মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৫। ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা - কৃষ্ণভামিনী দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


"ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা" নামক কৃষ্ণভামিনী দাস প্রণীত এই বইটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। গ্রন্থটিতে লেখিকার নাম গোপন রাখা হয়েছে। প্রকাশক সত্যপ্রকাশ সর্বাধিকারী বইয়ের মুখবন্ধে লেখিকাকে গ্রন্থকর্ত্রী বলে অভিহিত করেছেন। নিঃসন্দেহে লেখিকার ইচ্ছায় তাঁর নাম গোপন রাখা হয়েছে। তবে কী লেখিকার মনে বাঙালি মহিলার ইংল্যান্ডযাত্রার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয় বা নিন্দার ভয় ছিল? 


কৃষ্ণভামিনী দাস (১৮৬২-১৯১৯) বাঙালি লেখিকা ও নারীবাদী। মুর্শিদাবাদের জন্ম নিয়ে বিবাহ পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁর স্বামী দেবেন্দ্রনাথ দাস ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন শিক্ষাগ্রহণের কারণে। কৃষ্ণভামিনী দাস স্বামীর সঙ্গে ১৮৮২ থেকে ১৮৮৯ ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ভারতে ফেরেন। নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকার নিয়ে তিনি অনেক লিখেছেন ভারতী, প্রবাসী, সাধনা পত্রিকায়। বর্তমান বইটিতেও তিনি নারীবাদী মন্তব্য করেছেন বারংবার। বইয়ের শুরুতে লেখিকা বলেছেন তিনি গ্রন্থকর্ত্রী নাম পাওয়ার জন্য বা নিজের বিদ্যাবুদ্ধি প্রকাশ করার জন্য এই বই লেখেন নি। অন্য দেশে অনেক নতুন জিনিস দেখে তাঁর মনে যে নতুন ভাবোদয় হয়েছে তার সহজ সরল প্রকাশ হল এই বই। ভারতীয় যেসব যুবক ইংল্যান্ডে আসতে আগ্রহী, তারা দুই একটি বিষয় এই বই থেকে জানতে পারে। পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে তাঁর মত যাদের ইংল্যান্ডের বিষয় জানতে আগ্রহ হয় তাদের পরিতৃপ্ত করার জন্য এই বই। তাঁর স্বামী এই বই পড়ে সংশোধন, পরিবর্তন করেছেন এবং এই বইয়ের শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ে লেখায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন বলে লেখিকা জানিয়েছেন। বইটিতে লেখিকা বঙ্গনারীদের পরিস্থিতির সঙ্গে ইংল্যান্ডের নারীদের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। ইংল্যান্ডের সামাজিক রীতিনীতি, ধর্ম, উৎসব, শিক্ষা, রাজনীতি, মানুষের স্বভাব চরিত্র, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাগ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন বিস্তৃতভাবে। কিন্তু সেগুলি ভ্রমণ বিষয়ক নয় বলে এই লেখায় সেগুলি অনেক অংশে বর্জন করা হয়েছে। 

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮২ ইংল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাবরা (হাওড়া) স্টেশন থেকে বোম্বাইয়ের উদ্দেশ্যের রেলে (কলের গাড়িতে) স্বামীর সঙ্গে এই যাত্রারম্ভে তিনি মুখ খুলে রেখেছিলেন অর্থাৎ তিনি পর্দার আড়ালে ছিলেন না, তখনকার প্রচলিত রীতি না মেনে। স্বদেশ ও স্বজন বিয়োগের ব্যথায় তাঁর হৃদয় তখন পূর্ণ ছিল। হুগলি, বর্ধমান প্রভৃতি স্টেশন তাঁর পরিচিত কারণ আগে পিত্রালয়ে ঘোমটায় মুখ ঢেকে যাওয়ার সময় তিনি এসব জায়গার ওপর দিয়ে গেছেন। আজ মাথায় টুপি পড়ে তাঁকে কেউ চিনতে পারবে না। হয়তো মেম সাহেব ভাববে। 

পাটনা স্টেশন দেখে তিনি প্রাচীন পাটলিপুত্রের হত গৌরবের কথা ভাবলেন। মোগলসরাই স্টেশন দেখে কাশী দর্শনের ইচ্ছা জাগল। এলাহাবাদ স্টেশন দেখে তিনি ভাবলেন এই স্থান হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই কাছে পবিত্র। হিন্দুদের প্রয়াগ আর মুসলমানদের আল্লার নগর। এলাহাবাদের তিনি গাড়ি বদলিয়ে স্ত্রীলোকের গাড়িতে উঠলেন। সে কামরায় আর কোন স্ত্রী যাত্রী ছিল না। কামরায় একা সারারাত কাটিয়ে সকালে জব্বলপুর এল। এখানে আবার গাড়ি পাল্টাতে হল। কলকাতা থেকে এলাহাবাদ হয়ে দিল্লি এক রেলওয়ে কোম্পানির, এলাহাবাদ থেকে জব্বলপুর আর এক রেল কোম্পানির। অনেক ট্রেন সরাসরি কলকাতা থেকে বোম্বাই যায়, একবারও গাড়ি পাল্টাতে হয় না। কিন্তু তাঁরা সেরকম ট্রেন পাননি। জব্বলপুরে কয়েকদিন থেকে নর্মদা নদীর জলপ্রপাত, মার্বেল পাথরের পাহাড়, ভগ্নাবশেষ দেখার ইচ্ছা রইল। কিন্তু ২৯ শে সেপ্টেম্বর বোম্বাই থেকে ইংল্যান্ডের জাহাজ ছাড়বে বলে এখানে থাকা হল না। এরপর থেকে রেলের জানলা দিয়ে পাহাড় আর বনভূমি দেখা গেল দুই পাশে। রেলগাড়ি কখনো সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়েও গেল। 


পরদিন সকালে তাঁরা বোম্বাই স্টেশনে পৌঁছলেন। স্বামী তাঁকে একা রেখে হোটেল ঠিক করতে গেলে তাঁর কোনো অসুবিধা হল না কারণ বিদেশী পোশাক পরা নারীকে কেউ দেখার সাহসও পেল না। তাঁরা একটা বড় হোটেলে গেলেন। বোম্বাইয়ের রাস্তা কলকাতা থেকে অনেক পরিষ্কার। রাস্তার ধারে সান বাঁধানো চলা পথ (ফুটপাথ) আছে, যা একমাত্র কলকাতার চৌরঙ্গীতে আছে। এখানকার বাড়ি ইঁট ছাড়াও কাঠ ও পাথরের তৈরি। বাড়িগুলি ছয় সাত তলা উঁচু কিন্তু প্রতিতলার উচ্চতা কম। ছাদ স্লেট দিয়ে ঢাকা ও গড়ানো তাই সেখানে ওঠা যায় না। বড় রাস্তার দু'ধারে দোকানগুলি বেশিরভাগ পার্সিদের। 


নির্দিষ্ট দিনে একটা ছোট জাহাজে কিছুদূর গিয়ে বড় জাহাজে ওঠা হল। জাহাজে পার্সি, মুসলমান আর খ্রিস্টান দেখলেন কিন্তু কোনো হিন্দু দেখলেন না লেখিকা। ক্রমে বোম্বাই শহরের আলো দূরে মিলিয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু লাইট হাউসের আলো দেখা যাচ্ছিল। লেখিকার জাহাজে সমুদ্র রোগ (সি সিকনেস) হয়নি। 


জাহাজের ডেকের ওপর ক্যাপ্টেনের ঘর ও রান্নাঘর আছে। নীচে ছোট ছোট কামরার কেবিন আর প্রথম শ্রেণীর লোকেদের খাওয়ার ও বসার জন্য একটা বড় সাজানো ঘর আছে সেলুন নামে। কেবিনগুলিতে দুটি, চারটি বা তার বেশি বিছানা আছে একটি ওপর আরেকটি করে। কেবিনের মধ্যে সমুদ্রের দিকে দেওয়ালে ছোট জানালা পোর্টহোল আছে। কোনো কোনো কেবিনে স্নান করার জায়গা আছে। জাহাজের এক প্রান্তে প্রথম শ্রেণী, অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণী ও নাবিকদের ঘর, মধ্যে ইঞ্জিনের ঘর। সমুদ্রের বিভিন্ন রূপ দেখতে দেখতে চললেন তিনি। রাতের আকাশে পরিচিত নক্ষত্রমন্ডলী দেখে আনন্দিত হলেন এত দূরে তাদের দেখা পেয়ে। 


এরপর এডেন এল। ছেলেদের সাঁতার কেটে পয়সা চাওয়া, স্থানীয় লোকের জিনিসপত্র বিক্রয় করতে আসা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তিনিও দেখলেন। লোহিত সাগরে লেখিকা উড়ন্ত মাছ দেখলেন। এরপর সুয়েজনগরে জাহাজ থামল। তাঁরা সুয়েজ থেকে রেলপথে আলেকজান্ত্রিয়া যাবেন ও সেখান থেকে জাহাজে করে ব্রিন্ডিসি যাবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মিশরে এতদিন যুদ্ধ চলছিল বলে জাহাজ থেকে এখানে কাউকে নামতে দিল না। তাঁদের সুয়েজ খালের ভিতর দিয়ে জলপথে যেতে হবে। 


সেদিন রাতে তাঁরা সুয়েজ বন্দরে থাকলেন। সকালে চারপাশে দেখলেন অজস্র জাহাজ। সেইসব জাহাজের জাতি, কোম্পানি হিসেবে বিভিন্ন রকম নিশান। সুয়েজ খাল সরু, একটি বেশি জাহাজ পাশাপাশি যেতে পারে না। বেশি জোরেও যেতে পারে না, ধারের মাটি খসে পড়ার ভয়ে। খালের দু'ধারে মরুভূমি, দূরে দূরে দু'একটি ঘর। নৌকায় করে অনেক সময় ডিম মাছ ফল বিক্রি করতে আসে। অতি সুস্বাদু বেদানা আঙ্গুর আপেল প্রভৃতি খেলেন লেখিকা প্রথম এখানে। ইম্মা, পোর্টসেড হয়ে জাহাজ ৪৫ ক্রোশ দীর্ঘ সুয়েজ খাল হয়ে চলল। পোর্টসেডে তাঁরা ইতালি হয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়ার আরেকটি জাহাজে উঠলেন। 


এরপর গ্রিসের নিকটবর্তী ছোট ছোট পাহাড় দেখা যেতে লাগল। একটানা সমুদ্রে থেকে বিরক্ত লেখিকা ভাবলেন আগে যখন ইংল্যান্ড যেতে দেড় বছর, ৯ মাস, ৬ মাস ও ৩ মাস লাগতো তখন তাদের কত কষ্টই না হতো। 


এবার তাঁরা ইটালির দক্ষিণ পূর্বকোণে ব্রিন্ডিসী নগরের দুই ক্রোশ দূরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু মিশর থেকে ওলাওঠা রোগ যাতে ইউরোপে না প্রবেশ করে তাই কোয়ারেন্টাইন হিসেবে তিনদিন কাউকে জাহাজ থেকে নামতে দিল না। অনেক সময় প্রায় একমাস এই কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়ায় মানুষকে আটকে থাকতে হয়। 


তিনদিন পর জাহাজ ভেনিসের দিকে চলল, তখন লেখিকার জাহাজ আড্রিয়াটিক সাগরে ভাসমান। ভেনিসে নামার আগে আবার একদিন কোয়ারেন্টাইন ও ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে অনুমোদন পাওয়া গেল জাহাজ থেকে নামার। ১৮ই অক্টোবর তাঁরা ভেনিসে নামলেন। গন্ডোলায় করে ভেনিসের রেল স্টেশনে গেলেন ও জানলেন লন্ডন যাওয়ার ট্রেন রাত ১১ টায় ছাড়বে। তাঁরা তখন গন্ডোলায় শহর দেখলেন। শহরে যেমন রাস্তা থাকে এখানে তেমন খাল। বাড়ির দরজা থেকে নৌকায় উঠে কোথাও যেতে হয়। তাই কোন গাড়ি ঘোড়ার শব্দ নেই। অসংখ্য পোলের ওপর দিয়ে পার হয়ে শহর ঘোরা যায়, কিন্তু তাতে অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হয়। একটি বাগানে গিয়ে দেখলেন অনেক মহিলা বেড়াচ্ছে। তারা বেশ সুশ্রী, চোখ ও চুল কালো কিন্তু বর্ণ শুভ্র। এখানকার গরীব নারীরা মাথায় টুপির বদলে ঘোমটার মতো করে রুমাল বাঁধে। অনেকে উত্তর-পূর্ব ভারতীয়দের মতো জামা ও ঘাগরা পরে। অতি পূর্বে ভারতীয় ও রোমিওরা প্রায় একই সময় সভ্য হয়ে। দুই জাতিই পৌত্তলিক ছিল। অতীতের গৌরব হারিয়ে ইতালি নিজেদের মধ্যে বিবাদে রত ছিল। ইতালি শেষে মাৎসিনি, গ্যারিবোল্ডির সাহায্যে আবার স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু "ভারত শুধুই ঘুমায় রয়"। 


মিলান পৌছে রেলগাড়ি বদলে তাঁরা সুইজারল্যান্ডের দিকে চললেন ও অল্পক্ষণ পরেই পার্বত্য প্রদেশে এসে পরলেন। ক্রমে রেল অতি উচ্চ পর্বত ভেদ করে চলল সুড়ঙ্গ মারফত। তাঁরা আল্পস পর্বত অঞ্চলে এসে পৌঁছলেন। সেন্ট গথার্ড নামক শৃঙ্গ দেখলেন। সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড এলেন তাঁরা। পাঁচ ক্রোশ লম্বা সুড়ঙ্গটি পেরোতে রেলের প্রায় ২৫ মিনিট লাগল। সুইজারল্যান্ডের বাসল শহরে গাড়ি পাল্টিয়ে তাঁরা আবার চললেন। রাতে গাড়ি ফ্রান্সে প্রবেশ করল। সকালে দেখলেন ট্রেন সমতল ফ্রান্সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ফ্রান্সের কালি নগর তথা বন্দরে এলেন তাঁরা। শহরটি প্রাচীরে ঘেরা। ফ্রান্সের প্যারিস এবং নানা নগরী ভারতের দিল্লি, জয়পুরের মত প্রাচীর বেষ্টিত। কালে থেকে আবার জাহাজে উঠলেন তাঁরা। ডোভার প্রণালী পার হয়ে ইংল্যান্ডের ডোভারনগরে এসে পৌঁছলেন। সেখান থেকে রেলে সেই রাতে লন্ডন পৌঁছলেন (২০ অক্টোবর, ১৮৮২)। লন্ডনের চেয়ারিং ক্রস স্টেশনে নেমে দেখেন চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোয় দিনের মতো আলোকিত হয়ে আছে। ২৪ দিন পরে একটি হোটেলে গিয়ে অবশেষে তাঁরা বিশ্রাম পেলেন। 


লন্ডন বিরাট নগরী। কলকাতার প্রায় চার গুণ বড়। এখানে ৪০ লক্ষ লোকের বাস। শহর ক্রমাগত বাড়ছে। লন্ডনের চারপাশে যেসব মাঠ ছিল সেখানে এখন ঘাসের পরিবর্তে রাশি রাশি বাড়ি দেখা যায়। লন্ডনকে বিজ্ঞাপন নগর, দোকানের নগর, ধনের নগর, নাট্যশালা নগর বলা যায়। টাকা না থাকলে লন্ডনে থেকে সুখ নেই। 

লন্ডন আটটি ভাগে বিভক্ত। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভাগে মধ্যবিত্ত লোকের বাস। এখানে সস্তায় ঘর ভাড়া (পেয়িং গেস্ট) পাওয়া যায় ল্যান্ডলেডির অধীনে। হোটেলের থেকে এই ঘর ভাড়ায় থাকলে অর্ধেক খরচ হয়। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রধানত ধনীদের বাস। এখানকার ঘর ভাড়া অনেক বেশি। এই ভাগেই রানী ও প্রিন্স অফ ওয়েলসের রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট, রাজকীয় কার্যালয় প্রভৃতি আছে। পূর্ব-মধ্য ও পশ্চিম-মধ্য ভাগ কাজের জায়গা। পশ্চিম-মধ্যভাগে নাট্যশালা স্কুল কলেজ কার্যালয় দোকান আছে। পূর্ব-মধ্য ভাগকে সিটি বলে। এখানে ব্যাংক, কারখানা, দোকান আছে। এই অংশটি কিছুটা অপরিষ্কার, জনবহুল ও গাড়িবহুল। পূর্বভাগ দরিদ্র শ্রেণীর লোকের বাস, এখানে অপরিষ্কার অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা। 


লন্ডনে অনেক পার্ক আছে। সবচেয়ে বড়টির নাম রিজেন্টস পার্ক। গ্রীষ্মকালে এখানে লোকে লোকারণ্য হয়। এই বাগানের ঝিলে নৌকা চালানো যায়, লন টেনিস ক্রিকেট খেলার জায়গা আছে, একটি ক্ষুদ্র চিড়িয়াখানাও আছে। 


