শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪

৬। তীর্থ মঙ্গল ১ বিজয়রাম সেনবিশারদ

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                        ---- সুমনা দাম 

বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রন্থের মধ্যে প্রথম ভ্রমণ সাহিত্য হচ্ছে বিজয়রাম সেন বিশারদ-এর লেখা "তীর্থ মঙ্গল"। নগেন্দ্রনাথ বসুর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দির থেকে ১৩১৫ সনে অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কাব্যের প্রথম মুদ্রিত প্রকাশ হয়। ইছামতী নদীর তীরে নদীয়া জেলার নোনাগঞ্জের নিকটস্থ ভাজনঘাটে বাড়ি বিজয়রাম সেনের, বিশারদ তাঁর উপাধি। তিনি জাতিতে ও পেশায় বৈদ্য। সেই সময় ভাজনঘাট জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের জমিদারী ভুক্ত ছিল। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল যখন তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে কাশী যাত্রা করেছিলেন তখন পুঁটিমারিতে বিজয় রাম তাঁর সহযাত্রী হলেন চিকিৎসক হিসাবে। তবে কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি খিদিরপুর থেকে নদীয়ার পুঁটিমারি পর্যন্ত যাত্রার বিবরণ তিনি সঙ্গে না থাকলেও ঘোষাল মহাশয়ের মুখে শুনে লিখেছেন। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের সুনজরে পড়েছিলেন এবং তাঁর আদেশে এই গ্রন্থ রচনা করেন। 


গ্রন্থে বর্ণিত আছে ১১৭৭ সন ভাদ্র মাসে অর্থাৎ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হয়। এই ভ্রমণ হয় সম্ভবত ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে যা আন্দাজ করা যায় এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া অন্যান্য তথ্য থেকে । তখনকার প্রচলিত নিয়ম মতে এই গ্রন্থটি ছন্দোবদ্ধ কাব্য। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের পরিচয় এই গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর পুত্র ভূকৈলাসের প্রথম মহারাজ জয়নারায়ণ ঘোষালের লেখা করুণা নিধানবিলাস গ্রন্থ থেকে। কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা কন্দর্প ঘোষালের সময় থেকে এই বংশের ধনলাভ হয়। তিনি গোবিন্দপুরে বাড়ি করেন,পরে ইংরাজদের ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা নির্মাণের কারণে সেই স্থান ছেড়ে প্রথমে গড়া বেহালা ও পরে খিদিরপুরে বাস উঠিয়ে নিয়ে যান। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। দ্বিতীয় পুত্র গোকুলচন্দ্র লর্ড ক্লাইভের পরবর্তী গভর্নর ভেরলস্ট-এর আমলে তাঁর দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং কার্যত তিনি বাংলার সর্বময় কর্তা ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের স্বপার্ষদ কাশী তীর্থযাত্রা কালে এই গোকুল চন্দ্র সমস্ত খরচের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিজয় রামের লেখা অনুসারে গোকুলচন্দ্র খরচা বাবদ এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। এই অর্থের পরিমাণ অতিশয়োক্তি আছে কিনা জানা যায় না। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষালের এই তীর্থযাত্রা যেন রাজাদের শোভাযাত্রা। আত্মীয়-স্বজন পরিচিত ছাড়াও তাঁর নৌকা যেখানে লেগেছে, সেই স্থান থেকে যারাই তীর্থযাত্রায় আগ্রহী হয়েছেন তাদেরই সঙ্গে নিয়েছেন।


কালীঘাট থেকে কালীগঞ্জ (পায়ে হেঁটে বর্তমান গুগল ম্যাপ অনুসারে, উল্লেখ্য যে সেই যাত্রাটি ছিল নদীপথে )


১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রথম ইংরেজের অধিকারে আসে। তার অল্প কিছুদিন পরে সাধারণ জনগণের অবস্থা, চিন্তাধারা, ভৌগোলিক অবস্থান (এবং সাধারণ জনগণ ছাড়াও কিছু কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সাক্ষাৎকার হয় ) -এই সমস্ত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় এই গ্রন্থ থেকে। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল যাত্রা শুরু করলেন নৌকায়। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল অনেক বজরা, ময়ূরপঙ্খী, পালতোলা নৌকা, সরু নৌকা নিয়ে রওনা দিলেন। সঙ্গে চলল তাঁবু কানাত পালকি বহুমূল্য দ্রব্যাদি আর চলল নানা কর্মচারী - মুনসি, বকশি, সেপাই, বরকন্দাজ, হরকরা, পত্রবাহক, মশালচি। চললেন অনেক ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, বৈরাগী, বৈষ্ণব, বৈষ্ণবী। কালীঘাটে কালী পুজো করে গঙ্গায় যাত্রা শুরু হল। কৃষ্ণচন্দ্রকে বিদায় দিতে এসেছিলেন গোকুলচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র জয়নারায়ণ ঘোষাল। এরপর নৌবহর এলো শিবপুর, যেখানে কৃষ্ণচন্দ্রের নিজ বসত বাটি। তারপর চাঁদপালের ঘাট, বনমালী সরকারের ঘাট পেরিয়ে কুমারটুলির মিত্র বংশের রঘুনাথ মিত্র এবং শোভা বাজারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ মিত্র সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের সাক্ষাৎ হল। বাগবাজারের ঘাটে সেই রাতে বিশ্রাম নেওয়া হল। পরদিন ডান হাতে চিৎপুর ও বরানগর রেখে বালির ঘাটে পৌঁছে সেখানে সে রাতে থাকা হলো। পরদিন সুখচরে স্নান পূজা সেরে নৌযাত্রা শুরু হল। ফরাসডাঙ্গায় অর্থাৎ চন্দননগরে রাত্রিবাস। পরদিন হুগলিতে হুগলির দেওয়ান রাজকিশোর রায় এসে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করেন। অপর পাড়ে কুমারহট্ট হালিশহর ও কাঁচরাপাড়া ছাড়িয়ে বলাগড় এসে দামামা বাজিয়ে সে রাতে থাকা হলো। পরদিন সোমরাবাজার রেখে গুপ্তিপাড়া ছাড়িয়ে নৌকা গোকুল ঘোষের প্রতিষ্ঠিত গোকুলগঞ্জে এলো। সেখানে দশমহাবিদ্যা ও রাম লক্ষণ সীতা মন্দির ছিল সেই সময়, যা এখন আর নেই। গুপ্তিপাড়ায় রাম মন্দিরে বিদ্বান ব্রাহ্মণদের ঘোষাল কর্তা দানকার্য করলেন। পরদিন অম্বিকা, হরিনদী (নদিয়া জেলার এক সমৃদ্ধ গ্রাম গঙ্গা গর্ভে বিলুপ্ত হয়েছে), কালনা পেরিয়ে নৌকা নবদ্বীপ পৌঁছালো । এখানে তেমুয়নি (তেমোহানা) দিয়ে নৌকা খড়িয়া বা জলঙ্গি নদীতে পড়ল । বিজয়রাম নবদ্বীপকে কাশীর সমান পুণ্যস্থান বলেছেন। নবদ্বীপের বুড়াশিব আর নিত্যানন্দের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে নৌকা আবার চলল। কৃষ্ণনগরের পরবর্তী গ্রাম গোয়ারীতে রাত্রি বাস হল। তারপর দিন হ্যাঁড়রা বা হাটড়াতে রাত্রি যাপন হল। পরদিন বিজয় রাম নৌকায় কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয়ে এলেন, পুঁটিমারী নামক নদীয়ার গ্রামে। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে কবিরাজ হিসাবে নিয়োগ করলেন।

