রমেশ চন্দ্র দত্ত লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রমেশ চন্দ্র দত্ত লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৬৩। ইউরোপে তিন বছর ৯ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - জার্মানি।

২ নভেম্বর ১৮৮৬ থেকে ১৫ ই ডিসেম্বর ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ দিনের ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ কালে রমেশ চন্দ্র দত্ত ছটি দেশ এবং তিরিশটি শহর দেখলেন। এরপর লেখক ইউরোপ ভ্রমণার্থীদের জন্য কিছু বক্তব্য রেখেছেন। 


*ইউরোপের প্রতিটি সম্ভ্রান্ত হোটেলে ইংরাজি, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান বলা হয়। তাই এর যেকোনো একটি ভাষা জানলে টুরিস্টদের কোন অসুবিধা হয় না।
 
*ব্যাডেকার সিরিজের গাইড বই ভাল। এটি পড়া থাকলে গাইড-এর জন্য পয়সা খরচ করার দরকার হয় না।

* এই ৪৪ দিনের ভ্রমণে তাঁর ৬৬ পাউন্ডের সামান্য বেশি খরচ হয়েছিল। অর্থাৎ প্রতিদিন দেড় পাউন্ড খরচ গড়ে। 

*স্বল্পদিনে বেশি স্থান ঘুরতে হয়েছে বলে খরচ বেশি লেগেছে। যদি এক স্থানে বেশি দিন থাকা হয় তাহলে ইউরোপে হোটেল ভাড়া কম নেওয়া হয়। সাধারণত ইউরোপীয়রা এক দেড় মাস এক জায়গায় থেকে ভ্রমণ করে। 

*তাঁর হোটেল ভাড়া তিরিশ পাউন্ড ও রেল ভাড়া কুড়ি পাউন্ড লেগেছিল। ১৫ পাউন্ড-এ গাড়ি ভাড়া, মিউজিয়াম গ্যালারি ইত্যাদির প্রবেশ মূল্য, মেমেন্টো কেনা, ফটো তোলা প্রভৃতি খরচ হয়েছিল। 

*প্রতিটি দেশের মুদ্রা বিভিন্ন। এটি ভ্রমণকারীর পক্ষে অসুবিধা জনক। যদি সরকার সব দেশে চলে এমন মুদ্রা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ভ্রমণার্থীদের সুবিধা হবে। রমেশ চন্দ্র দত্ত মহাশয়-এর এই দূরদৃষ্টি বহু দিন পর্যন্ত অব্যবহৃত ছিল। পরে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ব্যতীত অন্য যেসব দেশে লেখক ভ্রমণ করেছেন, সেই সব জায়গায় ইউরো নামক একটি সাধারন মুদ্রা প্রচলিত হয়েছে। 


এরপরে লেখক আরেকবার ইউরোপ ভ্রমণ করেন। সেটি মূলত জার্মানিকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ করা হয়। সেই ভ্রমণ কাহিনী তিনি বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে যুক্ত করেন। 

১২ ই আগস্ট ১৮৯৩ রমেশ চন্দ্র দত্ত বাইশ বছর পরে আবার জার্মানির কোলন গেলেন। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কোলনে ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে যে ক্যাথিড্রালের সূচনা হয়েছিল নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের সম্রাট উইলিয়াম (প্রথম) ১৮৮০ -তে তার কাজ শেষ করেছেন। সেই বিশাল এবং রাজকীয় ক্যাথিড্রালের বর্ণনা ভাষায় বর্ণনা করা দুষ্কর। 

কোলন থেকে তিনি গেলেন ওয়াইসবাডেন। এটি স্বাস্থ্যধারের স্থান হিসাবে বিখ্যাত। লেখক দেশ থেকে অসুস্থ হয়ে ইউরোপে বায়ু পরিবর্তনে এসেছিলেন। কিন্তু এসেও দেড় মাস ইংল্যান্ডে ম্যালেরিয়ায় অসুস্থ হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিল সাইটিকা বাতের প্রকোপ। ফলে ওয়াইজবাডেন তাঁর শরীরের পক্ষে ভালো ছিল। এখানকার উষ্ণপ্রস্রবণের জলে প্রতিদিন সকালে স্নান করে এবং সেই জল পান করে অনেকের মতো লেখক মাস খানেকে সুস্থ হয়ে উঠলেন। এখানে তিনি জার্মান ভাষা শিক্ষা করতে থাকেন। 

মাঝে মাঝে আশেপাশের জঙ্গলে, রাইন নদীতে আনন্দ ভ্রমণ করতেন। জঙ্গলে গাছের নীচে বই হাতে গ্রীষ্মের দুপুরে একলা উপভোগ করতে তাঁর খুব ভালো লাগত। অনেক ইউরোপীয় শহরে প্রাকৃতিক জঙ্গল শহরের খুব কাছে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জঙ্গলের পথ ধরে পাহাড়ি পথে ওঠা নামা করে, আশেপাশের সোনেনবার্গ, নেরোবার্গ, আইসেনহান্ড প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে আসলেন। কখনো রাইন নদীতে স্টিমারে করে জার্মানির ন্যাশনাল মনুমেন্ট দেখতে গেলেন। ন্যাশনাল মনুমেন্ট জার্মেনিয়ার মূর্তি ৩৩ ফুট লম্বা মূর্তি, ৩৮ ফুট বেদির উপরে বসানো এবং ৭৪০ ফুট পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। (জার্মেনিয়া এক মহিলার মূর্তি যার মাথায় ওক পাতার সজ্জা, ডান হাতে জার্মান রাজকীয় মুকুট এবং বাঁ হাতে খোলা তরোয়াল। জার্মেনিয়া সমগ্র জার্মান জাতির প্রতীক)। 


রাইন নদীর ধারে অবস্থিত কিছু জার্মান শহরে ও নদীপথে ঘুরে এলেন লেখক। বর্তমানে প্রুশিয়ায় অবস্থিত ফ্র্যাঙ্কফার্ট প্রখ্যাত লেখক গ্যোটের জন্মস্থান রূপে ভ্রমণকারীদের কাছে জনপ্রিয়। লেখকের বাড়ি, মূর্তি, পুরনো টাউন হল, ক্যাথিড্রাল এবং ইহুদিদের মলিন বসতি এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান। 

রাইন নদীর ধারে আরেকটি শহর মেইন্স। এখানে ছাপাখানার আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের জন্ম হয়েছিল এবং একটি স্ট্যাচু তাঁর স্মরণে এখানে রয়েছে। আরেকদিন তিনি গেলেন ওর্মসে। মার্টিন লুথার কিং-এর জন্মস্থানে। তাঁর স্মৃতিসৌধ, স্ট্যাচু দেখলেন। রাইন নদী ধরে আরও এগোলে রাইনের উপনদী নেকার এসে রাইন নদীতে মেশে। নেকারের পাড়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হাইডেলবার্গ। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় জার্মানির মধ্যে সর্বপ্রাচীন। চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি এখানকার প্রাচীন ভগ্নপ্রায় দুর্গ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। রাইন নদী ধরে আরও এগোলে আসে স্পিরেস। তারপর স্ট্রাসবুর্গ, আলসেক, মেটস, লরাইন প্রভৃতি শহর। এগুলি অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস বহন করে চলেছে। 

রাইনল্যান্ড অর্থাৎ রাইন নদীর ধারের এই টুকরো টুকরো বেড়ানোর কথা দিয়েই শেষ হয় লেখক রমেশ চন্দ্র দত্তের ১৮৬৮ থেকে ১৮৭১ পর্যন্ত তিন বছর ইউরোপে বাস এবং পরবর্তী ১৮৮৬১৮৯৩ সালে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ভ্রমণকাহিনী। বইটি এত বেশি তথ্য নির্ভর যে পরবর্তীকালে ইউরোপের এই ব্লগে এই দেশগুলির অন্য লেখকদের ভ্রমণ কাহিনী যখন বর্ণিত হবে, তখন এটিকে ভিত্তি হিসেবে রেখে নতুন তথ্য যোগ করা হবে মাত্র। রমেশ চন্দ্র দত্ত মহাশয়-এর ইউরোপের ইতিহাস এবং স্থানগুলি সম্পর্কে এত বিশদ জ্ঞান থাকার কারণে তাঁর লেখা রচনা আজও বহু অংশে প্রাসঙ্গিক।

৬২। ইউরোপে তিন বছর ৮ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইতালি , ভ্যাটিকান সিটি।

রমেশ চন্দ্র দত্তের পরবর্তী দর্শনীয় স্থান ভ্যাটিকান সিটি। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ভ্যাটিকান সিটি রোম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। লেখক যখন ১৮৮৬ -তে সেখানে গেছেন তখন সেটি রোম। তাই তিনি এটিকে রোম বলে নথিবদ্ধ করেছেন। বর্তমানে ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত মধ্যযুগীয় রোমের সর্বোত্তম স্থাপত্য সেন্ট পিটার্স চার্চ। বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় সেই চার্চের প্রবেশপথে দুটি অর্ধচন্দ্রাকার শ্রেণীতে ২৮৪ টি স্তম্ভ রয়েছে। তার উপরে ১৯২ টি সন্তদের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চার্চে সুউচ্চ মার্বেল স্তম্ভ, সোনার জলের কাজ করা ছাদ, মার্বেলের রাস্তা, পিলার, ব্রোঞ্জ-এর পিলার, ব্রোঞ্জ-এর আচ্ছাদন, বিশাল ডোম, চার্চের উচ্চতা সবমিলিয়ে অসম্ভব আভিজাত্য, জাঁকজমক যুক্ত পরিবেশ স্বপ্নের জগত তৈরি করেছে। সমস্ত স্থাপত্যের পরিমাপ এত নিখুঁত যে ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। এখানে পোপেদের সমাধি ও মূর্তি রয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলোর তৈরি বেশ কিছু অসাধারণ মূর্তি আছে। চার্চের সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা ৬০৭ ফুট। চার্চের বাইরের যে ৭৭ ফুট লম্বা ওবেলিক আছে তা অত্যন্ত প্রাচীন। এটি মিশর থেকে রোমে আনেন সম্রাট ক্যালীগুলা। 


সেন্ট পিটার চার্চ-এর কাছে রয়েছে পোপের প্রাসাদ, যা ১৮৭১ -এর আগে পৃথক সাম্রাজ্য ছিল এবং লেখকের ভ্রমণ কালে তা ইতালির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই প্রাসাদে অনেক মূল্যবান চিত্রকলা আছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিস্তিন চ্যাপেলের দেওয়াল জুড়ে মাইকেল এঞ্জেলোর লাস্ট জাজমেন্ট ছবিটি। এই প্রাসাদের পাশে ভ্যাটিকানের মিউজিয়াম অবস্থিত, যেখানে অনেক প্রাচীন ভাস্কর্য রয়েছে। যেমন মাইকেল এঞ্জেলোর অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার। 


রোম থেকে ২৬ মাইল দূরে ভেলেত্রি-তে এলেন লেখক। এটি প্রাচীন ভোলসি উপজাতির শহর। এখানে তাদের প্রাচীন দুর্গ রয়েছে। তারপর প্রাচীন শহর সেগ্নি হয়ে সেপ্রানো পেরিয়ে লেখক নেপলস্ পৌঁছলেন। নেপলস্ শহর অন্যান্য ইতালীয় শহরের তুলনায় অপরিষ্কার, রাস্তায় ভিখারীর উৎপাত আছে। রাজপ্রাসাদ, সেন্ট ফ্রান্সিসকো ডি পাওলো চার্চ, অ্যাকুরিয়াম দেখলেন। একটি ইলেকট্রিক ফিস লেখকের হাতে শক দিল লেখক যখন অ্যাকুরিয়ামে তার গায়ে হাত দিয়েছিলেন। 


ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি দেখার দীর্ঘকালের স্বপ্ন লেখকের এবার পূর্ণ হল। ২৮ ফ্রাঙ্কের বিনিময়ে একটি কোম্পানি ভিসুভিয়াসের ক্রেটারের কাছে নিয়ে যায়। ঘোড়ার গাড়ি শহর ছেড়ে আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ে উঠতে থাকল। ভিসুভিয়াস পর্বতের গায়ে সর্বত্রই লাভার শত সহস্র বছরের আস্তরণ নানা রকম নকশা তৈরি করেছে। পাহাড়ের উপর থেকে নেপলস্ শহরকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা হোটেলে গাড়ি থেকে নেমে তাঁরা দুপুরের খাবার খেলেন। এরপর পাহাড়ের অংশ এত খাড়াই যে ঘোড়া উঠতে পারে না। সেখানে রেলের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু এই রেল স্টিম বা ইলেকট্রিকের সাহায্যে চলে না। দড়ি ও পুলির সাহায্যে রেললাইন ধরে গাড়ি টেনে উপরে তোলা হয়। এভাবে প্রায় চূড়ায় পৌঁছনো হলো। তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে উচ্চতার সঙ্গে। এরপরের অংশ হেঁটে উঠতে হলো। ক্রেটারের কিনারায় দাঁড়িয়ে লেখক দেখলেন নীচ থেকে সালফার মিশ্রিত সাদা ধোঁয়া সবেগে উপরে উঠে আসছে। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস থেকে ধোঁয়ার সঙ্গে মাঝে মাঝেই পাথরের টুকরো উৎক্ষেপিত হচ্ছে। নতুন লাভা গড়াতে দেখলেন তিনি ক্রেটার থেকে। এক টুকরো কাগজ ক্রেটারের মধ্যে ফেলতে তা নীচে না গিয়ে ধোঁয়ার চাপে বুলেটের মত তীব্র বেগে উপরে ফিরে এল। 


লেখকের এই সম্পূর্ণ ভ্রমণের মধ্যে সব থেকে বেশি দেখার ইচ্ছা ছিল আঠেরো 'শ বছর ধরে লাভার তলায় থাকা, মাটি খুড়ে পাওয়া পম্পেই। এই শহরের অবশেষ সেই সময়ের মানুষের রোজকার জীবনকে চোখের সামনে দেখা সুযোগ দেয়। সমস্ত প্রাচীন রোমান শহরের মতো পম্পেইতে ফোরাম রয়েছে। সেখানে নেপচুন, জুপিটার, ভেনাস, আইসিস, অগাস্টাস, মার্কারির সুন্দর মন্দির আছে। আছে বিচার সভা, কারাগার, থিয়েটার, আম্ফিথিয়েটার, স্নানাগার, দোকান বাজার, রুটি তৈরির কারখানা ইত্যাদি।হারকিউলানিয়াম গেট, ভেস্টাল কুমারীদের প্রাসাদ, সেসেরোস ভিলা সব দেখলেন লেখক। তবে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি খুব ছোট এবং জানলা নেই। ফলে আলো বাতাস পাওয়ার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। রাস্তাঘাট পাথরে বাঁধানো কিন্তু রাস্তা এমন প্রশস্ত নয়। জল নিকাশি ব্যবস্থা নেই। ঘরের মাপ তখন আশ্চর্যজনক ছোট ছিল এখনকার নিরিখে। সাধারণ মানের গৃহস্থালি দ্রব্য, যেমন - বাতি, তৈজসপত্র প্রভৃতি স্বল্প পরিমাণে এখানে রয়েছে। বেশিরভাগ নেপলসের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সাধারণ বাড়ির দেওয়ালেও নিম্ন রুচির অশ্লীল ছবি দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বর্তমানের শালীনতাবোধ ও পাপবোধ তখনকার মানুষের মনে সেভাবে ছিল না। 