প্রধানত নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে লন্ডন ফগ বা  কুয়াশায় ঢাকা থাকে। পথ চলতে অসুবিধা হয়, নিঃশ্বাসের কষ্ট হয় আর মন বিষাদময় হয়ে থাকে। মনে হয় নরকুন্ডে বসবাস করতে হচ্ছে। এইসব দিনে লেখিকার লন্ডন থেকে দূরে পালাতে ইচ্ছা করত। শীতকালে স্নো বা বরফপাত হয়। 

রাস্তায় ব্রুহাম, বারুচ, ফিটন, ক্যাব, অমনিবাস প্রভৃতি গাড়ি (ঘোড়ার গাড়ি) চলে। খুব সাবধানে এত গাড়ির মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। এদেশে পালকি গরুর গাড়ি নেই। রাস্তায় লোকের কথার থেকে গাড়ির আওয়াজ বেশি শোনা যায়। দোকানগুলি খুব আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো। অক্সফোর্ড স্ট্রীট দিয়ে লন্ডনের পশ্চিম দিকে হাইড পার্ক আছে। এই পার্কগুলিতে নারী-পুরুষ উভয়ে স্বাধীনভাবে বেড়ায়, ঘোড়ায় চড়ে। কেনসিংটন গার্ডেনের ভিতর মহারানী ভিক্টোরিয়ার পরলোকগত স্বামী প্রিন্স আলবার্ট-এর প্রকাণ্ড মূর্তি রয়েছে। তার চারপাশে ইউরোপের বড় বড় কবি, গায়ক, পন্ডিত, বিজ্ঞানীদের মূর্তি দেয়ালের গায়ে খোদিত আছে। চার কোণে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার সূচক চারটি পাথরের বড় বড় মূর্তি আছে। এশিয়ার প্রতিমূর্তিটি হল একটি ভারতীয় নারী হাতির পিঠে ঘোমটা টেনে বসে আছে ও তার দুপাশে চীনা ও মুসলমান লোক দাঁড়িয়ে আছে। 


লন্ডনে বাড়িগুলোর মাটির নীচে ঘর থাকে, সেই অংশে রান্নাঘর, জিনিসপত্র রাখার ঘর থাকে। আর রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে। এমনকি টেমস নদীর তলা দিয়েও রেল চলে। এছাড়া আছে ট্রাম, যাতে ২৪ জন লোক ধরে। আর রয়েছে ওয়েবাস বা বাস, যা ট্রাম-এর থেকে ছোট ও ট্রামের মত রেলের উপর দিয়ে চলে না। রাস্তা দোকান সর্বত্র গ্যাসের আলো জ্বলে। দু একটা বিখ্যাত দোকান, নাট্যশালা, মিউজিয়াম, স্টেশনে বৈদ্যুতিক আলো দেখতে পাওয়া যায়। 


লন্ডনে ৮-১০ টি রাজপ্রাসাদ আছে। রানী ভিক্টোরিয়া যে প্রাসাদে বসবাস করেন তাকে বাকিংহাম প্যালেস বলে। এই প্রাসাদের অনতিদূরে বিশাল অট্টালিকা পার্লামেন্ট হাউস অবস্থিত। পার্লামেন্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় একটি প্রকান্ড ঘড়ি (বিগ বেন) আছে, যা রাতে আলো দেয়। এর বাজনা রাতে সমস্ত লন্ডন থেকে শোনা যায়। 

লন্ডনের দক্ষিণ দিকে তিন ক্রোশ দূরে ক্রিস্টাল প্যালেস অবস্থিত, যা ১৮৫৪ এ সর্বজাতীয় মেলার জন্য দেড় কোটি টাকা ব্যয় নির্মিত হয়েছিল। এর চারপাশে কৃত্রিম প্রস্রবণ ও জলপ্রপাতে সজ্জিত বিশাল উদ্যান আছে। কাঁচের তৈরি এই বাড়িটি রাতে আলোয় অপূর্ব দেখায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আনা অনেক অতি পুরনো ও আশ্চর্য দ্রব্য দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার গ্রন্থাগার অসাধারণ। লন্ডনের প্রধান গির্জা সেন্ট পলস ক্যাথিড্রল খুব উঁচু। এর উপর থেকে লন্ডন শহর সুন্দর ভাবে দেখা যায়। ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে একটি প্রখ্যাত গির্জা তথা ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের কবর ও কীর্তিস্থল। 

লন্ডনে প্রায় ৩০ টি নাট্যশালা আছে। এক একটিতে তিন চার হাজার লোক ধরে। আর আছে বাদ্যশালা (কনসার্ট হল), গানবাড়ি (অপেরা)। মাদাম তুসোর মোমের মূর্তির প্রদর্শনীও খুব জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। লন্ডনে বিরাট বিরাট প্রাসাদসম হোটেল আছে আর আছে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যে রাঁধা খাবার পাওয়া যায়। বাড়িতে সুবিধা না হলে বা রাস্তা-চলতি সময়ে সেখানে খেয়ে নেওয়ার সুবিধা আছে। এছাড়া রয়েছে পানশালা বা পাবলিক হাউস, যাকে জিন প্যালেস বলা হয়। 

লন্ডনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা বাদ দিলে এখানে শেষ হয় কৃষ্ণভামিনী দাসের লন্ডন তথা ইংল্যান্ড ভ্রমণ কাহিনী।

সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৪| মিশরযাত্রী বাঙ্গালী - শ্যামলাল মিত্র

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



"মিশর যাত্রী বাঙালি"র লেখক শ্যামলাল মিত্র সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। বইটি প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালের আশ্বিন মাসে অর্থাৎ ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। আগে এই রচনাটি সঞ্জীবনী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে মিশর যুদ্ধে বাঙালি ভারত-সেনা শ্যামলাল মিত্রের অভিজ্ঞতার কথা এই বইতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এর আগে কোন বাঙালি এত দূর দেশে যুদ্ধে যায়নি। শুধু কাবুলে এর আগে কয়েকজন বাঙালি গেছিলেন কিন্তু তাঁরা কোন ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করেননি। দ্বিতীয় কাবুল যুদ্ধে (১৮৭৮-১৮৮০) শ্যামলাল মিত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে দুই বছর বিশ্রাম নিয়ে ১৮৮২-র জুলাই মাসে আত্মীয় বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে তিনি মিশর যুদ্ধে যাত্রা করেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি বোম্বাই পৌঁছান। 


বোম্বাই অতি চমৎকার দেখতে শহর। সমুদ্রবেষ্টিত, ছোট ছোট সবুজ পাহাড় সম্বলিত এই শহরের সুউচ্চ প্রাসাদ ও সৌধ এখানকার প্রাচুর্যের প্রকাশ। সমস্ত রাস্তায় ট্রামওয়ে, গ্যাসের বাতি ও নল প্রবাহিত জলের ব্যবস্থা আছে। সুন্দর সুন্দর উদ্যান, বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, বাজার সবই রয়েছে এখানে। তার মধ্যে চারদিক থেকে সৈন্যসমাগমে, প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী আয়োজনে, বন্দরে বন্দরে পতাকাশোভিত রণতরীর জন্য বোম্বাই শহরের শোভা আরো বর্ধিত হয়েছিল। অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ,'বোম্বে প্রিন্সেস ডক' থেকে জাহাজে তিন মাসের উপযুক্ত খাদ্য সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে তাঁরা মিশর যাত্রা করেন। জাহাজে একজন বাঙালি কেরানি ছিলেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রচুর সেনা, কর্মচারী, ডাক্তার ছাড়াও ৬৫টি অশ্ব ও ৩০০ টি অশ্বেতর (খচ্চর) জাহাজে ছিল। বিদায়কালে যে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা হৃদয়ভেদী। 


জাহাজে প্রধান কর্মচারী ও ডাক্তাররা সেলুনে; দ্বিতীয় শ্রেণী অর্থাৎ কেরানী, গোমস্তা প্রভৃতি কেবিনে; অন্যান্য সকলে ডেকে স্থান পেল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা জাহাজের হোটেলে প্রতিদিন যথাক্রমে চার ও দুই টাকার বিনিময়ে খাদ্যপ্রস্তুতের দ্রব্য পেত। জাহাজ গভীর সমুদ্রে পৌঁছতেই প্রায় সকলে অসুস্থ হয়ে পড়ল। মাথাঘোরা আর বমির পীড়ায় প্রায় সাতদিন এরকম চলল। সমস্ত ভারতবাসীর রান্নার জন্য একটি মাত্র স্থান ও চার ঘন্টা মাত্র সময় নির্ধারিত ছিল। একটা উনুনে হিন্দু-মুসলমান পরপর রান্না করে যে যার স্থানে গিয়ে খাবার খেত। একদিন জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়েছিল কিন্তু তা ঈশ্বরের কৃপায় রক্ষা পায়। তারপরের দিন তাঁরা আদম (এডেন) পৌঁছলেন, জাহাজ বোম্বাই ছাড়ার আট দিন পর। 


আদম বন্দরে পৌঁছানোর আগে এক ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ উড়ে যেতে দেখলেন। আদমকে ভারতের দ্বার বলা হয় কারণ ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে আসতে হলে সর্বদা আদম হয়ে আসতে হয়। ইংরেজ সৈন্য এই স্থান সর্বদা সুরক্ষিত রেখেছে। এখানকার আদি অধিবাসীরা কৃষ্ণকায়, দীর্ঘ কোঁকড়া চুল, লাল চোখের অধিকারী, আরবি-ভাষী, অশিক্ষিত এবং ইংরেজদের দ্বারা প্রতিপালিত। কিছু স্থানীয় যুবক জাহাজের চারপাশে সাঁতার কাটতে থাকল, নাবিকরা পয়সা ছুড়ে দিলে তারা সাঁতার কেটে সেখানে পৌঁছে আশ্চর্য উপায়ে সব পয়সা উদ্ধার করে নিয়ে গেল। অপরাহ্নে আবার যাত্রা শুরু হল। জাহাজ এতক্ষণ আরব সাগরে ছিল, এবার লোহিত সাগরে চলতে থাকল। 


আদম থেকে ছয় দিনের পথে সুয়েজ পৌঁছে তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার আদেশ এল। ছোট ছোট নৌকায় তীরে পৌঁছে তাঁরা সাত দিনের কুচকাওয়াজ পথে অর্থাৎ সাত দিন পায়ে হেঁটে বা অশ্বারোহণে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছালেন। ইসমালিয়া থেকে কাসাসিন ১২৯ মাইল রেলওয়ে দ্বারা যুক্ত। রেল লাইনের এক দিকে পানীয় জলের খাল বয়ে গেছে। অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। এই মরুভূমি বিগত মিশর যুদ্ধের রঙ্গভূমি।


[প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে মিশর ইউরোপীয়দের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান ছিল। মিশরের শাসক মোহাম্মদ আলী পাশার (শাসন কাল ১৮০৫-১৮৪৮) সময় অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে মিশর একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের পরিণত হয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বৃটেন ভারতে বাণিজ্য বজায় রাখার জন্য এবং বিদেশের মাটিতে নির্মিত প্রথম ব্রিটিশ রেলপথ নির্মাণের জন্য উত্তর মিশরে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে ফ্রান্স ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে সংযুক্ত করার জন্য সুয়েজ খাল নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করে। ইসমাইল পাশার (শাসনকাল ১৮৬৩-১৮৭৯) নীতির কারণে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক সংকট চূড়ান্ত হলে তিনি সুয়েজ খাল কোম্পানির মিশরের শেয়ার ব্রিটেনের কাছে বিক্রি করেন। ইউরোপীয় ও অটোমান শাসনের প্রতি অসন্তোষ ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে মিশরে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের সূচনা করে। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ১৮৮২ সালে দেশের আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্য মিশর দখল করে, যা একটি যুদ্ধে পরিণত হয়। যুদ্ধে ব্রিটেন জয়লাভ করে। জাতীয়তাবাদী নেতা আহমেদ উরাবি (যাঁকে লেখক আরবি পাশা বলে লিখেছেন) সহ বিদ্রোহীরা ধৃত ও শ্রীলঙ্কায় নির্বাসিত হন। এরপর ব্রিটিশ তাওফিক পাশাকে (শাসন কাল ১৮৭৯-১৮৯২) মিশরের শাসনকর্তা বা খেদিভ হিসেবে রেখে একটি নামমাত্র সরকার গঠন করেন। যদিও মিশর অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ রইল কিন্ত প্রকৃতপক্ষে মিশর ব্রিটিশ সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে]। 


মিশরের এই যুদ্ধের বিভিন্ন বর্ণনা যা লেখক লিখেছেন তা ভ্রমণ বিষয়ক না হওয়ায় বর্জিত হল। এরপর যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছে। কোথাও বিজয়ী সেনা অবলা মিশরীয় নারীর উপর অত্যাচার করছে, কোথাও অর্থ লুঠ করছে, কোথাও ক্ষুধার্ত মিশরীয়রা দুর্বলের খাবার কেড়ে খাচ্ছে - এইসব বীভৎস দৃশ্যে মিশর ভর্তি। 


যুদ্ধের শেষে একা লেখক কাইরো ফিরছেন ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র অবস্থায়। যুদ্ধে তিনি সঙ্গিদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। তিনদিন কিছু খেতে পান নি। ঘোড়াটিও খেতে না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু কোন গ্রাম চোখে পড়ছে না। যখন লেখক প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তখন দেখলেন ঘোড়া একটা সবুজ উপবনে প্রবেশ করেছে। ক্রমে একটি গ্রামে এসে পৌঁছলেন লেখক, যেটি যুদ্ধের ফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং প্রায় পরিত্যক্ত। একটি অসহায়া মিশরীয় মহিলাকে এক নরাধম শ্বেতকায় সৈন্যের হাত থেকে রক্ষা করলেন লেখক। নারীটি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। সেখানে লুকিয়ে থাকা একটি তরুণ লেখককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রুটি, খেজুর, জল খেতে দিল। লেখককে তারাই পথের সন্ধান দিল। 


লেখক নিকটস্থ জাগ-আ-জিগ শহরের রেল স্টেশনে পৌঁছলেন। স্টেশনটি সুন্দর এবং তার সংলগ্ন একটি সুন্দর হোটেল আছে। সেখানে ইংরেজ কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করে লেখক তাঁর সঙ্গীদের অবস্থান জানতে পারলেন। পরের দিন কাইরো যাওয়া ঠিক হল। পরদিন সকালে লেখক সেই রাজপুরুষের থেকে শহর দর্শনের পাস, ঘোড়া ও দুজন সঙ্গী নিয়ে জাগ-আ-জিগ শহর দর্শনে বেরোলেন। শহরটি সুন্দর কিন্তু যুদ্ধাবসানে শ্রীহীন। অধিকাংশ বাড়িতে লোকজন নেই, দোকান বাজার বন্ধ। শুধু দু একটি ফল বিক্রেতা রমণী ফলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ফল বিক্রি করছে। 


দ্বিপ্রহরে কাইরো যাওয়ার ট্রেন ছাড়ল। কাইরো পৌঁছাতে নয় ঘন্টা লাগল। এই সময় ট্রেন থেকে অনেক নতুন স্থান, সুন্দর উদ্যান, অপূর্ব ঘরবাড়ি এবং নীলনদের শোভা দেখলেন লেখক। নীলনদ এই দেশের মরুভূমিকে জল দিয়ে শস্যশ্যামলা একটি সাম্রাজ্যে পরিণত করেছে। কাইরো স্টেশন থেকে লেখক আবাসীয়া ছাওনিতে কোন মতে আশ্রয় পেলেন এবং সহযোদ্ধা এবং জাহাজের সহযাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হলেন। তারপর থেকে তিনি অফিসের কাজে নিযুক্ত হলেন আবাসীয়া রাজপ্রাসাদে জেনারেল সাহেবের বর্তমান আবাসস্থলে। এক মাসের বেশি কাইরো শহরে থাকার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ- র কাছে শহর ঘুরে দেখার প্রার্থনা জানাতে ভাগ্যক্রমে সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হল। 


এর মধ্যে লেখক একদিন এক মিশরীয় সহকর্মীর বাড়িতে রাতে খাবারের জন্য নিমন্ত্রিত হন। বাড়িতে সুন্দর ইঁটের তৈরি দোতলা বাড়ি, সামনে সুন্দর বাগান, নানা ফুলে ভরা। বাড়ির ভেতরে পরিছন্নতা ও সুরুচির ছাপ সর্বত্র। খাবার ঘরে গৃহকর্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি অতিথিদের অতিথিদের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং তাঁদের যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপর অন্য একটি কক্ষে তাঁরা গেলেন। সেখানে টেবিলে কারুকার্য করা ঢাকনা পাতা, তার উপর সোনালী রূপালী রঙের নানা পাত্রে নানা রকম ফল সাজান। এই ফলাহারকালে সকলের ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করার সময় জানা গেল এই মিশরীয় ভদ্রলোক আসলে একজন বঙ্গ সন্তান। কিশোর বয়সে পিতামাতৃহীন হয়ে তিনি দেশ ভ্রমণে বের হন এবং দশ বছর যাবত দেশে ভ্রমণ করে বিদেশ যাওয়ার বাসনা হয় তাঁর। তখন একটি জাহাজে কাজ নিয়ে প্রথমে মক্কা ভ্রমণ করে তারপর মিশরে যান। পরে সেখানে মিশরীয় মহিলাকে বিবাহ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। 