বিজয়রাম টুঙ্গিবালি নামক এক সমৃদ্ধ জনপদের কথা লিখেছেন। এই টুঙ্গিবালি বর্তমান মুর্শিদাবাদের বালিটুঙ্গী। এখানে রাত্রি বাস করা হয় এবং সহযাত্রী নিয়ে এক কপর্দক শূন্য বাঙাল বুড়ির এখানে মৃত্যু হয়, কৃষ্ণচন্দ্র নিজ খরচে তাঁর সৎকার করালেন। পরদিন মধুপুর ছাড়িয়ে রাতে কুশবেরিয়াতে বিশ্রাম নেওয়া হয়। পরদিন জলঙ্গীর মোহানা উপস্থিত হল। এখানে পদ্মা দেবী অর্থাৎ পদ্মা নদীর স্রোত খুব প্রবল জলের ঢেউয়ে যাত্রীরা ভয় পেয়ে গেল। নৌকার সঙ্গে জলজন্তুরা পালাতে লাগলো। অবশেষে নিরাপদে নৌকা জলঙ্গী অর্থাৎ পদ্মার থেকে জলঙ্গী নদীর উৎসস্থলে অবস্থিত প্রাচীন নগরে এলো। সেই সমৃদ্ধ নগর এখন পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জলঙ্গীতে জনৈক হাওলাদার চারজন সেপাই পাঠিয়ে দিলেন। আলাদা এক নৌকায় সেপাইরা সঙ্গে চলল। জলঙ্গীর অনেক বিশিষ্ট মানুষ এসে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করলেন। হিন্দুরা এসে প্রণাম ও মুসলমানেরা সেলাম করলেন। কৃষ্ণচন্দ্র প্রচুর দান করে, ধন্য ধন্য প্রশংসা শুনে, এখানে দুইদিন থেকে, নৌকাযাত্রা আবার শুরু করলেন রাতে কোদালিমারিতে বিশ্রাম নিল নৌকা। পথে রানী ভবানীর প্রসিদ্ধ নগর তারাগণ্যা দেখতে পান তাঁরা। নৌকা এরপর ভগবানগোলা হাটে এলো। এই নগরের হাটবাজারে সমৃদ্ধি দেখে সবাই মুগ্ধ হল। দুদিন এখানে থেকে নৌকা চলল। পথে এলো কালীগঞ্জ, সেখানে উত্তর বাহিনী মহানন্দা নদীর দেখা পেল যাত্রীরা। নানা রকম তৈজসপত্র কেনা হলো কাঁসার তৈরি। ধুলাউড়ি, তত্তিপুর বাঁয়ে রেখে শিবনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত শিবগঞ্জে এসে রাত্রিবাস হল। শিবনারায়ণ ছিলেন মুর্শিদাবাদ নবাবের কানুনগো দর্পনারায়ণের পুত্র। কালীগঞ্জ, শিবগঞ্জ স্থানগুলিকে কবি বন্দর বলেছেন, অর্থাৎ এখানে নদীপথে বাণিজ্য হত সেই সময়। 


                         (চলছে)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!



শনিবার, ১৫ জুন, ২০২৪

৫। শিগুর্ফ নামা ই বিলায়েত মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিন

 


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দীন-এর লেখা গ্রন্থ শিগুর্ফ নামা ই বিলায়েত হল বাঙালির লেখা প্রথম ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত জানা সর্বপ্রথম যে শিক্ষিত বাঙালি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি হলেন মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিন। যদিও তাঁর লেখা বই ফার্সি ভাষায় লেখা কিন্তু তিনি বাঙালি, সেই কারণে তাঁর গ্রন্থের আলোচনা এই ব্লগের অন্তর্গত হল। মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বইটি জেমস এডওয়ার্ড আলেকজান্ডার 'ট্রাভেলস অফ মির্জা  ইতেশামুদ্দিন ইন গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড ফ্রান্স' নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশিত করেন ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিনের ভ্রমণকাল হল ১৭৬৬ থেকে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ। 


মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিন বাংলার নদীয়া জেলার চাকদার পাঁচনুর গ্রামে আনুমানিক ১৭৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফার্সি ভাষায় দক্ষ ছিলেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরাজদের মুন্সির পদে চাকরি করেছেন। ১৭৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি লন্ডনে যান দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলমের রাষ্ট্রদূত ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইনটনের সহকারী দূত হিসেবে। বক্সারের যুদ্ধের পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাদশাহ্ শাহ আলমের এলাহাবাদ চুক্তি হয়। বাদশাহ্কে দিল্লির কাছে ইংরেজ সৈন্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা দেওয়ার শর্ত ছিল এই চুক্তিতে। এই শর্ত পূরণের অনুরোধ জানিয়ে বাদশাহ্ বিলেতের দরবারে একটি ফার্সি চিঠি পাঠান। সঙ্গে এক লাখ টাকা নজরানা। মূলত এই ফার্সি চিঠি বিলেতের দরবারে ব্যাখ্যা করার জন্য  লেখককে বাদশাহ্ বিলেতে প্রেরণ করেন চার হাজার টাকা খরচ দিয়ে। কিন্তু লেখক পথে জানতে পারেন টাকা না এসে পৌঁছনোর অছিলায় রবার্ট ক্লাইভ সেই চিঠি হস্তগত করেছেন। ফলে লেখকের এই যাত্রার উদ্দেশ্য শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে দেশে ফেরার পর তাঁর নাম হয় বিলায়েত মুন্সি। সম্ভবত ১৮০০ সালে তিনি মারা যান। 


ফার্সিতে রচিত হলেও তাঁর লেখায় বাঙালিয়ানা অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়। যেমন হিজরি সন ব্যাবহার করলেও তিনি বাংলা মাস মাঘ, কার্তিক প্রভৃতি ব্যবহার করেন হিজরী মাসের পরিবর্তে। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও মৎস্যপ্রেমী বাঙালির রূপ ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। 


১৭৬৬ -এর জানুয়ারি মাসে হুগলি থেকে জাহাজে ওঠার সময় তাঁর মন স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে যাওয়ার ব্যথায় কাতর ছিল।চারদিন পরে জাহাজ সমুদ্রে পৌঁছল। রাতে সমুদ্রের ফেনা আলোর মতো জ্বলছিল (সম্ভবত জৈবিক আলোক বিচ্ছুরণ দেখেছিলেন তিনি)। 


