সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দীন-এর লেখা গ্রন্থ শিগুর্ফ নামা ই বিলায়েত হল বাঙালির লেখা প্রথম ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত জানা সর্বপ্রথম যে শিক্ষিত বাঙালি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি হলেন মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিন। যদিও তাঁর লেখা বই ফার্সি ভাষায় লেখা কিন্তু তিনি বাঙালি, সেই কারণে তাঁর গ্রন্থের আলোচনা এই ব্লগের অন্তর্গত হল। মির্জা শেখ ইতেসামুদ্দিনের বইটি জেমস এডওয়ার্ড আলেকজান্ডার 'ট্রাভেলস অফ মির্জা ইতেশামুদ্দিন ইন গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড ফ্রান্স' নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশিত করেন ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিনের ভ্রমণকাল হল ১৭৬৬ থেকে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ।
মির্জা শেখ ইতেশামুদ্দিন বাংলার নদীয়া জেলার চাকদার পাঁচনুর গ্রামে আনুমানিক ১৭৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফার্সি ভাষায় দক্ষ ছিলেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরাজদের মুন্সির পদে চাকরি করেছেন। ১৭৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি লন্ডনে যান দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলমের রাষ্ট্রদূত ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইনটনের সহকারী দূত হিসেবে। বক্সারের যুদ্ধের পর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাদশাহ্ শাহ আলমের এলাহাবাদ চুক্তি হয়। বাদশাহ্কে দিল্লির কাছে ইংরেজ সৈন্য মোতায়েন করে নিরাপত্তা দেওয়ার শর্ত ছিল এই চুক্তিতে। এই শর্ত পূরণের অনুরোধ জানিয়ে বাদশাহ্ বিলেতের দরবারে একটি ফার্সি চিঠি পাঠান। সঙ্গে এক লাখ টাকা নজরানা। মূলত এই ফার্সি চিঠি বিলেতের দরবারে ব্যাখ্যা করার জন্য লেখককে বাদশাহ্ বিলেতে প্রেরণ করেন চার হাজার টাকা খরচ দিয়ে। কিন্তু লেখক পথে জানতে পারেন টাকা না এসে পৌঁছনোর অছিলায় রবার্ট ক্লাইভ সেই চিঠি হস্তগত করেছেন। ফলে লেখকের এই যাত্রার উদ্দেশ্য শুরুতেই নষ্ট হয়ে যায়। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে দেশে ফেরার পর তাঁর নাম হয় বিলায়েত মুন্সি। সম্ভবত ১৮০০ সালে তিনি মারা যান।
ফার্সিতে রচিত হলেও তাঁর লেখায় বাঙালিয়ানা অনেক ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়। যেমন হিজরি সন ব্যাবহার করলেও তিনি বাংলা মাস মাঘ, কার্তিক প্রভৃতি ব্যবহার করেন হিজরী মাসের পরিবর্তে। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও মৎস্যপ্রেমী বাঙালির রূপ ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়।