পরদিন সেই মিশরীয় তথা বাঙালির সঙ্গে লেখক নীলনদের তীরে পিরামিড দেখতে গেলেন। প্রথমে পিরামিড দেখে তিনি হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন এ শুধু কতগুলি শুষ্ক পাথরের স্তুপ। কিন্তু আকাশস্পর্শী পিরামিডগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে যা দেখলেন তা কখনো কোথাও দেখেননি, বর্ণনা করার ভাষাও তাঁর নেই বলেছেন তিনি। পিরামিড এত উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছে যে মনে হয় তা বিধাতা তৈরি করেছেন। ইংরেজরা বহু উন্নতি করেছে বিজ্ঞানে কিন্তু তাদের বর্তমান পূর্তকার্যের থেকে পিরামিড কোটি গুন উন্নত ও স্বতন্ত্র। প্রতিটি পাথর অন্য পাথরের সঙ্গে কোথায় যুক্ত হয়েছে কোনভাবেই বোঝা যায় না আর তাদের আলাদা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। 


কাইরো শহরে প্রশস্ত রাজপথের দুই পাশে দোতলা থেকে পাঁচতলা সুন্দর অট্টালিকা দেখলেন। কিন্তু সর্বত্র বিষাদের ছাপ। পথের ধারে পথিকদের খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে পশুর মাথার আকৃতি দেওয়া অংশ স্তম্ভের ওপরে বসানো আছে। সেই মুখ এক দিকে ঘোরালে জল পড়ে, অন্যদিকে ঘোরালে জল বন্ধ হয়। একটি স্থানে মন্দিরের সামনে তিনি পানশালা দেখলেন। অন্যত্র রাজকীয় পণ্যশালা দেখলেন, যা একটি বিশাল প্রাসাদ এবং সেখানে অজস্র জিনিসপত্র ক্রয়বিক্রয়ের জন্য সাজানো রয়েছে। এরকম পণ্যশালা ভারতের কোন শহরে লেখক এর আগে দেখেননি। 


এরপর তিনি রাজপ্রাসাদ দেখতে গেলেন। প্রাসাদের সামনে উদ্যানে একদল সুন্দর যোদ্ধার বেশধারী মিশরীয় জয়বাদ্য বাজাচ্ছে। প্রাসাদের দরজায় মিশরীয় যোদ্ধা ও ইংরেজ সশস্ত্র সেনা পাহারা দিচ্ছে। লেখক দেখলেন মিশরের সাধারণ মানুষ যখন যুদ্ধের কারণে গভীর বিষাদের মগ্ন তখন রাজপ্রাসাদে আমত প্রমোদ আনন্দ লীলা চলছে ইংরেজদের সঙ্গে। মিশরের রাজা আজ বিজয়ী ইংরেজ সেনাপতিকে আমন্ত্রণ করেছেন, তাই এত ধুমধাম আয়োজন। লেখক ইংরেজের মোহিনী শক্তিতে অবাক হলেন আর মিশর রাজের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলেন। এরপর লেখক যুদ্ধে আহত, পীড়িত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন যোদ্ধাদের দেখতে গেলেন। তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট চোখে দেখা যায় না। তবে দেখলেন কজন তুরস্ক দেশের মেয়ে নিজেরা অগ্রবর্তী হয়ে রোগীদের সেবার ভার তুলে নিয়েছেন। 


অবশেষে ১৮৮২ পয়লা অক্টোবর থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হল। ভারতবাহিনী পদাতিক, অশ্বারোহী, তাছাড়া উট, খচ্চর, ঘোড়ার গাড়ি সব একের পর এক দাঁড়িয়ে আদেশ পাওয়া মাত্র বাজনার সঙ্গে কুচকাওয়াজ করে যাত্রা শুরু হল। এইভাবে সাত দিন কুচকাওয়াজে এই পথ অতিক্রম করা হল। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এইভাবে তাঁরা কাইরো থেকে সুয়েজ যাত্রা করলেন। প্রতি রাতে ইংরেজরা তাঁবুতে শয়ন করল এবং ভালো খাবার পেল। ভারতীয় সৈন্যদের জন্য কোন ছাউনি ছিল না, খাবারের বন্দোবস্তও তেমন ছিল না। এমনকি মরুভূমিতে প্রচন্ড তাপে পানীয় জল পাওয়া দুষ্কর ছিল। এর উপর ছিল ইংরেজ ঊর্ধ্বতনদের অকথ্য অত্যাচার যার কিছু বর্ণনা লেখক তাঁর বইতে দিয়েছেন। সুয়েজ উপকূলে এসে বহু তাঁবু পরল। প্রথমে সাহেবরা জাহাজে চলে গেল, তারপর ধীরে ধীরে অন্যরা। কিন্তু লেখক কোন ভারতগামী জাহাজ যে স্থান পেলেন না। 


সুয়েজে প্রায় একমাস থাকার পর লেখক একটি জাহাজে স্থান পেলেন। সেনাবাহিনীর ইংরেজ ক্যাপ্টেনের অত্যাচারী মনোভাবের জন্য লেখক থাকার জায়গাও ভালো পেলেন না জাহাজে। খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন লোহিত সাগরে জাহাজ প্রচন্ড বজ্রবিদ্যুৎসহ তুফানে পড়ে কোনক্রমে রক্ষা পেল। কিন্তু এর দুদিন পর জাহাজ আরো বড় ঝড়ে পড়ল। ঢেউ এসে জাহাজের দোতলার ডেকে পড়ছিল। হঠাৎ একটি তরঙ্গ এসে লেখককে একেবারে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তিনি নীচের তলায় একটি ফলকের ওপর পড়লেন এবং তাঁর পা একটি খচ্চরের দুই পায়ের মধ্যে জড়িয়ে যাওয়ায় সমুদ্রে পড়লেন না। জ্ঞান হারিয়ে তিনি সেখানে পড়ে রইলেন আর তাঁর ওপর দিয়ে সমুদ্রের জলস্রোত বয়ে যেতে থাকল। কিছু পরে জ্ঞান হলে তিনি বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন ও কিছু লোকের সাহায্যে তিনি তাঁর শোয়ার জায়গায় এসে দেখলেন তাঁর প্রায় সমস্ত জিনিসপত্রই জলে ভেসে চলে গেছে। এমনকি তার পোশাক এবং প্রিয়জনদের জন্য কেনা তাঁর সব উপহার ভেসে গেছিল। শারীরিক ও মানসিক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এবং তার মধ্যে ইংরেজ প্রভুর নানা অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে তিনি অবশেষে বোম্বাই ফিরলেন। 


বোম্বাই থেকে তিনি এলাহাবাদে যান এবং সেখানে তাঁকে  কিছুকাল কাজ করতে হয়। তিন সপ্তাহ পর তিনি রাউলপিন্ডি যাওয়ার পাস পান। এরপর লেখক কলকাতায় গেলেন যা লেখক তাঁর জন্মভূমি বলে লিখেছেন। পনেরো দিন কলকাতায় কাটিয়ে রেলে পাঞ্জাব রওনা দিলেন তিনি। পথে কাশী, প্রয়াগ, কানপুর, আলীগড়, অমৃতসর, লাহোর প্রভৃতি স্থানে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে ১৮৮৩ -র শুরুতে রাউলপিন্ডি পৌঁছালেন তাঁর নিকটজনদের কাছে। ফেরার পথে জাহাজে তাঁর যে দুর্ঘটনা হয়েছিল তার ফলে তিনি অকর্মণ্য হয়ে যান ও পদচ্যুত হন। ইংরেজ গভর্মেন্ট তাঁর প্রতি নির্দয় ব্যবহার করে। 


পরিশেষে, লেখক ভারতবাসীদের দাসত্ব মনোভাব থেকে জেগে উঠে স্বাধীন কৃষি-বাণিজ্যের উন্নতি করে দেশের উন্নতি সাধন আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ভাব জাগরিত করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৫

৭৩। ভারত ভ্রমণ ২ - বরদাকান্ত সেনগুপ্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


            (আগের পর্বের পরে)


বরদাকান্ত সেনগুপ্ত এরপর আগ্রা থেকে রাজপুতানা এন্ড মালয়া স্টেট রেলওয়ের গাড়িতে ভরতপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন সঙ্গী 'শ--'কে নিয়ে। ভরতপুরে পৌঁছে লেখক বড় একটা সরাই-এ ঘর ও খাটিয়া ভাড়া নিলেন। ভরতপুরের মহারাজার একজন কর্মচারী এসে তাঁদের নাম, ধাম, সঙ্গে অস্ত্র আছে কিনা বা বিক্রি করার কোন জিনিস আছে কিনা এসব তথ্য নিয়ে গেল। এরপর ৫ পয়সার লুচি দিয়ে রাতের খাওয়া সারলেন। তাঁরা যত পশ্চিম দিকে যাচ্ছেন, তত লুচির দাম কমছে। সকালে এক্কা গাড়ি করে ভরতপুরের দুর্গ দেখতে চললেন। রাস্তার দু'ধারে বড় বড় গাছে অসংখ্য ময়ূর ময়ূরী বসে আছে। দুর্গের চারদিকে ডহর বা খাল রয়েছে। এরপরে একটি মাটির প্রাচীর। তারপর দুর্গের পরিখা। তারপর পাথরের কঠিন প্রাচীর। পরিখায় অজস্র কচ্ছপ দেখা গেল। পরিখার ওপর সেতু  পার হয়ে প্রকাণ্ড দুর্গদ্বার। ভরতপুরে দুর্গ দখলে ইংরেজরা বার বার ব্যর্থ হয়েছিল এবং এই দুর্গ অজেয় বলে খ্যাত। কিন্তু বর্তমানে দুর্গের ভিতরে ভগ্নদশা দেখে লেখক ব্যথিত হন। তাঁরা ভরতপুর রাজপ্রাসাদ দেখলেন, যেটির অবস্থা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। 

এরপর রেলপথে তাঁরা জয়পুর যাওয়ার পথে পর্বতসংকুল রাজপুতানার দৃশ্য দেখতে পেলেন। জয়পুর প্রাচীরে ঘেরা দুর্গ শহর। দ্বাররক্ষক পরীক্ষা করে তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দিল। পাথরে বাঁধানো পথের দুপাশে সুন্দর বাড়িগুলি ঠিক এক রকম ভাবে গঠিত ও চিত্রিত। এখানেও একটি বাঙালি বাবুর সাদরে তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন। লেখক জয়পুরের ইংরেজি কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, আর্ট স্কুল, মনুমেন্ট দেখলেন। পরের দিন রাজভবনে দরবার কক্ষ, হাওয়া মহল, যুগশালা, চন্দ্রমহল প্রভৃতি দেখলেন। কাশীর মতো এখানে জ্যোতিষ মন্দির আছে। মহারাজা সওয়াই মানসিং বহু অর্থ ব্যয় করে ইতালির কারিগর এনে একটি অসাধারণ নাট্যশালা নির্মাণ করিয়েছেন। পরদিন জয়পুরের বাজার, রেসিডেন্সি, রাম নিবাস বাগান দেখলেন যা মহারাজ রামসিং বাহাদুর প্রতিষ্ঠিত। রাম নিবাস বাগ কলকাতার ইডেন গার্ডেনের থেকে দেখতে সুন্দর। বাগানের কাছে ভূতপূর্ব গভর্নর জেনারেল লর্ড মেয়োর মূর্তি রয়েছে। তার একটি দিকে প্রাণী বিভাগ। নানারকম প্রাণীতে পূর্ণ। মিউজিয়াম দেখলেন, সেটি কলকাতার মতো বড় না হলেও অনেক জিনিস রয়েছে। তারপর মদনমোহনজি, গোবিন্দজি, গোপীনাথজি, রামচন্দ্রজি, গোকুলনাথজির মন্দির দেখলেন। ভারতবর্ষে স্বাধীন রাজ্যসমূহের মধ্যে জয়পুরের মতো সুন্দর শহর প্রায় নেই। মহারাজা রাম সিং জলের কল ও গ্যাসের আলোর প্রচলন করে জয়পুরকে সমৃদ্ধ করেছেন। 

জয়পুর থেকে ট্রেনে করে আজমিরে এলেন লেখক ও তাঁর সঙ্গী। রাস্তায় তিনি লক্ষ্য করলেন আজমির আরো বেশি পাহাড়ি এলাকা। এখানে এক স্বদেশী বাবুর বাড়িতে তাঁরা থাকলেন। আজমির দুর্গবদ্ধ শহর। পূর্ব ভাগে পরিখার চিহ্ন এখনো রয়েছে। পাঁচটি তোরণ আছে দিল্লি, আগ্রা, মাদার, উশ্রী ও ত্রিপোলি দরওয়াজা। শহরের উত্তর প্রান্তে আনা সাগর নামে হ্রদ রয়েছে, যেটি মহারাজা আনা খনন করিয়েছিলেন। এই সাগরের তীরে সম্রাট শাহজাহানের দেওয়ান খাস (বরাদরি) শ্রীহীন অবস্থায় রয়েছে। আজমিরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে তারাগড় উঁচু পর্বতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গ চৌহান রাজ অজয় পালের অজয় দুর্গ নামে খ্যাত। এই স্থান স্বাস্থ্যকর বলে এখানে অসুস্থ ইউরোপীয় সৈন্যদের বাসস্থান নির্মিত হয়েছে। তারাগড়ের উপরের অংশে আকবরের সামন্ত জব্বর খান নির্মিত মিরান হোসেনের দরকার দরগা রয়েছে। উপর থেকে নীচের দৃশ্য খুব মনোরম। 

আজমির থেকে তাঁরা আড়াই দিনকা ঝোপড়া দেখতে গেলেন। এটি একটি অপূর্ব কারুকার্যময় বাড়ি, যার মাথায় ছাদ এখন প্রায় নেই। তবু এটি ভারতীয় স্থাপত্যের একটি বিশিষ্ট নমুনা বলা যায়। এটি কোন ধনী ব্যক্তি আড়াই দিনে তৈরি করিয়েছিলেন অথবা তাঁর আড়াই দিনের উপার্জনের ধনে এটি তৈরি হয়েছিল। খাজা সাহেবের অর্থাৎ মইনুদ্দিন চিশতির দরগা দেখলেন তাঁরা। দরগায় প্রবেশ করেই নহবতখানায় দুটি দামামা দেখা যায়। বাদশাহ আকবর চিতোর থেকে এনে এই দুটি খাজা সাহেবের সম্মানার্থে প্রদান করেছিলেন। এরপর শাজাহান নির্মিত পাথরের মসজিদ দর্শনীয়। খাজা সাহেব ও তাঁর স্ত্রী, কন্যা হাফিজ জামান ও চিমনি বেগমের এবং শাজাহানের এক কুমারী কন্যার সমাধি আছে। অনেকে বলে দরগার কোন নিভৃত স্থানে একটি শিব মূর্তি লুকানো আছে। এরপর লেখকের সঙ্গীকে তার বাড়ির লোক এসে নিয়ে গেল। ফলে লেখক একাকী হয়ে পড়লেন। আজমিরে লেখক নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটি সীসার খনি দেখলেন। সুড়ঙ্গের মুখ কপাট দ্বারা বন্ধ করা থাকে কারণ অনেকদিন আগে এক দর্শনার্থী খনি দেখতে ঢুকে সেখানে লুকিয়ে বাস করা এক বাঘের শিকার হয়েছিল। লণ্ঠনের আলোতে দুজন সঙ্গী নিয়ে তিনি ভিতরে যান। ভিতরে প্রায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না, কথা বললে চারিদিকে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। ভিতরে অনেক জলের প্রবাহ রয়েছে। অন্ধকারে, প্রতিধ্বনিতে, বাঘের ভয় মনে জেগে ওঠায় লেখক আর বেশি নীচে না গিয়ে ফিরে এলেন। একদিন লেখক পুরাতন আজমির দেখতে গেলেন। এর প্রাচীন নাম ইন্দ্রকোট। তারাগড়ের পশ্চিম প্রান্তে একটি উপত্যকার মধ্যে অবস্থিত দুর্গটিতে ভাঙ্গা মন্দির ছাড়া এখন আর কিছু নেই। আজমিরের পাহাড়ে লেখক শিকারে বেরিয়েছেন মাঝে মাঝে। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আজমিরে দৌলতাবাদ নামে এক সুন্দর উদ্যান নির্মাণ করে সেখানে থাকতেন, যা আজও একটি মনোরম স্থান। এবার আজমির থেকে ১৪ মাইল দূরে নসিবাবাদের ঘোড়দৌড় দেখতে গেলেন। 