ভিসুভিয়াসের পাদদেশে হারকিউলিয়াম আরেকটি শহর যা পম্পেই-এর মত অগ্নুৎপাতে ধ্বংস হয়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর ৭৯ খ্রিস্টাব্দে। তবে এটি পম্পেই-র মতো লাভার ধুলোতে ঢাকা পড়েনি, গভীর লাভার স্তরে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল। নতুন শহরটি পোর্টিসি, রেসিনা, টরে দি গিরেসো নামের নতুন শহরগুলি এই লাভার স্তরের উপর গড়ে উঠেছে। তাই পম্পেই-এর মত এখানে মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতা উদ্ধার সম্ভব নয়। বিশাল থিয়েটার হারকিউলানিয়মের একটা অংশ শুধু খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। এটি সম্ভবত ১০০০০ মানুষের একসাথে বসে দেখার থিয়েটার ছিল। এছাড়া অল্প কিছু সাধারন ঘরবাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে যেগুলির গঠন পম্পেই-এর মতই। 


নেপলসের মিউজিয়ামে পম্পেই ও হারকিউলিয়ামে পাওয়া জিনিসপত্র রাখা আছে। ব্রোঞ্জের তৈরি ছোট বড় নানা মূর্তি, প্রধানত দেব-দেবী রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনটি হরিণ শিশুর মূর্তি, যাদের একটি ঘুমন্ত, অন্যটি নৃত্যরত ও তৃতীয়টি নেশাগ্রস্ত। তাছাড়া গৃহস্থালির বাসনপত্র, বাতি, ওজন, তুলা দণ্ড, কৃষি যন্ত্র, সূত্রধরের যন্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র, অস্ত্রপোচারের যন্ত্র, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি রয়েছে। ধনীদের ব্যবহারের সোনা রুপার পাত্র, গয়না রয়েছে। সেই সময়ের খাদ্যশস্য, সবজি, ডিম, ফল প্রভৃতি দেখা যায়। সেই সুদুরের মানুষরা যখন তারা জানতো না হঠাৎ তাদের জীবন থেমে যাবে, তখন তারা এইসব খাদ্যদ্রব্য ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রহ করে রেখেছিল। 


এবার রোম হয়ে লেখক পিসাতে গেলেন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হলেও আধুনিক পিসা খ্যাত তার হেলানো মিনারের জন্য। এই মিনার বেলফ্রী বা ঘন্টা ঘরে ক্যাথিড্রাল এর এক প্রান্তে অবস্থিত। আট তলা এই টাওয়ার ১৮০ ফুট উঁচু। এটি একদিকে এতটাই ঝুঁকে আছে যে মনে হয় পড়ে যাবে। ক্যাথিড্রালটি একাদশ শতকে তৈরি। বলা হয় এখানকার ব্রোঞ্জ বাতির দোলন দেখে গ্যালিলিও তাঁর পেন্ডুলামের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। 


পিসা থেকে জেনোয়া আসার পরে ইতালির পর্বতমালা অ্যাপেনাইন ধীরে ধীরে সমুদ্রের কাছে পৌঁছায়। ট্রেন অসংখ্য টানেলের মধ্যে দিয়ে সেই পাহাড় পেরোয়। জেনোয়া অশ্বখুরের আকৃতিতে সমুদ্রের (লিগুরিয়ান সী) তীরে অবস্থিত। পাহাড় যেন এর তিন দিকে প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি করেছে। এটি কলম্বাসের জন্মস্থান। এখানে তাঁর স্মৃতিসৌধ তথা মূর্তি আছে শ্বেত পাথরের তৈরি। জেনোয়ায় একাদশ শতাব্দীতে তৈরি  ইটালিয়ান রাজপুরুষদের তৈরি অনেক মধ্যযুগীয় প্রাসাদ আছে। তার মধ্যে এন্ডরিয়া ডোরিয়ার প্রাসাদ লেখক দেখেছিলেন। এই শহরের ক্যাম্পো সান্তো বা সমাধিস্থল অত্যন্ত সুন্দর ও দর্শনীয়।  


এবার তিনি গেলেন জেনোয়া থেকে টুরিন। পথে অ্যাপেনাইন পর্বত ও পিডমন্ট সমতলভূমির অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। টুরিন পিডমনটের রাজধানী, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও আধুনিক উন্নয়নের জন্য প্রসিদ্ধ। আধুনিকতায় একে প্যারিস, বার্লিন, ভিয়েনার সঙ্গে তুলনা করা চলে। উত্তর দক্ষিণ বিস্তৃত চওড়া সুন্দর রাস্তায় সাজানো শহরটি মনোরম। শহরের বড় বড় রাস্তা, স্কোয়ার, রেল স্টেশনে বৈদ্যুতিক আলো রয়েছে (ইউরোপের রাস্তা ইত্যাদিতে সেই সময় বিদ্যুৎ তেমন ছিল না। যদিও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের রাস্তায় প্রথম বৈদ্যুতিকরণ হয়েছিল)। এখানকার পালাজ্জো মাদাম বা লেডিস প্যালেস দর্শনীয়। ১৩ ডিসেম্বর টুরিন ত্যাগ করে রিভোলি হয়ে মাউন্টা সেনি টানেল দিয়ে আল্পস পর্বত পেরিয়ে তাঁরা মোডেন পৌঁছলেন। এটি সীমানা শহর। এখানে সঙ্গের জিনিসপত্র পরীক্ষা হল। পরদিন তাঁরা প্যারিসে পৌঁছলেন। 

                        (চলছে)

৬১। ইউরোপে তিন বছর ৭ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

  এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইতালি ।

২৫ শে নভেম্বর ১৮৮৬ ইতালির ভেরোনা শহর ঘুরে দেখলেন রমেশ চন্দ্র দত্ত। সরু কিন্তু পরিচ্ছন্ন রাস্তায় ঘোরার সময় তাঁর কখনো কখনো মনে হচ্ছিল তিনি কোনো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভারতীয় শহরে রয়েছে। বাড়িগুলোর মধ্যে ভারতীয় ধাঁচের বড় চৌকো উঠোন আছে। অনুকূল আবহাওয়া আর উর্বর মাটি ভারত আর ইতালিতে প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল, যখন পৃথিবীর অধিকাংশ অন্য দেশে সভ্যতার চিহ্নমাত্র ছিল না। দশম শতাব্দীর পরে ভারত আর ইতালি দুটি দেশই বৈদেশিক শক্তির আক্রমণে জর্জরিত হয়েছে। প্রাচীন রোমান সভ্যতার কিছু নিদর্শন এখনো ভেরোনায় রয়েছে। অ্যারেনা বা আম্ফিথিয়েটার তার মধ্যে প্রধান। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে সম্পূর্ণ মার্বেলে তৈরি এই অ্যারেনাতে ২২ হাজার মানুষ একত্রে বসে সেকালের রোমের হিংস্র খেলাগুলি দেখত। রয়েছে পোর্তা দেই বর্সারি - রোমান আমলের নগরের প্রবেশদ্বার। শহরের কেন্দ্রে রয়েছে প্যালেস অফ কাউন্সিল ও বর্তমান ইতালির শ্রেষ্ঠ কবি দান্তের মর্মর মূর্তি। এছাড়া রোমিও জুলিয়েটের রোমিওর বাড়ি বলে প্রচলিত মধ্যযুগীয় প্রাসাদ এখানে দর্শনীয়। 


সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ভেরোনা ত্যাগ করে ফ্লোরেন্স আর রোমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সে রাতে তিনি মন্টুয়া হয়ে বোলোগ্না শহরে এলেন। বোলোগ্না শহর আরকেডে বা আর্চে ঢাকা পথে পূর্ণ। এখানকার ভিক্টর ইমানুয়েল স্কোয়ারে নেপচুনের মূর্তি, চার্চ এবং কিছু প্রাচীন প্রাসাদ রয়েছে। কাছে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেশ কিছু প্রাচীন গির্জা। এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হল দুটি হেলান টাওয়ার, যা দ্বাদশ শতাব্দীর ইঁটের তৈরি। ২৭২ ফুট ও ১৩০ ফুট উঁচু মিনার দুটি মাটি থেকে লম্বভাবে না থেকে কিছুটা ঝুঁকে রয়েছে, দেখে মনে হয় পড়ে যাবে। ইটালিয়ান শিল্পী ভাতৃদ্বয় রেনী আর ক্যারাক্সির জন্ম বোলোগ্নাতে হয়েছিল। এই শিল্পীদের আঁকা মূল্যবান ছবি এখানকার একাডেমিতে আছে। এখানকার সমাধিক্ষেত্র কাম্পো সান্তো ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর সমাধিস্থল। এখানে অনেক প্রসিদ্ধ মানুষের সমাধি, তাঁদের মূর্তি রয়েছে যা দর্শনীয়। 


বোলোগ্না থেকে যাত্রা করে রেনো নদী পেরিয়ে, অনেক টানেল পার হয়ে পিসতোজা (যেখানে প্রথম পিস্তল তৈরি হয়েছিল) হয়ে ফ্লোরেন্সে পৌঁছলেন লেখক। আর্নো নদীর তীরে ফ্লোরেন্স খুব সুন্দর শহর। চারদিক ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা ফ্লোরেন্স ইউরোপে তথা পৃথিবীকে প্রাচীন যুগের অবসান ঘটিয়ে মধ্যযুগের আলো দেখিয়েছিল। এই শহর কবিতা, সাহিত্য, শিল্প, ভাস্কর্য, বিজ্ঞানে যে চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল তার তুলনা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। গ্যালিলিও, দান্তে, পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো প্রমুখ সকলের জন্মস্থান এই ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্সের উফিজি ও পিত্তি এই দুটি আর্ট গ্যালারির সংগ্রহ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাছাড়া ক্যাথিড্রাল, বেল ফ্রী এবং ব্যাপটিস্ট্রি অবশ্যই দর্শণীয়। মেদিচিয়ানে চ্যাপেল একটি অপূর্ব স্থাপত্য, যার ভেতরের দেওয়ালগুলি ১৮ রকম মার্বেল ও নানা রকম মূল্যবান দ্রব্য দিয়ে তৈরি। মেদিচি পরিবারের এই সৌধে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর তৈরি কিছু ভাস্কর্য এখানে রয়েছে। যেমন দিন, রাত, ভোর, গোধূলি; যেগুলি রেনেসাঁ যুগের শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিছু অসমাপ্ত কাজও রয়েছে কারণ মাইকেল এঞ্জেলো এরপর রোমে চলে যান। (মেদিচি ইতালির একটি ধনী পরিবার, যাঁরা রেনেসাঁ যুগে ফ্লোরেন্সের শাসন করতেন। তাঁরা শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই পরিবারের সদস্যরা অনেকে পোপ এবং বিভিন্ন স্থানের শাসক ছিলেন)। এবার লেখক দেখলেন সান ক্রোচে গির্জা, সেখানে তিনি বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর সমাধি দেখলেন এবং তাঁর স্মরণে তৈরি টেলিস্কোপ হাতে তাঁর মূর্তি দেখলেন। মাইকেল এঞ্জেলোর সমাধি দেখলেন, সঙ্গে তিনজন নারীর মূর্তি যারা চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের প্রতীক। রাজনীতিবিদ ম্যাকিয়াভেলির সমাধিও দেখলেন। কবি দান্তের সমাধি এখানে না থাকলেও তাঁর ১৮ ফুট উঁচু মূর্তি রয়েছে যেটি ২২ ফুট উঁচু বেদির উপর বসানো রয়েছে। 


এরপর লেখকের গন্তব্য রোম, যা লেখকের মতে ভালো করে দেখতে অন্তত এক মাস সময় দরকার। লেখক এখানে চার দিন কাটিয়েছিলেন। রোমের উপর একটি আস্ত বই লেখা যায় বলেছেন লেখক, তবে তিনি শুধু সারমর্ম টুকু লিখেছেন বলে জানিয়েছেন। রোম দেখা শুরু হয় ফোরাম থেকে। রোমের ফোরাম ছিল প্রাচীন রোমের জনসাধারণের প্লাজা এবং শহরের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এটি প্যালাটিন পাহাড় ও ক্যাম্পিডোগলিও পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। ফোরাম রোমের প্রাচীন সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবার ভায়া সাকরা নামক পথ ধরে দর্শনীয় স্থান দেখতে শুরু করলেন লেখক। এই রাস্তাটি রোমের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, যা রোমের ফোরাম থেকে ক্যালিনিন পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো এবং রোমান বিজয়ীদের পদচারনার পথ ছিল। প্রথম এল ট্যাবুলারিয়াম, যেখানে টেবিলস অফ ল লিখিত ছিল (১২ টি টেবিল যাতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান আইনকানুন জনগণের জন্য প্রদর্শিত ছিল)। এরপর দেখা যায় সেভেরাসের আর্চ নামক স্মৃতিসৌধ। ভেস্পাসিয়ান মন্দিরের ভগ্নাবশেষ রয়েছে এরপরে। আছে স্যাটার্ন মন্দিরের কিছু স্তম্ভ। তারপর দেখা গেল বেসিলিকা জুলিয়ার ভগ্নাবশেষ, যা জুলিয়াস সিজারের শুরু করা ও উত্তরসূরীদের শেষ করা। এটি প্রধানত আইনগত ও বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত হতো। এরপর কাস্টর এবং পলুস্ক মন্দিরের কোরিনথিয়ান পিলার চোখে পড়ে। এরপর এল রেগিয়া যেখানে জুলিয়াস সিজার মৃত্যুকাল পর্যন্ত ছিলেন। এরপর  ভেস্টার মন্দির, যেখানে পবিত্র অগ্নি রাখা থাকত এবং ভেস্টার কুমারীরা থাকতেন সেখানে সেই আগুন রক্ষা ও সর্বদা প্রচলিত রাখার জন্য। ভেস্টার কুমারীদের থাকার প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। এরপর টেম্পল অফ ফস্টিনার দশটি সুন্দর স্তম্ভ এখনো রয়েছে। তারপর সম্রাট ভেস্পাশিয়ানের নির্মিত সুবিশাল ব্যাসিলিকা অফ কনস্ট্যানটাইনের ধ্বংসাবশেষ। এবার আসে টিটাসের আর্চ, এটি প্রায় অক্ষত আছে। ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের বিজয়ের স্মরণে এটি তৈরি। আর্চের ভাস্কর্যে রোমান সামরিক বিজয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি ভেনাসের মন্দির। এরপর মেটা সুডানস নামের ফোয়ারা, যাতে হাত-পা ধুয়ে গ্ল্যাডিয়েটাররা কলোসিয়ামে প্রবেশ করত। আর্চ অফ কনস্ট্যান্টিন পেরিয়ে বিশাল কলোসিয়াম দাঁড়িয়ে আছে। এটি অতি বৃহৎ অ্যাম্ফিথিয়েটার যেখানে গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধ, প্রাণী ও মানুষ নিধন, জনসাধারণের বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হতো। সম্রাট ভেসপিয়ান এটির নির্মাণ শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র টিটাস এটি শেষ করেন ৮০ খ্রিস্টাব্দে। এখানে এক লাখ দর্শক বসে দেখতে পারত অনুষ্ঠান। পাঁচ হাজার বন্য পশু, দশ হাজার বন্দী মানুষ এই কলোসিয়ামের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে টিটাস কর্তৃক বলিপ্রদত্ত হয়। পরে পূর্ব-পশ্চিমের অনেক বন্দী, খ্রিস্টান, গ্ল্যাডিয়েটরকে এখানে হত্যা করা হয়েছে সাহসী ও নিষ্ঠুর রোমবাসীর উত্তেজিত দৃষ্টির সামনে। পরবর্তীকালে এখানকার পাথর ইত্যাদি অনেকাংশে রোমের অনেক ঘরবাড়ি রাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে, এখন তাই কলোসিয়াম অনেক অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত। অন্যদিকে প্যালাটাইন পাহাড়ের উপরে সুপ্রাচীন রোমান রাজা টারকুইনের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, জুপিটার স্টাররের মন্দির আর রোমের কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা রমুলাসের তৈরি (বলে প্রচলিত) সৌধের প্রাচীন দেওয়াল রয়েছে। এর কাছে রয়েছে ভেসপিয়ানের তৈরি প্রাসাদ, অগাস্টাসের তৈরি প্রাসাদের প্রায় বিলুপ্ত অংশ। এরপরের দর্শনীয় স্থান কারাকাল্লার স্নানাগার, যা সম্রাট কারাকাল্লার শাসনকালে তৈরি প্রাচীন জন স্নানাগার। এটি স্নান, ব্যায়াম ছাড়াও নানা বিনোদনমূলক কাজে ও সকলের মেলামেশা স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া রোমে ডায়োক্লেশনের স্নানাগার নামে আরেকটি প্রাচীন স্নানাগার আছে। এই স্নানাগারের একটি অংশ মাইকেলেঞ্জেলো একটি চার্চে রূপান্তরিত করেন। রোমের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল প্যান্থিয়ন। প্যান্থিওন রোমের একটি প্রাচীন মন্দির যা সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের তৈরি। বর্তমানে এটি গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্যান্থিয়ান তার বিশাল গম্বুজের জন্য বিখ্যাত। প্রখ্যাত শিল্পী রাফায়েল এখানে সমাহিত আছেন। পিলার অফ ট্রাজান সম্রাট ট্রাজানের যুদ্ধবিজয়ের স্মরণসৌধ। পিলার অফ অ্যান্টনিনাস সম্রাট অ্যান্টনিনাসের স্মরণে তৈরি। রোমের প্রাচীন সভ্যতার আরেকটি দর্শনীয় নিদর্শন হল অ্যাকুই ডাক্ট, যা প্রাচীন রোমের জল সরবরাহ ব্যবস্থা। এটি সাধারণত একাধিক পিলারের উপর নির্মিত একটি কাঠামো, যা দূরবর্তী জলের উৎস থেকে শহরের ভিতর জল আনত। উন্নত জল প্রকল্প ছাড়াও প্রাচীন রোমে উন্নত জলনিকাশি ব্যবস্থা ছিল, একে ক্লোয়াকা মাক্সিমা বলা হতো। এই দুটি উন্নত প্রযুক্তির উদাহরণ বর্তমানে দর্শনীয় স্থান বলে বিবেচিত। রোমে তিনশোর বেশি গির্জা আছে, তার মধ্যে বেশ কিছু দর্শনীয়। সেন্ট পলস চার্চ, সেন্ট জন ল্যাটেরান চার্চ, সেন্ট মারিয়া, মাগিওর চার্চ প্রভৃতি। লেখক এবার দেখলেন ক্যাটাকম অফ সেন্ট ক্যালিক্টাস। এটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরি খ্রিস্টীয় কবরখানা ও ধর্মীয় স্থান। এখানে প্রথম যুগের খ্রিস্টানেরা গোপনে প্রার্থনা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান করত। সেন্ট সিবাস্টিয়ান চার্চ ক্যাটাকমের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে অনেক খ্রিস্টান শহীদ সমাহিত ছিলেন। রোমের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলি প্রাচীন রোমান ধর্মের বিনাশ আর ক্যাটাকমগুলি নতুন খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশের প্রতীক।
 
