তাই তাঁকে সবাই ক্ষীর ভোগ দেয়। বালেশ্বর শহর থেকে একটি রাস্তা নীলগিরি নামক করদ রাজ্যে গেছে। এই রাজ্যের রাজধানী রাজনীলগিরি (এখন নীলাগিরি) বালেশ্বর থেকে মাত্র ৮ মাইল দূরে অবস্থিত।
বালেশ্বর ত্যাগ করে দক্ষিণ দিকে কটক রোড ধরে ৪২ মাইল যাওয়ার পর লেখক ভদ্রক নামক স্থানে এলেন। সম্প্রতি ভদ্রক থেকে একটি ক্যানাল প্রস্তুত হয়েছে যা ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদী হয়ে কটকের নীচে মহানদীতে মিলিত হয়েছে। ভদ্রকে কিছুদিন থেকে লেখক স্টিমারে উঠে সেই ক্যানাল দিয়ে কটক অভিমুখে রওনা দিলেন। এই খাল ছাড়াও চাঁদবালি বন্দর থেকে কটক পর্যন্ত আর একটি কৃত্রিম ক্যানেল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট-এর হাতে, যদিও এই যাতায়াত ব্যবস্থা কষ্টকর স্টিমারের অব্যবস্থার জন্য। পথে এক বাঙালি পরিবারকে সাহায্য করার জন্য ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদী পার হয়ে স্টিমার থেকে নেমে গরুর গাড়িতে নেউলপুর নামক স্থানের কাছে কোঙয়াপাল নামক স্থানে গেলেন লেখক। সেখান থেকে নয়াগ্রাম নামক স্থানে কিছু পুরা কীর্তি দর্শন করলেন। শুক্লেশ্বর নামক শিবের পুরাতন মন্দির (মহঙ্গা, উড়িষ্যা), রাজার কুলদেবী ভগবতী নামক ষড়ভুজা সিংহবাহিনী দেবীর মন্দির সেখানে রয়েছে। মানিকেশ্বর নামক জনৈক রাজা এই স্থানে রাজধানী নির্মাণ করেন এবং ওই মন্দিরগুলি স্থাপন করেন। মানিকেশ্বর শিবের মন্দির ভগ্নাবশেষে পরিণত। মূর্তি গহ্বরে প্রবেশ করেছে। গড়বেষ্টিত জঙ্গলময় পুরাতন রাজধানী চোখে পড়ে। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন গৌড় থেকে তাড়িত হয়ে উৎকলে এসে নাকি মানিকেশ্বর গড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাকি সব কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে শুধু দেবীর (মানিকেশ্বর মন্দির, মহঙ্গা) পূজা আজও হয়।
সেখান থেকে গরুর গাড়িতে লেখক কটক রওনা দিলেন কটক রোড হয়ে। কটক শহর উৎকলের হিন্দু রাজাদের, মুঘল, পাঠান এবং মারাঠাদেরও শাসনাধীন ছিল। বিভিন্ন রাজাদের কালে এখানে বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে কাটযুড়ি নদীর পাড় মহারাষ্ট্রীয় শাসকরা পাথরে বাঁধিয়ে দিয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর আগে। সেই পাথরের প্রাচীরের মধ্যে নানা দেব দেবীর মূর্তি খোদিত আছে। কটকে কটক চিন্তাই পুরাতন মন্দির (কটক চন্ডী মন্দির)। কটকে অনেক বাঙালি বাস করে। এই শহরের লোকেরা পাখি পুষতে ভালোবাসে, জমিদার মহাশয়ের বাড়িও পাখিতে পরিপূর্ণ।