১৭৬৬ -এর জানুয়ারি মাসে হুগলি থেকে জাহাজে ওঠার সময় তাঁর মন স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে যাওয়ার ব্যথায় কাতর ছিল।চারদিন পরে জাহাজ সমুদ্রে পৌঁছল। রাতে সমুদ্রের ফেনা আলোর মতো জ্বলছিল (সম্ভবত জৈবিক আলোক বিচ্ছুরণ দেখেছিলেন তিনি)।
মরিশাসে এসে তিনি হুগলী প্রভৃতি বাংলার কিছু স্থান থেকে আগত মানুষের দেখা পেলেন। তারা সেখানে কাজ করে এবং বিবাহ করে পাকাপাকিভাবে সেখানেই রয়েছে। মরিশাসের কেন্দ্রে পাহাড়, জঙ্গল রয়েছে কিন্তু পূর্ব দিকে প্রচুর কৃষি জমি ও ছোট শহর আছে। ফরাসি দুর্গ ও ফ্যাক্টরিও আছে। ফরাসি সম্ভ্রান্তদের বাড়ির সঙ্গে নিজস্ব কৃষি জমি রয়েছে, যেখানে ক্রীতদাসরা (মাদাগাস্কার আর মালাবার থেকে চড়া দামে কেনা) কৃষিকাজ করে। এখানে খুব বড় বড় আম হয়, খুব সুন্দর স্বাদের, যার বাইরের রং সবুজ আর ভিতরে নীল। এখানে তামার পয়সা বা কড়ির প্রচলন নেই। আছে কাগজের টাকা। এখানকার বাড়িগুলো কাঠের তৈরি আর চাকার উপর বসানো। তাই সেগুলো গাড়ির মতো এক দুই ক্রোশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়।
এরপর প্রবল ঝড়ে পড়ে তাঁদের জাহাজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হল এবং সারানোর জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হল। প্রবল ঝড়ো হাওয়া অতিক্রম করে জাহাজ উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছলো। এটি হাবশী, হটেনটট ও বুশম্যানদের দেশ ছিল। এখন ডাচ অধিকারে রয়েছে। হটেনটটরা ও বুশম্যানরা তাদের নারী-পুরুষ-শিশু ঘরবাড়ি নিয়ে কিছু বছর এক জায়গায় থাকে, তারপর অন্য জায়গায় চলে যায়। তারা পশু চামড়া পরে, কাঁচা মাংস দুধ আর বুনো ফল খায়। তারা খুব ক্ষিপ্র। সহজেই বুনো শুয়োর, হরিণ ধরতে পারে। হাতি ধরার জন্য তারা বড় গর্ত করে রাখে। গাদা বন্দুকের শব্দ করে হাতির পালকে সেই গর্তের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। হাতি গর্তে পড়ে জল, খাবার না পেয়ে মারা যায়। হটেনটটেরা তখন হাতির দাঁত ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। ডাচেরা বাংলা থেকে নারী-পুরুষ-শিশু কিনে এখানে ক্রীতদাস করে রেখে। লেখকের তাদের কজনের সঙ্গে দেখা হলো। তারা হিন্দি, বাংলা ভাষা ভুলে গেছে। তাই আকার ইঙ্গিতে কথা হলো।
অ্যাসেনশন দ্বীপে (অতলান্তিক মহাসাগরের একটি দ্বীপ) কেউ বাস করে না। সেখানে প্রচুর মাছ। বাগদা চিংড়ির মতো একরকম মাছ রয়েছে আর বিশাল বড় বড় কচ্ছপ রয়েছে। নাবিকরা অনেক কচ্ছপ ও কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করল খাবার জন্য। সমুদ্রে কত যে বৈচিত্র্য, বিষ্ময় আছে তা বলে শেষ করা যায় না, লিখেছেন লেখক। এবার তিনি দেখলেন উড়ুক্কু মাছ। মাছের দৈর্ঘ্য তিন আঙ্গুল আর ডানার দৈর্ঘ্য চার আঙ্গুল। সিল্কের কাগজের মতো পাতলা সেই ডানা যতক্ষণ ভিজে থাকে ততক্ষণ উড়তে পারে ওই মাছ। ডানা শুকিয়ে গেলে তারা জাহাজের মধ্যে এসে পড়ে যায়। নাবিকরা এই মাছ সংরক্ষণ করে রাখে ও চড়া দামে অন্য দেশে বিক্রি করে কারণ এই মাছের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার আছে। তিমি মাছ দেখার বর্ণনাও দিয়েছেন লেখক। এরপর লেখক মৎস্যকন্যার কথা লিখেছেন। এদের দেখা পেলে আর ডাক শুনলে নাবিকের নাকি আর বাঁচার আশা নেই। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখলেও সে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে।
অবশেষে প্রায় ছয় মাস পরে ফ্রান্সের নঁত (Nantes) -তে জাহাজ নোঙর করলে সেখানকার গরীব মানুষেরা ফল, রুটি, টাটকা মাছ বিক্রি করতে এল। এতদিন পর স্থলভাগে এসে লেখক যেন নতুন জীবন পেলেন। ফ্রান্সের গরিব মানুষেরা চামড়ার জুতো কিনতে পারেনা। তারা এক রকম কাঠের জুতো পরে অদ্ভুত ভাবে চলাফেরা করে। বাংলা থেকে অনেক সহযাত্রী নানা রকম সিল্ক কাপড়, কিংখাব-এর কাপড় প্রভৃতি নিয়ে গেছিল, কাস্টমস চেকিং বাঁচিয়ে তারা বাড়ি গেল।
ষোলো দিন এখানে কাটিয়ে তাঁরা এক সপ্তাহের সমুদ্রযাত্রায় পৌঁছলেন ফ্রান্সের ক্যালে বন্দরে। লেখক দুই সপ্তাহ এখানে কাটালেন ও শহর ঘুরে দেখলেন। এখানকার ঘরবাড়ি পাথর আর প্লাস্টার ব্যবহার করে তৈরি। ছাদে কাঠ আর টালি ব্যবহার করা হয়। ইউরোপে বাঁশ নেই, তাই ছাদ তৈরিতে বাসের বদলে কাঠের তক্তা ব্যবহার করে। গরিব মানুষরা বার্লির রুটি আর ঝোল খায়। তাদের মোটা পশমের বা গাছের শনের পোশাক। ফরাসিরা বলে ইংরেজরা তাদের কাছে শিল্প-সঙ্গীত, বিজ্ঞান আর ঘোড়ায় চড়া শিখেছে; তাই ইংরেজরা এখন এত উন্নতি করেছে। না হলে তারা হিন্দুস্তানিদের মতো বোকা থাকতো। এইভাবে লেখক লক্ষ্য করেন ফরাসিরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর জাতি হিসেবে দেখাতে ও অন্য জাতিকে কোন কারণ ছাড়া গালি দিতে অভ্যস্ত।
এরপর তাঁরা একদিনে ইংল্যান্ডের ডোভার নামক ছোট সমুদ্র বন্দরে পৌঁছলেন। ডোভার শহর দেখার সময় ইংরেজরা লেখককে অসীম কৌতূহলের সঙ্গে দেখত কারণ তারা কখনো হিন্দুস্তানি পোশাক পরা কোন মানুষ দেখেনি। অবশ্য তাদের ব্যবহার দয়ালু ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। তারা তাঁকে ভিড় করে ঘিরে ধরত। একদিন কজন তাঁকে একটা হলে নিয়ে গেল হচ্ছিল। সেখানে তারা নাচ গান বন্ধ করে নারী-পুরুষ সবাই লেখকের পোশাক, পাগড়ি, শাল, কোমরবন্ধ, ছুরি প্রভৃতি দেখতে লাগলো। তারা ভাবছিল এটি নাচ বা অভিনয়ে ব্যবহারের পোশাক। নতুন দেশ দেখতে গিয়ে তিনি নিজেই দ্রষ্টব্য হয়ে গেলেন।