                          (চলছে)

৬০। ইউরোপে তিন বছর ৬ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - জার্মানী, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া।


হল্যান্ডের আর্মস্টারডাম থেকে রমেশচন্দ্র দত্ত এলেন জার্মানির হ্যানোভারে। শহরের একটি অংশে প্রাচীন বাড়িঘর রয়েছে এবং আরেকটি নতুন অংশ গড়ে উঠেছে। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ দার্শনিক লেইবনিজের বাড়ি এখনো দর্শকদের জন্য চিহ্নিত করা আছে। রাজপ্রাসাদ, টাউন হল, চার্চ, বাজার দেখলেন লেখক। 

এর পরের দ্রষ্টব্য বার্লিন। বার্লিন দ্বাদশ শতাব্দীতে একটি মৎস্যজীবীদের গ্রাম ছিল। ১২৫০ সালে এখানে শহর তৈরি করা হয় এবং ১৩০০ সালে প্রাচীর দিয়ে শহর ঘিরে দেওয়া হয়। টিয়ারগার্টেন বার্লিনর সবচেয়ে মনোরম উদ্যান। এখানে একটি বিজয় সৌধ আছে। পার্ক থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে গিয়ে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট দিয়ে শহরে ঢুকলেন লেখক। গেটটি ৮৫ ফুট উঁচু, মাথায় বিজয়ের প্রতীক হিসেবে চার ঘোড়ার টানা রথে মহিলার ব্রোঞ্জের মূর্তি কোয়ানড্রিগা অফ ভিকট্রি। পাঁচটি প্রবেশ পথ আছে। মাঝের পথটি রাজকীয় শটকযানের জন্য সংরক্ষিত। ভিতরে প্রথমে পারিস প্লেস নামক স্কোয়ার রয়েছে, সেখানে দু'ধারে গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি রয়েছে। যেমন বিভিন্ন এম্বাসিগুলি। এরপর উন্টারডেন লিণ্ডেন নামের সুন্দর রাস্তা শুরু হয়েছে। এই পথে রয়েছে ফ্রেডরিক দি গ্রেট-এর (১৮ শতাব্দীর প্রুশিয়ার শাসক) ব্রোঞ্জ মূর্তি। এর উল্টোদিকে রয়েছে সাধারণ চেহারার রাজপ্রাসাদ বা কাইজারের আবাসস্থল। সেখান থেকে তিনি কাইজারের দর্শন পেলেন রাজবাড়ির জানালায়। রাজপ্রাসাদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন, রয়াল লাইব্রেরী। এই লাইব্রেরীতে গুটেনবার্গের পার্চমেন্টে লেখা বাইবেল, ১৪৬০ মার্টিন লুথারের বাইবেলের অনুবাদের মতো দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে। রাজপ্রাসাদের সামনে রয়েছে আর্সেনাল বা অস্ত্রাগার, যা পুরনো কামান ও অস্ত্রের মিউজিয়াম। এরপর উন্টারডেন লিনডেন রাস্তার একটি ব্রিজ পেরিয়ে একটা দ্বীপের মতো স্থান আসে। সেই দ্বীপে পুরনো কেল্লা ও পুরনো মিউজিয়াম আছে। এই পুরনো মিউজিয়ামে মূল্যবান অনেক চিত্র আছে। রেমব্রান্ট, রুবেন, ভ্যান ডাইক, রাফায়েল, টিটিয়ান প্রমুখ চিত্রকরের কাজ এখানে আছে। নতুন মিউজিয়ামে অনেক আধুনিক চিত্র, মূর্তি ও মিশরের প্রাচীন সংগ্রহ রয়েছে। প্রাচীন রাজপ্রাসাদটি চারতলা উঁচু, বড় এবং সুসজ্জিত। রাজাদের প্রার্থনা গৃহ রয়েছে, যার ডোম ২৪০ ফুট উঁচু। দ্বীপ থেকে ব্রিজের মাধ্যমে পার হয়ে পুরনো শহরে প্রবেশ করে লেখক টাউন হল (রথ হাউস) দেখলেন, যার মিনার বার্লিন-এর সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্য। জার্মানির আরেকটি সুন্দর রাস্তা হল উইলহেম স্ট্রিট। সেখানে তিনি প্রুশিয়ার রাজনীতিবিদ বিসমার্কের বাড়ি দেখলেন। আরেকটি সুন্দর রাস্তা ফ্রেডেরিক স্ট্রীটে রয়েছে বিখ্যাত জার্মান থিয়েটার, যার সামনে শিলার-এর মার্বেল মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। আছে ফরাসি ও জার্মান গির্জা এবং গ্যোটের মূর্তি। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে যেখানে উইলহেলম স্ট্রিট আর ফেডরিক স্ট্রীট মিশেছে সেই স্থানকে বেল আলায়েন্স বলা হয়। সেখানে ওয়াটারলুু মনুমেন্ট রয়েছে। এই সৌধের চারটি শ্বেত পাথরের স্তম্ভ ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, জার্মানি ও প্রুশিয়ার প্রতীক। এই চার দেশ নেপোলিয়নের বিজয় গর্বে গর্বিত। এটি বোঝা যায় ইংল্যান্ডের ওয়াটারলু ব্রিজ ও ওয়াটারলু প্রেস, বেলজিয়ামের ব্রুসেলসের বেলজিয়াম সিংহ ওয়াটারলুর রণক্ষেত্রে, আর্মস্ট্রাডামের ওয়াটারলু প্লেস, হেনোভারের ওয়াটারলু স্তম্ভ আর বার্লিনের এই সৌধ থেকে। 


জার্মানির আরেকটি শহর ড্রেসডেন হল সাক্সনি প্রদেশে অবস্থিত সাম্রাজ্যের একটি সদস্য। এখানকার জুইঙ্গার প্রাসাদের চিত্রশালা ড্রেসডেনকে ইউরোপের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। এখানে পোর্সেলিন আবিষ্কার হয়েছিল এবং পোর্সেলিনের কাজ এখানে অত্যন্ত বিখ্যাত। চিত্রশালার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান হলো র‍্যাফায়েল-এর ম্যাডোনা। এছাড়া মাইকেল এঞ্জেলো, টিটিয়ান, রুবেন, ভ্যান ডাইক প্রমুখের চিত্রকলা এই গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে। 


ড্রেসডেন থেকে বোহেমিয়া (বর্তমান চেক রিপাবলিক) যাওয়ার পথে এলব নদীর দুপাশে সুউচ্চ পাহাড় আর জঙ্গল। এই অববাহিকাকে সাক্সন সুইজারল্যান্ড বলা হয় এর চমৎকার সৌন্দর্য আর বন্য পরিবেশের জন্য। লেখক লিখেছেন বোহেমিয়া যখন স্বাধীন ছিল তখন প্রাগ তার রাজধানী ছিল। (এখন চেক রিপাবলিকের রাজধানীর প্রাগ)। এই শহরটি মলডাউ নদীর দু'তীরে অবস্থিত। শহরটি এখনো প্রাচীনতা ছেড়ে আধুনিক সময়ে আসেনি বলে মনে হয়। শহরে ঢোকার প্রাচীন প্রবেশদ্বারের নাম পালভারথুর্ম। তারপর এলো গ্রস রিং বা বড় ক্ষেত্র, যেখানে বোহেমিয়ান রাজা ও নাইটরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রভৃতি করত। এর কাছেই রয়েছে পুরনো ঘেটো বা ইহুদিদের বাসস্থান, যেখানে অনেক অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে এবং শেষে তাদের শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। মোলডাও নদী বা ভলতাভা নদীর পাড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে বোহেমিয়ান রাজাদের প্রাসাদ দেখার মত। পাহাড়ের নীচে রয়েছে ওয়ালেনস্টাইন প্যালেস, যা ওয়ালেনস্টাইন নামক তিরিশ বছরের যুদ্ধের নায়কের প্রাসাদ। বোহেমিয়ার গৌরব অনেকাংশেই বিনষ্ট হয়েছে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে। কিন্তু অনেকাংশেই স্লাভদের মধ্যে দেশপ্রেম বজায় আছে। 


এবার লেখক এলেন অস্ট্রিয়া দেশের ভিয়েনা শহরে। এটি রাজধানী শহর। ইউরোপের প্রতিটি দেশে গত ২০-৩০ বছরে রাজধানী শহরগুলিকে প্যারিসের মতো গড়ে তোলার জন্য সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। কিন্তু সেই কাজ ভিয়েনায় অসম্ভব ভালো হয়েছে। নতুন চওড়া রাস্তা, স্কোয়ার, বাগান, প্রাসাদোপম বাড়ির সারি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে শহরের মধ্যে প্রকৃতির ছোঁয়াও রাখা হয়েছে। পুরনো শহর দানিউব ক্যানালের ডান পাড়ে অবস্থিত ( দানিউব ক্যানাল দানিউব নদীর সঙ্গে যুক্ত খাল, যা ১৮৬৭ সালে মূলত নৌযান চলাচলের জন্য নির্মিত হয়েছিল)। দানিউব ক্যানালের পাশ দিয়ে যে অর্ধ বৃত্তাকার প্রশস্ত পথ গেছে তাকে রিং ইন ভিয়েনা বলা হয়। এই রাস্তার পাশে বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল ডি ভিল, পার্লামেন্ট ভবন, থিয়েটার হল, পালৈ দি জাস্টিস, রাজপ্রাসাদ, অপেরা হাউস, সেন্ট চার্লস চার্চ, সুন্দর পার্ক প্রভৃতি রয়েছে। ভিয়েনা রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কক্ষটি হলো রেগালিয়া, এটি ঐতিহাসিক রাজকীয় সাজ সজ্জার প্রতীক। এই সাজ সজ্জার মাধ্যমে রাজা রানীর ক্ষমতা প্রতিফলিত হতো। এটি অস্ট্রিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতি অংশ হিসেবে সংরক্ষিত। এখানে রাজারাণীর ব্যবহৃত বাসনপত্র, পোশাক, গয়না, ঘড়ি, রত্ন সংগ্রহ, রাজ মুকুট , সেপ্টার বা রাজদণ্ড, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি দেখা যায়। এখানে ফ্লোরেন্টিন নামে একটা হীরা রয়েছে, যা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম হীরা। এই প্রাসাদের রাজকীয় অশ্বালয়ে নানা জাতের, নানা মাপের ঘোড়ার বিশাল সংগ্রহ আছে। আর আছে প্রাচীনকাল থেকে নানা রকম ঘোড়ার গাড়ির সংগ্রহ। এরপর লেখক দেখলেন বেলভেডের প্যালেস। প্রাসাদের বাগান, মূর্তি প্রভৃতি আগের মত রেখে বাকিটা মিউজিয়াম হিসেবে সাজানো হয়েছে। এখানকার পিকচার গ্যালারী অসাধারণ। টি, রুবেন, র‍্যাফায়েল, আলবার্ট ডুরে প্রমুখ শিল্পীদের আঁকা ছবি এখানে রয়েছে। প্র্যাটের হল শহরের একটি বড় ও সুন্দর পার্ক। এটি পর্যটকদের কাছে প্যারিসের বয়া দে বুলগানের মতো জনপ্রিয়। 


ভিয়েনার পর লেখক গেলেন সালজবুর্গ, যা পাহাড়ের মাঝখানে সালজ নদীর তীরে অবস্থিত। চারদিকের সুউচ্চ তুষারশৃঙ্গ একে অসাধারণ সৌন্দর্য দিয়েছে। 


সালজবুর্গে অল্প সময় কাটিয়ে তিনি আরো পশ্চিমে বাভারিয়া রাজ্যে চললেন। আল্পসের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তিনি ট্রাউনস্টাইন পেরিয়ে পাহাড় আর পাইন গাছে সাজানো ছবির মত সুন্দর গ্রামে বেরগেনে এলেন। এরপর একটা চেমস নামের সুন্দর লেক পেরোলেন। লেকের মধ্যে দূরে তিনটি জঙ্গলে ভরা দ্বীপ দেখা গেল। আগে ওই দ্বীপগুলিতে খ্রিস্টান সাধু-সাদ্ধিরা বাস করতেন। 


প্রিয়েন ও ইন নদী পেরিয়ে তিনি বাভেরিয়ার রোজেনহাইম শহরে পৌঁছলেন। এখান থেকে মিউনিখ মাত্র ৪০ মাইল দূরে। তাও সময়ের অভাবে সেখানে তিনি যেতে পারলেন না বলে লেখক আফসোস করেছেন। 