মরিশাসে এসে তিনি হুগলী প্রভৃতি বাংলার কিছু স্থান থেকে আগত মানুষের দেখা পেলেন। তারা সেখানে কাজ করে এবং বিবাহ করে পাকাপাকিভাবে সেখানেই রয়েছে। মরিশাসের কেন্দ্রে পাহাড়, জঙ্গল রয়েছে কিন্তু পূর্ব দিকে প্রচুর কৃষি জমি ও ছোট শহর আছে। ফরাসি দুর্গ ও ফ্যাক্টরিও আছে। ফরাসি সম্ভ্রান্তদের বাড়ির সঙ্গে নিজস্ব কৃষি জমি রয়েছে, যেখানে ক্রীতদাসরা (মাদাগাস্কার আর মালাবার থেকে চড়া দামে কেনা) কৃষিকাজ করে। এখানে খুব বড় বড় আম হয়, খুব সুন্দর স্বাদের, যার বাইরের রং সবুজ আর ভিতরে নীল। এখানে তামার পয়সা বা কড়ির প্রচলন নেই। আছে কাগজের টাকা। এখানকার বাড়িগুলো কাঠের তৈরি আর চাকার উপর বসানো। তাই সেগুলো গাড়ির মতো এক দুই ক্রোশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়। 


এরপর প্রবল ঝড়ে পড়ে তাঁদের জাহাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হল এবং সারানোর জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হল। প্রবল ঝড়ো হাওয়া অতিক্রম করে জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছলো। এটি হাবশী, হটেনটট ও বুশম্যানদের দেশ ছিল। এখন ডাচ অধিকারে রয়েছে। হটেনটটরা ও বুশম্যানরা তাদের নারী-পুরুষ-শিশু ঘরবাড়ি নিয়ে কিছু বছর এক জায়গায় থাকে, তারপর অন্য জায়গায় চলে যায়। তারা পশু চামড়া পরে, কাঁচা মাংস দুধ আর বুনো ফল খায়। তারা খুব ক্ষিপ্র। সহজেই বুনো শুয়োর, হরিণ ধরতে পারে। হাতি ধরার জন্য তারা বড় গর্ত করে রাখে। গাদা বন্দুকের শব্দ করে হাতির পালকে সেই গর্তের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। হাতি গর্তে পড়ে জল, খাবার না পেয়ে মারা যায়। হটেনটটেরা তখন হাতির দাঁত ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। ডাচেরা বাংলা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু কিনে এখানে ক্রীতদাস করে রেখে। লেখকের তাদের কজনের সঙ্গে দেখা হলো। তারা হিন্দি, বাংলা ভাষা ভুলে গেছে। তাই আকার ইঙ্গিতে কথা হলো। 


অ্যাসেনশন দ্বীপে (অতলান্তিক মহাসাগরের একটি দ্বীপ) কেউ বাস করে না। সেখানে প্রচুর মাছ। বাগদা চিংড়ির মতো একরকম মাছ রয়েছে আর বিশাল বড় বড় কচ্ছপ রয়েছে। নাবিকরা অনেক কচ্ছপ ও কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করল খাবার জন্য। সমুদ্রে কত যে বৈচিত্র্য, বিষ্ময় আছে তা বলে শেষ করা যায় না, লিখেছেন লেখক। এবার তিনি দেখলেন উড়ুক্কু মাছ। মাছের দৈর্ঘ্য তিন আঙ্গুল আর ডানার দৈর্ঘ্য চার আঙ্গুল। সিল্কের কাগজের মতো পাতলা সেই ডানা যতক্ষণ ভিজে থাকে ততক্ষণ উড়তে পারে ওই মাছ। ডানা শুকিয়ে গেলে তারা জাহাজের মধ্যে এসে পড়ে যায়। নাবিকরা এই মাছ সংরক্ষণ করে রাখে ও চড়া দামে অন্য দেশে বিক্রি করে কারণ এই মাছের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার আছে। তিমি মাছ দেখার বর্ণনাও দিয়েছেন লেখক। এরপর লেখক মৎস্যকন্যার কথা লিখেছেন। এদের দেখা পেলে আর ডাক শুনলে নাবিকের নাকি আর বাঁচার আশা নেই। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলেও সে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। 


অবশেষে প্রায় ছয় মাস পরে ফ্রান্সের নঁত (Nantes) -তে জাহাজ নোঙর করলে সেখানকার গরীব মানুষেরা ফল, রুটি, টাটকা মাছ বিক্রি করতে এল। এতদিন পর স্থলভাগে এসে লেখক যেন নতুন জীবন পেলেন। ফ্রান্সের গরিব মানুষেরা চামড়ার জুতো কিনতে পারেনা। তারা এক রকম কাঠের জুতো পরে অদ্ভুত ভাবে চলাফেরা করে। বাংলা থেকে অনেক সহযাত্রী নানা রকম সিল্ক কাপড়, কিংখাব-এর কাপড় প্রভৃতি নিয়ে গেছিল, কাস্টমস চেকিং বাঁচিয়ে তারা বাড়ি গেল। 


ষোলো দিন এখানে কাটিয়ে তাঁরা এক সপ্তাহের সমুদ্রযাত্রায় পৌঁছলেন ফ্রান্সের ক্যালে বন্দরে। লেখক দুই সপ্তাহ এখানে কাটালেন ও শহর ঘুরে দেখলেন। এখানকার ঘরবাড়ি পাথর আর প্লাস্টার ব্যবহার করে তৈরি। ছাদে কাঠ আর টালি ব্যবহার করা হয়। ইউরোপে বাঁশ নেই, তাই ছাদ তৈরিতে বাসের বদলে কাঠের তক্তা ব্যবহার করে। গরিব মানুষরা বার্লির রুটি আর ঝোল খায়। তাদের মোটা পশমের বা গাছের শনের পোশাক। ফরাসিরা বলে ইংরেজরা তাদের কাছে শিল্প-সঙ্গীত, বিজ্ঞান আর ঘোড়ায় চড়া শিখেছে; তাই ইংরেজরা এখন এত উন্নতি করেছে। না হলে তারা হিন্দুস্তানিদের মতো বোকা থাকতো। এইভাবে লেখক লক্ষ্য করেন ফরাসিরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর জাতি হিসেবে দেখাতে ও অন্য জাতিকে কোন কারণ ছাড়া গালি দিতে অভ্যস্ত। 


এরপর তাঁরা একদিনে ইংল্যান্ডের ডোভার নামক ছোট সমুদ্র বন্দরে পৌঁছলেন। ডোভার শহর দেখার সময় ইংরেজরা লেখককে অসীম কৌতূহলের সঙ্গে দেখত কারণ তারা কখনো হিন্দুস্তানি পোশাক পরা কোন মানুষ দেখেনি। অবশ্য তাদের ব্যবহার দয়ালু ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। তারা তাঁকে ভিড় করে ঘিরে ধরত। একদিন কজন তাঁকে একটা হলে নিয়ে গেল হচ্ছিল। সেখানে তারা নাচ গান বন্ধ করে নারী-পুরুষ সবাই লেখকের পোশাক, পাগড়ি, শাল, কোমরবন্ধ, ছুরি প্রভৃতি দেখতে লাগলো। তারা ভাবছিল এটি নাচ বা অভিনয়ে ব্যবহারের পোশাক। নতুন দেশ দেখতে গিয়ে তিনি নিজেই দ্রষ্টব্য হয়ে গেলেন। 