কদিন পরে লেখক পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বারো মাইল যাওয়ার পর বালিহন্তা নামক নদীর তীরে রাতে থাকলেন। তার পরদিন পুরী রোড ত্যাগ করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে জঙ্গলময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেলায় ভুবনেশ্বর পৌঁছলেন পান্ডাদের সঙ্গে। ভুবনেশ্বর পৌঁছে অনেক সুদৃশ্য মন্দির দেখলেন। কিন্তু পান্ডা জানাল সেগুলো ভুবনেশ্বরের বিখ্যাত মন্দির নয়। বিন্দু সাগর নামক সরোবর দেখলেন কিন্তু তার জল খুব দূষিত হয়ে পড়েছে। তারপর ভুবনেশ্বর মন্দির দর্শন করলেন। সেই মন্দিরের সুদৃশ্য দেউল দেখে মুগ্ধ হলেন। শিব পুরাণে ভুবনেশ্বর নগরকে গুপ্তকাশি বলা হয়েছে। এখানে প্রতি ব্যক্তির বাড়িতে মন্দির আছে। ভুবনেশ্বরের রথযাত্রা বৈশাখ পূর্ণিমায় হয়।
পরদিন তাঁরা সাক্ষীগোপালে উপস্থিত হলেন। এই দেব মূর্তি কাঞ্চি রাজের সম্পত্তি। উৎকলের রাজা কাঞ্চি রাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাঁর অভীষ্ট দেব গোপাল ও গণেশ এনে সাক্ষীগোপাল ও পুরীতে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে লেখক বৈশাখ মাসে উড়িষ্যাবাসীদের রাসলীলা দেখলেন। কয়েকটি মাটির মূর্তি একটি ঘরে স্থাপন করে একটি ম্যারাপ নারকেল পাতা দিয়ে ছেয়ে তার তলায় প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত নাচতামাশা সহ এই পরব হল। কয়েকটি বালক নানা রকম সেজে উড়িষ্যার ভাষায় গান গাইল। সাক্ষী গোপালের সম্পর্কে সাক্ষ্য দান করার যে কাহিনি প্রচলিত আছে সে বিষয় লেখক বলেছেন যে তার কোন ভিত্তি নেই।
এখান থেকে ৫ মাইল দূরে পুরী। সকালে পুরী রোডে যেতেই পাণ্ডারা বিরক্ত করতে লাগল। আঠারো নালা পেরিয়ে তিনি চন্দন তালাও এলেন, যেটি পুরীর বৃহত্তম সরোবর। নরেন্দ্র নামধারী এক ব্যক্তি এটি খনন করে দেন বলে এর নাম নরেন্দ্র পুষ্করিণী। এই জলাশয়ে জগন্নাথদেবের চন্দন যাত্রা হয়। সমগ্র বৈশাখ মাস চন্দন যাত্রার নির্দিষ্ট সময়। পুষ্করিনীর পাশে চন্দন যাত্রা উপলক্ষে নানা দোকান বসেছে। তৃতীয় প্রহরের পর পুরী থেকে মদন গোপাল জীউ এখানে আগমন করেন।
পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সামনে দিয়ে নির্গত হয়েছে পুরীর প্রধান রাজপথ। গুঞ্জবাটি পর্যন্ত এই রাস্তায় রথ চলে। রাস্তাটি প্রায় ১০০ ফুট চওড়া। এই রাস্তায় জগন্নাথদেবের মন্দির অভিমুখে গেলে বামদিকে উৎকল রাজের আবাস পড়ে। রাস্তার অপর পাড়ে দোকান ও পাণ্ডাদের ঘরবাড়ি। এক পান্ডার বাড়িতে রাত্রিবাস হল পুরীতে চন্দন যাত্রা দেখার পর। সেই পান্ডার সঙ্গে পরদিন শ্রীক্ষেত্র (পুরীর জগন্নাথ মন্দির) দর্শন ও প্রসাদ লাভ হল। পুরীর মহারাজের দেওয়ানের সঙ্গে এরপর দেখা করলেন লেখক। তিনি বাঙালি। এরপর প্রায় এক মাসকাল পুরীতে সেই দেওয়ানের বাড়িতে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা সুখে শান্তিতে রইলেন।