রোজেনহাইম থেকে ইন্সব্রুক (টিরোলের রাজধানী) পর্যন্ত পথ ইন নদীর পাড় ধরে রয়েছে। এই অববাহিকা অসম্ভব সুন্দর। তুষারাবৃত পর্বত, গিরিখাত নিয়ে। নভেম্বরে বরফে ঢাকা ইন্সব্রুক খুব সুন্দর। তার রাজা ম্যাক্সমিলারের (হোলি রোমান এম্পায়ার) পঞ্চদশ শতাব্দীর কারুকার্যময় সমাধি, রাজার মূর্তি, ক্যাথিড্রাল দেখলেন। ২৪ শে নভেম্বর ১৮৮৬ অস্ট্রিয়া থেকে ইটালির উদ্দেশ্যে ব্রেনার পাস পেরিয়ে যাত্রা করলেন রমেশ চন্দ্র দত্ত। আল্পস পর্বতের এই পাস অস্ট্রিয়া ও ইটালির মধ্যে সীমানা রচনা করেছে। ট্রেন ধীরে ধীরে সীল উপত্যকায় উপরে উঠতে থাকল। মধ্যে মধ্যে সরু গিরিখাত পাহাড় কেটে তৈরি করা টানেল পরল। নীচে সিল নদীর ফেনিল জল সশব্দে বয়ে চলেছে জঙ্গলে ঢাকা অধিত্যকায় আর চারদিক ঘিরে রয়েছে সাত হাজার ফুট উঁচু বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ। উপরে উঠতে উঠতে ট্রেন এবার সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা অঞ্চলে পৌঁছালো। তারপর এল ৪৪৯০ ফুট উঁচু ব্রেনার পাস। ট্রেন এখানে ৫ মিনিট থামল। নভেম্বর মাসে সেখানকার তুষারাবৃত দৃশ্য নীল আকাশের পটভূমিতে অসম্ভব সুন্দর লাগল। এরপর ট্রেন নামতে শুরু করল। আবার অনেক টানেল পেরিয়ে নীচে এবার আদিজে নদীর সুন্দর উপত্যকা দেখা গেল। 


পাহাড় থেকে অপূর্ব সুন্দর উপত্যকায় নেমে ট্রেন আদিজের ধার ঘেঁষে চলতে থাকল। ছোট ছোট গ্রামের বাড়ি, চার্চ, আঙ্গুর বাগান চোখে পড়তে লাগল। আঙুর থেকে এখানে টিরোল ওয়াইন তৈরি করা হয়। (টিরোল অস্ট্রিয়ার একটি রাজ্য)। তাঁদের ট্রেন টিরোলের রাজধানী বটজেন পৌঁছাল। এখানে উত্তর দিক উঁচু পাহাড়ে এমনভাবে ঘেরা যে ঠান্ডা বাতাস আরো উত্তর দিক থেকে আসতে পারে না, দক্ষিণ থেকে উষ্ণতর বাতাস এসে স্থানটিকে আরামদায়ক আবহাওয়া দেয়। তাই এটি একটি স্বাস্থ্য নিবাস হিসেবে গড়ে উঠেছে। এরপর ট্রেন্ট, আলা হয়ে ট্রেন পৌঁছালো ভেরোনা, লেখক এবার ইতালি দেশে প্রবেশ করলেন।
                     
                            (চলছে)

৫৯। ইউরোপে তিন বছর ৫ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)


এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - বেলজিয়াম, হল্যান্ড।

২ নভেম্বর ১৮৮৬ লেখক পরিবারকে ইংল্যান্ডে রেখে একা জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি প্রভৃতি বারোটা দেশে দেড় মাসের জন্য ভ্রমণ করেন। লন্ডনের হোয়াইট ক্লিফ অফ ডোবার থেকে লেখকের স্টিমার যাত্রা শুরু হয়। 

জলপথে বেলজিয়ামের প্রথম শহর এল ওস্টেন্ড। এখানে বেলজিয়ামের রাজপ্রাসাদ রয়েছে। এখানেই ইউরোপের একটি জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত রয়েছে। এরপর এল প্রাচীন শহর ব্রুগেস, যেটি একসময় ইউরোপের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। এখানকার নত্র ডাম অনেক প্রাচীন এবং সুউচ্চ। এখানে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির সমাধি, বিভিন্ন মূল্যবান, পেন্টিং প্রভৃতি রয়েছে। এখানকার বেল ফ্রী অর্থাৎ ঐতিহাসিক ঘন্টাঘর, যা বেলজিয়ামের শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে, তা দর্শনীয়। আর রয়েছে হোটেল দি ভিল, চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত বিখ্যাত বাজার এলাকা। এর পরবর্তী শহর ঘেন্ট। এখানে দর্শনীয় ক্যাথিড্রাল, বেলফ্রি, হোটেল দি ভিল (সিটি হল), বাজার, কাউন্ট ফ্ল্যান্ডার্স-এর প্রাচীন প্রাসাদ। 

পরবর্তী শহর ব্রাসেলস, যা প্যারিসের মতো দৃষ্টি নন্দন শহর। এখানে বুলেভার্ড আছে প্যারিসের মতো। এখানকার প্যালস দি জাস্টিস (বিচারালয়), কাউন্ট এগমন্ট ও কাউন্ট হুরন- এর মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, রাজ, ক্যাথিড্রল, হোটেল দি ভিল, কংগ্রেস কলাম দর্শণীয়। 

ব্রাসেলস থেকে ওয়াটারলু যুদ্ধক্ষেত্র (যেখানে ১৮১৫ তে হওয়া যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন হয়) মাত্র ৪০ মিনিটের পথ রেলে। শাতো অফ হুগম নামক স্থানে লেখক দেওয়ালে গুলির চিহ্ন দেখলেন। 

অ্যান্টওয়ার্প এখন বেলজিয়ামের সামরিক কেন্দ্র। তাছাড়া প্রখ্যাত চিত্রকর রুবেন্স, ভ্যান ডাইকের জন্য বিখ্যাত। এখানকার ক্যাথিড্রালটি নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গথিক স্থাপত্য। এছাড়া হোটেল দি ভিল, মিউজিয়াম রয়েছে। 


অ্যান্টওয়ার্প থেকে লেখক হল্যান্ডের রটারডামে গেলেন ট্রেনে। এই পথে ট্রেন বিখ্যাত হল্যান্ডইচ ডিপ নদীর উপর ব্রিজ পার হল রেল। রটারডামে শহরের উপর দিয়ে লোহার ব্রিজ বা ভায়াডাক্ট ( সেই সময় নদীর ওপর দিয়ে ব্রিজ ও শহরের ওপর দিয়ে ওভার ব্রিজ ট্রেন যাওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রশংসনীয়) রয়েছে, যার উপর দিয়ে আর্মস্টারডাম গামী ট্রেন যায়। এমনিতে এটি একটি সাধারণ ডাচ শহর কিন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। 

এরপর লেখক হেগ গেলেন। এটি রটারডামের থেকে ঐতিহাসিক ও সৌন্দর্যগতভাবে উল্লেখযোগ্য স্থান। এখানে রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট ও হল্যান্ডের সরকারের প্রধান কার্যালয়গুলি আছে। হেগের বিনেনহফ একটি মধ্যযুগীয় দুর্গ, যার চারপাশে পরিখা আছে। বুইটেনহফ এক ঐতিহাসিক প্রাসাদ, যেখানে ডাচ পার্লামেন্ট ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি অবস্থিত। এছাড়া আছে টাউন হল, পিকচার গ্যালারী। 

হেগের পর লেখক গেলেন হল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় নগরী লেইডেনে। এই শহরকে জ্ঞানচর্চার জন্য 'এথেন্স অফ টি ওয়েস্ট' বলা হয়। এখানকার মিউজিয়ামটি অবশ্য দর্শনীয়। এখানে ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, গনেশ, দুর্গা প্রভৃতি ভারতীয় দেবদেবীর প্রাচীন মূর্তি রয়েছে। এগুলি ডাচদের জাভা উপনিবেশ থেকে আনা। ভারতীয় ধর্মের জাভায় প্রচলন প্রমাণ করে যে বর্তমানে (লেখকের সময়) কালাপানি পার হওয়া নিয়ে যে হিন্দু কুসংস্কার প্রচলিত তা সুদূর অতীতে ছিল না। 

এবার লেখক হারলেম হয়ে রাজধানী আর্মস্টারডাম গেলেন। একাদশ শতকে আর্মস্টেলের লর্ড আর্মস্টেল নদীতে একটি ড্যাম বা বাঁধ তৈরি করেন, সেই থেকে নাম হয় আর্মস্টার্ডাম। এই শহরের আশ্চর্য বিষয়টি হল এই শহরটি অসংখ্য খালের দ্বারা ৯০ টি দ্বীপে বিভক্ত ও দ্বীপগুলি প্রায় ৩০০ টি ব্রিজ দিয়ে যুক্ত। তাছাড়া শয়ে শয়ে নৌকাও শহরের সর্বত্র যাতায়াত করে। খালগুলির দুপাশে সারি দিয়ে কাঠের তৈরী বাড়িগুলি 'পাইলস অফ উড' বা কাঠের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ এখানকার দোয়াশ মাটিতে ইঁটের ভিত টেকসই হয় না।  রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট সবেতেই একই ব্যবস্থা। চার্চ, মিউজিয়াম দর্শনীয়। 
এখান থেকে লেখক উত্তর হল্যান্ডের হেল্ডার ঘুরে এলেন। 

আর্মস্টার্ডম ছেড়ে লেখক ঐতিহাসিক শহর জানডামে এলেন ও অনেক জঙ্গল, উইন্ডমিল দেখতে পেলেন। তারপরের স্থান আলকমার, এখানে মূলত চিজ-এর ব্যবসা হয়। এরপর এল হেলডার, যা একটি মৎস্যজীবীদের গ্রাম। হল্যান্ডে লেখকের শেষ গন্তব্য ছিল সমুদ্র সৈকত জুইডার জী, যেখানে তিনি স্টিম ট্রামে করে গেলেন। এটি একটি ইনল্যান্ড সী বা অভ্যন্তরীণ সাগর। তিনি শুনলেন এই সমুদ্রকে কৃষি ও পশুচারণের স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বিংশ শতাব্দীতে তাই করা হয়েছে, যা ডাচ ইঞ্জিনিয়ারিং -এর একটি অন্যতম আশ্চর্য নিদর্শন। 

                           (চলছে)

                      

৫৮। ইউরোপে তিন বছর ৪ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - নরওয়ে, সুইডেন।

১৮৮৬ এর ২২ শে জুলাই লেখক তাঁর কিছু বন্ধুর সঙ্গে লন্ডন থেকে নরওয়েসুইডেন বেড়াতে যান। লন্ডন থেকে রেলে হাল বন্দরে এসে তাঁরা স্টিমারে করে সমুদ্রপথে (নর্থ সী) নরওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। 

২৪ শে জুলাই রাত ১০:৩০ পর্যন্ত তিনি স্টিমারের ডেকে বসে বই পড়লেন কারণ তখনও যথেষ্ট সূর্যের আলো ছিল। পরদিন সকালে অ্যালেসুন্ড নামক ছোট বন্দরে অল্পক্ষণ থেকে স্টিমার আবার চলল। শীতল উত্তরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। দুপুরে ক্রিস্টিয়ান্সুন্ড নামক ছবির মত সুন্দর শহর এল। নরওয়ের বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঘরবাড়িগুলি পরিষ্কার, সুন্দর এবং কাঠের তৈরি। সন্ধ্যায় স্টিমার পৌঁছায় ড্রন্থাইমে। সেখান থেকে রাতে নর্থকেপের উদ্দেশ্যে নতুন স্টিমারে উঠলেন তাঁরা। গভীর রাত হলেও স্টিমার যখন ছাড়লো সূর্যের আলো রয়েছে। (নরওয়েকে নিশীথ সূর্যের দেশ বলা হয়)। মেরুসাগর থেকে আসা হাওয়ার প্রচন্ড ঠান্ডা পরিবেশ। তাছাড়া দিনটি মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। অসংখ্য দ্বীপ আর খাড়ি দেখা যেতে লাগল স্টিমারের দুদিকে। বেশিরভাগ জায়গার জমি এখানে নিষ্ফলা, দু এক জায়গায় অল্প কৃষি হয়েছে। এখানে কড আর হেরিং মাছ ধরা হয়। এই দুটি নরওয়ের একমাত্র রপ্তানির দ্রব্য। বিকেলে টরঘাট্টেন নামের একটা ছোট দ্বীপে নেমে দুধ আর লেমোনেড খেলেন তাঁরা। সেভেন সিস্টার্স অফ এলস্টেনো নামে সাতটি সুউচ্চ শৃঙ্গ সমুদ্র থেকে উপরে উঠেছে এখানে। তাদের মাথায় বরফের চূড়ায় কুয়াশার ঘোমটা টানা। সেদিন মধ্যরাতে লেখক মেরু রেখা পার করে মেরু প্রদেশে পৌঁছালেন। সকালে ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জল আবহাওয়া পেলেন তাঁরা। বোডো শহর পেরিয়ে নরওয়ের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের দ্বীপপুঞ্জ দেখতে দেখতে তাঁরা  রাফটারসুন্ডে এলেন। অসাধারণ সুন্দর পাহাড়, উপত্যকা, খাড়ি চোখে পড়ল। হিমশৈল আর পাহাড়ের উপরের অপরূপ বরফের দৃশ্য দেখতে দেখতে রাত দশটায় যখন ঘুমোলেন তখনও পাহাড়ের উপর সূর্যের আলো রয়েছে। 

পরদিন ট্রোমোসো শহরে স্টিমার নোঙর করল। তাঁরা ট্রোমোসো ডেল-এ পায়ে হেঁটে বেড়ালেন। তাঁরা এখন নরওয়ের ল্যাপল্যান্ডে এসেছেন, যেখানে একসময় শুধু ল্যাপ উপজাতির মানুষের বসবাস ছিল। ল্যাপেরা খর্বকায় হয় এবং তারা বলগা হরিণের চামড়ার পোশাক পরে। বার্চ গাছের ছাল ও ঘাস দিয়ে কুঁড়েঘর বানায়। ঘরের মাথায় গর্ত থাকে আলো ঢোকার ও ধোঁয়া বেরোবার জন্য। বাচ্চারা কুঁড়েঘরে চামড়ার দোলায় শক্ত করে বাঁধা থাকে, তারা হাত-পা নাড়াতে পারে না কারণ শুধুমাত্র মুখটা বাইরে থাকে। ল্যাপদের চোয়ালের হাড় বেশ উঁচু। বলগা হরিণ তাদের একমাত্র সম্পত্তি। তারা ভ্রমণার্থীদের এখন হাড়ের তৈরি চামচ-ছুরি, চামড়ার ব্যাগ-জুতো বিক্রি করে। ট্রোমোসোর রাস্তায় বেশ কিছু মেরু অঞ্চলের পশুর লোম ও চামড়া বিক্রি হতে দেখলেন লেখক। স্টাফড ভাল্লুক, মেরু নেকড়ে, সাদা শেয়াল, তিমি, হাঙর, ওয়ালরাস, ঈগল, সীগাল প্রভৃতিও বিক্রি হতে দেখলেন। 

ট্রোমোসো ছেড়ে সন্ধ্যায় আবার স্টিমার যাত্রা শুরু হল। পথে একটি অসাধারণ হিমশৈল দেখলেন। পরদিন হ্যামারফেস্ট (যেটি পৃথিবীর উত্তরতম শহর) শহরে গেলেন লেখক। কিছু কুঁড়েঘর আর গির্জা আছে সেখানে শুধু। শীতকালে বরফে ঢাকা থাকে। স্লেজ গাড়ি একমাত্র যানবাহন। হ্যামারফেস্ট-এ মাছ ধরা আর মাছের প্রক্রিয়াকরণ হয়। হ্যামারফেস্ট ছেড়ে সমুদ্রে বার্ডস রক নামক এক স্থানে তারা অগণিত সীগাল দেখলেন। স্টিমার থেকে কামানের গোলার আওয়াজ করা হলে পাখিরা উড়তে শুরু করল চক্রাকারে। তাদের ওড়ার সময় মনে হচ্ছিল মেঘ। এত পাখি পৃথিবীর কোথাও একসঙ্গে তিনি দেখেননি। 