এরপর ঘোড়ার গাড়িতে করে লন্ডনে পৌঁছে, মিস্টার সুইনটনের ভাইয়ের বাড়িতে থাকলেন লেখক। লন্ডনেও তিনি একই রকম ব্যবহার পেলেন ইংরেজদের কাছে। লেখক কুন্ঠিত কিন্তু আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ বোধ করতে লাগলেন। ইংরেজরা আগে মুনশি অর্থাৎ কোন শিক্ষিত ভারতীয় দেখেননি। শুধু চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরের কিছু লস্কর বা নাবিক দেখেছে। তাই তিনি বাংলার কোন নবাব জাতীয় বিখ্যাত ব্যক্তির সম্মান পেতে লাগলেন। যেখানেই তিনি যান ভিড় জমে যায়। বাচ্চারা অবশ্য তাঁকে কালো শয়তান ভেবে ভয় দূরত্ব রেখে চলে। কোনো কোনো মানুষের ধারণা হয়েছিল লেখকের পোশাক হল হারেমের সুন্দরীদের পোশাক। দুই তিন মাস তাদের ভয় কৌতুহল কাটতে লাগল। তারপর ইংরেজ ভদ্রমহিলারা তাঁকে এসে হেসে বলতে থাকলো এসো প্রিয় চুম্বন করো। 


লন্ডনের মতো বড় আর সুন্দর শহর এই পৃথিবীতে নেই। শহরের মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে গেছে। তার পাশে মজবুত কালো পাথরের দুর্গ, যার নাম টাওয়ার। এই দুর্গে অজস্র অস্ত্র, কামান প্রভৃতি আছে। অনেক ইঁটের বাড়ি ও চার্চ আছে এখানে। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল আকার ও সৌন্দর্যে শ্রেষ্ঠ। এই ক্যাথিড্রালের গম্বুজ থেকে চারপাশে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। একমাত্র বিজাপুরের গোল গম্বুজ ছাড়া এত উঁচু গম্বুজ হিন্দুস্তানে কোথাও নেই। 


ডেনমার্কের এক রাজা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে বানিয়েছিলেন (বর্তমানে এরকম কোন তথ্য পাওয়া যায়নি)। এখানে কিছু মূর্তি আছে যা অবিকল জীবন্ত বলে মনে হয়। রাজার প্রাসাদ বাইরে থেকে সুন্দর নয়, এমনকি প্লাস্টার করাও নয়। তবে রাজার প্রাসাদের ভিতরে নাকি সুন্দর সাজসজ্জা আছে। রানীর প্রাসাদ কিন্তু সুন্দর ও চমকালো। (বর্তমান ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেস ডিউক অফ বাকিংহামের দ্বারা ১৭০৩  তৈরি। রাজা তৃতীয় জর্জ এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিটি ১৭৬১ সালে অধিগ্রহণ করেন এবং রানী শার্লটের থাকার জন্য দেন। এটি তখন থেকে রাণীর প্রাসাদ নামে খ্যাত ছিল। ১৮৩৭ থেকে বাকিংহাম প্যালেস প্রধান রাজপ্রাসাদ হিসেবে স্বীকৃত হয়। লেখক যে সময় লন্ডনে যান তখন সেন্ট জেমস প্যালেস রাজপ্রাসাদ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এটি ওয়েস্টমিনস্টার শহরে অবস্থিত)। 


লন্ডনের শহরের বাড়িগুলি প্রায় সব তিন থেকে পাঁচতলা। এখানকার ঘরের উচ্চতা কম। মেঝে কাঠের, দেয়ালে রঙিন কাগজ লাগান। জোরে হাওয়া বইলে দেওয়াল কাঁপে, ভয় হয় যে পড়ে যাবে, যদিও বাস্তবে তা হয় না। চারদিকে পরীর মত নারীরা ঘুরে বেড়িয়ে জায়গাটা স্বর্গের মতো হয়ে ওঠে। কবি এই স্থান প্রথম দেখে বলে উঠেছিলেন যে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানে এখানে এখানে। রাস্তাগুলো প্রশস্ত, দুপাশে বাড়ি। বাড়িগুলো কলকাতার সেনা ব্যারাকের মতো একরকম দেখতে। সেগুলো একেবারে সরলরেখায় সাজানো আছে। বিভ্রান্তি এড়াতে বাড়ির দরজায় পিতলের ফলকে বাড়ির মালিকের নাম লেখা আছে। তার সঙ্গে মালিকের পেশার চিহ্ন ফলকে আঁকা আছে। যেমন মুচির বাড়িতে জুতোর ছবি ইত্যাদি। বাড়ির একতলা দোকান হিসেবে ভাড়া দেওয়া থাকে। সেখানে কাঁচের তাকে জিনিসপত্র সাজান। দুই, তিনতলা অবস্থাপন্নরা থাকে। চারতলায় ভৃত্য শ্রেণীর লোক থাকে। রাস্তা পাথরে বাঁধানো, দুপাশে পথচারীদের হাঁটার সুন্দর রাস্তা রয়েছে।


রানীর প্রাসাদের কাছে (বাকিংহাম প্যালেস) একটা পার্ক আছে (সেন্ট জেমস পার্ক)। সেখানে দু'ধারে ওয়ালনাট গাছের সারির মধ্যে দিয়ে ছায়াচ্ছন্ন পথ। এখানে অনেক হরিণ রাখা আছে। সেখানে রবিবার নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই যায় ও আনন্দ উপভোগ করে। 


নাচ, গান, নাটকের ক্ষেত্রে ইউরোপ আর ভারতবর্ষের পার্থক্য রয়েছে অনেক। ভারতে যেমন এক রাতের জন্য একজনের বাড়িতে গাইয়ে নাচিয়েরা এসে অনুষ্ঠান করে এবং তার জন্য সেই ব্যক্তিটির লাখ লাখ টাকা খরচ হয়, ইংল্যান্ডে তেমন হয় না। এখানে অনেক নাচিয়ে, গাইয়ে, অভিনেতা ইত্যাদি নিয়ে একটি কোম্পানি তৈরি করা হয়। তারা একটা বাড়িতে একসঙ্গে অনুষ্ঠান করে। সেখানে বহু লোক এসে তাদের সামর্থ্য অনুসারে দামের স্থানে বসে উপভোগ করে। রাজা, রাজকুমাররা একদম সামনে বসেন আর গরীব মানুষরা সামান্য পয়সা দিয়ে সেই একই অনুষ্ঠান দেখতে পায় পিছনে বসে। এক রাত অনুষ্ঠান করে শিল্পীরা অনেক টাকা পায়। বেহালা, গিটারের সঙ্গে যে নাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয় তার বর্ণনা দেওয়ার ভাষা খুজে পাওয়া যায় না বলে লেখক লিখেছেন। নাটকের সময় হলে কোন কথা বলা নিষেধ। প্রশংসাসূচক শব্দও বলা চলে না। পা ঠুকে বা হাততালি দিয়ে বাহবা জানান যায়। লেখক অনেক নাটক দেখেছিলেন। 