এরপর ঘোড়ার গাড়িতে করে লন্ডনে পৌঁছে, মিস্টার সুইনটনের ভাইয়ের বাড়িতে থাকলেন লেখক। লন্ডনেও তিনি একই রকম ব্যবহার পেলেন ইংরেজদের কাছে। লেখক কুন্ঠিত কিন্তু আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ বোধ করতে লাগলেন। ইংরেজরা আগে মুনশি অর্থাৎ কোন শিক্ষিত ভারতীয় দেখেননি। শুধু চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরের কিছু লস্কর বা নাবিক দেখেছে। তাই তিনি বাংলার কোন নবাব জাতীয় বিখ্যাত ব্যক্তির সম্মান পেতে লাগলেন। যেখানেই তিনি যান ভিড় জমে যায়। বাচ্চারা অবশ্য তাঁকে কালো শয়তান ভেবে ভয় দূরত্ব রেখে চলে। কোনো কোনো মানুষের ধারণা হয়েছিল লেখকের পোশাক হল হারেমের সুন্দরীদের পোশাক। দুই তিন মাস তাদের ভয় কৌতুহল কাটতে লাগল। তারপর ইংরেজ ভদ্রমহিলারা তাঁকে এসে হেসে বলতে থাকলো এসো প্রিয় চুম্বন করো।
লন্ডনের মতো বড় আর সুন্দর শহর এই পৃথিবীতে নেই। শহরের মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে গেছে। তার পাশে মজবুত কালো পাথরের দুর্গ, যার নাম টাওয়ার। এই দুর্গে অজস্র অস্ত্র, কামান প্রভৃতি আছে। অনেক ইঁটের বাড়ি ও চার্চ আছে এখানে। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল আকার ও সৌন্দর্যে শ্রেষ্ঠ। এই ক্যাথিড্রালের গম্বুজ থেকে চারপাশে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। একমাত্র বিজাপুরের গোল গম্বুজ ছাড়া এত উঁচু গম্বুজ হিন্দুস্তানে কোথাও নেই।
ডেনমার্কের এক রাজা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে বানিয়েছিলেন (বর্তমানে এরকম কোন তথ্য পাওয়া যায়নি)। এখানে কিছু মূর্তি আছে যা অবিকল জীবন্ত বলে মনে হয়। রাজার প্রাসাদ বাইরে থেকে সুন্দর নয়, এমনকি প্লাস্টার করাও নয়। তবে রাজার প্রাসাদের ভিতরে নাকি সুন্দর সাজসজ্জা আছে। রানীর প্রাসাদ কিন্তু সুন্দর ও চমকালো। (বর্তমান ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেস ডিউক অফ বাকিংহামের দ্বারা ১৭০৩ তৈরি। রাজা তৃতীয় জর্জ এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিটি ১৭৬১ সালে অধিগ্রহণ করেন এবং রানী শার্লটের থাকার জন্য দেন। এটি তখন থেকে রাণীর প্রাসাদ নামে খ্যাত ছিল। ১৮৩৭ থেকে বাকিংহাম প্যালেস প্রধান রাজপ্রাসাদ হিসেবে স্বীকৃত হয়। লেখক যে সময় লন্ডনে যান তখন সেন্ট জেমস প্যালেস রাজপ্রাসাদ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এটি ওয়েস্টমিনস্টার শহরে অবস্থিত)।
লন্ডনের শহরের বাড়িগুলি প্রায় সব তিন থেকে পাঁচতলা। এখানকার ঘরের উচ্চতা কম। মেঝে কাঠের, দেয়ালে রঙিন কাগজ লাগান। জোরে হাওয়া বইলে দেওয়াল কাঁপে, ভয় হয় যে পড়ে যাবে, যদিও বাস্তবে তা হয় না। চারদিকে পরীর মত নারীরা ঘুরে বেড়িয়ে জায়গাটা স্বর্গের মতো হয়ে ওঠে। কবি এই স্থান প্রথম দেখে বলে উঠেছিলেন যে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানে এখানে এখানে। রাস্তাগুলো প্রশস্ত, দুপাশে বাড়ি। বাড়িগুলো কলকাতার সেনা ব্যারাকের মতো একরকম দেখতে। সেগুলো একেবারে সরলরেখায় সাজানো