দু'ঘণ্টা পরে স্টিমার এল নর্থ কেপে। নর্থ কেপ সমুদ্র থেকে সোজা হাজার ফুট উপরে উঠে গেছে। এখানে ইউরোপ শেষ। এরপরের মেরু সাগর যে মেরু প্রদেশে গেছে তা কোন মানুষ কখনো দেখেনি (নরওয়ের অভিযাত্রী ১৯২৬ -এ প্রথম উত্তর মেরু গেছিলেন)। তাঁদের স্টিমার দক্ষিণ দিকে ফিরতি পথে চলতে শুরু করল। হ্যামারফেস্টের পরে এল লিঙ্গেন খাড়ি। নরওয়ের অন্যান্য সমুদ্রের খাড়ির মতো এখানেও সমুদ্রের জল ৩০-৪০ মাইল স্থলভাগের মধ্যে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হয় সুন্দর হ্রদ, যার দুপাশে খাড়াভাবে হাজার ফুট উঁচু পাহাড় উঠে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় ৩০০০-৪০০০ ফুট উঁচু পাহাড় রয়েছে আবার কোথাও কোথাও পাথরগুলো পিছনে সরে অববাহিকা তৈরি করেছে। সেখানে ছোট ছোট ঝরনা চারপাশ থেকে এসে একত্রিত হয়েছে। প্রতিটি খানাখন্দে বরফের বিশাল বিশাল চাই জমে রয়েছে। পাহাড়ের গা দিয়ে রূপালী ঝরনা নামছে আর নামছে হিমবাহ। হিমবাহের গতি এত মন্থর যে চোখে তার গতি ধরা পড়ে না। এই বৈচিত্র্যময় নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে তাঁরা মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে কাটালেন। 

এবার ট্রোমোসো হয়ে লোফাডেন দ্বীপপুঞ্জের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অস্তমিত সূর্যের সোনালী আলোতে কী যে অপার্থিব রূপ ধারণ দেখলেন তা বলার নয়। রাত ১১ টায় সূর্যাস্ত শেষ হল। ঘুম আসতে রাত দুটো হল, কিন্তু তখন পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় শুরু হল। এরপর তাঁরা সার্টিসেন নামক ইউরোপীয় বৃহত্তম হিমবাহটি দেখলেন, যেটি আশি মাইলের বেশি লম্বা। তাঁরা হিমবাহের উপরে কিছুটা হাঁটলেন। ২ আগস্ট ১৯৮৬, এই স্টিমারে আট দিন ভ্রমণ করার পর তাঁরা ট্রন্ডজেম শহরে এলেন। 


এই কদিনে তাঁরা ৬৩ ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমাংশ থেকে ৭১ ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমাংশ ঘুরে এলেন। ট্রন্ডজেমে সেন্ট ওলাফের (ইনি সুইডেনকে নরওয়ের থেকে স্বাধীন করেন ও প্রথম সুইডেনের রাজা) সমাধির ওপর অনেক শতাব্দি প্রাচীন ক্যাথিড্রল রয়েছে। 


৩ আগস্ট তাঁরা ৫৩০ মাইল দূরে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের উদ্দেশ্যে রেলপথের রওনা দিলেন। নরওয়ে ও সুইডেনে সীমান্তে থাকা কিওনলেন পর্বত পেরিয়ে স্টোরলিন এল, যা এ পথের প্রথম সুইডেনের শহর। ঘন সবুজ পাইনে ঢাকা পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, মনোরম হ্রদের অনুপম দৃশ্য চোখে পড়তে থাকল ট্রেনে জালনা দিয়ে। জনসংখ্যা খুব কম। গ্রামের ছোট কাঠের বাড়ি কিছু দেখা গেল। আরেসস্কুটান পাহাড়ের নীচে অবস্থিত আরে, ডালেফ,  ক্রিলবো ইত্যাদি হয়ে ট্রেন এল সালাতে। এরপর দেশের ভূপ্রকৃতি সমতল হতে শুরু করল। ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর উপসালাতে ট্রেন বদল করে কিছুক্ষণ কাটালেন। গথিক স্টাইলে তৈরি প্রাচীন ক্যাথিড্রাল, গুস্তাভা ভাসার সমাধি, বিজ্ঞানী চার্লস লিনিয়াসের সমাধি ও সৌধ, বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরী দেখলেন। লাইব্রেরিতে পার্চমেন্ট পেপারে সোনা ও রুপার হরফে লেখা প্রাচীন গথিক ভাষার পুঁথি রয়েছে। 


এরপর ট্রেনে চড়ে তাঁরা রাতে স্টকহোম পৌঁছালেন। স্টকহোমের জনঘনত্ব বেশ কম কিন্তু এটি পৃথিবীর একটি সুন্দরতম শহর। লেক মালারেন ও বালটিক সাগরের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বেশ কিছু দ্বীপ দিয়ে গঠিত এই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরিসীম। শহরটি সমুদ্রের উত্তর উপকূলে নরমালমেন ও দক্ষিণ উপকূলে সডারমালমেন নামে পরিচিত। মূল ভূখণ্ড স্টাডেন ও অন্যান্য দ্বীপ নিয়ে তৈরী। ব্রিজ দিয়ে নরমালমেন থেকে স্টাডেন দ্বীপে এসে রাজপ্রাসাদ, বলরুম, গ্যালারি, চার্চ, সমাধিক্ষেত্র দেখা হল। সডারমালমেনে শহর উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত। লিফটের সাহায্যে মুহূর্তে নীচ থেকে উপরে পৌঁছানো যায়। উপর থেকে বালটিক সাগর ও সেখানে নোঙর করা অসংখ্য স্টিমারের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়। নরমালমেনের দৃশ্যও দেখা যায়। 


এবার তাঁরা বালটিক সাগরে স্টিমারে করে গুস্তাভবার্গ নামক স্থানে ঘুরে এলেন। এই যাত্রায় তাঁরা অপূর্ব প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দিত গ্রামীণ জীবনের ছবি দেখে এলেন। সুইডেন ও নরওয়ের মানুষ সরল ভদ্র ও হাসি খুশি। তাদের আনন্দিত মুখে ইংরেজ সুলভ অহংকার ছাপ নেই। এরা খুব উপকারী। স্টকহোমে লেখক পার্লামেন্ট, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেখলেন। 


এরপর তাঁরা স্টিমারে বালটিক সাগর ও নর্থ সী হয়ে গোটেনবার্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পরদিন স্টিমারে রোসেন লেকে এল। এরপর স্টিমার ১৫ টি লেক পার হল এবং ১৫০ ফুট উপরে উঠল। মাত্র ৮ মাইল দূরত্বে ১৫০ ফুট উপরে ওঠা খুব আকর্ষণীয় বিষয়। একটার পর একটা গেট সামনের দিকে খুলে গেল ও পিছনে বন্ধ হল এবং প্রতি বার স্টিমার দশ ফুট করে উপরে উঠে গেল। শেষে তাঁরা লেক বোরেনে এলেন। সেখান থেকে ভেটের্ন লেক, ভাইকেন লেক, ভেনার্ন লেক দেখতে দেখতে ট্রোলহাট্টান জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছলেন। গোটা নামের নদীতে স্টিমারে করে নীচে গোটেনবার্গ এলেন। এই বন্দর নগরী একটি বাণিজ্য কেন্দ্র। লেখক যখন গেলেন তখন সেখানে বার্ষিক মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। 


পরবর্তী গন্তব্য ক্রিস্টিয়ানা। গোটা নদী হয়ে বালটিক সমুদ্রে পড়ে স্টিমার এবার চলতে থাকল। অশান্ত সমুদ্র আর ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে প্রাচীন ভাইকিং -দের নৌযাত্রার জায়গায় এই অস্থির স্টিমার যাত্রায় তাঁরা শঙ্কিত হলে উঠলেন। (ভাইকিংরা ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের সামুদ্রিক যোদ্ধা, যারা ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের বিভিন্ন স্থান আক্রমণ ও বসতি স্থাপন করেছিল)। (১৯২৫ -এ ক্রিস্টিয়ানা নাম পরিবর্তন হয়ে নাম হয়েছে অসলো, এটি নরওয়ের রাজধানী)। 

অবশেষে ১৩ আগস্ট স্টিমার ক্রিস্টিয়ানা পৌঁছাল। সেখানে তাঁরা রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয় দেখলেন। এখানে লেখক সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যা দেখলেন তা দুটি ভাইকিংদের ব্যবহৃত জলযান, যা সম্ভবত নবম শতাব্দীর। ভাইকিং যোদ্ধাদের কবর খুঁড়ে এদুটি সম্প্রতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এরপর লেখক স্টিমারে করে ইংল্যান্ড প্রত্যাবর্তন করলেন।

                        (চলছে)

৫৭। ইউরোপে তিন বছর ৩ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ইটালি।


লেখক রমেশ চন্দ্র দত্ত তিন সপ্তাহের একটি ঝটিতি সফরে ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও ইতালির বিভিন্ন জায়গা দর্শন করলেন। ১৪ই আগস্ট ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন ফ্রান্সের প্যারিস পৌঁছলেন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা। প্যারিস বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর কিন্তু তখন তা হতশ্রী হয়ে পড়েছে। বিশেষত কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানে অনেক স্থাপত্য নষ্ট হয়েছে। প্যালেই রয়াল, ভঁডোম স্তম্ভ, টুইলারি (ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদ) ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও সুন্দর আলোকোজ্জ্বল পথ দেখে মনে হবে প্যারিস সবসময় আনন্দ উৎসবের মধ্যে আছে। কী ঝড় এই শহরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তা একমাত্র ধ্বংসস্তূপগুলি দেখলে বোঝা যায়। (ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধের কারণে ও প্যারিস গণঅভ্যুত্থানের জন্য ১৮৭১ এ প্যারিসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল)। প্যারিসে লুভর মিউজিয়াম একটি রাজকীয় প্রাসাদ যা টুইলারির সংলগ্ন। কিন্তু ভাগ্যবশত লুভর এই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। লেখক লুভরে স্ট্যাচু ও ছবির অমূল্য সংগ্রহ দেখলেন। প্রথম নেপোলিয়নের আর্ক দ্য ট্রিঅঁফ অক্ষত আছে। সেখানে সুন্দর শিল্পকলার সঙ্গে নেপোলিয়নের জয়লাভের বর্ণনা লেখা আছে। তাঁরা স্তম্ভের উপর উঠে প্যারিস ও স্যেন নদীর শোভা দেখলেন। স্যেন নদীতে স্টিমারে চড়ে তাঁরা অনন্য সুন্দর নোত্র ডাম চার্চ দেখতে গেলেন। নেপোলিয়নের মরদেহ সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে এনে এখানে সমাধি দেওয়া হয়েছে। সমাধির কাছে লেখা আছে নেপোলিয়নের শেষ ইচ্ছা যে মৃত্যুর পর তাঁর অবশেষ যেন স্যেন নদীর ধারে তাঁর প্রিয় ফরাসি জনগণের মধ্যে সমাহিত করা হয়। সমাধি চার-পাশ ঘিরে শ্বেত পাথরের স্তম্ভ, মূর্তি রয়েছে ও সমাধির উপর একটি সুন্দর ডোম আছে। 

প্যারিস থেকে তাঁরা সেন্ট ক্লাউড নামে ফ্রান্সের রাজাদের প্রিয় অবসরস্থলে গেলেন। এখানকার প্রাসাদ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সুন্দর উদ্যান ও রাস্তাঘাট রয়েছে। এবার তাঁরা গেলেন ভার্সেই, যা ফ্রান্সের সব থেকে শক্তিশালী রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কীর্তি। যদিও এখন সেখানে বিভিন্ন অফিস বসেছে তবু তাঁরা দেখার অনুমতি পেলেন। তাঁরা বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখলেন। সেখানকার বিভিন্ন ছবি ও মূর্তিগুলি ফ্রান্সের উজ্জ্বল দিনের গৌরব প্রকাশ করছে। ভার্সেইয়ের উদ্যান, ছায়াচ্ছন্ন পথ, ফোয়ারা, নিকুঞ্জ, বসার আসন প্রভৃতি কেন রূপকথার জগতের মত সুন্দর। 

এরপর প্যারিস হয়ে তাঁরা রাইন নদীর ধারে অবস্থিত জার্মানির কোলন শহরের দিকে যাত্রা করলেন। অডি কোলনের জন্য বিখ্যাত শহর কোলন কিন্তু অত্যন্ত নোংরা। পরদিন স্টিমারে তাঁরা মায়েন্স শহরে চললেন। রাইন নদীর দু'পাশে পাহাড় আর অনেক দুর্গ দেখা যায়। বন (Bohn) পেরোনোর পর তাঁরা সেভেন হিলস ও তার উপর ড্রাচেনফেলস দুর্গ দেখলেন। রাইন নদীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কিছু দু'পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সুউচ্চ শৃঙ্গ কুয়াশা ভেদ করে ওপরে উঠে আছে। 

এবার এল সুইজারল্যান্ড। ফ্লুলেন ও  লুসার্ন লেক দেখলেন, যা পৃথিবীর সুন্দরতম স্থান। শান্ত সরোবর সুউচ্চ পর্বত বেষ্টিত হয়ে এক অপূর্ব দৃশ্যপট রচনা করেছে। লুসার্ন থেকে স্টিমার ও ঘোড়ার গাড়িতে ইন্টারলাকেন গেলেন, যেটি ব্রেঞ্জ ও থুন হ্রদের মধ্যে অবস্থিত। ইন্টারলাকেনে তাঁরা সাদা তুষারাবৃত জুং ফ্রাউ (আল্পসের একটি সুউচ্চ শৃঙ্গ) দেখলেন চাঁদের আলোয়। এরপর স্টিমারে হ্রদ পার হয়ে তাঁরা ট্রেনে বার্ন গেলেন। বার্নে সুন্দর সুন্দর গির্জা, বাড়ি, রাস্তাঘাট আছে। বার্ন থেকে বরফে ঢাকা আল্পসের দৃশ্য অসাধারণ। এবার তাঁরা জেনেভা লেকের ওপর অবস্থিত লুসার্ন গেলেন। এখানে ঐতিহাসিক গীবন তাঁর 'হিস্ট্রি অফ রোম' লেখা শেষ করেন। সেখান থেকে এলেন শিলন ক্যাসেলে। গভীর জলে ঘেরা মূল ভূখণ্ড থেকে একটি মাত্র ব্রিজ দিয়ে যুক্ত এই দুর্গের অন্ধকার মাটির নীচের ঘরে গ্যালান্ট বনিভার্ড (সুইস স্বাধীনতা সংগ্রামী) ছয় বছরের জন্য শিকল দিয়ে স্তম্ভে বাঁধা ছিলেন। সেই ঘর, স্তম্ভ, শিকল লেখক দেখলেন। আর দেখলেন ঘরের একটি স্তম্ভে কবি বায়রণ তাঁর নাম খোদাই করে রেখে গেছেন। শিলন থেকে তাঁরা লেকের অন্য পাড়ে জেনেভা শহরে গেলেন। স্টিমারে চলতে চলতে লেকের একধারে জুরা পর্বতমালা ও অন্য পারে সুউচ্চ আল্পস পর্বত মালা দেখতে পেলেন। জেনেভা রুশো (দার্শনিক) ও সিসমন্ডির (ঐতিহাসিক) জন্মস্থান। এখান থেকে তুষারাবৃত মণ্ট ব্ল্যাঙ্ক (৪৮০৮ মিটার) দেখা যায়। 


সুইজারল্যান্ড ভ্রমণকালে লেখক লক্ষ্য করলেন যে অত্যন্ত দরিদ্ররাও এখানে ভালো আছে। তাদের ছোট কাঠের কুটির তারা সুন্দরভাবে রং করে সাজিয়েছে। ঘরের লাগোয়া জমি তারা চাষ করেছে। সবকিছু খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তাদের ব্যবহার খুব ভদ্র এবং তারা ইউরোপের বিশেষ করে ইংল্যান্ডের দরিদ্র কৃষকদের থেকে খুব স্বতন্ত্র। 