সার্কাস হল বিনোদনের আরেকটি স্থান। একজন ঘোড়সওয়ার ঘোড়ার খেলা দেখায়, এক শিলিং দিলে তা দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া জাগলিং -এর খেলা হয়। নদীর ওপর পারে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরেকটি বিরাট বাগান আছে। তার মধ্যস্থলে নাচ গান প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ডে বাঘ, সিংহ, চিতা, ভালুক, নেকড়ে কিছুই নেই। হাতি, উট প্রভৃতি প্রাণী ভারত থেকে নিয়ে এসে তারা একটা বড় বাড়িতে (চিড়িয়াখানা) রাখে। মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসে দল বেঁধে এক দুই টাকার বিনিময়ে সেই বাড়িতে ঢুকে সেই সব প্রাণী দেখে। টাকা তোলার এটা এক উপায়। তবে এখানে নানা জাতের কুকুর পাওয়া যায়। (লন্ডনে যে সব নতুনত্ব দেখে লেখক অবাক হয়েছিলেন উপনিবেশ হিসেবে ভারত তার প্রায় প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আত্তীকরণ করেছে পরবর্তী কালে) ।


তিন মাস লন্ডনে থাকার পর মন খারাপের সঙ্গে তিনি লন্ডন ছেড়ে অক্সফোর্ড চললেন ক্যাপ্টেন সুইনটনের সঙ্গে। কিন্তু সুন্দর ও পরিষ্কার অক্সফোর্ড শহর দেখে তাঁর দুঃখ দূর হল। বিশ্ববিদ্যালয়, পূরনো চার্চ, ক্যাথিড্রাল, লাইব্রেরী দেখলেন। সেখানে অনেক আরবি, ফার্সির বই ছিল। একটি লাইব্রেরীতে অনেক বিখ্যাত শিল্পীর চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ছিল। এগুলি বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মূল্য দিয়ে কিনে আনা হয়েছে। লেখক বলেন ইংল্যান্ডের শিল্প বা বিজ্ঞান কেন উন্নতি করবে না এরকম পৃষ্ঠপোষকতা উৎসাহ পেলে। কিন্তু এখন ভারতবর্ষে যদি কেউ বহুদিন ধরে চেষ্টায় কোন জ্ঞান সংগ্রহ করে সে কোন সম্মান পাবে না। বরং দুর্ভাগ্য আর দুঃখ বরণ করতে হবে তাকে। সেজন্যই ভারতে কেউ তেমন উন্নতি করায় আগ্রহী নয় কলা ও বিজ্ঞানের। লাইব্রেরির প্রতি তলায় জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রাদি, টেলিস্কোপ রয়েছে। 


শীতকালে ক্যাপ্টেন সুইংটনের সঙ্গে লেখক অক্সফোর্ড থেকে স্কটল্যান্ড চললেন। এই যাত্রায় বরফের উপর দিয়ে মানুষজনকে স্কি করে যেতে দেখলেন। শুনলেন এভাবে তারা একদিনে ১০০ ক্রোশ পর্যন্ত যেতে পারে। স্কি করার সময় তাদের দেখে লেখকের মনে হলো দেবদূত, পরিরা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। 

স্কটল্যান্ডের দুটি অংশ - পার্বত্য স্কটল্যান্ড আর সমভূমির স্কটল্যান্ড। এই দেশে পাহাড় আর জঙ্গল অনেক বেশি শহরের তুলনায়। স্কটিশরা সাহসী, বীর ও সংযমী। স্কটিশরা নিজেদের ইংরেজদের থেকে শ্রেষ্ঠতর জাত বলে মনে করে। অন্যদিকে ইংরেজরা দারিদ্রের জন্য স্কটিশদের ঘৃণা করে। তাদের ভাষাও কিছুটা আলাদা। এডিনবরাতে তাঁরা ক্যাপ্টেন সুইনটনের বাবার বাড়িতে থাকলেন। পার্বত্য স্কটল্যান্ডে প্রায় সারা বছর বৃষ্টি আর তুষারপাত হয়। কিন্তু সেখানকার মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখানকার মানুষ এক রকম টুপি আর জ্যাকেট পরে কিন্তু ফুলপ্যান্ট বা বুট পরে না। শরীরের নীচের অংশ ঢাকা থাকে লম্বা জ্যাকেট আর সুতির মোজায়, হাঁটু অনাবৃত থাকে। পায়ে ফিতে বাঁধা জুতো থাকে। সঙ্গে থাকে দ্বিধারী তরোয়াল। 


ক্যাপ্টেন সুইনটন ও আরো কয়েকজন ইংরাজ লেখকের কাছে ফার্সি ভাষা শিখছিলেন। তাঁরা লেখককে ইংল্যান্ডে আরো কিছু সময় থাকতে অনুরোধ করেন। কিন্তু যখন তাঁরা লেখককের ধর্ম বিশ্বাস ও মূল্যবোধ নিয়ে বক্রোক্তি করেন তখন লেখক আর ইংল্যান্ডে থাকতে চান না। ইতিমধ্যে লন্ডনে এসে লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারে সরাসরি বাদশাহ শাহ আলমের পাঠানো নজরানা দিয়ে নিজে নিশ্চয়ই রানীর অনুগ্রহ লাভ করেন এবং তাঁর পাঠানো চিঠির কথা বেমালুম চেপে যান। অবশেষে ইউরোপে দু বছর নয় মাস কাটিয়ে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে লেখক ভারতে ফেরেন।

রবিবার, ৯ জুন, ২০২৪

৪। শ্রীচৈতন্যদেবের ভ্রমণ


         সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                    -------  সুমনা দাম

শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬ - ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ) -এর জীবনে যে ভ্রমণের একটি বড় অংশ আছে সে ব্যাপারটা প্রথম আমার নজরে আসে প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও সুলেখক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বাঙ্গালার ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড পড়ার সময়। 


বৃন্দাবন দাস, গোবিন্দদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, জয়ানন্দ প্রমুখ চৈতন্য জীবনীকারদের রচিত কাব্যগ্রন্থ থেকে শ্রীচৈতন্যের বিভিন্ন যাত্রার পুঙ্খানপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। নিঃসন্দেহে তিনি পায়ে হেঁটে এই তীর্থ ভ্রমণ করেন। যেহেতু বহুদিন অতিক্রান্ত , তাই বহু স্থানে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে, বহু স্থানের নাম আমূল পরিবর্তিত হয়েছে, বেশ কিছু নদী বা খাল গতিপথ পাল্টেছে বা শুকিয়ে গেছে। তাই ওই গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত সব জায়গা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, তবু আমি প্রধানতঃ গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে বেশ কিছু জায়গা খুঁজে পেয়েছি, কিছু পাই নি, কিছু নিয়ে সন্দিহান থেকেছি। লেখার সময় ব্রাকেটের () মধ্যে আমি সেগুলি উল্লেখ করেছি। যেগুলি পাই নি, প্রশ্ন চিহ্ন (?) ব্যবহার করেছি। 


