সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) অন্যতম প্রথম বাঙালি মহিলা কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার। তিনি প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি কোনো পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা সহোদরা। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভারতী" নামের পত্রিকা প্রচলন করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে এই পত্রিকার সম্পাদক পদে স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত হন। তারপরে তিনি দুটি পর্যায়ে মোট ১৮ বছর ভারতী পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যের জন্য তিনি "সখী সমিতি" স্থাপন করেছিলেন। তাঁর লেখা দীপনির্বাণ, ছিন্নমুকুল, হুগলির ইমামবাড়ি, ফুলের মালা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনেক কাব্যগ্রন্থ ও নাটক রয়েছে। তিনশোর বেশি গান তিনি রচনা করেছেন। তিনি জগৎতারিনী স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ পর্বের প্রথম খবর পাওয়া যায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কারোয়ার যাত্রায়। তিনি মেজদাদা আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল বোম্বাই প্রদেশের কারোয়ার গেছিলেন। সঙ্গী ছিলেন ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ,রবীন্দ্রনাথ, ভগ্নি সৌদামিনী। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই ভ্রমণ সংক্রান্ত। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীর নিজের কোন রচনা পাওয়া যায়নি।
এরপর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দেই স্বর্ণকুমারী দেবী বোলপুর যান সপরিবারে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরী দেবীও তাঁর সঙ্গে যান। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবীর লেখা থেকে এই বোলপুর ভ্রমণ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী দার্জিলিং ভ্রমণে যান। সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর পত্নী মৃণালিনী দেবী, তাঁর শিশু কন্যা বেলা, ভগ্নি সৌদামিনী দেবী ও স্বর্ণকুমারী দেবীর দুই কন্যা ১৩৯৫-এর ভারতী পত্রিকায় বৈশাখ থেকে ভাদ্র ও কার্তিক সংখ্যায় দার্জিলিঙ পত্র নামে ধারাবাহিকভাবে এই লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথমে তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পড়ার মজলিস হত, সেটাই তিনি উপভোগ করতেন। লেফট্যানেন্ট গভর্নরের পুরনো বাড়ি ক্যাসেলটন হাউসে ছিলেন তাঁরা। সেই বাড়ির দক্ষিণে মল রোড, অবজারভেটরি হিল বলে একটা ৫০০ ফুট উঁচু পাহাড় বেষ্টন করে এই বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে। এই রাস্তার মতো সমতল সুখে বেড়ানোর জায়গা আর নেই। এখানে গাছপালার জঙ্গল নেই, কলকাতার রাস্তার মতো পথের ধারে এক একটি ফুলে ভরা গাছ। রাস্তার পশ্চিম ধারে অল্প খাড়াই ঢালু তৃণময় স্থানে ফার্ন আর গোলাপের ঝোপঝাড়। এই ঢালু স্থানের পর পশ্চিমে রাস্তার কিছু নীচে ইংরেজদের সুসজ্জিত দোকান। পাহাড়ের সবুজ গায়ে সাদা সুন্দর বাড়িগুলি স্তরে স্তরে উঠেছে। রোদ পড়ে কাঁচের মতো ঝলমল করে বাড়িগুলি। রাতে বাড়ির আলোগুলি নক্ষত্রের মতো পাহাড়ের গায়ে ফুটে থাকে। মল রোডের বিপরীত দিকটা , লেখিকা যাকে পার্ক বলেছেন, ইংরেজরা শহর হওয়ার আগে দার্জিলিং যেমন জঙ্গল ছিল তার কিছু কিছু চিহ্ন রেখে দিয়েছে। চওড়া রাস্তার দু'ধারে পুরনো জঙ্গল বজায় আছে। একদিন তিনি পার্কে যাওয়ার পথে রাস্তা ভুল করে অন্যত্র চলে গেছিলেন।