সেখান থেকে লুসার্ন ফিরে তাঁরা ডিজিলেন্স নামে ঘোড়ার ডাকগাড়ি করে সেন্ট গথার্ড নামক ইউরোপের অত্যন্ত সুন্দর একটি গিরিপথ হয়ে ইতালি গেলেন। এই গিরিপথ টি সমুদ্রতল থেকে ৭০০০ ফুট উঁচু। এবার এলো ইতালির কোমো। সেন্ট গথার্ড অতিক্রম করার সারা দিনের ক্লান্তি কোমো লেকে স্নান করে দূর হল। কোমো থেকে তাঁরা গেলেন মিলানে। মিলানে শ্বেত পাথরে তৈরি ক্যাথিড্রোলের গঠনশৈলী ইউরোপের অন্য সব স্থানের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। মিলানের পর ভেনিস। 

ভেনিস এক আশ্চর্য শহর। যেখানে এবিং সমুদ্রের জল শহরের রাস্তায় বয়ে চলেছে। তার মধ্যেই রয়েছে অপূর্ব সুন্দর গির্জা, ক্যাথিড্রাল, প্রাচীন প্রাসাদ, গম্বুজ প্রভৃতি। সেন্ট মার্কস প্লেস শহরের কেন্দ্রস্থল। এছাড়া ডগেস প্যালেস, প্রিন্সলি প্যালেস দেখলেন। আর দেখলেন প্রাসাদের অন্ধকারময়, অস্বাস্থ্যকর নির্মম কারাগার। সেন্ট মার্কস চার্চে ভেনিসিয়দের পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান জয় করে নিয়ে আসা (মিশর, কনস্টান্টিনোপল, জেরুজালেম প্রভৃতি স্থান থেকে নিয়ে আসা) মূর্তি, স্থাপত্য দেখলেন। তাছাড়া ভেনিসের প্রসিদ্ধ স্বর্ণ সিংহ (শহরের প্রতীক) রয়েছে এখানে। আরো কিছু চার্চ এখানে রয়েছে যেগুলি ইতালিয় শিল্পকলার অপূর্ব নিদর্শন। তারপর তাঁরা  ভেনিস থেকে স্টিমারে ব্রিন্দিসি হয়ে বোম্বের (ভারত) উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন, প্রায় তিন সপ্তাহ পথে। 


এর আঠেরো বছর পরে ১৫ ই এপ্রিল ১৮৮৬ লেখক কলকাতা থেকে আবার একই পথে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। এবার তাঁর সঙ্গী তাঁর স্ত্রী, এক ভাই ও চার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। জলপথে একই স্থানের বর্ণনার পুনরাবৃত্তি না করে শুধু মাত্র যেসব নতুন সংযোজন লেখক এবারের বর্ণনায় করেছেন সেটুকুই এখানে রাখা হল। ভারত মহাসাগরে লেখক এবার অনেক তিমি দেখলেন, যদিও সেগুলি তেমন বড় নয়। লন্ডন শহরে তাঁরা কেনসিংটন গার্ডেন, কেনসিংটন প্যালেস দেখলেন। এই প্রাসাদে থাকাকালীন রানী ভিক্টোরিয়া প্রথম তাঁর রানী হওয়ার সংবাদ পান। এর কাছেই আলবার্ট মেমোরিয়াল ও অ্যালবার্ট হল অবস্থিত। হাইড পার্ক, গ্রীন পার্ক হয়ে সেন্ট জেমস পার্কে পৌঁছলেই আসে মহারানীর প্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেস। ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবের কাছে রয়েছে পার্লামেন্ট হাউস। লন্ডনের উত্তর দিকে রিজেন্ট পার্কে আছে লন্ডনের চিড়িয়াখানা। 

এবার লেখক শিক্ষা জগতের পীঠস্থান অক্সফোর্ড দর্শন করলেন। পরিবারকে ইংল্যান্ডের সমুদ্র উপকূল দেখানোর জন্য তিনি লিটল হ্যাম্পস্টনে নিয়ে গেলেন কারন এটি শান্ত নির্জন স্থান এবং এ অরুনডেলের কাছে অবস্থিত। সেখান থেকে তাঁরা ব্রাইটনের একুরিয়াম দেখলেন, যেখানে অক্টোপাস সহ অনেক অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণী আছে। সমুদ্রতীরের বালিতে হাঁটতে আর সমুদ্রের ঠান্ডা জলে স্নান করতে লেখক ও তাঁর পরিবারের খুবই ভালো লাগত। আশেপাশের গ্রাম্যপথে হেঁটে বেড়ানো একটা আনন্দের কাজ ছিল। বাচ্চারা ঝোপঝাড় থেকে ব্ল্যাকবেরি সংগ্রহ করতে খুব মজা পেত। 

এরপর লেখক ব্রিস্টলে গেছিলেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে। ব্রিস্টলের সেন্ট মেরি র‍্যাডক্লিফ চার্চের প্রাঙ্গণে একটি সৌধ রয়েছে বালক কবি চ্যাটারটানের নামে, যিনি বলতেন তাঁর লেখা কবিতাগুলি আসলে তিনি ওই গির্জায় পেয়েছিলেন। ব্রিস্টলের সব থেকে সুন্দর অংশ ক্লিফটন। এখানে অ্যাভন নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। বাথ ইংল্যান্ডের একটি সুন্দরতম শহর, যার চারপাশ সবুজ পাহাড় ঘেরা। অতি প্রাচীনকাল থেকে এটি স্বাস্থ্য নিবাস ছিল। প্রাচীন রোমান যুগের স্নানাগার এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানকার অ্যাবে চার্চকে সুন্দর অজস্র জালনার জন্য 'পশ্চিম ইউরোপের লণ্ঠন' বলা হয়। ওয়েলস্ একটি ছোট শহর কিন্তু এটি কাথিড্রালের জন্য বিখ্যাত। এখানে প্রাচীন বিশপের দুর্গ দেখলেন তিনি। তারপর প্রাচীন গ্লাসনবেরি অ্যাবে দেখলেন। এরপর ওয়ে নদী, যা ইংল্যান্ডের রাইন নামে খ্যাত, দেখে তিনি লিটল হ্যাম্পস্টনে পরিবারের কাছে ফিরে গেলেন। 

লিটল হ্যাম্পস্টন থেকে লেখক ২৫ শে এপ্রিল ১৮৮৬ ফ্রান্সের প্যারিসে পৌঁছান। আগে প্যারিসের অনেক দ্রষ্টব্য লেখকের চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে। এবার বাকি স্থানগুলির পালা। 

স্যেন নদীর উত্তর ও দক্ষিণে বর্তমান প্যারিস ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু আগে নদীর উত্তর, দক্ষিণের এই অংশ দুটিকে প্যারিস বলা হত না। স্যেন নদীর বুকে দুটি দ্বীপ-ই প্যারিস ছিল। এখন এই অংশকে সিটি বা পুরনো প্যারিস বলা হয়।  সিটিতে নোত্র-ডাম (ক্যাথিড্রাল), প্যালেই দ্য জুস্টিস (বিচারালয়), লা সাঁত চ্যাপেল দেখে তিনি স্যেনের উত্তর পাড়ে গেলেন। সেখানে লুভর আর্ট মিউজিয়াম, টুইলারি, প্যালেই দি লা কনকর্ড (ইউরোপের সব থেকে বড় ও সুন্দর স্কোয়ার বা প্রাঙ্গণ), শঁপস এলিজে (দুদিকে উদ্যানে সাজানো রাস্তা) আর আর্ক দ্য ট্রিঅঁফ (নেপোলিয়নের বিজয় সূচক সৌধ), বোয় দ্য বুলগন (এটি রাজাদের শিকারের জঙ্গল ছিল, এখন বিশাল বড় পার্ক ও চিড়িয়াখানা), ভঁডোম স্তম্ভ (নেপোলিয়নের জয়সূচক স্তম্ভ), জোয়ান অফ আর্কের মূর্তি (ফ্রান্সের সাহসী যোদ্ধা যিনি ১৪৩১ এ শহীদ হন), পালই রয়াল (ঐতিহাসিক প্রাসাদ), সেন্ট-উস্তাচ চার্চ, ওটেলদ্য ভিল (১৮৭১ এর বিদ্রোহীরা এটি পুড়িয়ে দেয়, এটি প্যারিসের একটি সুন্দর টাউন হল), সেন্ট্রাল মার্কেট, বাস্তিল দুর্গ দেখলেন। পালই দিলা কনকর্ড থেকে বাস্তিল রু দ্য রিভোলি নামক রাস্তা ধরে সোজা এসে দেখলেন। 

এরপর থেকে বুলেভার্ড নামক প্যারিসের বিখ্যাত ও আকর্ষণীয়, দুপাশে গাছের ছায়াযুক্ত দোকান, ক্যাফে, চওড়া ফুটপাত দেওয়ার পথ ধরে চলতে শুরু করা হল। এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান মেডেলীন চার্চ, অপেরা হাউস (সংস্কৃতির পিঠস্থান প্যারিসে অপেরা গানের হল), বুরস (প্যারিসের স্টক এক্সচেঞ্জ), ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্স (১৮০৩ এ প্রতিষ্ঠিত), চতুর্দশ লুই-এর বিজয় সূচক আর্চ, মন্টমার্ত্র (প্যারিসের উত্তরতম ও উচ্চতম স্থান), শোমঁ (প্যারিসের উত্তর-পূর্ব অংশের একটি ছোট টিলা, যার পাদদেশে সুন্দর লেক উদ্যান রয়েছে)- এই সব দেখলেন। এই পাহাড়ের নীচে প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র পের লাশেজ রয়েছে (অনেক বিখ্যাত ফরাসি মানুষের সমাধিস্থল এটি)। 

স্যেন নদীর দক্ষিণ পাড়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু করে শঁপ দ্য মার্স  (এটি একটি বড় পার্ক যেটি আগে সামরিক প্যারেডে ব্যবহৃত হতো), নেপোলিয়নের সমাধি, পার্লামেন্ট হাউস, পন্থেওঁ (২৭২ ফুট উঁচু ডোম বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ভবন, এখানে ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি ভিক্টর হুগো প্রমুখকে সমাহিত করা হয়েছে), জারদাঁ দে প্লাঁত (ঐতিহাসিক উদ্যান যেখানে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মিউজিয়াম আছে), ক্যাটাকম্ব (প্যারিসের বিশাল ভূগর্ভস্থ সমাধিস্থল যেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের অতিরিক্ত অবস্থান থেকে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত খনিগুলি কবর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আগে এগুলি জনসাধারণ দেখতে পারত, ২০০৯ থেকে তা বন্ধ করা হয়েছে), ভূগর্ভস্থ প্রণালী (তৃতীয় নেপোলিয়ানের তৈরি এই প্রণালীগুলি মানুষ দেখতে পারে পায়ে হেঁটে বা নৌকা করে)। এই সমস্ত দেখে লেখক আবার ইংল্যান্ডের লিটল হ্যাম্পস্টনে ফিরে যান।

                        (চলছে)

শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪

৫৬। ইউরোপে তিন বছর ২ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

   সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ।
 
লেখক রমেশ চন্দ্র দত্তের এবারের ভ্রমণ স্থান কেমব্রিজ। এখানকার ক্রাইস্ট কলেজে কবি মিল্টনের নিজের হাতে লাগানো মালবেরি গাছটি এখনো সযত্নে রাখা আছে। কিংস কলেজ চ্যাপেল, সেন্ট জোন্স চ্যাপেল খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। ট্রিনিটি কলেজের লাইব্রেরী দেখার মত। বেকন, নিউটন, বায়রন, টেনিসন প্রমুখেরা যেখানে পড়েছেন সেইসব স্থান দেখার সৌভাগ্য কেমব্রিজে এলে হয়। ক্যাম নদীর ধারে সুন্দর ছোট শহর অবশ্যই দ্রষ্টব্য স্থান। তাঁরা অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের মধ্যে টেমস নদীতে অনুষ্ঠিত নৌকার প্রতিযোগিতা দেখলেন। নয় বছর পর কেমব্রিজ সেবার প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করল। 

ব্রাইটনে তাঁরা ২৬ হাজার জন স্বেচ্ছাসেবকের মার্চ পাষ্ট ও কৃত্রিম যুদ্ধ দেখলেন। সমুদ্র তীরে সুসজ্জিত বিলাসবহুল শহর ব্রাইটন থেকে তাঁরা ওয়ারথিং-এ গিয়ে ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম দুর্গ অরুনডেল দেখলেন। এরপর তাঁরা গেলেন উইন্ডসর সেখানে রানীর বাসভবন, কলেজ, উইন্ডসর ফরেস্ট দেখলেন। দেখলেন কবি গ্রের সমাধিস্থল। 

লেখক ও সঙ্গীরা এবার বিখ্যাত ডার্বি রেস দেখতে ডার্বি। এই রেসে ইংরেজরা তাদের স্বভাবসুলভ চাপা, সংযত ব্যবহার ছেড়ে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে দেখলেন লেখক। 

ইংল্যান্ডের গ্রাম্য জীবন না দেখলে এই দেশ দেখা অসম্পূর্ণ থাকে। গ্রামের বাড়িগুলি পরিষ্কার ও সুন্দরভাবে তৈরি। বাড়িগুলিতে বড় উঠান, সুন্দর বাগান ও লন থাকে। রাস্তাগুলি লম্বা ও সুন্দর, অনেক পার্ক থাকে যেখানে অনেক হরিণ চড়ে বেড়ায়। নানারকম বুনো ফুল এদিকে ওদিকে ফুটে থাকে। গ্রামে একটি চার্চ অবশ্যই থাকে। ইংল্যান্ডের গ্রামের মানুষ অনেক বেশি মিশুকে শহরের তুলনায়। 

একদিন তাঁরা টাওয়ার অফ লন্ডন (ইংল্যান্ডের রাজার দুর্গ ও প্রাসাদ, প্রাচীন কারাগার এবং রাজ মুকুট প্রদর্শনের স্থান) দেখতে গেলেন। তাঁরা লাইওনস্ গেট দিয়ে ঢুকে বেল টাওয়ার দিয়ে বেরোলেন। এখানে নিষ্ঠুর মেরি (ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডের রানী) তাঁর বোন এলিজাবেথকে বন্দী করে রেখেছিলেন। এখানে অনেক রাজকীয় তথা নারকীয় হত্যাকান্ড হয়েছে। হর্স আরমারিতে রাজাদের ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র দেখলেন। জুয়েল রুমের রাজা রানীদের ব্যবহৃত নানান মুকুট দেখলেন। সব থেকে আকর্ষণীয় হলো পৃথিবীর বৃহত্তম হীরা, ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া কোহ ই নূরের মডেল। লন্ডন টাওয়ারের বাইরে টাওয়ার হিল দেখা হল, যেখানে বিশ্বাসঘাতকদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হতো। সেন্ট পিটার্স চার্চ-এর প্রাঙ্গণটিতে প্রাণদন্ডিতদের সমাধিও দেখলেন। এবার তাঁরা বিশাল সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চ দেখলেন। 

এবার সমুদ্রতীরের ডেভনশায়ারে কিছু আনন্দে দিন যাপন। সবুজ পাহাড় উপত্যকায় ভরা এই স্থানে টটনেস, ডার্টমাউথ প্রভৃতি জায়গা ঘুরে প্রকৃতি উপভোগ করলেন। 

এবপর দ্রষ্টব্য ইংল্যান্ডের অতি প্রাচীন কেনিল ওয়ার্থ ক্যাসেল আর স্ট্রাটফোর্ড অন অ্যাভনে শেক্সপিয়ারের বাড়ি। যে ঘরে কবি জন্মেছিলেন, তার দেওয়ালে অজস্র দর্শকের শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখা আছে। রমেশ চন্দ্র দত্ত তার মধ্যে থেকে ওয়াল্টার স্কট ও চার্লস ডিকেন্সের নাম খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। বাড়িটি ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়েছে এবং একটি মিউজিয়াম হয়েছে। এখানকার চার্চে কবি ও কবি-পত্নীর সমাধি দেখলেন তাঁরা। এখানে লেখকের ইংল্যান্ড ভ্রমণ তথা দর্শন শেষ হল। 