এরপর তিনি ট্রেনে করে দিল্লি গেলেন ও এক বাঙালির বাড়িতে উঠলেন। তখন দুর্গাপূজা। সেখানে একমাত্র বাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়িতে পূজা হয়। সেখানে বাঙালিরা মিলিত হয়। সেখানে বাইজীর গান অনুষ্ঠিত হতে দেখলেন। 


দিল্লিতে লেখক যা যা দেখলেন তা হল - পুরানা কিলা, শের মঞ্জিল, লাল বাংলা, আরব কি সরাই, নিজামউদ্দিনের সমাধি, নীলভুজ, মকবারা খাঁ খান্না, চৌষট খাম্বা, নিজামউদ্দিনের সমাধির কাছের কূপ, খসরুর সমাধি, মির্জা জাহাঙ্গীরের সমাধি, জাহানারা বেগমের সমাধি, মোহাম্মদ সাহার সমাধি। এর মধ্যে ভোলানাথ চন্দ্রের লেখা থেকে অতিরিক্ত যা পাওয়া গেল সেটাই এখানে রাখা হল -

লাল বাংলা - পুরানা কিলার কাছে অবস্থিত লাল পাথরের দুটি সমাধি। বড়টি সম্রাট হুমায়ুন কর্তৃক তৈরি তাঁর এক স্ত্রীর সমাধি। অন্যটি বাদশাহ শাহ্ আলমের স্ত্রী লাল কাউরের। লাল কাউরের নাম থেকে লাল বাংলা নাম হয়েছে। (উইকিপিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে সমাধি দুটি কাদের তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সেখানে বলছে শাহ আলমের মা জিনাত মহল ও বা লাল কুনওয়ার এবং মেয়ে বেগম জানের সমাধি)। 
আরব কি সরাই - পুরানা কিলার কাছে হুমায়ুন সমাধির কাছে অবস্থিত হুমায়ুন পত্নী হাজী বেগমের প্রতিষ্ঠিত আরব মোল্লাদের দ্বারা সংস্থাপিত বা মতান্তরে আরব মোল্লাদের থাকার জন্য তৈরি সরাই। এর দুটি সুন্দর ফটক দর্শনীয়। নীল ভুজ - আরব কি সরাই-এর কাছে অবস্থিত কোনো পাঠান সম্রাট কর্তৃক এক সৈয়দের সমাধির ওপর নির্মিত। আগে একটি নীল রঙের চিত্রিত ছিল কিন্তু এখন অল্পই অবশিষ্ট। 
৬৪ খাম্বা - এই শ্বেত পাথরের বাড়িটিতে ৬৪ টি স্তম্ভ ছিল বলে এই নাম। এটি তোগা খাঁ বা আতাগা খানের (আকবরের বিশিষ্ট সভাসদ) পুত্র মির্জা আজিজা বাকুলতুগ খান সমাধি। এইখানে শ্বেত পাথরের পর্দার কাজ রয়েছে। 

পুরনো দিল্লিতে তিনি লৌহস্তম্ভ, লাল কোট, কিলা-রাই পিথরা, ভূত খানা, কুতুবুল ইমাম মসজিদ, কুতুবুদ্দিনের কবর, কুতুব মিনার, আলতামাসের সমাধি, আলাই দরওয়াজা, যোগমায়া, মেটকাফ হল, মোহাম্মদাবাদ, তোগলাকাবাদ, জেহান পান্না, রৌশান চিরাগ, ভুলভুলিনজা বা গুমগাসটেজি, হাস খাস, কির্কি, সফদর জঙ্গের সমাধি, যন্ত্র মন্ত্র, ফিরোজাবাদ দেখলেন। লেখক ভোলানাথ চন্দ্রের লেখায় যে অংশগুলি আলোচনা করা হয়নি সেগুলো এখানে রাখা হল - 

ভূতখানা - কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থিত সাতটি হিন্দু মন্দিরের উপকরণের তৈরি গৃহ। হয়তো স্তম্ভের গায়ে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি খোদিত আছে বলে মুসলমানরা এই নামকরণ করেছিলেন। 
যোগমায়া দেবী - এই মূর্তি কুতুব মিনারের উত্তর দিকে প্রতিষ্ঠিত। কোন সময়ে এই মন্দির নির্মিত হয় বলা সম্ভব নয়। লেখক মনে করেন মোগল রাজত্বে শেষ ভাগে রাজপুতানার কোন হিন্দু রাজা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। না হলে অন্য হিন্দু স্থাপত্যের মতো এখানে এই মন্দিরও বিনষ্ট হতো। 
রওশন চিরাগ - সিরির দক্ষিণ পূর্বভাগে অবস্থিত এটি একটি প্রাচীর বেষ্টিত দরগা। বাদশাহ ফিরোজ শাহ এটি শেখ নাসির উদ্দিন মোহাম্মদের সম্মানে তৈরি করিয়েছিলেন। এর কাছেই বহুলুল লোদীর সমাধি। 
ভুল ভলিঞ্জা বা ভুলভুলাইয়া - এটি আকবরের প্রসিদ্ধ সেনাপতি আদম খাঁ -র সমাধি, যিনি মান্ডুর রূপমতী-বাজ বাহাদুর কাহিনীর খলনায়ক। 
কির্কী - এটি কুতুবের উত্তর পূর্ব চার মাইল দূরে অবস্থিত একটি প্রাচীর বেষ্টিত ক্ষুদ্র শহর। ফিরোজ শাহের শাসনকালে খাঁ জাহান এটি তৈরি করেছিলেন। কিরকি নামে একটি মসজিদ এখানে বর্তমান। 

বর্তমান দিল্লিতে তিনি কেল্লা, চাঁদনী চক, জুম্মা মসজিদ, দিল্লি মিউজিয়াম ও কুইন্স গার্ডেন, শালিমার বাগ, কুমারী মসজিদ, রসিনারা বেগম সমাধি, সেলিম গড় দেখেছেন। 

এছাড়া তিনি সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতি জড়িত কাশ্মীর দরজার বাইরে লাডলো ক্যাসেল, বার্ন বুরুজের (burn bastion) কথা আলোচনা করেছেন। দিল্লির মিউজিয়ামের দরজায় লেখক বাহনশূন্য জয়মল ও পুত্তের মূর্তি দেখেন। লালকেল্লার দেওয়ানী খাসে যে দ্রষ্টব্যগুলি ছিল সেগুলো এখন এই মিউজিয়ামে এনে রাখা হয়েছে এবং এর নাম হয়েছে দিল্লি ইনস্টিটিউট। এর সংলগ্ন কুইন্স বাগ উদ্যানের এক পাশে তিনি জয়মলের মূর্তির বাহন হাতিটি ভাঙ্গা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। 

ভোলানাথ চন্দ্রের মত বরদাকান্ত সেনগুপ্ত এই বইতে সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। কিন্তু তার সঙ্গে ভ্রমণ কাহিনীর সম্পর্ক না থাকায় সেটি এখানে আলোচনা করা হল না।

৭২। ভারত ভ্রমণ ১ - বরদাকান্ত সেনগুপ্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


       

"ভারত ভ্রমণ" গ্রন্থের লেখক বরদাকান্ত সেনগুপ্ত সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতে পারা যায়নি। তাঁর লেখা অন্য কয়েকটি বইয়ের নাম শুধুমাত্র জানা গেছে - আমার গান ও কবিতা, সারদা (উপন্যাস), চাঁদের বিয়ে (উপন্যাস), হৈমপ্রভা (উপন্যাস), প্রতিভা (উপন্যাস)। তিনি সঞ্জীবনী, সন্দর্ভ প্রভৃতি পত্রিকায় লিখতেন। এই লেখার ভ্রমণ কাল নির্ধারণ করতেও কিছুটা সমস্যা এসেছে কারণ লেখক লিখেছেন যে এই ভ্রমণ শুরু হয় ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ অর্থাৎ ১৮৮১ সনের ১৯ জুলাই। অথচ তিনি বইটির উৎসর্গ অংশে তারিখ লিখেছেন মাঘ ১২৮৪ (যেটি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু ভ্রমণের আগে উৎসর্গ পর্ব সম্ভব নয়। যেহেতু লেখক ভ্রমণ শুরুর দিনটি বাংলা এবং ইংরেজি দুরকম তারিখে বর্ণনা করেছেন আর উৎসর্গে শুধুমাত্র বাংলা তারিখ উল্লেখ করেছেন, অতএব ধরে নেওয়া হচ্ছে মুদ্রণকালে উৎসর্গের তারিখটি ভুল ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ ভ্রমণ শুরু হয়েছিল ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে উনিশে জুলাই তারিখেই। 

বইয়ের শুরুতে তিনি লিখেছেন বাংলা ভাষায় ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রায় নেই। তিনি তিন বছর ধরে ভারতের নানা স্থান ভ্রমণ করে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তা এই বইয়ে লেখা হল। বিবরণ সংগ্রহ করতে দু একজন বিদেশী ভ্রমণকারীর বই, জনপ্রবাদ প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে এই বই লেখা হয়েছে। এই বইটির একটি দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ হবে বলে তিনি লিখেছেন, যাতে মালব মধ্যভারত, বম্বে ইত্যাদি স্থানের ভ্রমণকাহিনী থাকবে বলে জানান হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় খন্ডটি হয় প্রকাশিত হয়নি অথবা যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। তাই শুধুমাত্র প্রথম খন্ডের ওপরে ভিত্তি করেই এই ব্লগটি লিখিত হল। 

লেখকের ভ্রমণ তৃষ্ণা বাল্যকাল থেকেই ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৮৮১ সনের ১৯ শে জুলাই তিনি 'শ _ ' নামক এক উৎসাহি কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে ঘর ছেড়ে দেশ ভ্রমণে বের হন। যাওয়ার সময় হাওড়া স্টেশনে ডাক-বাক্সে আত্মীয়দের কাছে লেখা চিঠিতে এই গৃহত্যাগের খবর জানিয়ে তাঁরা ট্রেনে উঠলেন। তারপর থেকে শুরু হল লেখকের আসল ভ্রমণ কাহিনী। 

বরদাকান্ত সেনগুপ্তের বেশ কিছু ভ্রমণ স্থান ও ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনীর ভোলানাথ চন্দ্রের ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু -র সঙ্গে অনেক মিল আছে। এই কারণে নতুন কোন বিষয়ের অবতারণা হলে তাহলে শুধুমাত্র আলোচনা করা হবে। 

ট্রেনে প্রথম ভ্রমণ স্থানগুলি পরপর বলা হল - শ্রীরামপুর, মাহেশ, বৈদ্যবাটি, চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলি ইমামবাড়ী, সপ্তগ্রাম, পান্ডুয়া, বর্ধমান। এই পর্যন্ত অংশে নতুন কথা লেখক যা লিখেছেন তা হল - (প্রথম) মহম্মদ মহসিন তাঁর দুঃখিনী বোনের সমব্যথী হয়ে ইমামবাড়ী প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান গরীব ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন এবং নিজে ও তাঁর বোন সন্ন্যাসের ন্যায় জীবন বেছে নিয়েছিলেন। (দ্বিতীয়) বর্ধমানে আত্মীয়ের বাড়িতে ধরা পড়ে যেতে যেতে পালিয়ে কিভাবে তাঁরা বর্ধমান থেকে পালালেন সেই বর্ণনা। 

বর্ধমানের পরেই কানু জংশন স্টেশন (খানা জংশন)। সেখান থেকে লুপ লাইনের গাড়িতে রাজমহল চললেন। পথে পড়ল তিনপাহাড় স্টেশন। তিনপাহাড়ের দৃশ্য খুব সুন্দর। পাহাড় কেটে রেলপথ তৈরি হয়েছে। এখানে রেলগাড়ি পরিবর্তন করে তাঁরা রাজমহল গেলেন। সেখানে তাঁরা ইলিশ মাছ রান্না করে খেয়ে একটা দোকানে শয়ন করলেন। রাজমহল থেকে ট্রেনে লক্ষীসরাই হয়ে মোকামা পৌঁছে অন্য গাড়িতে বারেঘাটের (বরদাঘাট, নেপাল) উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। তাঁরা তখন দেশ ছেড়ে নেপাল যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। 

ট্রেনে মত পরিবর্তন করে তাঁরা বেনারস পর্যন্ত টিকিট বাড়িয়ে নিলেন। বাঁকিপুর, দানাপুর, আরা, শোন নদীর সেতু ইত্যাদি পেরিয়ে মোগলসরাই পৌঁছাল ট্রেন। এরপর তাঁরা অন্য ট্রেনে রাজঘাট (বেনারসের একটি ঘাট) পৌঁছে নৌকা পার হয়ে বেনারস গেলেন। বিশ্বনাথ মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, জ্ঞানবাপি, বেনীমাধবের ধ্বজা দেখে কাশীতে মনিকর্নিকা ঘাটে তাঁরা ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে দেখলেন। সেখানকার লোকেরা মহাপুরুষের অনেক অলৌকিক কীর্তির কথা বলল কিন্তু লেখক সেসব কিছু দেখেননি। এরপর মানমন্দির, তিল ভান্ডেশ্বর, সারনাথ দর্শন করলেন। 


এবার বেনারস থেকে ঔড এন্ড রোহিলখন্ডের রেলওয়েতে তাঁরা এবার অযোধ্যা যাত্রা করলেন। একটা সরাইতে খাটিয়া আর ছারপোকার কামড় খেয়ে কাটালেন। অবশ্য দোকানে লুচি তরকারি খেয়েছিলেন তার আগে। অযোধ্যায় পান্ডার উপদ্রব সহ্য করে, অজস্র বাঁদরের লীলা খেলা দেখে লেখক মন্তব্য করেছেন অযোধ্যায় এখন দেখার বিশেষ কিছু নেই যে কটি মন্দির আছে তা আধুনিক বলে মনে হয়। মন্দিরের মধ্যে হনুমান গড় (অন্য নাম মহাবীর গড়) সর্বপ্রধান, এরপরে গুরুত্বপূর্ণ রামচন্দ্রের জন্মস্থান। সরযূ নদীর তীরে রামঘাট, সীতাঘাট, লক্ষণঘাট প্রভৃতি আছে। 

এবার তাঁরা ৫-৬ মাইল হেঁটে ফাইজাবাদে এলেন। শহরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মুসলমান রাজা কর্তৃত প্রতিষ্ঠিত বলে মসজিদ ও সুন্দর অট্টালিকায় পরিপূর্ণ। এখানে ব্রিটিশ সেনানিবাস আছে। এই ফাইজাবাদেই সুজাউদ্দৌল্লার পুত্র নবাব আসাফুদ্দৌলার প্রবঞ্চনায় হেস্টিং সুজাউদ্দৌল্লার বিধবা বেগম ও মাতার ভাতৃদ্বয়কে নির্দয় উৎপীড়ন করে সর্বস্ব অপহরণ করেছিলেন। সেখানে ভাত খাওয়ার জন্য (অনেকদিন লুচিপুরি খেয়ে বাঙালির রসনা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল) অনেক অস্থির হয়ে তাঁরা চাল, আলু ও এক ঠাকুর জোগাড় করে বহু আকাঙ্ক্ষিত ভাত খেলেন। যদিও সেই ভাত আধ সেদ্ধ বা আধ ফোঁটা ছিল, তবু শাল পাতায় ঢালা সেই ভাত খেয়ে যে তৃপ্তি তিনি পেলেন তা বোধহয় জীবনে কোনদিন পাননি। 

রাতে বেনারসের ট্রেনে তাঁরা লখনৌ রওনা দিলেন। লখনৌ পৌঁছে লেখক দ্বিধা ভয় কাটিয়ে একজন অপরিচিত বাঙালি অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। লখনৌতে তাঁরা চক, কেল্লা দেখলেন। লখনৌয়ের মানুষজনের ভদ্রতা, আদবকায়দা সংক্রান্ত গল্প শুনেছিলেন, এখন স্বচক্ষে দেখলেন। কোইশোর বাগ (কাইজার বাগ) ওয়াজেদ আলী সাহেবের সময় অসাধারণ শোভাসম্পন্ন ছিল কিন্তু ইংরেজদের হাতে পড়ে শোভা বিনষ্ট হয়েছে। এর মাঝখানে ক্যানিং কলেজ ও সরকারি অফিস, মিলিটারি জেলখানা হয়েছে। রেসিডেন্সিতে বিখ্যাত ইংরাজ সেনানিদের সমাধি দেখলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় মৃত ইংরেজ শিশুদের সমাধি দেখে ও ফলকে লেখা পড়ে তাঁর মন ব্যথাতুর হয়ে উঠল। লখনৌয়ের মিউজিয়াম দেখলেন এরপর। সেখানে একটি পিস্তল দেখে খুব কষ্ট পেলেন। এই পিস্তল দিয়ে সিপাহী বিদ্রোহে দিল্লির বাদশাহের এক পুত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। এখন রাজগৌরবে ইংরেজ সেটি যত্ন করে মিউজিয়ামে রেখেছে। লখনৌর পুরনো রাজবাড়ি ছত্র মঞ্জিল এখন অফিস ও ক্লাব রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইমামবাড়া অতি সুন্দর দেখতে। এই মসজিদের পশ্চিমে হোসেনাবাদ নামে একটি বড় সুন্দর মসজিদ আছে। 

এরপর লেখক কানপুর গেলেন একা। সিপাহী বিদ্রোহে নিহত ইংরেজদের স্মরণে নির্মিত স্মরণ উদ্যান, স্মরণ কূপ দেখলেন। এই উদ্যানে কোট-প্যান্ট পরা থাকলে প্রবেশ অবাধ। লেখকের জজ সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি পত্র আনতে হয়েছিল কারণ তিনি কোট প্যান্ট পরিধান করেন নি। মেমোরিয়াল চার্চ ও মেমোরিয়াল হোটেল দেখলেন। চার্চের দেওয়ালে সিপাহী বিদ্রোহের দৃশ্য চিত্রিত। যেমন - সাহেবের সিপাহী পা ধরে প্রাণভিক্ষা চাওয়া আর সিপাহী তাকে বধ করার জন্য তরবারি তোলার চিত্র। হোটেলটি সিপাহীদের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছিল। 

যযমৌ (জজমউ) নামে স্থান কানপুরের দক্ষিণে গঙ্গা তীরে অবস্থিত। একে যযাতি রাজার বাড়ি বলা হয়। এখানে অনেক মাটির ঢিবি ছাড়া প্রাচীনকালের কিছু দেখার নেই। লোকে বলে উঁচু একটা ঢিপিতে যযাতি রাজার সিংহাসন আছে।  ( পরে কিছু খনন কার্য করে খ্রিস্ট পূর্ব ১৩০০-১২০০ - এর চিহ্ন পাওয়া গেছে। খনন কার্য সম্পূর্ণ করা আজও হয়নি)। 

কানপুরের উত্তরে বিটুনগর (বিঠুর) হিন্দুদের পবিত্র তীর্থ। এটি বাল্মিকী মুনির আশ্রম ছিল বলে প্রচলিত আছে। লেখক বলেন ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র সীতাকে এই বিঠুরে বনবাসে পাঠিয়ে ভবিষ্যতে লব কুশের যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিলেন যেমন, তেমনই ইংরেজ কলিযুগে পেশোয়া বাজিরাও-কে বিঠুরে বনবাসে পাঠিয়ে ভবিষ্যতে সিপাহী যুদ্ধের সূত্রপাত করে। ইংরেজ রাজত্বতে অনেক নির্দোষীর বনবাসের বিশেষ ত্রুটি হয় না তাই জন্যই বোধহয় ইংরেজ রাজত্বকে অনেকে রাম রাজত্ব বলে। 

এরপর লেখক টুন্ডলা হয়ে আগ্রা গেলেন রেলপথে। আগ্রায় তাঁরা এক বাঙালি বাবুর বাড়িতে সানন্দে আশ্রয় পেলেন। তাজমহলের শিল্প সম্বন্ধে ইউরোপীয়দের বিশ্বাস শাহজাহানের রাজত্বকালে দিল্লির আগ্রা দরবারে অস্টিন ডি বার্ডিয়াক্স নামে এক ইউরোপীয় নক্সা-নবীশ ছিলেন। তাঁর নকশা অনুসারে তাজমহল তৈরি হয়। কিন্তু লেখক বলেন এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তাজমহলের প্রবেশদ্বারের ডানপাশে নির্মাণকর্তার নাম হিসেবে আমানত খাঁ সিরাজীর নাম রয়েছে। অস্টিনের নকশা অনুসারে তৈরি হলে তাঁর নামও তাজমহলের গায়ে লেখা থাকত। এরপর আগ্রা দুর্গ দেখলেন। সেখানকার বর্ণনা ও ইতিহাস আলোচনা পুনরাবৃত্তি এড়াতে এখানে রাখা হল না। 


লেখক জেনানা, মতি মসজিদ, নগদা মসজিদ, শিশমহল প্রভৃতি দর্শন করলেন। এরপর ইতমুদৌল্লা, রামবাগ, আগ্রা কলেজ, সেনানিবাস দেখে সেকেন্দায় আকবরের সমাধি দেখতে গেলেন। সেকেন্দ্রার মসজিদের কাছে আকবরের পর্তুগীজ পত্নী মনিবেগমের সমাধি রয়েছে। অযোধ্যার মতো আগ্রাতেও বানরের উৎপাত দেখলেন লেখক।

                     (চলছে)

রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

৭১। তিব্বত অভিযান ৪ - শরৎ চন্দ্র দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


            (আগের পর্বের পরে)
 
গ্যান্তসে হয়ে লাশা হাইওয়েতে এসে লেখক এর মনে হল সেটি যেন ভারতের কোন অমসৃণ রাস্তা। কোনো কোনো জায়গায় সেটি কুড়ি ফুট চওড়া, কোনো কোনো জায়গায় খুব সরু। তিব্বতের সরকার রাস্তাঘাট বাবদ খরচ করে না বললেই চলে পুরো তিব্বতে চাকা দেওয়া কোন যান নেই। 

অনেকগুলি ছোট বড় গ্রাম পেরিয়ে রিং-লা গ্রামে এসে লেখক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় ঘোড়ায় চেপে তাঁকে সামডিং গোমবাতে যেতে হল কারণ সেখানে চিকিৎসক আছে। তিব্বতি চিকিৎসকের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে কদিন পরে ২৭ নভেম্বর লেখক সামডিং থেকে লাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ঘোড়ায় করে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর লেখক বন্য ছাগল, বন্য ভেড়া আর কয়েকটি কস্তুরী মৃগকে ঘাস খেতে দেখলেন। এই ইয়ামদো জেলায় কোনো বন্য প্রাণীকে শিকার করা নিষিদ্ধ। 

তারপর নানগার্টসে শহর পেরিয়ে ইয়ামদো লেকের তীরে এলেন তাঁরা। এরপর এক জায়গায় সঙ্গিদের কথায় লেখককে ঘোড়া থেকে নেমে ধূপকাঠি জ্বেলে অশরীরী আত্মাকে শ্রদ্ধা জানাতে হল। পরদিন পালতি লেকের পাড় ধরে চলতে চলতে খাম্বা-লার পাদদেশে পৌঁছলেন। এই পাহাড়ে চড়ার পথ অনেকটা সহজ। রাস্তার পাশে পাথরের মাঝে মাঝে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের ছবি আঁকা আছে। 

খাম্বা-লার উপর থেকে তিব্বতের এক শ্রেষ্ঠ দৃশ্য দেখা গেল। সাংপো নদীর উপত্যকা এখন চোখের সামনে। বেলা থাকতে তাঁরা পাহাড়ের অপর দিকের পাদদেশে নেমে গেলেন। বার্লি ক্ষেতে কর্মরতা দুটি মহিলা লেখককে একটি বার্লির গুচ্ছ দিয়ে টাকা চাইল। এই প্রক্রিয়া তিব্বতে সর্বত্র প্রচলিত। এরপর এক জায়গায় দেখলেন মহিলারা ইঁট বানাচ্ছে। শুকিয়ে গেলে গাধা আর চমরির পিঠে সেগুলো দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেখলেন পালচেন চুভরি মনাস্ট্রি আর সাংপোর ওপর চেইন ব্রিজ। এই চেন ব্রীজ পঞ্চদশ শতাব্দীতে তৈরী। 

নৌকায় ঘোড়া নিয়ে তাঁরা নদী পার হলেন। সাংপো এরপর লাসার নদী কী-চুর সঙ্গে মিশেছে। অসাবধান হলে উপর থেকে নদীর জলে পড়ে অথবা তীরের চোরাবালিতে ডুবে প্রাণনাশের আশঙ্কা। এভাবে তিন মাইল কষ্টকর পথ পেরিয়ে লেখক এলেন বিখ্যাত নেতাং গ্রামে, যেখানে অতীশ দীপঙ্কর দেহত্যাগ করেছিলেন। 

পরদিন ৩০ মে ভোরবেলায় রওনা দিয়ে বেশ কিছু গ্রাম পেরিয়ে লেখক পাহাড় কেটে তৈরি এক বিশাল বুদ্ধের মুখের ভাস্কর্য দেখে বুঝলেন তাঁর দীর্ঘকালের প্রার্থিত লাসা সামনে উপস্থিত। পশ্চিমের দরজা দিয়ে লেখক শহরে প্রবেশ করলেন বল্লম হাতে পাডর আর ঘোড়া নিয়ে ফুর্চুং-এর সঙ্গে। প্রহরী বুঝলো তাঁরা নতুন কিন্তু কিছু বলল না। ক্লান্তিতে তাঁর চোখ ফুলে গেছিল। চোখে কালো চশমা আর মাথায় পাগড়ি পরে তাঁকে লাদাখি মনে হচ্ছিল। রাস্তায় কজন তাঁকে দেখে গুটি বসন্ত আক্রান্ত রোগী মনে করল। প্রহরীরা এক লামার নির্দেশে লোকজনের জিনিসপত্র পরীক্ষা করছিল। তারাও লেখককে পরীক্ষা করল না। 

রাস্তার দুপাশে তিব্বতি আর চিনা দোকান। প্রতি দোকানের সামনে একটা পিরামিডের মতো আকারের পাত্রে জুনিপারের ডালপালা আর শুকনো পাতা পুড়িয়ে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা হয়। নেপালী, কাশ্মীরি দোকানও আছে। সিল্ক, পোর্সেলীন, চা প্রভৃতি বিক্রি হচ্ছে। তাসিহুনপো মঠের লামা ও অফিসাররা লাসায় এলে যে বাড়িতে থাকেন সেখানে লেখকের থাকার ব্যবস্থা হল। 

পয়লা জুন বুদ্ধদেবের নির্বান লাভের পবিত্র দিনে ধূপ জ্বালানো হল পাহাড়ের চূড়ায়, মঠে, মন্দিরে, প্রতিটি বাড়িতে। মূল বৌদ্ধ মন্দির সাং-খাঙ-এর সামনে একটা লম্বা পতাকা দন্ডে চমরি গায়ের লেজের চামর, চমরি ও ভেড়ার শিং লাগানো। মঠে বুদ্ধের মূর্তিটি পঞ্চ ধাতুর তৈরী। এটি নাকি মগধে তৈরি হয়েছিল এছাড়া মৈত্রেয় বুদ্ধ, দীপঙ্কর বুদ্ধ এবং বুদ্ধের প্রধান বারো জন শিষ্যের মূর্তি রয়েছে। মহান সংস্কারক সং-খাপার মূর্তি রয়েছে। বিখ্যাত পাথর আমলোঙ্খা দেখলেন। এই পাথর বুদ্ধের শিষ্য মাদ্গল্যায়ানা ব্যবহার করেছেন। দেখলেন সব থেকে বিখ্যাত মূর্তি, এগারো মুখ বিশিষ্ট অবলোকিতেশ্বর। এছাড়া মঠের দুই ও তিনতলাতেও আরো নানা রকম মূর্তি রয়েছে। 

পরদিন তিনি রামোচে গুমফা দেখে এলেন। লাসা থেকে লেখক গ্যান্তসেতে যান সেখানে ও তাশিলহুনপোতে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে উগ্যেন ভারতে ফেরার জন্য যাত্রা করেন এবং লেখক সাম্যেলোখার উদ্দেশ্যে রওনা হন একুশে অক্টোবর ১৮৮২। এবারের যাত্রায় তাঁর গাইডের নাম গোপান। 

প্রথমে লাসা পর্যন্ত যাওয়ার হাই রোড দিয়ে রিং-লা গ্রামে পৌঁছে তাঁরা সুন্দর পশুচরণভূমি ও জুনিপার-সিডারের পার্বত্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টালুন গ্রামে এলেন, অশ্বপালনের জন্য বিখ্যাত। তারপর চং-খর মঠ দেখে সারি গ্রামে এলেন। ইআমডো লেক আর ছোট একটা মিষ্টি জলের লেকে ধারে অবস্থিত এই গ্রামে একটি বিশাল জপযন্ত্র আছে। একজন বৃদ্ধ এখানে থাকেন, যাঁর কাজ শুধু এই জপযন্ত্র ঘোরানো। 

পরদিন কাবু-লা বলে ছোট পাহাড় পেরিয়ে মেলুং, খামদো, লিং, প্রভৃতি গ্রাম পার হলেন। কর্মোলিং গ্রামে শয়ে শয়ে ঘোড়া চড়তে দেখলেন। এইসব জায়গায় মানুষের বসতি কম, ঘোড়া গাধা চমরিদের চারণক্ষেত্র বেশি। এরপর টিব-লা পাহাড়ে ওঠা, যা ইয়ামদো আর লোখা জেলার সীমান্ত। উপর থেকে সেই হ্রদভূমির যে অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল সেরকম লেখক কখনো দেখেননি। পাহাড়ের অবতরণ বেশ শক্ত বিশেষ করে প্রচন্ড বেগে বওয়া বাতাসের জন্য। রাতে ছোট টিব গ্রামের মানুষের মিষ্টি গান শুনতে শুনতে নিদ্রা গেলেন। এরপর টিব চু নদীর গতিপথ ধরে পথ জুনিপার, ফার গাছের ঘন জঙ্গলে ঘেরা। রাতে খেদেসো নামে পুরনো দুর্গ শহরে থাকলেন। শহরে ফুলের বাগান রয়েছে। প্রতিটি বাড়ির জানলা দরজায় ফুলের গাছ রয়েছে মাটির পাত্রে। এখানে দালাইলামা ও পাঞ্চেন রিনপোচির পোশাক তৈরি হয়। 

পরদিন দুই মাইল নরম বালির ওপর দিয়ে হেঁটে তাঁরা সাং-পো কাছে পৌঁছলেন। আধ মাইল চওড়া সেই নদী নৌকায় পার হয়ে (ঘোড়াসহ) এবার সাংপো নদীর ধার দিয়ে পথ গেছে টিলা আর পাথুরে জমির উপর দিয়ে, যার উপর গোড়া নিয়ে চলতে সাবধানতা লাগে। পরদিন এল সংকার নামের বড় গ্রাম। সেখান থেকে সাম্যে পর্যন্ত পথ সাংপো থেকে লম্বা হিলস পর্যন্ত বালুময়। 

পাহাড়ের ওপর থেকে সাম্যের মঠের সোনালী চূড়া সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকলো। সাম্যেতে পৌঁছে সেখানকার মঠে লেখক গ্রন্থাগারের খোঁজ করলেন যেখানে বহু আগে অতীশ দীপঙ্কর অনেক মূল্যবান গ্রন্থ দেখেছিলেন। কিন্তু জানা গেল দুর্ভাগ্যবশত সেই গ্রন্থাগার বহুদিন আগে ভষ্মীভূত হয়েছিল। এখন যা আছে তা সবই নতুন বই। ধর্মসভায় দালাই লামার সিংহাসন রাখা আছে। 

সাম্যে গ্রামে চারপাশে ঘুরে দেখার সময় জানলেন নিকটস্থ পর্বত শ্রেণীতে অনেক বন্য ছাগল, ভেড়া, হরিণ আর স্নো লেপার্ড আছে। সাম্যে গ্রাম আস্তে আস্তে সাংপোর বালিতে ডুবে যাচ্ছে। লেখক শুনলেন গুরু পদ্মসম্ভব এর এই মর্মে ভবিষ্যৎ বাণী রয়েছে। 

২ নভেম্বর লেখক সাম্যে থেকে ইয়ারলুং দেখতে রওনা দিলেন। বালুকাময় সমতল রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে অনেক ছোট, বড় গ্রাম দেখলেন। টাগকার-শো নামে এক প্রাচীন রাজার প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখলেন। গ্রামে যে প্রাচীন বৌদ্ধমঠ দেখলেন তা দেখতে যেন বাংলার বাড়ির মত। নদী নৌকায় পার হয়ে তাঁরা সে-টাং এলেন, যা ইয়ারলুঙের রাজধানী। এখানে কিছু নেপালি, চীনা, কাশ্মীরি দোকান আছে। 

সেখান থেকে ইয়ারলুং উপত্যকা ঘুরে দেখলেন। নে-ডং-জং-এ প্রাচীন রাজাদের রাজধানীর ভগ্নাবশেষ রয়েছে। সপ্তম তিব্বতের সবচেয়ে প্রাচীন প্রাসাদ এই প্রাসাদের স্থাপত্য শতাব্দীতে তৈরি তান্দুব মন্দির দেখলেন। ওম্বু-ইহা-খান তিব্বতের সবচেয়ে প্রাচীন প্রাসাদ এখানে রয়েছে। এই প্রাসাদের স্থাপত্যতে ভারতীয়ত্ব মিশে আছে। 

তারপর গেলেন তিব্বতের সবচেয়ে প্রাচীন নগর ফোডাগ জং। এখান থেকে যেসব রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের উপাধি ছিল চস-গ্যিয়াল। ইয়ার্লুং উপত্যকা, তিব্বতের অন্যতম প্রাচুর্যপূর্ণ স্থান। এখানকার মানুষ ভদ্র ও শান্ত। এরপর ১০ নভেম্বর ইয়ার্লুঙ ত্যাগ করে তাঁরা তাশিলহুনপো ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হলেন। ২৪ শে নভেম্বর তাশিলহুনপো পৌঁছলেন। 