বৃন্দাবনদাসের চৈতন্য ভাগবতে পাই যে পিতার মৃত্যুর পর তিনি গয়া গেছিলেন পিণ্ডদানের জন্য। পথে তিনি মন্দার পর্বতে (বিহারের বাঁকা জেলায় অবস্থিত) মধুসূদন দর্শন করেন। তিনি পুনপুনা তীর্থ, বহ্মকুণ্ড, প্রেতশীলা, রামগয়া, উত্তরমানস, দক্ষিণমানস, বিষ্ণুপদ, ভীমগয়া, শিবগয়া প্রভৃতি ষোড়শ গয়া দর্শন করেন। গয়াতে তিনি বিষ্ণুর শ্রীচরণস্থান দর্শন করে আবিষ্ট হন। (এই সময় থেকে মহাপন্ডিত ও সুতার্কিক বিশ্বম্ভরের মধ্যে ভক্তিরস প্রাধান্য পায়)। সেখানে তিনি ঈশ্বরপুরীর সাক্ষাৎ পান। পরে ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান কুমারহট্ট (হালিশহর) দর্শন করেন এবং তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। চব্বিশ বছর বয়সে (১৫০৯ খ্রিস্টাব্দ) গৃহত্যাগ করে শ্রীচৈতন্য (তৎকালীন নাম বিশ্বম্ভর ও নিমাই) কাটোয়ায় যান ও কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন।


                 পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির

কাটোয়া থেকে তিনি শান্তিপুরে আচার্য অদ্বৈতের গৃহে যান ও সেখান থেকে পুরুষোত্তম বা পুরী যাত্রা করেন। 


গোবিন্দদাসের কড়চার রচয়িতা গোবিন্দদাস, যিনি এই যাত্রায় শ্রীচৈতন্যের সঙ্গী ছিলেন তিনি লিখেছেন চৈতন্যদেব বর্ধমান হয়ে দামোদর পার হয়ে কাশীপুর (কেশপুর?), হাজীপুর (পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের হাজীপুর), মেদিনীপুর, নারায়নগড় (এখানে ধলেশ্বর শিব দর্শন করেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের কসবা নারায়ণগড়) হয়ে যাত্রা করেন। জলেশ্বর গিয়ে বিলেশ্বর শিব দর্শন করে হরিহরপুর (উড়িষ্যা), বালেশ্বর, নীলগড় হয়ে বৈতরণী ও মহানদী পার হয়ে ভুবনেশ্বর এসে লিঙ্গরাজ মন্দির দেখেন। তাঁর সঙ্গীরা ছিলেন ঈশান, প্রতাপ, গঙ্গাদাস, গদাধর, বাণেশ্বর প্রমুখ। 


                 পুরীতে চৈতন্যদেবের আবাসস্থল


চৈতন্য মঙ্গলের রচয়িতা জয়ানন্দ পথের বর্ণনা একটু অন্যরকম লিখেছেন। চৈতন্যদেব শান্তিপুর থেকে আম্বুয়া (সম্ভবত অম্বিকা কালনা, পূর্ব বর্ধমান), কাচমনি, বেতড়া (মেমারির অন্তর্গত বিতড়া অঞ্চল) হয়ে কুলীন গ্রামে (পূর্ব বর্ধমান) যান। তিনি দেবনদ (দামোদর নদী), সেয়াখালা (হুগলির সেয়াখলা কি?) দিয়ে তমলিপ্ত (তমলুক) যান। মন্ত্রেশ্বরে (?) বিষ্ণুদর্শন করে, সুবর্ণরেখা পার হয়ে বারাসাতে (?) পৌঁছান। তারপর দাঁতন ও জলেশ্বর (বর্তমান উড়িষ্যা) হয়ে অমরদাতে (গোপীবল্লভপুরের অন্তর্গত গ্রাম) পৌঁছান। বাঁশদা (পূর্ব মেদিনীপুর) রামচন্দ্রপুর (পূর্ব মেদিনীপুর) হয়ে রেমুণাতে ( উড়িষ্যা) পৌঁছে গোপীনাথ এবং সরোনগরে সিদ্ধেশ্বর দর্শন করেন। তারপর বাঙালপুর (উড়িষ্যা) হয়ে অসুরগড়ের (উড়িষ্যা) পাশ দিয়ে ভদ্রকে পৌঁছান। ভদ্রক থেকে তুঙ্গদা হয়ে জাজপুরে পৌঁছান এবং বিরজা, নাভিগয়া প্রভৃতি দর্শন করে একাম্রবন (ভুবনেশ্বর) যান। পথে পুরুষোত্তমপুর (উড়িষ্যা), পাটনা (উড়িষ্যার কেন্দুঝাড় জেলার পাটনা), আমরাল হয়ে কটকে এসে রাজরাজেশ্বর দর্শন করে ভুবনেশ্বর যান। ভুবনেশ্বর থেকে কপিলেশ্বর,  কাঁঠতিপাড়া, কমল, আঠারনালা (পুরী ঢোকার মুখের সেতু) হয়ে পুরুষোত্তম বা পুরীতে এলেন। 

জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গল অনুযায়ী পুরীতে চৈতন্যদেবের সঙ্গে ছিলেন কৃষ্ণদাস, হরিদাস, শ্যামদাস, প্রেমদাস, মোহান্ত ব্রাহ্মণ, গোপীদাস, রঘুনাথদাস, নরহরি, দামোদর স্বামী, গদাধর, কাশীমিশ্র, শঙ্কর ভারতী, পরমানন্দপুরী, সার্বভৌম ভট্টাচার্য প্রমুখ। 

বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত অনুযায়ী তিনি ছত্রভোগে অম্বুলিঙ্গ (দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর?) ঘাটে গেছিলেন। সেখান থেকে নৌকায় উড়িষ্যার প্রয়াগ ঘাটে (সম্ভবতঃ বিরূপা নদীর তীরে অবস্থিত ত্রিবেণীশ্বর?) এসেছিলেন। এই নৌযাত্রার ভয়াবহতা প্রকাশ পায় তাঁর এই লেখায় "কুলেতে উঠিলে বাঘে লইয়া পলায়। জলেতে পড়িলে কুম্ভীরেতে ধরি খায়।। নিরন্তর এ পাণিতে ডাকাইত ফিরে। পাললেই ধন প্রান দুই নাশ করে।।" সুবর্ণরেখা পার হয়ে জলেশ্বর, বাঁসধা (ভদ্রক-এর বানসাধা গ্রাম), রেমুণা (রেমুনা), জাজপুর, কটক (এখানে সাক্ষীগোপাল দর্শন করেছিলেন) হয়ে ভুবনেশ্বরে আসেন। চৈতন্য ভাগবত অনুযায়ী নিত্যানন্দ, গদাধর, মুকুন্দ, গোবিন্দ, জগদানন্দ, ব্রহ্মানন্দ চৈতন্যদেবের সহযাত্রী ছিলেন।

বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবত মতে কিছুকাল পুরুষোত্তমে থেকে শ্রীচৈতন্য গৌড়ে ফিরে আসেন। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল অনুসারে তিনি এরপর দক্ষিণাপথ (দক্ষিণ ভারত) যাত্রা করেন। গোবিন্দদাসের কড়চা অনুসারে তিনি দক্ষিণাপথযাত্রা করেন এবং কড়চার লেখক গোবিন্দদাস ছাড়া আর কাউকে সঙ্গে নেন নি। 

জয়ানন্দের মতে চৈতন্য মহানৈ (মহানদী) পার হয়ে কাটাতিপাড়া (?) বাঁয়ে রেখে জিঅড় পর্বতে (?) যান ও নৃসিংহ দর্শন করেন। এরপর গোদাবরী পার হয়ে পঞ্চবটী (পঞ্চবটী,মহারাষ্ট্র) হয়ে কাবেরী নদীতে স্নান করে ত্রিমন্দ্রনাথে (তিরুমালা গিরি, তেলেঙ্গানা) যান। কিন্তু এই অঞ্চলে কাবেরী নদী নেই, তাই এই তথ্যে কিছু ত্রুটি আছে বলে মনে হচ্ছে। 

গোবিন্দদাসের কড়চা অনুসারে পুরী থেকে চৈতন্যদেব গোদাবরী তীরে যান। তারপর ত্রিমন্দ্রনগরে (তিরুমালাগিরি) যান। সেখানে তিনি বৌদ্ধ পণ্ডিতদের তর্কে পরাজিত করেন। তারপর যান পন্থগুহা (পাণ্ডগভুলা গুহা, অন্ধ্রপ্রদেশ)। তারপর সিদ্ধ বটেশ্বর (বর্তমান কড়পা, অন্ধ্রপ্রদেশ) তীর্থে যান। এরপর তিনি মুন্নানগর (অন্ধপ্রদেশ) হয়ে বেঙ্কটনগরে (ভেঙ্কটনগর, পন্ডিচেরি) যান। তারপর বগুলা (?) অরণ্য হয়ে গিরিশ্বর নামের মন্দির দর্শন করে ত্রিপদী নগরে (?) যান ও রামের মূর্তিদর্শন করেন। 

সেখান থেকে পানানরসিংহ (মঙ্গলগিরি, অন্ধ্রপ্রদেশ) দর্শন করে বিষ্ণুকাঞ্চি (কাঞ্চিপুরম) যান। সেখানে ত্রিকালেশ্বর শিব ও কালতীর্থে বরাহমূর্তি দর্শন করেন (ভূবরাহ স্বামী মন্দির, তামিলনাড়ু সম্ভবত)। চৈতন্যদেব নন্দা ও ভদ্রা নদীর সঙ্গমে স্নান করেন, যাকে সন্ধিতীর্থ বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা কোথায় অবস্থিত? তবে কি তা বর্তমানে লুপ্ত? তারপর তিনি গেলেন চাঁইপল্লীতীর্থতে (ত্রিচিনাপল্লী)। গেলেন নাগর (নাগর, তামিলনাড়ু)। সেখান থেকে তাঞ্জোরনগরে (তাঞ্জোর)। সেখানে চন্ডালু নামে এক পাহাড় দেখলেন যার মধ্যে অনেক গুহা আছে এবং সেই গুহায় অনেক সন্ন্যাসী থেকে তপস্যা করেন। সেখান থেকে চৈতন্য পদ্মকোটে (?) যান ও দেবী অষ্টভূজা দর্শন করেন। এবার তিনি যান ত্রিপাত্রনগরে ও চন্ন্ডেশ্বর শিব  (ত্রিপত্র নগর বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু তামিলনাড়ুর হসুরে চন্দ্রচূড়েশ্বর শিব মন্দির আছে) দর্শন করেন।

শ্রীচৈতন্য যেখানেই যান সেখানেই আবালবৃদ্ধবণিতা উপস্থিত হয় ও হরিনামে মেতে ওঠে। অনেকে বৈষ্ণব হয়। প্রতিটি স্থানেই চৈতন্যের লীলাকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এই রচনার উদ্দেশ্য ধর্ম নয়, ভ্রমণ। তাই শুধু ভ্রমণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই চৈতন্য জীবনী গুলি দেখা হয়েছে। 

এবার এলো ঝারিবন নামে প্রকাণ্ড জঙ্গল। তার মধ্যে দিয়ে একপক্ষকাল যাত্রা করে এল রঙ্গধাম ( শ্রীরঙ্গম, তামিলনাড়ু), নরসিংহ মূর্তি দর্শন করে এবার তিনি গেলেন ঋষভ পর্বতে (মলয় পর্বত বা মলায়াদ্রী)। তারপর রামনাথ নগরে (?) এলেন ও শ্রীরামের পাদপদ্ম স্পর্শ করলেন। গেলেন তত্ত্বকুন্ডি তীর্থ  (?), তাম্রপর্ণী (থামিরাবারানি নদী, তামিলনাড়ু) নদীতে স্নান করলেন। এবার এলেন কন্যাকুমারী সেখানে সমুদ্র দর্শন করলেন ও স্নান করলেন। 

এরপর এক সন্ন্যাসীদের দলের সঙ্গে চললেন সাঁতল পাহাড় (?) ডিঙিয়ে গেলেন ত্রিবঙ্কুদেশে (ত্রিবাঙ্কুর)। সেখানকার রাজা রুদ্রপতি নিজে এসে চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর রামগিরি (রামগিরি, কর্ণাটক) যান। পাহাড়ের উপরে তারপর পয়ষ্ণী নগরে (?)  শিব নারায়ণের দর্শন করেন শিংগারির মঠে (শৃঙ্গেরী মঠ, শঙ্করাচার্যের মঠ, কর্ণাটক) গেলেন। ঈশ্বর ভারতীকে শুষ্ক বিদ্যা অপেক্ষা কৃষ্ণপ্রেমের সারময়তা উপলব্ধি করালেন। এরপর পর্বত জঙ্গল বেষ্টিত দুর্গম পথে চলতে চলতে বাঘ দেখে কবি ভয় পেলেও শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণনামে বিভোর হয়ে পেরিয়ে গেলেন সে পথ। এরপর কান্ডার দেশের (কন্নড় দেশ বা কর্ণাটক) কাছে নীলগিরি পর্বত দর্শন। এবার এলেন গুর্জরী নগরে। এখানে অগস্তকুন্ডে (বাদামি, কর্ণাটক) স্নান করলেন। বহু মহারাষ্ট্রী নামগান শুনতে আসেন। কুলনারীরাও আসেন। কখনও তামিল বুলি বলেন শ্রীচৈতন্য, কখনো সংস্কৃত। 