আছে। বিভ্রান্তি এড়াতে বাড়ির দরজায় পিতলের ফলকে বাড়ির মালিকের নাম লেখা আছে। তার সঙ্গে মালিকের পেশার চিহ্ন ফলকে আঁকা আছে। যেমন মুচির বাড়িতে জুতোর ছবি ইত্যাদি। বাড়ির একতলা দোকান হিসেবে ভাড়া দেওয়া থাকে। সেখানে কাঁচের তাকে জিনিসপত্র সাজান। দুই, তিনতলা অবস্থাপন্নরা থাকে। চারতলায় ভৃত্য শ্রেণীর লোক থাকে। রাস্তা পাথরে বাঁধানো, দুপাশে পথচারীদের হাঁটার সুন্দর রাস্তা রয়েছে।
রানীর প্রাসাদের কাছে (বাকিংহাম প্যালেস) একটা পার্ক আছে (সেন্ট জেমস পার্ক)। সেখানে দু'ধারে ওয়ালনাট গাছের সারির মধ্যে দিয়ে ছায়াচ্ছন্ন পথ। এখানে অনেক হরিণ রাখা আছে। সেখানে রবিবার নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই যায় ও আনন্দ উপভোগ করে।
নাচ, গান, নাটকের ক্ষেত্রে ইউরোপ আর ভারতবর্ষের পার্থক্য রয়েছে অনেক। ভারতে যেমন এক রাতের জন্য একজনের বাড়িতে গাইয়ে নাচিয়েরা এসে অনুষ্ঠান করে এবং তার জন্য সেই ব্যক্তিটির লাখ লাখ টাকা খরচ হয়, ইংল্যান্ডে তেমন হয় না। এখানে অনেক নাচিয়ে, গাইয়ে, অভিনেতা ইত্যাদি নিয়ে একটি কোম্পানি তৈরি করা হয়। তারা একটা বাড়িতে একসঙ্গে অনুষ্ঠান করে। সেখানে বহু লোক এসে তাদের সামর্থ্য অনুসারে দামের স্থানে বসে উপভোগ করে। রাজা, রাজকুমাররা একদম সামনে বসেন আর গরীব মানুষরা সামান্য পয়সা দিয়ে সেই একই অনুষ্ঠান দেখতে পায় পিছনে বসে। এক রাত অনুষ্ঠান করে শিল্পীরা অনেক টাকা পায়। বেহালা, গিটারের সঙ্গে যে নাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয় তার বর্ণনা দেওয়ার ভাষা খুজে পাওয়া যায় না বলে লেখক লিখেছেন। নাটকের সময় হলে কোন কথা বলা নিষেধ। প্রশংসাসূচক শব্দও বলা চলে না। পা ঠুকে বা হাততালি দিয়ে বাহবা জানান যায়। লেখক অনেক নাটক দেখেছিলেন।
সার্কাস হল বিনোদনের আরেকটি স্থান। একজন ঘোড়সওয়ার ঘোড়ার খেলা দেখায়, এক শিলিং দিলে তা দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া জাগলিং -এর খেলা হয়। নদীর ওপর পারে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরেকটি বিরাট বাগান আছে। তার মধ্যস্থলে নাচ গান প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ডে বাঘ, সিংহ, চিতা, ভালুক, নেকড়ে কিছুই নেই। হাতি, উট প্রভৃতি প্রাণী ভারত থেকে নিয়ে এসে তারা একটা বড় বাড়িতে (চিড়িয়াখানা) রাখে। মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসে দল বেঁধে এক দুই টাকার বিনিময়ে সেই বাড়িতে ঢুকে সেই সব প্রাণী দেখে। টাকা তোলার এটা এক উপায়। তবে এখানে নানা জাতের কুকুর পাওয়া যায়। (লন্ডনে যে সব নতুনত্ব দেখে লেখক অবাক হয়েছিলেন উপনিবেশ হিসেবে ভারত তার প্রায় প্রতিটি বৈশিষ্ট্য আত্তীকরণ করেছে পরবর্তী কালে) ।