এবার শাক্য যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পাসপোর্ট পাওয়া গেল মন্ত্রী সহায়তায়। ৩০ নভেম্বর তাশিলহুনপোকে বিদায় জানিয়ে ফুর্চুং আর গোপানের সঙ্গে শাক্য রওনা দিলেন। সেখান থেকে তাঁরা খাম্বা-জং আর কোগরা লামো পাস হয়ে দার্জিলিং ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা। 
রী চু নদীর গতিপথ ধরে পথ চলা। সামডং-এ একটা বাড়িতে রাত কাটালেন। সেই বাড়ির কর্ত্রীর দুই স্বামী এবং তারা দুই ভাই নয়। তারপর শাব চু নদীর পাশ দিয়ে চলা। 

টমচু নদীর তীরে অবস্থিত শাক্য সুন্দর শহর। এখানকার মন্দির, লাইব্রেরী, সরকারি ও বেসরকারি বাড়িগুলি লাল রং করা। তার ওপর কালো ও নীল দাগ কাটা। এটি শহরটিকে অন্যান্য তিব্বতী শহরের থেকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে। এখানকার মঠের লামারা দীর্ঘ চুল রাখে এবং সেই চুল বেনি করে। একরকম দুল পড়ে যা কান ঢেকে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই কান ঢাকা বিরাট দুল সোনার তৈরি এবং পান্না ও ফিরোজা মনি পাথর বসানো। এখানকার লাইব্রেরী বিশাল। এখানকার বেশ কিছু পুঁথি সোনার হরফে লেখা। পুঁথির পাতা ছয় ফুট লম্বা, দেড় ফুট চওড়া, বইগুলি লোহা দিয়ে বাঁধানো। এগুলি সম্রাট কুবলাই খানের (১২১৫-১২৯৪) আদেশে তৈরি হয়েছিল। 

৫ ডিসেম্বর ১৮৮২ শাক্য ছেড়ে চোসখোর ইহুনপো মনাস্ট্রি ছেড়ে লোনা গ্রাম হয়ে ইয়াহুগ নদী পার হয়ে ডংলা পাহাড়ে উঠলেন। চূড়া থেকে পশ্চিম দিকে অনেক শৈল শৃঙ্গের মধ্যে মাউন্ট এভারেস্ট (চোমো কানকার) দেখলেন। ডংলা পাহাড় থেকে কোশি নদী উৎপন্ন হয়েছে। 
এরপর পথ গেছে এক বিশাল রুক্ষ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে, যার চারপাশে উত্তুঙ্গ শিখর শ্রেণী। মাপ-যা, ডনকার হয়ে সং-চু নদীর গতিপথ ধরে শন-পা-লা -এর দিকে চলা। শ্রীমঙ বলে এক ইঁদুর জাতীয় প্রাণী অনেক মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রেখেছে। ঘোড়ার পা সেই গর্তে পড়ে চলায় অসুবিধা তৈরি করছে। শোন-পা পাহাড় পেরিয়ে চিব-লুঙ উপত্যকা এল। তারপর এল ডোবটা-লাচেন-লা। এখান থেকে তিব্বতের অনেক অংশ এবং নেপাল ও সিকিম হিমালয়ের কিছু অংশ দেখা যায়। এরপর আরো বেশ কিছু গ্রাম, উপত্যকা পেরিয়ে তাঁরা খাম্বায় এলেন। সেখানকার দুর্গে লামাদের সঙ্গে দেখা হলে লেখক অনুমতি পত্র দেখালেন। লামারা সীল দিয়ে অনুমোদন করলেন এবং লেখককে চাল, ভেড়ার চামড়া,কম্বল উপহার দিয়ে আগামী বছর আবার দেখা হওয়ার আশা প্রদান করলেন। 

এরপর গাইড গোপানকে বিদায় জানিয়ে নতুন দুটি ঘোড়া আর চমরি গায়ের লোমের তাঁবু ভাড়া নিয়ে ফুর্চুং-এর সঙ্গে লেখক চললেন। পথে অনেক বন্য ভেড়া আর কিছু শেয়াল দেখলেন। এবার এল কংরা ল্যামো পাস। অত্যন্ত সুন্দর ও বন্য এই জায়গায় কোন জনবসতি না থাকায় তাঁদের চোমরির লোমের তাঁবুটি কাজে লাগল। রাতে অসম্ভব শীত আর কনকনে হাওয়া প্রতিহত করতে ফুর্চুং সারারাত আগুন জ্বালিয়ে রাখলো। 

পরের দিন ১০ ডিসেম্বর, লেখক এলেন গেন-গাং, যা তিব্বত, সিকিম আর ভারতের সীমান্ত। এরপর সিকিম হয়ে পর্যটকদের প্রচলিত পথে ২৭ ডিসেম্বর ১৮৮২ লেখক দার্জিলিং-এ তাঁর বাড়িতে ফিরলেন এক বছরের বেশি সময় পরে। 

শরৎচন্দ্র দাস তিব্বত থেকে যে বই ও জ্ঞান সংগ্রহ করে এনেছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিব্বতি ভাষার অভিধান-ও রচনা করেছেন। 

১৮৮৫ -তে কোলম্যান মেকলে নামক প্রশাসক যখন তিব্বতে একটি মিশন প্রেরণ সম্পর্কে অনুমোদন লাভের জন্য চীনের রাজধানী পেকিং গেছিলেন তখন শরৎচন্দ্র দাস তাঁর সঙ্গী ছিলেন। এই যাত্রা সম্পর্কে তিনি কিছু লিখে যান নি, তার ফলে বিশদ জানা যায় না।

৭০। তিব্বত অভিযান ৩ - শরৎ চন্দ্র দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


          (আগের পর্বের পরে)

শরৎচন্দ্র দাসের প্রথম তিব্বত ভ্রমণকালে তাশীলহুনপো মঠে ছয় মাস কাল প্রধানমন্ত্রীর অতিথি হিসেবে ছিলেন। সেই সময় মন্ত্রী তাঁর কাছ থেকে পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন এবং সেই সভ্যতা সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হন। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় লেখকের দ্বিতীয় বার তিব্বত যাত্রা৭ নভেম্বর ১৮৮১ দার্জিলিং থেকে যখন শরৎচন্দ্র তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তখন তাঁর মন আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল। 

লামা উগ্যেনের সঙ্গে তিন-চারটে বাঁশ দিয়ে তৈরি নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে সরু পিচ্ছিল পথে গভীর রাতে পরিত্যক্ত গোক গ্রামে পৌঁছলেন। ঘাসের উপর কম্বল পেতে বৃষ্টিতে ভিজে রাতে কিছুটা শুয়ে কাটিয়ে ভোর চারটেয় আবার যাত্রা শুরু হল দুর্গম পথে। সকালে রাম্মাম উপত্যকায় পৌঁছলেন তাঁরা। রঙ্গিতের একটি শাখা নদী রাম্মাম ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন সিকিমের মধ্যে সীমানা রচনা করেছে। 

দার্জিলিং থেকে এই পর্যন্ত লেখককে কেউ দেখতে পায়নি। এবার তিনি ভারতীয় পোশাক ছেড়ে তিব্বতি পোশাক পড়ে নিলেন। তারপর পাহাড়ে ক্রমাগত ওঠা ও নামা করতে করতে তাঁরা ধুরামদিয়েন উপত্যকায় (ভুটিয়াদের ভাষায় চোর্টেন গাঙ) এসে পৌঁছলেন। পথে অনেক অ্যান্টিলোপ আর বন্য ছাগল দেখলেন। এখানকার গ্রামবাসীরা এত গরীব যে তাদের বন্দুক কিনে এসব জন্তু মারার পয়সা নেই। লিম্বু উপজাতিরা জমি চাষ করে না। তারা এক জমিতে তিন চার বছর চাষ করে আর তিন বছর চাষ না করে ফেলে রাখে। তারপর আগাছা আগুনে পুড়িয়ে আবার চাষ করে। লিম্বুদের অনেক বিচিত্র রীতিনীতি আছে। যেমন ছোটখাটো বিষয়ে তারা ড্রাম বাজায়। উদাহরণ - স্বামী যখন গ্রাম থেকে বের হয়ে যায় আর গ্রামে ফেরে তখন স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে স্বামীর সম্মানে ড্রাম বাজায়। 

এরপর এল নিবিড় বন লম্বা পাইন ও ম্যাগনলিয়া গাছের আর বিরাট বিরাট ফার্নের। বুনো শুয়োরের পায়ের চিহ্ন দেখে আর অনেক ছোটো ঝোরা পেরিয়ে দুপুরে ৬০০০ ফুট উপরে উঠে পরিশ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা পেলেন না, কারণ সর্বত্র জোকে ছেয়ে আছে। অবশেষে পাহাড় থেকে নীচে নেমে ধর্মীয় লাল কাপড় বাঁধা বাঁশ গাছের ঝোপের ধারে একটা ওক গাছের নীচে রাত্রিযাপন। ভুটিয়া, লেপচা, লিম্বুদের বাড়ি সম্বলিত সমৃদ্ধি হী গ্রামের পাশ দিয়ে তাঁরা চললেন। দেখলেন এলাচ চাষ হয়েছে। নীচে কালাই বা কালহাইত নদী পার হওয়ার জন্য এখানে দুটি বাঁশের তৈরি সাঁকো রয়েছে। এই নদীতে বাঁশের জালে লিম্বুরা সুস্বাদু মাছ ধরে। আবার পাহাড় চড়া লম্বা লম্বা ঘাস বনের ভিতর দিয়ে। এখানে বুনো শুয়োর আর শজারু প্রচুর আছে। উপর থেকে পেমিয়ানশি, হী, ইয়াংতে প্রভৃতি জায়গা দেখা যাচ্ছে। 

এরপর ক্রমে লিংচাম, সাংনাগ চোইলিং মঠ, তালে গ্রাম, নামবুরা গ্রাম হয়ে পথ চলা। লেখক পাখি বিশেষ করে ফেসান্ট শিকারী দেখলেন, যারা পাখি শিকার করে স্টাফড পাখি বিক্রি করে দার্জিলিং শহরে। কেটা গ্রামে তাঁরা রইলেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে। সেই জঙ্গলে ভালুক, শুয়োর আর লেপার্ডদের স্বর্গরাজ্য। এর পরের পথ আরো আশংকায় কাটল যখন তাঁরা খবর পেলেন এক নরখাদক বাঘ দুজন নেপালি কাঠুরেকে সিঙ্গালিলাতে মেরেছে। গত বছর একটা বাঘ অনেক চমরি মেরেছিল। সবাই ভয় পাচ্ছিল যে যদি সেই বাঘ এখানে ফিরে আসে চমরির লোভে। 

ইয়াম-পুং-লা যদিও জংরি-লার মত উঁচু নয় কিন্তু এখানে ওঠা আরো শক্ত। তারপর দু-লা (দানব পাহাড়) যা চড়ার সময় উগ্যেন ও একজন কুলি অসুস্থ হয়ে পড়ল। বরফের মধ্যে দিয়ে হাঁটা এত কঠিন যে লেখক দুই হাত ও দুই পা ব্যবহার করে চলতে থাকেন। 

২০ নভেম্বর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, হালকা বাতাস বইছিল। গাইড ফুর্চুং কিন্তু তুষার ঝড় আসবে আশঙ্কা করছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে সে নিজের জিনিস তুলে নিয়ে রওনা হল। তাঁরা নোগা পাস উঠতে থাকলেন। এক মাইল উপরে ওঠার পর তাঁরা একটি বরফ হয়ে যাওয়া লেকের কাছে পৌঁছলেন। গাইড সামনে গিয়ে কিছু বরফের টুকরো নিয়ে লেকের ওপর ছড়িয়ে পথ নির্দেশ করতে লাগল যাতে কেউ পিছলে পড়ে না যায়। সেই পথ অনুসারে অন্যরা যেতে থাকল গাইডের পিছনে পিছনে। কিছুক্ষণ পর গাইড ভয়ে হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল যে আর এগিয়ে কি লাভ, মৃত্যু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ঘন্টা আছে, তারপর আমরা শেষ। লেখক জানতে চাইলেন কোথায় সে মৃত্যু দেখছে। গাইড আকাশে দেখাল মেঘগুলো খুব তাড়াতাড়ি সূর্যের উপর দিয়ে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। সেগুলি নাকি খুব তাড়াতাড়ি গভীর বরফপাত ঘটাবে। কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। বাঁচার একমাত্র রাস্তা বোগটা-লাতে ফিরে যাওয়া। সে কাঁদতে লাগল। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে ফেরা সম্ভব নয়। তাছাড়া আবারও বরফ পড়তে পারে ফিরে যাওয়ার পর। তাহলে তো আবার ফিরে যেতে হবে। এসব অনেক বুঝিয়ে গাইড ফুর্চুং-কে রাজি করানো হল। লেখক নিজে নেতৃত্ব দিলেন এবং এক ঘন্টা পরে তাঁরা পাসে পৌঁছলেন। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। নীল আকাশকে স্বর্গ মনে হচ্ছে। সূর্যের আলো সব ভয় দূর করে দিয়ে গেছে। 

আর ঘন্টাখানেক চলার পর তাঁরা একটি তিব্বতের লম্বা লেজওয়ালা লেপার্ডের পায়ে চলার ছাপ দেখতে পেলে নরম বরফের ওপর। লেখক যখন বিস্ময় প্রকাশ করলেন যে কি করে এত নরম বরফের উপর দিয়ে লেপার্ড যেতে পারে। তখন সঙ্গীরা বলল লেপার্ডের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে। 

আরও ঘন্টাখানেক চলার পর লেখক যখন অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে হাঁটার ক্ষমতা হারালেন গাইড তাঁর জিনিসপত্র (অভঙ্গুরগুলি) বরফের ওপর ছুঁড়ে দিল, ঢাল বেয়ে তা নেমে গিয়ে পাথরে আটকাল। এবার একই পথে লেখক ঢাল বেয়ে শুয়ে নেমে গেলেন। বিকেলে তাঁরা চুলনকিওক -এর গিরিপথে নেমে গেলেন। এরপর সেমারাম পাস থেকে নামার রাস্তা গভীর বরফের মধ্যে দিয়ে ফুর্চুং কিছুতেই খুঁজে পেল না। শেষে তাঁদের উপর থেকে বরফে গড়িয়ে  কয়েকশ ফুট নীচে নামতে হল। খরগোশ, চামডাং নামের এক রকম পাখি এবং তুষার চিতার পায়ের চিহ্ন দেখলেন লেখক সেখানে। 

কাংপা-চান গ্রামে গাইডের বাড়ি। সেখানে তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে লেখকের দেখা হল। ক্রমে তাঁরা মান্ডিং গুম্ফাতে পৌঁছলেন। সেখানে তিব্বতে ঢোকার অনুমতি পাওয়ার জন্যে ফুর্চুং লামা ও গ্রামের মাথাদের সঙ্গে অনেক আলোচনা করে রাজি করাল। লেখক অনুমতি পেলেন। তারা তাঁকে তীর্থযাত্রী হিসেবে গণ্য করল এবং স্বীকার করল লেখক তিব্বতি পোশাক পরেন, তিব্বতি রীতিনীতি মানেন ও বেশিরভাগ নেপালির থেকে ভালো তিব্বতী বলেন। প্রধান লামা দেখা করে তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং এক বছর পর পুনরায় দেখা হওয়ার হওয়ার শুভেচ্ছা জানালেন। 

এবার যাংগমা নদীর পাড় ধরে যাত্রা, যদিও বরফে ঢাকা নদীকে আলাদা করে চেনা যায় না। কোথাও প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। সেই বরফের দেশে তারপর চ্যাং-চুব-গ্যা-লা হিমবাহতে উঠতে হল। পথে অনেকবার লেখককে ফুর্চুং পিঠে করে তুলেছে। রাত কাটানোর একটি গুহা গাইড চিনত কিন্তু অন্ধকার রাতে কিছুতেই পথ চিনে সেখানে পৌঁছানো গেল না। বরফের ফাটলে পড়তে পড়তে বাঁচলেন তাঁরা। অবশেষে পাথরের উপর সারারাত হাঁটুতে মুখ গুজে বসে কাটালেন ক্ষুধা তৃষ্ণায়, অস্বাভাবিক ঠান্ডায়। কী যে বিভীষিকাময় রাত সেটি ছিল তা ভাবা যায় না। 

পরদিন গাইড ও কুলিরা মন্ত্র পাঠ করতে করতে পিঠে বোঝা তুলে নিল। দিনটা খুব ঝকঝকে ছিল। কাংলা চান সামনে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছিল সূর্যের সোনালী আলোতে। আর নতুন বরফপাত হয়নি। অত্যন্ত বিপজ্জনক পথে গাইড সামনে লাঠি দিয়ে বরফ পরীক্ষা করে করে এগিয়ে আর অন্যদের জন্য নরম বরফে পা রাখার জায়গা বানাতে বানাতে চলল। লামা উগ্যেনকে ফুর্চুং-এর কয়েকবার পিঠে নিতে হল। 