এবার বিজাপুরে (মহারাষ্ট্র) পাহাড়ের শিখরে উঠলেন ও হরগৌরী দর্শন করলেন। আগে মহেন্দ্র মলয়গিরি বা মলায়াদ্রী দেখেছেন এবার সহ্যগিরি বা সহ্যাদ্রী দেখে আনন্দিত হন। ক্রমে পূর্ণনগরে (পুণা) এসে পাহাড়ের ওপর ভোলেশ্বর, দেবলেশ্বর দেখে জিজুরী (জেজুরী) নগরে গিয়ে খাণ্ডবা দেব দর্শন করেন। এখানে তিনি বহু পতিতা নারীদের কৃষ্ণ নামে পাপ মুক্তি ঘটান। তারপর যান চোরানন্দী বন (?)। সেখানে ডাকাতদের বাস। হরি ভক্তি দিয়ে ডাকাতদের ডাকাতি ছাড়িয়ে পাপ মুক্তি ঘটান। ডাকাতের সর্দার নারোজী এরপর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে চললেন। নাসিকে গেলেন, যেখানে সূর্পনখার নাসিকা ছেদন হয়েছিল। ত্রিমুকের (ত্রিমক, মহারাষ্ট্র) কাছে রামের কুটিরক্ষেত্র দর্শন করেন ও জঙ্গলে রামের চরণচিহ্ন দর্শন করেন তারপর পঞ্চবটি বনে (পঞ্চবটি, নাসিক, মহারাষ্ট্র) গেলেন ও লক্ষণের প্রতিষ্ঠিত গণেশ দেখলেন (অধুনালুক্ত?)। 

এরপর গেলেন দমন নগরে (দমন)। সুরতের রাজ্যে (সুরাট, গুজরাট) যান ও অষ্টভূজা ভগবতী দেখেন। তারপর তাপতী (তাপ্তি) নদীতে স্নান করে বামন দেবের (?) দর্শন করেন। তারপর নর্মদা নদীর তীরে ভরোচ নগরে (ব্রোচ, গুজরাট) যান ও বলিরাজার কুন্ড দর্শন করেন। মহাতীর্থ নর্মদা স্নান করে বরোদা নগরে যান ও ডাকোরজী (?) দর্শন করেন। বরোদার রাজা চৈতন্যদেবের দর্শনে এসেছিলেন। এবার এলেন আমেদাবাদ, যা অত্যন্ত সুসজ্জিত নগর। অনেক অট্টালিকা ও উদ্যান আছে। শুভ্রামতী নদী (সবরমতী নদী) দেখার পরে দ্বারকাগামী দুজন বাঙালির সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। অর্থাৎ আরো বাঙালি তীর্থ ভ্রমণে যেতো তখনও। তাঁরা সোমনাথ গেলেন, জাফেরাবাদ (জাফরাবাদ) হয়ে। সোমনাথ মন্দিরের ঢিবি আর ভাঙ্গা চিহ্ন ছাড়া কিছু অবশিষ্ট ছিল না যবনের অত্যাচারে। তারপর জুনাগড় নগর, যা বহু অট্টালিকা শোভিত। রণছোড়জীর (ডাকোর, গুজরাট) মন্দির দর্শন করেন। চৈতন্যদেব এবার চললেন গৃণার পাহাড়ে (গিরনার পাহাড়) এবং কৃষ্ণের পদচিহ্ন দর্শন করলেন। দীর্ঘ জঙ্গলময় পথ পেরিয়ে আসেন প্রভাস তীর্থ (প্রভাস, গুজরাট)। এবার দ্বারকা নগরী, যা সমুদ্রের ধারে অবস্হিত। রইবতক পাহাড় ( গিরনার পাহাড়?) দেখতে পেলেন মন্দির দর্শন করলেন। 

এবার চৈতন্যদেব পুরীতে ফিরতে মনস্থ করলেন। বরোদা হয়ে নর্মদার তীর ধরে দোহদ নগর (দোহদ, গুজরাট), কুক্ষিনগর (কুক্ষি, মধ্যপ্রদেশ), আমঝোরা নগর (আমঝর, মধ্যপ্রদেশ), বিন্ধ্যগিরির উপরে মন্দুরা নগর (মন্ডলা মধ্যপ্রদেশ?), বিন্ধ্যের নীচে মন্ডল নগরী (মন্ডলা?), দেবঘর (দেওঘর, মধ্যপ্রদেশ), শিবানী নগর (সিওনি, মধ্যপ্রদেশ?), মহল পর্বত (?), চণ্ডীপুর নগর (?,এখানে চন্ডী দেবী দর্শন) হল। এবার এল রায়পুর (ছত্রিশগড়), বিদ্যানগর (ছত্রিশগড়), রত্নপুর (রতনপুর, ছত্রিশগড়)। সেসব পেরিয়ে পৌঁছলেন  স্বর্ণগড় (সরনগড়, ছত্রিশগড়)। সেখানকার রাজা এসে দেখা করলেন। এরপর একে একে এল সম্বলপুর (উড়িষ্যা), ভ্রমরানগর (ভানগড়, উড়িষ্যা), প্রতাপনগরী ভুবনেশ্বরে নিকটে প্রতাপনগরী, দাসপাল নগর ( দশপাল্লা, উড়িষ্যা), রসাল কুণ্ড। রসাল কুন্ডে (চম্পেশ্বরের চম্পানাথ মন্দিরের সংলগ্ন দীঘিতে এখনও কচ্ছপ আছে অনেক) কূর্মদেবের ( মন্দিরের পোষা কচ্ছপ সম্ভবত) দেখা পেলেন। এবারে ঋষিকূল্যা ধাম (ঋষিকূল্যা নদীতীরে তারাতারিণী মন্দির সম্ভবত তখনও তৈরি হয় নি, তাহলে কোন ধাম?) হয়ে পুরী ফিরলেন শ্রীচৈতন্যদেব

পরবর্তীকালে শ্রী চৈতন্যদেব বৃন্দাবন ধাম যাত্রা করেছিলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত "শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত" গ্রন্থে সেই বর্ণনা পাওয়া যায়। সঙ্গী ছিলেন শুধু বলভদ্র ভট্টাচার্য ও তাঁর এক ভৃত্য। পুরী থেকে তিনি প্রধানপথে না গিয়ে উপপথ ধরে চললেন। কটকের কাছে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলেন। বাঘ ও হাতিসঙ্কুল সেই পথে নির্দ্বিধায় কৃষ্ণ নাম করতে করতে তিনি চললেন। ঝারিগ্রাম (?) হয়ে ক্রমে কাশীতে আসেন। কাশীতে কিছুদিন বাস করার পর প্রয়াগ হয়ে মথুরায় যান। মধুপুরী বা মথুরার ২৪ ঘাটে প্রভু স্নান করেন ও নানা তীর্থস্থান দর্শন করেন। বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ড দর্শন, গোবর্ধন পরিক্রমা গোবিন্দ কুঞ্জে স্নান, নন্দীশ্বর, কাম্যবন প্রভৃতি সব দর্শনীয় স্থান দর্শন করেন। মথুরা, বৃন্দাবনে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে মহাপ্রভু প্রয়াগ ও কাশী হয় হয়ে পুরী বা নীলাচলে প্রত্যাবর্তন করেন।


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...