এবার পরবর্তী গন্তব্য স্কটল্যান্ড, যে যাত্রা শুরু হল একুশে জুলাই ১৮৬৯। টেমস নদীতে স্টিমারে যেতে যেতে লেখক দেখলেন নদীটির জল অনেক দূর পর্যন্ত লন্ডনের মতোই অপরিষ্কার। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর দৃশ্য পরিবর্তিত হল। কল কারখানার জায়গায় নদীর দু'ধারে শস্যক্ষেত, পশুচারণ ভূমি, ঘাসে ঢাকা জমি, গাছপালা দেখা গেল। নদীর জল স্বচ্ছ হয়ে উঠল। ক্রমে টেমস নদী ছেড়ে স্টিমার জার্মান সাগর (নর্থ সি) এল। ইয়ারমাউথ শহর দেখা গেল। এরপর আর কূল চোখে পরলো না। পরদিন সকালে ফ্ল্যামবরো পাহাড় চোখে পড়ল। এরপর স্ক্যারবরো ও হুইটবি শহর পেরিয়ে তাঁরা চললেন। বিকেলে স্কটল্যান্ডের উপকূল দৃশ্যমান হল। বাস রক নামে একটি ছবির মত সুন্দর পাহাড় পেরোলেন, যাতে অসংখ্য সামুদ্রিক পাখির বাসস্থান। ২২ জুলাই সন্ধ্যায় স্কটল্যান্ডের গ্রান্টনে নেমে তাঁরা এডিনবরাতে গেলেন। 

লন্ডনের থেকে এডিনবরা আয়তনে ও জনসংখ্যায় অনেক কম। অসংখ্য সুন্দর বাড়ি, চুড়াওয়ালা গির্জা আর পাহাড় শহরটিকে অপূর্ব সৌন্দর্য দিয়েছে। কালটন হিল আর ক্যাসেল পাহাড় শহরের মধ্যে রয়েছে আর আর্থার সিট ও সালিশবারি ক্র্যাগস শহরের খুব কাছে। স্যার ওয়াল্টার স্কট-এর (স্কটল্যান্ডের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক) স্মৃতিতে একটি সৌধ আছে এখানে, যার ওপর থেকে শহরের শোভা দেখা যায়। কালটন হিলের ওপর থেকে দৃশ্য আরো সুন্দর, এখানে রবার্ট বার্নস (স্কটিশ কবি ও গীতিকার) -এর স্মরণে একটি মিউজিয়াম আছে। এরপর তাঁরা হলিরুড প্যালেস ও চ্যাপেল দেখলেন। দেখলেন এডিনবরা ক্যাসেল। হ্রদের ধারে অবস্থিত এই দুর্গে স্কটল্যান্ডের রাজমুকুট সংরক্ষিত আছে। 

লিনলিথগো একটি ছোট শহর, যা পাহাড় আর গোচরণ ভূমিতে ঘেরা। সেখানকার মুখ্য আকর্ষণ প্রাচীন, ভগ্নপ্রায় স্কটিশ রাজাদের রাজপ্রাসাদ। এরপর স্টিরলিং নামক ছোট শহরে পাহাড়ের উপরে উইলিয়াম ওয়ালেসের স্মৃতিসৌধ দেখে সেখানকার দুর্গ দেখলেন লেখকেরা। এরপর তাঁরা গেলেন ক্যালেন্ডার নামে স্থানে, যা সুউচ্চ ও বরফে ঢাকা পর্বতের মধ্যে অবস্থিত। এখানে তাঁরা প্রথম অনুভব করলেন স্কটল্যান্ড কী রকম অনন্ত পর্বত ও জঙ্গলময় স্থান। 


সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়িতে ট্রোসোক্স যাওয়ার পথে অসংখ্য পাহাড়, হ্রদ, উপত্যকা, গিরিখাত পার হতে হলো। মনে হল বিশাল পর্বতশ্রেণী এই দেশকে পাহারা দিচ্ছে। কাটরিনলোমন্ড লেক নিঃসন্দেহে স্কটল্যান্ডের তথা পৃথিবীর একটি সুন্দরতম স্থান। চারদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা। বৃক্ষের ছায়া পড়ে হ্রদের সৌন্দর্য অপরিসীম হয়েছে। নিস্তব্ধতা সেই সৌন্দর্যের মাত্রাকে আরো বাড়িয়েছে। লেক লোমন্ডে একটি সুন্দর জলপ্রপাত আছে। 

এবার বালেখ হয়ে লেখা গ্লাসগো গেলেন রেলপথে। গ্লাসগো এডিনবরার থেকে বড় শহর এবং এটি স্কটল্যান্ডের বাণিজ্যকেন্দ্র। শহরের মধ্যে রয়েছে জর্জ স্কোয়ার, যেখানে রানী ভিক্টোরিয়া ও তাঁর স্বামীর মূর্তি রয়েছে। আর রয়েছে স্যার ওয়াল্টার স্কটের স্মৃতিসৌধ। 

এরপর তাঁরা স্টিমারে ওবান শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ফার্থ অফ ক্লাইড ছাড়িয়ে কান  টায়ার উপদ্বীপ বাঁয়ে রেখে তাঁরা সমুদ্রে পৌঁছলেন এবং সেখান থেকে ওবান এলেন। এখানে ডুনল্লী ক্যাসেলের ভগ্নাবশেষ দেখলেন। স্কটল্যান্ডের পশ্চিমকুল বন্ধুর, অনুর্বর আর পর্বতময়। সমুদ্র থেকে উঁচু পর্বতময় শহরটি অতি সুন্দর দেখায়। 

পরদিন স্টিমারে করে আইওনা দ্বীপে গেলেন। সেখানে অতি প্রাচীন সেন্ট মেরিস চার্চ দেখলেন। তারপর স্টাফা দ্বীপে কিছু অদ্ভুত প্রাকৃতিক গুহা দেখলেন। ফিঙ্গাল গুহায় সমুদ্র থেকে নৌকায় করে প্রবেশ করলেন। সেখানে ব্যাসল্টের প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী অসংখ্য স্তম্ভ রয়েছে। এখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ পাথরে প্রতিফলিত হয়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করে। 


এরপর স্টিমারে গ্লেনকো নামক স্থানে গেলেন যেখানে তৃতীয় উইলিয়ামের সময় এক ভয়ংকর নরহত্যাকাণ্ড হয়েছিল। পরদিন স্কটল্যান্ডের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বেন নেভিস (৪৪০০ ফিট) দর্শন করলেন। এরপর তাঁরা ক্যালিডোলিয়ান ক্যানেল-এর মধ্যে দিয়ে চললেন। এই খালের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে লোচি লেক, ওইচ লেক, নেস লেক -এই তিনটি লেককে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

তারপর ইনভারনেস হয়ে অ্যাবারডিন গেলেন তাঁরা। এই শহর গ্রানাইট শহর নামে খ্যাত। কারণ প্রায় সব বাড়ি এখানকার গ্রানাইটে তৈরি। সেখান থেকে এডিনবরা হয়ে গেলেন লেভেন লেক। স্কটল্যান্ডের রানী মেরি এই দ্বীপে নির্বাসিত ছিলেন। 

এরপর কিনরস, হথর্নডেন, মেলরোজ, রোজলিন হয়ে অ্যাবটস্ ফোর্ড গেলেন। ওয়ালটার স্কটের বাড়ি এখানে রয়েছে। তার পড়ার ঘর, লাইব্রেরী, তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্র প্রভৃতি দেখলেন তাঁরা। স্কটের সমাধি দেখতে তাঁরা ড্রাইবরা  অ্যাবেতে গেলেন। এবার তাঁরা কার্লাইল পেনরিথ হয়ে কেসুইক গেলেন ইংল্যান্ডের হ্রদ দেখার উদ্দেশ্যে। সুইজারল্যান্ডের মতো কাম্বারল্যান্ড ইংল্যান্ডের লেক আর পর্বতের স্থান (লেক ডিস্ট্রিক্ট)। কেসুইক সেখানকার একটি শহর, যা ডারওয়েস্ট ওয়াটার লেক-এর ধারে অবস্থিত। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা এই লেকগুলি স্কটল্যান্ডে উচ্চভূমির থেকে সৌন্দর্যে কম নয়। লেক-এর ওপর পারে লডোর নামক প্রদেশের বিখ্যাত জলপ্রপাত দর্শন করে তাঁরা মুগ্ধ হলেন। সব দেখা শেষ হলে তাঁরা আবার লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করলেন। 


১৫ জুন ১৮৭০ -এ লেখক আয়ারল্যান্ড-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। আইরিশ চ্যানেল পেরিয়ে ডাবলিনে পৌঁছে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, পার্ক দেখলেন। শহরের কাছেই সমুদ্র তীরে কিংস্ টাউন ডাবলিনবাসীর অবসর যাপন ও প্রেম করার জায়গা। 

তারপর সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্যে আভোকা নদীর উপত্যকা দর্শন করে তিনি গ্লেডেনলোতে এলেন। সেখানে ষষ্ঠ শতাব্দীর সাতটি গির্জার ভগ্নাবশেষ রয়েছে। ক্রমে ব্রে, বয়নি, ড্রঘেডা ও বেলফাস্ট হয়ে তাঁরা বিখ্যাত জায়ান্টস কজওয়েতে গেলেন (এটি উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান, যেখানে হাজার হাজার ব্যাসল্ট ষড়ভূজ স্তম্ভ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে আগ্নেয়গিরির উদগিরণের ফলে), যা অনেকটা স্কটল্যান্ডের ফিংগালস কেভের মত। তারপর তাঁরা ডানলাস ক্যাসেল দেখলেন সমুদ্রের মধ্যে পাহাড়ের ওপর। 

তারপর লন্ডনডেরি দেখলেন, যেখানে ওয়াকারের নামে সৌধ আছে (ওয়াকার প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মযাজক ১৬৮৯ তে  লন্ডনডেরি অবরোধে শহর রক্ষার জন্য লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন)। এরপর তাঁরা আর্ন নামক লেকের জলে নৌকায় ভ্রমণ করলেন। তাঁরা লিমেরিক নামক ব্যস্ত শহর থেকে শ্যানন ঝরনা দেখতে গেলেন আর আয়ারল্যান্ডের গর্ব কিলার্নি লেক দেখলেন। এটি স্কটল্যান্ড-এর লেকগুলির তুল্য। আয়ারল্যান্ডের সর্বত্র নিবিড় শ্যামল জঙ্গল, শস্যক্ষেত্র, বৃক্ষ লতা চোখে পড়েছে। তাই একে পান্না দ্বীপ (এমারেল্ড আইল্যান্ড) বলে। এই শোভা অনেক খুঁজেও ইংল্যান্ডে পাওয়া যাবে না। 

আয়ারল্যান্ডের গরীব মানুষের আলু একমাত্র ভরসা। তারা কখনো মাংস খেতে পায় না। এখানে আলুর ক্ষেত নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখা যায়। এখানকার গ্রামবাসী দুঃখী, তাদের রৌদ্র জলে ক্ষেতে কাজ করতে হয় আর রাতে নোংরা কুটিরে শুয়োর হাঁস মুরগির সঙ্গে শয়ন করতে হয়। উর্বর দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা অন্য আরো কিছু দেশের মতো (ভারতের মতো) এখানে অত্যন্ত দরিদ্র। 

ব্রিস্টলে তাঁরা রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি দেখলেন। এটি ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। এরপর ওয়েলস্ প্রদেশে মিলফোর্ড হ্যাভেন, অ্যাবেরস্টিথ, কার্মারথেন, ডেভিলস ব্রিজ, কার্নারভন, ল্যানবেরিস ও কনওয়ে নামক স্থানগুলির দর্শনীয় স্থান দেখে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করলেন ১৪ জুলাই ১৮৭০ -এ।


                       (চলছে)



মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৪

৫৫। ইউরোপে তিন বছর ১ রমেশ চন্দ্র দত্ত

  

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, মালটা, ইংল্যান্ড ।

Romesh Chunder Dutt এর "Three years in Europe 1868-1871 with an account of subsequent visit to Europe in 1886 and 1893" বই-এর প্রথম সংস্করণ ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে S. K. Lahiri and Co. থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইটির একটি বাংলা অনুবাদও আছে। "ইউরোপে তিন বছর" - রমেশ চন্দ্র দত্ত। কিন্তু দুটি বই একেবারে হুবহু এক নয় সেই কারণে এখানে এই ব্লগে মূলত ইংরেজি বইটিকে অনুসরণ করে লেখা হলো। ইংরেজি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণটিতে (১৮৯০ -এ প্রকাশিত) কিছু পরিমার্জন ছাড়াও এটিতে লেখকের ১৮৭২ -এর পরবর্তী সময়ের (১৮৮৬ -র ভ্রমণকাহিনী)  ভ্রমণের কথা যুক্ত হয়েছে। ১৮৯৬ -এ প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণে তাঁর ১৮৯৩ -এর রাইনল্যান্ড ভ্রমণের কাহিনী যুক্ত হয়েছে। তাই ইংরেজি বইটির তৃতীয় সংস্করণের অনুসরণে ব্লগটি লিখিত হল।

রমেশ চন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) একজন ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসার, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক এবং অনুবাদক। চাকরি থেকে অবসরের পরে তিনি ইউনিভার্সিটির কলেজ, লন্ডনে অধ্যাপনা করেছেন; ইকোনমিক ন্যাশনালিজমের উপর গবেষণা করেছেন ও বরদা রাজ্যে দেওয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি ছিলেন, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে) সহ-সভাপতি। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। 

এই বইটি ইউরোপীয় আচার ব্যবহার সম্বন্ধে ও নানা দেশের বর্ণনা বিষয়ে কতগুলি পত্রের সারাংশ, যেগুলি লেখক বিভিন্ন সময় লিখেছিলেন। রমেশ চন্দ্র দত্ত স্টিমারে করে ৩ মার্চ ১৮৬৮ তে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন, সঙ্গী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিবিহারীলাল গুপ্ত (দুজনেই সিভিল সার্ভিসের সদস্য ও রাজনীতিবিদ)। জলপথে কলকাতা থেকে গঙ্গা নদী হয়ে ডায়মন্ড হারবার গিয়ে মুলতান নামক স্টিমারে তাঁরা রওনা দিলেন। গঙ্গাসাগরে এসে স্টিমার নোঙর করল ও পরদিন সকালে সমুদ্রে প্রবেশ করল। গঙ্গার জল ও সমুদ্রের জল স্পষ্ট মিশে যেতে দেখা গেল। চতুর্দিকে শুধু নিবিড় নীল জল আর নীল আকাশ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। চন্দ্রালোকিত রাতে সাদা ফেনাময় তরঙ্গ আর নক্ষত্র মালার মতো সমুদ্রকীট (বিভিন্ন সমুদ্রে কিছু জীবাণু, শৈবাল, সামুদ্রিক প্রাণী প্রভৃতির শরীর থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে আলো নির্গত হতে দেখা যায়) যখন সেই ফেনার উপর দেখা দেয়, তার রূপ বর্ণনাতীত। 


চার দিন পরে জাহাজ মাদ্রাজ শহরে উপস্থিত হল। লেখক মাদ্রাজের দুর্গ, পিপিলস্ পার্ক ও চিড়িয়াখানা দর্শন করলেন। জাহাজ মাদ্রাজ ছাড়ার তিন দিন পর শ্রীলংকার উপকূল দেখা গেল। শ্রীলংকার পর্বত দূর থেকে মেঘের মতো লাগছিল। লেখক সেই প্রথম পর্বত দেখলেন। 


পরের দিন সকালে জাহাজ থেকে একটি ছোট নৌকায় উঠে তাঁরা সিংহলে অবতরণ করলেন। নারকেল, বাঁশ প্রভৃতি বৃক্ষের ছায়ায় সাধারণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন কুটির শোভা পাচ্ছে। লেখকের মনে হল বাল্মিকী যে এই দেশকে স্বর্ণলঙ্কা বলেছেন তা অত্যুক্তি নয়। তাঁরা ওয়াকওয়ালেতে (ওয়াকওয়েল্লা) গেলেন। এই স্থানের সৌন্দর্য অপরিসীম। বহুদূরে ধূসর পর্বত শ্রেণী দেখা যায়। সেখানে অ্যাডামস পিক দেখা যায়। উঁচু ও নীচু বৃক্ষশ্রেণী ঢেউ খেলিয়ে বিরাজ করছে। কাছে অনেক পরিষ্কার পথ, কৃষি ক্ষেত্র, খাল ও একটি ক্ষুদ্র একটি নদী রয়েছে। এ দেশের মানুষ বিদেশীদের কাছে বিক্রয়ের জন্য দারচিনি, হীরা, সোনা, আংটি প্রভৃতি নিয়ে এসেছে। তবে জিনিসপত্র কেনার সময় দরদাম না করলে ঠকতে হয়। তাঁরা একটি দারচিনি বাগানে ও একটি বৌদ্ধ মন্দির দর্শন করলেন। মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের অষ্টাদশ হাত মূর্তি রয়েছে। লেখক জেনে অবাক হলেন যে মন্দিরের পুরোহিত রাম-রাবণের বিষয়ে কিছু জানেন না। মন্দিরের ছায়ায় বসে লেখক অতি সুমিষ্ট নারকেলের জল পান করলেন এবং রাতে হোটেলে ইলিশ মাছ সহ অনেক সুখাদ্য উপভোগ করলেন। 

আরো দিন সাতেক চলার পরে আফ্রিকার উঁচু পর্বত শ্রেণী দৃশ্যমান হল। আরো দুইদিন পরে আফ্রিকার অ্যাডেন (ইয়েমেনে অবস্থিত) শহর দেখতে বেরোলেন লেখক ও সঙ্গীরা। নগর সৌন্দর্যবিহীন, অনুর্বর পাহাড়ে ঘেরা, গাছপালা প্রায় নেই। এখানকার কৃষ্ণকায় মানুষরা সূর্যের উত্তাপকে ভয় করে না। বালক বালিকারা লেখকের গাড়ির সঙ্গে আধঘন্টা পর্যন্ত এই রোদে দৌড়তে লাগলো। এরা সাঁতারেও পারদর্শী। লেখকদের স্টিমারের চারপাশে সাঁতার কেটে তারা ভিক্ষা চাইছিল। অ্যাডেন শহরের দুর্গ খুব সুরক্ষিত কারণ প্রস্তরময় স্থানে একটি অবস্থিত। এখানে জলাশয় দেখার মত। জল এখানে দুষ্প্রাপ্য বলে পর্বত দ্বারা ঘেরা স্থান বা প্রাচীর দ্বারা ঘেরা স্থানে বর্ষার জল এরা ধরে রাখে, সেই জল সারা বছর ব্যবহার করে। 


পরদিন অ্যাডেন ছেড়ে বাব-এল-মানডেব প্রণালীতে পৌঁছলেন। একদিকে আরব দেশীয় পাহাড়, অন্যদিকে পেরিম (ইয়েমেনের দ্বীপ) নামক ক্ষুদ্র দ্বীপ। লোহিত সাগরের জলের তলায় অনেক ক্ষুদ্র পাহাড় আছে, তাই  এই পথে সমুদ্রে জাহাজের চলাচল বিপদজনক। তারপর তাঁরা সুয়েজ উপসাগরে প্রবেশ করলেন। এখন দুই ধারে ভুমি, সমুদ্রের জল স্থির। সেই রাতে তাঁরা সুয়েজ পৌঁছলেন। বন্দরটি জাহাজ, স্টিমারের অজস্র আলোয় খুব সুন্দর লাগছিল। এবার তাঁরা মুলতান স্টিমার ত্যাগ করলেন। 

এরপর মিশর দেশের রেলগাড়িতে তাঁরা আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে চললেন। মিশরের রেলগাড়ির চলাচলে সময়ের ঠিক-ঠিকানা নেই। আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছে শহর দেখতে বেরোলেন লেখক ঘোড়ার গাড়ি করে। রাস্তাঘাট প্রশস্ত, ঘরবাড়ি বড় ও সুন্দর। একটি সুন্দর উদ্যানে পম্পির স্তম্ভ দেখলেন, ৬৫ হাত উঁচু। এই স্তম্ভের চারপাশে সুপ্রাচীন দেব-দেবীর মূর্তির ভগ্নাবশেষ রয়েছে। ৫০ হাত উঁচু ক্লিওপেট্রার স্তম্ভ দেখলেন। 


এবার আলেকজান্দ্রিয়া থেকে স্টিমারে করে তাঁরা মালটা দ্বীপে পৌঁছলেন। এই স্থানের পরিষ্কার পাথরে বাঁধানো পথ, সুন্দর বাড়িঘর, সুসজ্জিত দোকান দেখলেন। এই প্রথম তিনি কোন ইউরোপীয় নগর দেখলেন। একটি উদ্যানে গেলেন, যা ফোয়ারা, সাইপ্রাস গাছ, কমলা লেবু গাছ দিয়ে সুসজ্জিত। এখানকার কমলালেবুর ভিতরটা রক্তবর্ণ এবং সেগুলি অতি সুস্বাদু। মালটার গভর্নরের প্রাসাদ, সেন্ট জন চার্চ, বীরপুরুষের সমাধিস্থান, কিছু প্রস্তর নির্মিত মূর্তি প্রভৃতি দেখে লেখকেরা আবার স্টিমারে ফিরে এলেন। 


স্টিমার মালটা দ্বীপ পরিত্যাগ করে লণ্ডন অভিমুখে যাত্রা করল। চলার পথের দূর থেকে জিব্রাল্টার পাহাড় ও জেবেল-আলতারিক (আরবী ভাষায় আল তারিখ নামক বীরের শহর) নগর দেখা গেল। ছবির মত জেবেল আল তারিখ বা তারিখের পাহাড় (জিব্রাল্টার পাহাড়) ও দুর্গ দর্শন করে তাঁরা সন্ধ্যায় স্টিমারে ফিরে এলেন। পরদিন সেন্ট ভিন্সেন্ট অন্তরীপের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অনেক বড় পাহাড় ও একটি বাতিঘর দেখলেন। রাতে ফিনিস্টেয়ার অন্তরীপ অতিক্রম করা হলো। পরদিন ফ্রান্সের ব্রেস্ট শহরের কাছে উসান্ট অন্তরীপ দেখা গেল। দুদিন পর আইল অফ ওয়াইট নামক সুন্দর দ্বীপের কাছ দিয়ে তাঁদের স্টিমার চলল। সেখানে ভারতের মতো সুন্দর সবুজ বন, উদ্যান, শস্য ক্ষেত্র চোখে পড়ল। 


সেদিন সন্ধ্যায় (১১ ই এপ্রিল, ১৯৬৮) সাউদাম্পটন হয়ে তাঁরা লন্ডনে পৌঁছলেন। লন্ডন এক বিশাল শহর সেখানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাস করে। বাড়িগুলি চার-পাঁচ তলা। নীচের তলাটি প্রায়শ মাটির নীচে অবস্থিত। বাড়ির বাইরের দেওয়াল ইঁটের আর ভিতরের দেওয়াল কাঠের উপরে কাগজে মোড়া। এখানে খুব বড় বড় উদ্যান আছে, সেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারে। এগুলি আছে বলেই লন্ডন শহরের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর আছে। বাড়িগুলি শ্রেণীবদ্ধ ও খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ঘর গুলি ছোট ছোট কারণ বাড়িগুলি শীতকালের উপযোগী করে তৈরি। গ্রীষ্মকাল স্বল্প স্থায়ী ও অস্বাস্থ্যকর। আকাশ এই সময় মেঘে ঢাকা থাকে। সব সময় বৃষ্টি হয়। কুয়াশায় চারদিক ভোরে থাকে, সূর্য প্রায় দেখাই যায় না। 


লেখক লন্ডনের নিকটে সিডেনহ্যামের ক্রিস্টাল প্যালেস দেখতে গেলেন। বিশাল কাচের তৈরি অট্টালিকা, সূর্যালোকে ঝকমক করতে থাকে। বাইরের অংশে সুন্দর উদ্যান, ফোয়ারা, লেক, মূর্তি প্রভৃতি দিয়ে সাজানো। ভিতরের চিত্রশালার ছবিগুলি বিক্রয়ের জন্য রাখা আছে।


রমেশ চন্দ্র দত্ত সেন্ট জেমস হলে বিশিষ্ট লেখক চার্লস ডিকেন্সের নিজের লেখার পাঠ শুনতে গেলেন। তাঁর পাঠের পদ্ধতি এতই চমৎকার যে সবাই মুগ্ধ হল। 


নভেম্বরে লন্ডনের পথঘাট, বাড়িঘর, উদ্যান, গাছপালা সব বরফে ঢেকে গেল। মনে হল সব যেন রুপো দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। শীতকালে লন্ডনে সূর্য দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। মাঝে মাঝে বরফ পড়ে, পরিবেশ খুব শীতল ও আর্দ্র থাকে। 


সেই মাসেই লন্ডনের লেখক ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নির্বাচন দেখলেন। তিনি দেখে চমৎকৃত হলেন যে ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের মূল স্থানে নাগরিকরা এত স্বাধীনতা সুখ ভোগ করে, যা একমাত্র আমেরিকা ছাড়া কোন দেশ করে না। 


এরপর ডিসেম্বরে এলো বড়দিন। সকালে উচ্চমাত্রায় ঘন্টার ধ্বনি শোনা ছাড়া রাস্তায় কোন উৎসবের চিহ্ন বা শব্দ পাওয়া যায় না। যা কিছু উৎসব এখানে যার যার বাড়ির মধ্যে হয়। 


এক বছর ধরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করে লেখক পরীক্ষায় বসলেন ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ তিনি এই পরীক্ষার প্রস্তুতি জন্য পড়েছেন এবং ওই কলেজের অধ্যাপকদের কাছে ব্যক্তিগতভাবেও পড়েছেন। অধ্যাপকরা খুব দয়ালু ছিলেন এবং তাঁরা বন্ধুর মতো লেখকের সঙ্গে মিশেছেন। বিশেষ করে ইংরাজীর অধ্যাপক মিস্টার হেনরি মর্লে, সংস্কৃতের অধ্যাপক ডক্টর থিওডোর গোল্ডস্টুকারের কথা তিনি স্মরণ করেছেন। পরীক্ষায় তিনশোর বেশি ইংরাজ ছাত্র বসেছে, যার মধ্যে শুধু পঞ্চাশ জন মনোনীত হবে। পৃথিবীর অন্যতম কঠিনতম পরীক্ষাটি এক মাসের বেশি সময় ধরে চলল। লেখকের বিষয় ছিল ইংরেজি, অংক, দর্শন ও সংস্কৃত। প্রতিটি বিষয়ে মৌখিক পরীক্ষাও দিতে হলো। এক মাস অত্যন্ত উৎকণ্ঠা সঙ্গে অপেক্ষা করার পর ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল লেখক শুধু পাসই করেননি, তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর সঙ্গীরাও উত্তীর্ণ হয়েছেন এই পরীক্ষায়। 


এরপর লেখক সঙ্গীদের সঙ্গে কিছুদিনের জন্য সমুদ্রে বেড়াতে গেলেন। ইস্টবোর্ন নামক সমুদ্র শহরে সমুদ্রের শোভা উপভোগ করে লেখক পেভেন্সি ক্যাসেল দেখতে গেলেন। দুর্গটি এখন ভগ্নপ্রায়। সমুদ্রপথে আসা-যাওয়া করার সময় ফিরতি পথে তাঁরা মার্টিলো টাওয়ার দেখলেন, যেটি ইংরেজরা নেপোলিয়নের আক্রমণের ভয়ে ১৮০৪-এ তৈরি করেছিল। কেন্ট ও সাসেক্স উপকূল বরাবর এরকম দুর্গ বেশ কিছু আছে। লেখক হার্স্টমন্সকো দুর্গ নামক মধ্যযুগীয় ইংরাজ দুর্গ দেখতে গেছিলেন। তারপর সেন্ট লিওনার্ড ও হেস্টিংস শহর দেখলেন সমুদ্র তীরে। সেন্ট লিওনার্ডের 'লাভার্স সিট' একটি রোমান্টিক জায়গা, যেখানে একটি মেয়ে তার প্রেমিকের মৃত্যুতে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল বলে শোনা যায়। ফেয়ারলাইট গ্লেন আরেকটি মায়াময় স্থান যা একটি লম্বা ছায়াচ্ছন্ন পথ। হেস্টিংস দুর্গ একটি ত্রিকোণ ছোট পাহাড়ের উপর সমুদ্রের ধারে অবস্থিত দুর্গ। লন্ডনে ফেরার পথে উইলিয়াম, দ্য কংকারারের তৈরি অ্যাবে দেখলেন তাঁরা। 


পরবর্তী দ্রষ্টব্য স্থান মাদাম তুসোর মিউজিয়াম, যেখানে একেবারে জীবন্ত রূপের মোমের মূর্তি রাখা আছে। অনেকবার লেখক মূর্তিকে সত্যি মানুষ ভেবে ভুল করলেন। যন্ত্রের সাহায্যে মূর্তিগুলোর মাথা, অঙ্গ নাড়ানো যায়। 'চেম্বার অফ হররে' বীভৎস খুনি ও অপরাধীদের মূর্তি দেখে শিহরিত হলেন। 


এরপর একদিন লেখক গেলেন ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে। সেখানে ইংল্যান্ডের সম্রাট, যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, কবি, লেখকদের সমাধিস্থল ও প্রস্তর নির্মিত প্রতিমূর্তি দেখে আনন্দিত হলেন। যাঁরা ইংল্যান্ডের ইতিহাস, কাব্য, সাহিত্য পড়েছেন তাঁরা এই স্থান দেখে মুগ্ধ হবে। 


এরপর একদিন লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা লন্ডন থেকে ট্রেনে রিচমন্ড এসে টেমস নদীতে নৌকায় আলেকজান্ডার পোপের (ইংরেজ কবি) টুইকেনহ্যাম দেখে টেডিংটন পর্যন্ত গেলেন। এই স্থানে টেমস নদী অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। দুপাশের গাছে বসন্তের প্রভাবে পরম রমণীয় রূপ। 


ইংল্যান্ডে বসন্ত খুব সুন্দর আবহাওয়া, সূর্যালোকিত দিন, গাছে নতুন পাতা, ফুল, ও পাখির ডাকে ভরা। ভারতের থেকে ইংল্যান্ডে শীতের পরে বসন্তের আগমন অনেক বেশি নজর কাড়ে কারণ ভারতের শীত অনেক বেশি আকর্ষণীয়। টেমস নদীর দুধারে সবুজ ঘাস জমি, চেস্টনাট গাছ, সুন্দর ঝোপঝাড় সহ অপূর্ব রূপ নিয়েছে। টেডিংটন থেকে এক সুন্দর রাস্তায় পায়ে হেঁটে ঘন্টাখানেকে এল হাম্পটন কোর্ট (রাজা অষ্টম হেনরির প্রাসাদ)। তাঁরা প্রাসাদের রাজকীয় কক্ষগুলি, সভাঘর দেখলেন, অনেক সুন্দর পেইন্টিং দেখলেন প্রতিটি ঘরে। লন্ডনে টেম্পল বার, যা এখন কেশচর্চার স্থান, একসময় সেটিও রাজা অষ্টম হেনরির প্রাসাদ ছিল।

                      (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...