ঘন্টাখানেক চলার পর কাংলা চেনের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছলেন তাঁরা। সেখান থেকে বরফের সমুদ্র ছাড়া যেন কিছু দেখা যায় না। তুষার ধ্বসের গর্জন দূর থেকে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে। উত্তুঙ্গ সাদা শৃঙ্গগুলি আকাশ ছুঁয়েছে। লেখকের মনে ভয় দূর হয়ে আশ্চর্য আনন্দের ভাবে ভরে উঠল। সঙ্গে এই পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা উপলব্ধি করলেন। 

পরদিন গাইডের পদচিহ্ন অনুসরণ করে দর্রেজে-তাগ রেঞ্জের পাহাড়ের চড়াই পেরিয়ে নীচে এসে রডোডেনড্রন, জুনিপার গাছ দেখলেন বেশ কয়েকদিন পরে। নদীর জলে শব্দ শুনলেন অনেকদিন পর। আর দুদিন পর রান্না করা ভাত আর বাটার চা খেলেন পরম স্বস্তিতে। 

এরপর নদীর গতিপথ ধরে আরো নেমে চলা। এখানে চমরি গাই পালন করা হয়, তাই মাঝে মাঝে নেকড়ের দল তাদের আক্রমণ করে খেতে আসে। এইভাবে ক্রমাগত আরো সাত দিন চলার পর অবশেষে তাঁরা নয় ডিসেম্বর তাশীলহুনপো গিয়ে পৌঁছালেন। পথে একবার তাঁরা এক টাকায় দুটি চমরি ভাড়া করে তার পিঠে সাত মাইল পথ অতিক্রম করেছিলেন। 


মন্ত্রীর প্রতিনিধি শরৎচন্দ্র দাসকে পন্ডিত সম্বোধন করে সাদরে আহ্বান জানালেন। ১৮৮২ এপ্রিল মাসে লেখক তাশীলহুনপো থেকে ডঙটসে যান লাসা যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেখানে যাবতীয় বন্দোবস্ত করে ১২ মে ১৮৮২ তিনি লাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ডংটসে থেকে। মন্ত্রী মহোদয় শরৎচন্দ্রকে আশীর্বাদ করে সাবধান করলেন লাসার মানুষরা তশীহুনপোর মানুষের মতো ভালো নয়, তিনি যেন বেশি দিন কোথাও না থাকেন। লামারা যেন শহরের বাইরে কোথাও থাকেন। তাছাড়াও গুটি বসন্তের প্রকোপ হয়েছে, লাসাতে। সেজন্য তিনি সতর্ক থাকতে বলেন। এবার উগ্যেন লামা ও ফুর্চুং সঙ্গে নেই। সম্পূর্ণ দুজন নতুন সঙ্গীর সঙ্গে তিনি রওনা দিলেন। এবারে তাঁর সঙ্গী দুজন হলেন সেরিং তাশী আর পাদোর

                        (চলছে)

৬৯। তিব্বত অভিযান ২ - শরৎ চন্দ্র দাস



সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


          (আগের পর্বের পরে)

কামবাচান মঠের বড় লামা লেখকদের সহায়তা করলেন। তিনি গোপনে খবর দিলেন যে ওই আধিকারিক গ্রামে এসে পৌঁছানোর আগে লেখকদের গ্রাম থেকে রওনা দিতে হবে চা-থাং-লার উদ্দেশ্যে। 

পরদিন খুব ভোরে যাত্রা করে মাইল তিনেক গিয়ে এল কান-ডুম-চু জলপ্রপাত, যা খুব পবিত্র। এখানে আট জন ভারতীয় সাধু, যাঁরা অষ্টবিদ্যাধর তাং-শ্রুং-গ্যাপা নামে পরিচিত, তাঁরা এখানে স্নান করেছিলেন। হাজার ফুট উঁচু থেকে নামা এই জলপ্রপাত অপূর্ব সুন্দর। পথে একটা ছোট কুন্ড দেখলেন। বৌদ্ধ গুরু পেমা এখানে স্নান করেছিলেন বলে এটি পবিত্র। 

সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা যে গুহায় আশ্রয় নিলেন তার মালিক এক পার্বত্য শেয়াল। গাইড জানাল সেখানে মাস্ক গোট, হিমালয়ের অ্যান্টিলোপ আর নাও  (ওভিস আম্মন) অনেক আছে। স্থানটি ১৮৮২০ ফুট উঁচু। তাঁরা চা আর ভুট্টা খেয়ে রাত কাটালেন। পরদিন পথ চলার সময় লেজহীন একরকম ছোট ছুঁচো দেখলেন যারা নাকি বরফের উপর গজানো মস (moss) খেয়ে থাকে। 

এরপর শুধু বরফ আর বরফ। উনিশ হাজার ফুটের উপর উঠে তাঁদের নিঃশ্বাসের খুব সমস্যা হতে লাগল। সঙ্গে বরফের উপর সূর্যের আলোর ঝলকানিতে চোখে খুব কষ্ট হতে লাগল নীল চশমা থাকা সত্ত্বেও। চলা অসম্ভব হলেও চলতে হল কারণ রাতে থাকার মত কোন জায়গা পাওয়া গেল না। অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় একটা জায়গা পেয়ে গাইড রাতে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করল। সেখানে বড় পাথরের ওপর বরফ জমে শক্ত হয়ে আছে। রাতে বরফ গলবে বলবে না বলে পাথর খসে পড়ার ভয় নেই যতক্ষণ না ভোর হচ্ছে। তাই ভোরে আবার যাত্রা শুরু হবে ঠিক করে খালি পেটে তাঁরা বরফের ওপর কম্বল পেতে রাত্রি যাপন করলেন। 


পরদিন ভোরে যেন বরফের সমুদ্রে তাঁদের যাত্রা শুরু হল। বরফে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে আছে। লেখকের পা অবশ হয়ে এল আর চলা যাচ্ছে না। তখন লেখকের পাহাড়ে সাথী গাইড ফুর্চুং তাঁকে পিঠে নিয়ে বেশ কিছু দূর পার করিয়ে দিল। তারপর লেখক আবার চলতে পারলেন। কিন্তু এরপর এল এক বিশাল ঢাল যার উপরে উঠে অন্যদিকে পৌঁছলে রাতে থাকার জায়গা মিলবে। লেখক বারবার পা পিছলে নীচে গড়িয়ে পড়তে থাকেন। তিনি ভাবলেন এবার বরফে ডুবে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। গাইড ফুর্চুং আবার এগিয়ে এল। কুকরি দিয়ে বরফ কেটে লেখককে পা রাখার সিঁড়ি বানিয়ে দিয়ে, তাঁকে হাত ধরে টেনে তুলতে থাকল। অবশেষে সন্ধ্যে ছটায় তাঁরা একটা পার্বত্য গুহায় পৌঁছলেন, যা বেশ বড়, যেখানে রাতে বেশ আরামে থাকা যাবে। আরামে অর্থাৎ বরফের ওপর কম্বল পেতে শোয়া, গুহার ছাদের ফাটল দিয়ে জল পড়ে ভেজা জামা কাপড়ে রাত কাটানো। 

এইভাবে এই পথে সব থেকে শক্ত অংশ চা-থাং-লা পেরোলেন তাঁরা, যা সম্ভবত কুড়ি হাজার ফুট উঁচু। পরদিন ছয় ঘন্টা পাড়ি দিয়ে এই পাস থেকে নামলেন। এরপর তাঁরা চীনের সঙ্গে নেপাল ও সিকিমের সীমান্তে উপস্থিত হলেন। এখানে গাইড খুব ভীত হয়ে পড়ল দোগপাদের জন্য। দোকপারা এই পাস পাহারা দেয়। লেখকরা পর্যটকদের জন্য বন্ধ এই পাসে এসেছেন অবৈধভাবে, তাই তাঁদের পাসপোর্ট কাজে লাগবে না। শাস্তি এড়াতে তাঁরা সন্ধ্যা পর্যন্ত গুহায় লুকিয়ে থেকে রাত্রির অন্ধকারে এক মাইল চওড়া নদী পাথরের উপর দিয়ে পার হলেন। 

এরপর উঁচু পাহাড়ে খাড়াই পথ ধরে এলেন চর্তেন-ন্যিমা-লার দক্ষিণ দিকে। চাঁদের আলোয় অল্প বরফ পড়া মাটিতে কম্বল পেতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন তাঁরা। পরদিন চলার পথ খুব খাড়াই না হলেও কষ্টকর ছিল। তিনদিন কোন খাবার তাঁরা খাননি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর অবস্থায় আট মাইল হেঁটে চর্তেন-ন্যিমা-লার দক্ষিণ দিকের পাদদেশে পৌঁছালেন তাঁরা। 

ফুর্চুং-এর সাহায্যে লেখক সেই সুউচ্চ পাসের ওপর উঠলেন। নীচে তিব্বতের মালভূমি দেখা গেল। এবার নামার পালা, তিনটের সময় তাঁরা নীচে এক সুন্দর লেকের ধারে নেমে এলেন। আয়নার মতো স্বচ্ছ লেকের জলে চারপাশে শৃঙ্গগুলির আর নীল আকাশের ছায়া পড়েছে। লেক থেকে নির্গত হয়ে চর্তেন ন্যিমা নদী বয়ে গেছে। সেই নদী অনুসরণ করে এবার পথ চলা। ভুট্টা আর চিনি খেয়ে এবার নীচে চলা শুরু হল। হিমালয়ের উত্তর দিকে চারপাশে গাছপালা নেই বললেই চলে (কারণ এই তিব্বত হিমালয় বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে পড়েছে। বৃষ্টিপাত এখানে নগণ্য)। 

সব সময় তাঁদের মনে ভয় যে চর্তেন ন্যিমা গুম্ফাতে যেসব প্রহরী রয়েছে তারা হয়তো দেখে ফেলবে, তাই তাঁরা যতটা সম্ভব বড় বড় পাথরের চাইয়ের আড়াল দিয়ে চলছিলেন। কখনো কোনো পাথর দেখে মনে হচ্ছিল চমরি বা ঘোড়া আসছে। তখন তাঁরা সটান মাটিতে শুয়ে পড়ছিলেন। এইভাবে পাঁচ মাইল পথ পেরিয়ে এক জায়গায় তাঁরা পৌঁছালেন যেখানে অতি প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধদের তৈরি সৌধ আছে। তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, চীন থেকে প্রতিবছর তীর্থযাত্রীরা এখানে আসে। মঠে কোন মানুষ নেই। 

পরবর্তী পথে দু'পাশে সাদাকালো সবুজ রঙের স্লেট পাথর দেখতে থাকলেন, যা এই প্রথম এখানে দেখা গেল। একটানা চলতে চলতে তাঁরা গভীর রাতে তাঁরা থেকং গ্রামের কাছে মূল রাস্তার দেখা পেলেন। তারপর খোলা আকাশের নীচে কম্বল পেতে ঘুম। পরদিন চলার পথে ক'জন পর্যটকের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। তারা সারে চলেছে। লেখককে নেপালি তীর্থযাত্রী বলে পরিচয় দিল গাইড। তাঁরা টাং-লুং নামের একটি গ্রামে আশ্রয় নিলেন একটি বাড়িতে। অনেক গ্রামবাসী তাঁদের দেখতে এল। এসে তারা ভিক্ষা চাইতে লাগল। একজন ফেরিওয়ালা তার স্ত্রীকে নিয়ে তাঁদের কাছে এসে নাচ গান করে গেল তাঁদের শুভযাত্রা কামনা করে। পরদিন ভেড়ার মাংস কিনে খেলেন তাঁরা অনেক দিন পর। ডিমও কিনে নিলেন কিছু। তারপর ঘোড়া ভাড়া করে যাত্রা শুরু হল। 

এবার আরামদায়ক যাত্রা। সুন্দর খান-লা-ডংকি-চু নদীর ধার দিয়ে। থেকে থেকে বার্লি চাষ হয়েছে। চমরি, ভেড়া, ছাগল মাঠে চড়ছে। অজস্র গর্ত থেকে শয়ে শয়ে মারমট এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা ছোট গ্রামে তাঁরা পৌঁছতে জনা কুড়ি গ্রামবাসী এসে তাঁদের কাছে জড়ো হল তাঁরা কি বিক্রি করতে এসেছেন জানতে। লেখকের রিভলবার এবং লামার পিস্তল তাদের পছন্দ হলো ও তারা কিনতে চাইল। মোড়ল চমরি গায়ের লোমের আসনে বসিয়ে বার্লি বিয়ার আর বাটার দেওয়ার চা খাওয়াল। রাতে আরেকটি গ্রামের পথিকদের ছাউনিতে থাকা হলো। 

পরদিন পথে কয়েকজন বিক্রেতার সঙ্গে একপাল গাধাকে পেরিয়ে দুপুরে গুরমে নামক শহরে পৌঁছলেন। সেখানে ৬০০ পরিবারের বাস, এরা পশুচারণ করে। নিকটবর্তী পাহাড়ে পশু চড়ায় পশুর চামড়ার তাঁবুতে থে। ফুর্চুং মাংস আর বিয়ার সংগ্রহের জন্য সেই গ্রামে যেতে কুকুর আর গ্রামবাসীরা তাকে ডাকাত মনে করল। পরে সবাইকে দেখে তারা তাঁদের গ্রামে ঢুকতে ও সব খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে দিল। এখানে তাঁরা খবর পেলেন যে কাছে ডাকাতের দল ঘুরছে। লেখক ও লামা তাঁদের বন্দুক, তরোয়াল, ভুটানি ছোরা তৈরি রাখলেন। 

পরদিন যাত্রাকালে দুপুর বেলা বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি হল। ভিজে অবস্থায় তাঁরা মেষপালকদের আস্তানায় আশ্রয় নিলেন। সেই আস্তানায় গোবরের ওপর কম্বল পেতে শুলেন, ভাত আর মাংস রান্না করে খেয়ে। বিকেলে মেষপালকের দল সেখানে ফিরল। তারা সংখ্যায় ৫০০ কম নয়। কুলিরা মেষপালকদের বোঝাল লেখকরা বড় লামা আর ব্যবসায়ী। মেষপালকেরা যেন তাদের বিরক্ত না করে। মেষপালকরা বলল গতকাল ডাকাত এসে তাদের থেকে ভালো ভালো ভেড়া নিয়ে গেছে। লেখকেরা যে ডাকাত নয় তাতেই তারা খুশি। এবার কজন তিব্বতি লেখকদের সহযাত্রী হল। ডাকাতের ভয়ে সবাই সঙ্গী পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হল। ক্যাগো-লা গিরিপথ বেয়ে এবার পথ উতরাই। 

পথে প্রথমে এলো রি নদীর ধার। সেখানে ভেড়া চড়ছে। দুটি বিশাল পাহারাদার তিব্বতি কুকুর অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ভাবে তাঁদের তাড়া করল। তাদের নিরস্ত করা যখন গেল না তখন একটিকে লামা গুলি করে মারল , অন্যটি ফিরে গেল। পরদিন এল লেখকের দেখা প্রথম তিব্বতের বৌদ্ধমঠ রি-গনপা বা রি মনাস্ট্রি। এই প্রাচীন মঠে ৩০০ লামা থাকেন ও তন্ত্র মতে সাধনা করেন। বড় লামা নাকি তুষারপাত নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা জানেন। অনবরত তুষারপাতের মধ্যে তাঁরা ক্যা-গো-লা পাসের শীর্ষে পৌঁছলেন। সেখানে নদীর পাথরের ওপর কম্বল পেতে বৃষ্টি আর অসম্ভব ঠান্ডায় হাত-পা অসার অবস্থায় রাত কাটালেন। 


সকালে খালি পেটে অত্যন্ত ঢালুপথে পাস থেকে নামতে থাকলেন তাঁরা। বিকেলে একটা গ্রামে চা, বিয়ার আর বার্লি খেতে পেলেন। পরদিন গ্যা-লা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে তার শেষ প্রান্তে লেখকের গন্তব্য স্থল তাশিহুনপো দেখতে পেলেন। নীচে মধ্য তিব্বতের অন্যতম সুন্দরতম দৃশ্য। পেনাম-ন্যাং চু নদী বয়ে যাচ্ছে। নীচে নেমে ক্রমে তাশিহুনপো মঠের সোনালী চূড়া চোখে পড়ল। পথে অনেক লামা, ব্যবসায়ীদের ঘোড়া, চমরি, গাধার পিঠে যেতে দেখা গেল। 

অবশেষে জংরি থেকে যাত্রা শুরু করার ২১ দিন পরে ৭ জুলাই ১৮৭৯ তাঁরা তাশিলহুনপো পৌঁছালেন। এরপর নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে লেখকের মানিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম, প্রধান লামা, মন্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে কাটানো সময় এইসব আকর্ষণীয় হওয়া সত্ত্বেও ভ্রমণ কাহিনীর অন্তর্গত করে একে ভারাক্রান্ত না করে এখানেই তাঁর ভ্রমণের প্রথম পর্ব শেষ করা হল। তাশিলহুনপোতে থাকার সময় ঘোড়ায় করে তিনি ও লামা উগ্যেন সাংপো থেকে ঘুরে এসেছিলেন। 