দার্জিলিং-এর শোভা দার্জিলিং পৌঁছানোর পথের থেকে শুরু হয়েছে। জলপাইগুড়ির অল্প পরে শিলিগুড়ি, যেটি দার্জিলিং-এর উপত্যকা। সেখান থেকে পাহাড়ে রেলগাড়িতে উঠতে হয়। এই রেলগাড়ি কলকাতার ঘোড়ায় টানা ট্রামের থেকেও ছোট। গাড়ি চড়ে রাস্তার ধারে দুই পাশের গাছপালা অনায়াসে হাত দিয়ে ধরা যায়।
সুস্থ হওয়ার পর লেখিকা সবসময়ই বাইরে ঘুরে দার্জিলিং এর মুক্ত দৃশ্য দেখতে চাইতেন। তাঁরা ২-৩ দিন ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস বা কাকঝোরা দেখতে গেছিলেন। তাঁরা অবজারভেটরি হিলের উপরে উঠেছিলেন। সেখান থেকে চারদিকে দৃশ্য দারুন দেখা যায়। তাছাড়া দুর্জয় লিং দেবতার অধিষ্ঠান সেখানে। অনেকে বলে দুর্জয় লিং বা লিঙ্গ থেকে দার্জিলিং শব্দ এসেছে। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাস (দ্রষ্টব্য: তিব্বত অভিযান) যিনি তিব্বতে গেছিলেন তিনি বলেছেন দর্জিলিং তিব্বতি শব্দ। দরজি থেকে দার্জিলিং হয়েছে। দরজি কথার অর্থ বজ্র। তিব্বতি ভাষায় বজ্র শ্রেষ্ঠ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ দার্জিলিং মানে শ্রেষ্ঠ স্থান। শরৎ চন্দ্র দাস বলেছেন বর্ধমানের রাজা এসে এখানে দুর্জয় লিং প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে এরকম কোন দেবতা এখানে ছিলেন না। কিন্তু লেখিকার মতে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের পিতা (রামলোচন ঘোষ, যিনি পাথুরিয়াঘাটার প্রাচীন প্রাসাদ তৈরি করেন এবং যিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান হয়েছিলেন) এখানে এসেছিলেন। পথঘাট তখন প্রায় ছিল না, তখনও তিনি দুর্জয় লিং দেখে গিয়েছিলেন।
এরপর লেখিকা দার্জিলিং শহরের কিছু নীচে ভুটিয়াদের প্রধান আবাসস্থল ভুটিয়া বস্তিতে গোল গম্বুজাকৃতি মন্দির দেখলেন। এখানে একজন লামার স্মরণে তাঁর দাঁত ও নখ রাখা আছে। আর আছে এক গুম্ফা, যার বারান্দায় বড় বড় মন্ত্রচক্র আছে। চক্র যত ঘোরে, মন্ত্র তত ঘোরে ও তত পাপ ক্ষয় হয়। গুম্ফার মধ্যে মহাকাল ও মহাকালীর মূর্তি আছে। মন্দিরের আসল দেবতা হিসেবে একটি বুদ্ধ ও কালীর মূর্তি আছে। তৃতীয় প্রধান দেবতার নাম তাঁরা বারবার জিজ্ঞাসা করেও বুঝতে পারেননি। তিব্বতের মতো এখানকার বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিশ্রিত। অহিংসা এখানে পরম ধর্ম নয়। লামাদের মদ মাংস নিষিদ্ধ নয়। এরপর তিনি দার্জিলিং-এর মেঘ রৌদ্রের খেলার কথা লিখেছেন।
সিঞ্চল দার্জিলিং থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু। এখানে আগে সেনা নিবাস ছিল ইংরাজের। কিন্তু এখানকার শীত সেনারা সহ্য করতে না পারায় তাদের ব্যারাক জলাপাহাড়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। শত শত চিমনি ও ভাঙা দেওয়াল নিয়ে সিঞ্চল এখন শহরের ভগ্নাবশেষ মাত্র। টাইগার হিল সিঞ্চল থেকে ৫০০ ফুট উঁচু, এখান থেকে ধবলগিরির (মাউন্ট এভারেস্ট) কিছু অংশ দেখা যায়। টাইগার হিলের পথ অতি খারাপ, এখানে ডান্ডি উঠে না। ছোট সংকীর্ণ পথে অতি সাবধানে হেঁটে উঠতে হয়। চুড়ায় পৌঁছে অপূর্ব দৃশ্যে মন ভরে গেল। ধবলগিরির চূড়া সেদিন দেখা গেল না কারণ সেদিক মেঘে আচ্ছন্ন। কাঞ্চনজঙ্ঘা শ্রেণী বেশ ভাল দেখা গেল।