তিন মাস লন্ডনে থাকার পর মন খারাপের সঙ্গে তিনি লন্ডন ছেড়ে অক্সফোর্ড চললেন ক্যাপ্টেন সুইনটনের সঙ্গে। কিন্তু সুন্দর ও পরিষ্কার অক্সফোর্ড শহর দেখে তাঁর দুঃখ দূর হল। বিশ্ববিদ্যালয়, পূরনো চার্চ, ক্যাথিড্রাল, লাইব্রেরী দেখলেন। সেখানে অনেক আরবি, ফার্সির বই ছিল। একটি লাইব্রেরীতে অনেক বিখ্যাত শিল্পীর চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ছিল। এগুলি বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মূল্য দিয়ে কিনে আনা হয়েছে। লেখক বলেন ইংল্যান্ডের শিল্প বা বিজ্ঞান কেন উন্নতি করবে না এরকম পৃষ্ঠপোষকতা উৎসাহ পেলে। কিন্তু এখন ভারতবর্ষে যদি কেউ বহুদিন ধরে চেষ্টায় কোন জ্ঞান সংগ্রহ করে সে কোন সম্মান পাবে না। বরং দুর্ভাগ্য আর দুঃখ বরণ করতে হবে তাকে। সেজন্যই ভারতে কেউ তেমন উন্নতি করায় আগ্রহী নয় কলা ও বিজ্ঞানের। লাইব্রেরির প্রতি তলায় জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রাদি, টেলিস্কোপ রয়েছে।
শীতকালে ক্যাপ্টেন সুইংটনের সঙ্গে লেখক অক্সফোর্ড থেকে স্কটল্যান্ড চললেন। এই যাত্রায় বরফের উপর দিয়ে মানুষজনকে স্কি করে যেতে দেখলেন। শুনলেন এভাবে তারা একদিনে ১০০ ক্রোশ পর্যন্ত যেতে পারে। স্কি করার সময় তাদের দেখে লেখকের মনে হলো দেবদূত, পরিরা স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে।
স্কটল্যান্ডের দুটি অংশ - পার্বত্য স্কটল্যান্ড আর সমভূমির স্কটল্যান্ড। এই দেশে পাহাড় আর জঙ্গল অনেক বেশি শহরের তুলনায়। স্কটিশরা সাহসী, বীর ও সংযমী। স্কটিশরা নিজেদের ইংরেজদের থেকে শ্রেষ্ঠতর জাত বলে মনে করে। অন্যদিকে ইংরেজরা দারিদ্রের জন্য স্কটিশদের ঘৃণা করে। তাদের ভাষাও কিছুটা আলাদা। এডিনবরাতে তাঁরা ক্যাপ্টেন সুইনটনের বাবার বাড়িতে থাকলেন। পার্বত্য স্কটল্যান্ডে প্রায় সারা বছর বৃষ্টি আর তুষারপাত হয়। কিন্তু সেখানকার মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখানকার মানুষ এক রকম টুপি আর জ্যাকেট পরে কিন্তু ফুলপ্যান্ট বা বুট পরে না। শরীরের নীচের অংশ ঢাকা থাকে লম্বা জ্যাকেট আর সুতির মোজায়, হাঁটু অনাবৃত থাকে। পায়ে ফিতে বাঁধা জুতো থাকে। সঙ্গে থাকে দ্বিধারী তরোয়াল।
ক্যাপ্টেন সুইনটন ও আরো কয়েকজন ইংরাজ লেখকের কাছে ফার্সি ভাষা শিখছিলেন। তাঁরা লেখককে ইংল্যান্ডে আরো কিছু সময় থাকতে অনুরোধ করেন। কিন্তু যখন তাঁরা লেখককের ধর্ম বিশ্বাস ও মূল্যবোধ নিয়ে বক্রোক্তি করেন তখন লেখক আর ইংল্যান্ডে থাকতে চান না। ইতিমধ্যে লন্ডনে এসে লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারে সরাসরি বাদশাহ শাহ আলমের পাঠানো নজরানা দিয়ে নিজে নিশ্চয়ই রানীর অনুগ্রহ লাভ করেন এবং তাঁর পাঠানো চিঠির কথা বেমালুম চেপে যান। অবশেষে ইউরোপে দু বছর নয় মাস কাটিয়ে ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে লেখক ভারতে ফেরেন।