এর পরবর্তী পর্যায়ে তিব্বতের যে ভ্রমণ কাহিনী বর্ণিত হবে তা নেওয়া হবে "জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্টার টিবেট" নামে শরৎচন্দ্র দাসের লেখা অন্য বইটির থেকে।

                        (চলছে)

৬৮। তিব্বত অভিযান ১ - শরৎ চন্দ্র দাস

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



শরৎচন্দ্র দাস (১৮৪৯-১৯১৭) তাঁর "জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট"এবং "অটোবায়োগ্রাফি : ন্যারেটিভ অফ দা ইন্সিডেন্টস অফ মাই আরলি লাইফ" নামক দুটি বইয়ে নিজের ভ্রমণ (মূলতঃ তিব্বত) সম্পর্কে যা লিখেছেন, তা এই পোস্টের উপজীব্য বিষয়। যদিও তাঁর ভ্রমণকে ভ্রমণ না বলে অভিযান বলা উচিত। দুটি বই-ই ইংরেজিতে লেখা কিন্তু যেহেতু বইটি বাঙালির ভ্রমণ কাহিনী তাই এই ব্লগের অন্তর্ভুক্ত হল। জার্নি টু সেন্ট্রাল টিবেট বইটি জন মুরে, লন্ডন থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। অটোবায়োগ্রাফি: ন্যারেটিভস অফ দ্য ইনসিডেন্স অফ মাই আরলি লাইফ প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে ১৯৬৯-এর মার্চ মাসে। যদিও দ্বিতীয় লেখাটি প্রথমে প্রবাসী নামক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

শরৎচন্দ্র দাস ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যালেরিয়ার কারণে স্বাস্থ্য উদ্ধারের পড়া স্থগিত রেখে দার্জিলিংয়ের ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের হেডমাস্টারের চাকরি নিয়ে দার্জিলিং যান। জার্নি টু লাসা বইয়ের মুখবন্ধে ডব্লু ডব্লু রকহিল (আমেরিকান কূটনীতিক এবং প্রথম তিব্বতি ভাষা জানা আমেরিকান) লিখেছেন যে কলেজে পড়ার সময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয় অ্যালফ্রেড ক্রফটের, যিনি ডাইরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনস অফ বেঙ্গল ছিলেন। স্যার আলফ্রেডের সহায়তায় শরৎচন্দ্রের তিব্বত যাত্রা ভারত সরকার অনুমোদন করেছিল। যদিও শরৎচন্দ্রের অটোবায়োগ্রাফি বইতে সেরকম কোন উল্লেখ নেই। 

'অটোবায়োগ্রাফি...'বইটিতে শরৎচন্দ্রের প্রথম দার্জিলিং যাত্রা ১৮৭৬-এ, সিকিম যাত্রা ১৮৭৬ ও ১৮৭৭-এ এবং ১৮৭৭-এ তিব্বতের তাশিলহুনপো যাত্রা বর্ণিত হয়েছে। 'জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট' বইতে ১৮৮১-১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্রের তিব্বতের লাসা ও মধ্য তিব্বত যাত্রার কথা বর্ণিত হয়েছে। 

দার্জিলিং-এর ভুটিয়া স্কুলে চাকরিতে যোগদান করার সময় সাহেবগঞ্জে ফেরি স্টিমারে কারাগোলা ঘাট গিয়ে সেখান থেকে মোষের গাড়িতে পূর্ণিয়া হয়ে তিনি শিলিগুড়ি যান। শিলিগুড়ি থেকে কালাবাড়ি পর্যন্ত ঘোড়া চলার রাস্তায় পায়ে হেঁটে যান। তারপর কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং ঘোড়ায় করে যান। সেই তাঁর প্রথম ঘোড়ায় চড়া। 

দার্জিলিং গিয়ে দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার জন এডগারের কাছে তিনি জানেন যে মূলত সিকিমের রাজার ছেলে ও সিকিমের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ছেলেদের ইংরেজি শেখানোর জন্য এই স্কুল খোলা হয়েছে। উগ্যেন গ্যাটসো নামের এক অল্পবয়স্ক লামাকে পেমিয়াংশী মঠ থেকে আনা হয় তাঁকে সহায়তা করার জন্য। কিছু স্থানীয় ভুটিয়া শিশুও এই স্কুলে ভর্তি হয়। কাজের প্রয়োজনে তিনি ভুটিয়া শিখে যান এবং তিব্বতি ভাষা শিখতে শুরু করেন কারণ দার্জিলিং-এর ভুটিয়ারা তিব্বতি বলত আর সিকিমের ভাষা হল তিব্বতী ভাষার একটি উপভাষা। সঙ্গী লামাও তিব্বতি ও ইংরেজি শিখতে থাকেন। তিব্বতি ভাষা শেখার সময় লেখক এই ভাষার সাহিত্যের গভীরতা ও প্রাচুর্য দেখে মুগ্ধ হন। 

১৮৭৬-এ স্কুলের বালকদের নিয়ে তিনি সিকিমের পেমিয়াংশী সহ কিছু বৌদ্ধ মঠে বেড়াতে গেছিলেন। সেখানে লামাদের মুখে গল্প শুনে ও বই পড়ে তিনি জানেন ভারতীয় পণ্ডিতরা আগে তিব্বতে কত সম্মান পেতেন। মিস্টার এডগার তাঁকে তিব্বত সম্পর্কে আরো বই দিয়ে উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে তাঁকে এখানে আনার একটা উদ্দেশ্য ছিল যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে কিছু ভুটিয়া ছেলেকে তিব্বতি হিমালয় অঞ্চলে পাঠানো। সেই সময় তিব্বতে ইউরোপীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ সরকার এর আগে দুজন ভারতীয়কে তিব্বত পাঠিয়েছিল বিভিন্ন জরীপ ও তথ্য সংগ্রহের জন্য, তাঁরা হলেন নাইন সিং আর কিষেন সিং, যাঁরা যথাক্রমে ১৮৬৬ ও ১৮৮০ তে লাসায় গেছিলেন। শরৎ চন্দ্র দাসকেও ব্রিটিশরা অভিযানের অর্থ ও প্রয়োজনীয় সাহায্য দিয়ে তিব্বতে পাঠান। শরৎ চন্দ্র দাসের তিব্বতের ধর্ম ও সংস্কৃতি জানার আগ্রহও তাঁর এই অভিযানে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ ছিল।

ফেব্রুয়ারি ১৮৭৭-এ তিনি ভাই নবীনচন্দ্র দাস, লামা উগ্যেন ও সিকিমের সেনাপতি ছেলেদের সঙ্গে আবার সিকিম যান। ইয়াঙ্গাং, তাসিডিং, সংগাং চোলিং, পেমিয়াংশী প্রভৃতি জায়গায় যান তাঁরা। অটোবায়োগ্রাফি বইতে তিনি তাঁর ভাই নবীনচন্দ্র দাসের এই ভ্রমণ সম্পর্কে লেখা কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছেন, যা এরকম : ২৭শে জানুয়ারি দার্জিলিং থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁরা। পায়ে হেঁটে চললেন শ্যাওলা ধরা পাথর আর নুড়ির ওপর দিয়ে। সেখানে প্রকৃত কোন পথ নেই। ঝরনাই পানীয় জলের একমাত্র উৎস। রাতে বাঁশ দিয়ে একটু আচ্ছাদন বানিয়ে শীত এড়ানোর চেষ্টা। সামান্য বাঁশের সাঁকোতে রঙ্গীতের মতো খরস্রোতা নদী পেরতে হয়। এভাবে প্রথমে নামচির বড় বড় পাথরের তৈরি বৌদ্ধ মঠে পৌঁছান তাঁরা। প্রতিটি পাথরে তিব্বতি ভাষায় দেব দেবীর নাম বা মন্ত্র লেখা। মঠের ভিতরের দেওয়ালে বুদ্ধের নানা ভঙ্গিমার ছবি রয়েছে। মঠের সামনে আছে স্তূপ সেখানে বৌদ্ধ পতাকা উড়ছে, তিব্বতি ভাষার ছবির মত হরফে কিছু লেখা নিয়ে। এই পতাকা প্রতিটি ভুটিয়া গ্রামে দেখা যায়, যা অশুভ আত্মাকে সরিয়ে দেয় এই বিশ্বাস আছে তাদের। গুম্ফার লামার আনুকূল্যে সেখানে রাত্রি বাস করে পরদিন ঘোড়ায় চেপে পাহাড় চড়া শুরু হল। মখমলের মতো সবুজ মসে ঢাকা কাণ্ড-ওয়ালা ওক গাছের নিবিড় জঙ্গল আর গাছ থেকে ঝুলে থাকা বিশাল লম্বা লম্বা লতা। একসময় পাহাড় থেকে নামতে হলো ক্রমাগত পিচ্ছিল পথে। ঘোড়ায় নামা অত্যন্ত আশঙ্কা-জনক, রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা। রাতে টিমি নামের এক গ্রামের একটি বাঁশ ও লম্বা ঘাস দিয়ে তৈরি ঘরে রাত্রিবাস। কাঠের তক্তা দিয়ে বাড়িটিতে দুটি তল তৈরি করা হয়েছে। নীচের তলায় ছাগল, শুয়োর থাকে। ঘরের বাঁশের দেওয়ালে মাংস ঝোলানো আছে। ছাদ থেকে ঝুলছে ভুট্টার সারি। কাঠের একটা আলমারিতে বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে, সেখানে সারারাত আলো জ্বালানো ছিল। 

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুন শরৎচন্দ্র লামা উগ্যেন গ্যাটসোকে নিয়ে সিকিমের ডুবডি থেকে জংরির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। একটু বেলা হতেই চারপাশে জুনিপার, বার্চ, রডোডেনড্রনের এল ওক, চেস্টনাটের জায়গায়। ৯০০০ ফুট থেকে ১২০০০ ফুট উঁচু এই খাড়াইয়ের নাম মন লেপচা। উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জোক উধাও হয়ে গেল। বিকেল বেলায় জংরি পৌঁছে চমরি গাই পালকদের বড় বড় পাথরের চাই দিয়ে তৈরি বাড়িতে থাকলেন। ঘরের চাল কাঠের। এখানকার মানুষ করাত, পেরেক এসবের ব্যবহার জানে না। এখানকার অসম্ভব সুন্দর জংলি সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সামনে খাবুর, কাং-লা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার ধবল শৃঙ্গ। রাতে লেখক সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের দ্বারা তারা দেখে রাস্তা ঠিক করার চেষ্টা করে পারেননি ঘন কুয়াশার জন্য। 

পরদিন গাছের গুড়ির সাঁকো দিয়ে রথোঙ নদী পার হলেন। পথ চলেছে রডোডেনড্রনের বিস্তীর্ণ ঝোপের মধ্যে দিয়ে। এবার ইউম্পাং ও কাং-লার রাস্তার সংযোগ স্থলে এলেন তাঁরা। এখান থেকে সিঙ্গালীলা, ফালুট, সান্দাকফু, টংলুর দিকে পথ চলে গেছে। লেখকেরা চু-রুং নদীর গতিপথ ধরে এগিয়ে চললেন। বেলায় তাঁরা তে গিয়াক-লা পর্বতের কাছে একটা গুহায় আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনজন তিব্বতীর সঙ্গে দেখা হল। তাদের কাছে খবর পেলেন নেপালি আউটপোস্ট রক্ষীরা যাত্রায় বাধা দেবে না। এখানে কোন গাছপালা নেই, শুধু ঘাস আর লাইকেন। ১৪ হাজার ৮০০ ফিট উচ্চতায় রাতে ঠান্ডায় খুব কষ্টকর ভাবে কাটল। 

ভোরে আবার যাত্রা শুরু। সবুজ ঘাসের প্রান্তর আর চারপাশ ঘিরে সূর্য তুষার শৃঙ্গ। তারপর শুধু বড় বড় পাথরের পথ। সেখানে তিনটি ম্যার্মট দেখলেন তাঁরা। এবার তাঁরা কাং-লা শৃঙ্গের নিচে এসে পৌঁছলেন (১৬ হাজার ৩১৩ ফুট)। দুপুরবেলা মধ্য গগনের সূর্যের আলো বরফের ওপর পড়ে যে ঝলকানি তৈরি হয়েছে তাতে তাকানো যায় না। লেখক আর লামা নীল চশমা পড়লেন। কুলি, গাইডরা তাদের চোখের পাতার নীচে চোয়ালে কালো রং করেছে, এই উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ প্রতিহত করার জন্য। গাইড ফুর্চুং সাবধান করল এক মুহূর্ত অসতর্ক হলে বরফের ওপরে পা ক্রিভাস বা বরফের ফাটলে পড়লে জীবন শেষ। লেখকের ১০০ ইয়ার্ডের মতো দূরে অ্যাভাল্যাঞ্চ বা তুষারধ্বস হতে দেখলেন। 

দূরে পাথরের উপর কিছু পতাকা উড়ছে দেখা গেল। গাইড ফুর্চুং বলল এটা সিকিম ও নেপালের সীমান্ত। আরো এক মাইলের মতো একটি বরফে ঢাকা ক্ষেত্র পার হতে হবে। কিন্তু ঢাল দ্রুত বাড়ছে আর নরম বরফ ক্রমাগত সবুজ নালায় পরিণত হচ্ছে। গাইড বলল এটি নিয়াম-গা নদী, যার স্রোত সবথেকে মারাত্মক। এই নদীর জল হঠাৎ বেড়ে গিয়ে সেতু ভেঙে পর্যটকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নেপালি ভুটিয়ারা এই নদীর পুজো করে। অতি সাবধানে এই অংশ পেরিয়ে তারপর আরো ৫ মাইল হেঁটে তাঁরা একটা সমতল ভূমিতে পৌঁছলেন, যেখানে গাছপালা দেখা গেল। এই জায়গার নাম ফুরপা কারপু। নদীর গতিপথ ধরে আবার এগিয়ে চলা। মাঝেমাঝে বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরি চমরিপালক আর পর্যটকদের থাকার কিছু আস্তানা করা রয়েছে। আরো নীচে টুংগা কঙমা এল। এখানে আবার রডোডেনড্রন, জুনিপার গাছ ফিরে এসেছে। তাঁরা উচ্চতা বুঝছিলেন জলের স্ফুটনাঙ্ক এবং কখনো কখনো গাছপালার প্রকৃতি পরিবর্তন দেখে। 


এবার আবার উত্তর পূর্ব অভিমুখে হাঁটা। ইয়ালুং নদী পেরিয়ে ডেচান রোলপা মঠ দেখে সো চুঙ্গা লা পর্বতে ওঠা শুরু হল। খাড়াই পথ প্রায় আড়াই হাজার ফুট উঠতে হল। ইয়ারলুঙ্ নদী এবং ইমা-তারি-চু নদীর মধ্যে চারটি শৈলশিরা মৃগেন-লা, পাংগো-লা, সেওন-লা এবং তামা-লা, যেগুলি ১৪৮০০ থেকে ১৫০০০ ফুট উঁচু, পার হলেন। সন্ধ্যেবেলা তাঁরা কামবা-চান-গিউন্সা গ্রামে এলেন। সেখানে পরদিন মঠে গেলেন। এখানকার লামারা লম্বা কানের দুল পরেন আর মাথায় লম্বা চুল রাখেন। এখানে সবাই তাকে নেপালি লামা, পালবু লামা বলে ভাবছিল। রাতে ভাত, আলু, খাসির মাংস আর মারওয়া বিয়ার দিয়ে ভোজ খাওয়াল গ্রামবাসীরা তাঁদের। লামারা ও গ্রামবাসীরা তাঁদের তিব্বত পৌঁছতে সাহায্য করার অঙ্গীকার করলেন। 


পরদিন আবার কাং-চেন নদীর গতিপথ ধরে চলা। বাঁদিকে জান্নু হিমবাহ রেখে চলতে চলতে বিকেলে নদী পেরিয়ে কামবা-চান গ্রামে পৌঁছে নদীর স্রোতে একটা বার্লি মিল চলছে দেখলেন। চারপাশে বার্লি খেত এই গ্রামে। তিনি দেখলেন কাং-চেন শৃঙ্গের উদ্দেশ্যে গ্রামবাসীদের পুজো দেওয়া - বন্দুক ফাটিয়ে, তীর ধনুক ছুড়ে, অ্যাথলেটিক্স করে। 


মঠের বড় লামা গোপনে খবর দিলেন যে সীমান্তে আধিকারিক এখানে আসছেন এবং তিনি গ্রামবাসীদের আদেশ করেছেন যেন তারা কোনো চমরি বা মেষ বিক্রেতাকে তিব্বতে ঢুকতে না দেয় কারণ সেখানে পশুর মরক শুরু হয়েছে। চাথাং-লা পাসটি পর্যটকদের জন্য সাধারণভাবে বন্ধ থাকে আর কাং-লা চেন পাস খোলা থাকে। এবার লেখক তাঁর তিব্বতে পৌঁছানো নিয়ে অত্যন্ত সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়লেন।

                        (চলছে)

      

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...