লেখিকা ও সঙ্গীরা একদিন রঙ্গিতে গেছিলেন। রঙ্গিত সিকিমের একটি নদীর নাম। চারপাশের নামও নদীর নামের রঙ্গিত হয়েছে। এটি দার্জিলিং থেকে ১১ মাইল নীচে। নদীর ওপারে স্বাধীন সিকিম রাজ্য। ডান্ডিতে করে জঙ্গলময় পথে কাঞ্চনজঙ্গা দেখতে দেখতে তাঁরা পৌঁছলেন নদীর কাছে। এই নদীর জল সবুজ। পথে ফার্ন, বুনো ফুল, পরগাছা, বড় গাছ যত আছে তা দার্জিলিংয়ে নেই। ডান্ডি করে সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা মল রোড হয়ে বাসায় ফিরলেন। মল রোড তখন ইংরাজ স্ত্রী পুরুষে ভর্তি, ব্যান্ড বাজছে, চারদিক গমগম করছে। ইংরাজ সরকার যখন স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য বসতি প্রস্তুত করার জন্য সিকিমের রাজার থেকে করের বিনিময়ে এই স্থান গ্রহণ করেছিল তখন দার্জিলিং জঙ্গল এলাকা ছিল, বাংলা থেকে আসার পথঘাট কিছুই ছিল না। সম্প্রতি মেকলের তিব্বত মিশনে যাওয়ার পর সিকিমের রাজাকে এই কর দেওয়া ইংরেজ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে।
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী গাজিপুরে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছুদিন সস্ত্রীক সেখানে অবস্থান করেন। ১২৯৬-এ ভারতীতে "গাজিপুর পত্র" প্রকাশিত হয়। এখানে হাওড়া থেকে রেল যাত্রা সহ যাত্রাপথের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কৌতুক এবং আরো নানারকম সরস আলোচনা করেছেন লেখিকা। গাজিপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি কাশী ঘুরে এসেছিলেন।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী পুনা, সোলাপুর এইসব মহারাষ্ট্রের স্থান ভ্রমন করেন। এখানেও তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ম উপলক্ষে থাকতেন। ১২৯৮ সালে ভারতী পত্রিকায় তিনি এই ভ্রমণ সম্পর্কে লিখেছেন "পত্র" শিরোনামে। পুনা, সোলাপুরে চিত্রশালা, শিল্পপ্রদর্শনী দর্শন, ইংরাজদের ফ্যান্সি ড্রেস বল, ঘোড়দৌড়, বিভিন্ন ক্রীড়া প্রদর্শনী দেখা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন। এই সময় তিনি পান্ডারপুর ও আকোলকোট ঘুরে এসেছেন ট্রেনে। আকোলকোট স্টেশনে এসে সেখানকার রাজার পাঠানো গাড়িতে তাঁরা রাজপ্রাসাদে গেলেন। রানী অত্যন্ত রুচিশীলা, তিনি সুন্দর ভাবে গৃহসজ্জা করেছেন। রাজা নিজে তাঁদের রাজপ্রাসাদ, দূর্গ, বিচারালয়, স্কুল, রাজ বাজার, ভান্ডার গৃহ, মহামূল্য হস্তি সিংহাসন রাখার হাওদাখানা সব দেখালেন। এই রাজা ইংরেজের আনুকূল্যে রাজ্যাভিষিক্ত হয়েছেন এবং ইংরেজদের সন্তুষ্ট রাখতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন।
(চলছে)
পর্ব টি থেকে প্রথমত স্বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে পরিচিত হলাম ,এনার অনেক গুণের কথা জানলাম। সেই সময়ের দার্জিলিঙের নানান বিষয়ে জানলাম তবে মনে হলো তখনকার দার্জিলিঙ অপেক্ষা এখনকার দার্জিলিঙ অনেক বেশি সৌন্দর্যে ভরা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুনখুবই তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ 🙏🏽
উত্তরমুছুন