জগন্নাথ দেবের বাটির (মন্দিরের) পরিধি প্রায় ২ মাইল হবে, পাথরের প্রাচীরে ঘেরা চারদিকে চারটি তোরণ। পূর্ব তোরণকে সিংহদ্বার বলে। এই দ্বারের সামনে একটি প্রস্তরখন্ডের প্রায় ৩০ ফুট দীর্ঘ স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভটি আগে কোনারক মন্দিরের সামনে ছিল। কোনারক মন্দির ভেঙে যাওয়ার পর ওই স্তম্ভ এখানে এনে স্থাপিত হয়েছে। তোরণের সামনে প্রবেশের সময় এক জগন্নাথ মূর্তি খোদিত আছে, তাঁর নাম পতিতপাবন। যেসব জাতির মন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই তারা পতিতপাবন মূর্তি দর্শন করে। এই মূর্তি আগে ছিল না। পুরীর এক রাজা ঘটনাবশতঃ পতিত হয়ে মন্দিরে প্রবেশের অধিকার হারান। তখন রাজার দর্শনের জন্য এই পতিতপাবন মূর্তি স্থাপন করা হয়। সিংহদ্বার অতিক্রম করে ২২ সোপান পেরিয়ে দ্বিতীয় তোরণ আসে। এটি নতুন করে প্রস্তুত করেছেন একজন সন্ন্যাসী ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করে। সিঁড়ির দুই পাশে ও উপরে তোরণের সামনে মিষ্টান্ন প্রসাদের বাজার। এই তোরণের দক্ষিণে একটি দ্বার আছে, তার মধ্যে অন্নের বাজার বসে, যার নাম আনন্দ বাজার। দ্বিতীয় তোরণের ভিতরে প্রথমে ভোগ মন্দির অবস্থিত। রাজার দেওয়া ভোগ মন্দিরের ভেতরে যায়। অন্য ভক্তদের প্রদত্ত ভোগ ঐ ভোগ-মন্দিরে উপস্থিত হয়। তারপর সুপ্রশস্ত নাট্যমন্দির (নাট মন্দির)। তারপর শ্রীমন্দির। মন্দিরের হর্ম্য সুউচ্চ কিন্তু ভুবনেশ্বরের মন্দিরের মতো শিল্পকলা এখানে নেই। কিছু অশ্লীল মূর্তি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে, যা লজ্জাকর। তবে সম্ভবত এগুলি তান্ত্রিক উপাসনার অঙ্গ। শ্রীমন্দিরের চারপাশে নানা দেবদেবীর মন্দির উপস্থিত।
জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সমস্ত সেবা ও ভোগের জন্য প্রাত্যহিক আড়াইশো টাকার বেশি খরচ হয় বলে লেখক লিখেছেন। প্রতিদিন জগন্নাথ দেবের তিন প্রকার বেশ (পরিধান) হয়। বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন বেশ হয়। রথযাত্রায় তিনটি নতুন রথ নির্মাণ করা হয়। একটি পুস্তকে লেখা নিয়ম অনুসারে রথ তৈরি হয়। কত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ হবে, কবে রথ তৈরী শুরু ও শেষ হবে প্রভৃতি সেই পুস্তকে লেখা আছে। উৎকলের গড়জাত মহলের দশপালার রাজা রথের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের যোগান দেন। এর জন্য তিনি একটি মহল জায়গীর লাভ করেছেন। সেই জঙ্গলের কাঠ কাটিয়ে নদী তীরে পৌঁছে দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। পুরী রাজার কর্মচারীরা সেই কাঠ নদীতে ভাসিয়ে পুরীতে নিয়ে আসে। পুরীর মন্দির থেকে গুঞ্জবাটিতে রথ পৌঁছতে পাঁচ ছয় দিন লাগে। এই সময় দেবতাদের মূর্তি রথেই থাকে। নয়দিনের মধ্যে গুঞ্জবাটিতে পৌঁছে, নবম দিনে রথ পুনরায় পুরীর মন্দিরে ফেরার জন্য যাত্রা করে।
(চলছে)
সুন্দর একটি পর্ব। ময়ুরভঞ্জ ,বালেশ্বর,ভুবনেশ্বর,কটক বালেশ্বর ক্ষীরচোরা গোপীনাথ, সাক্ষীগোপাল, ,পুরী এই সব পরিচিত স্থানের নানান কাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুন