শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫

৮২। স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ ২

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

            
            (আগের পর্বের পরে)

১৯১২ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রয়াগ বা এলাহাবাদে যান। ১৩১৯ ও ১৩২০ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকায় কয়েকটি সংখ্যায় তাঁর এই ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হয়। এই যাত্রার সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং লেখিকার পুত্র ও কন্যা। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি এই লেখায় "সক্রেটিস দাদা" নামে অভিহিত করেছেন। ট্রেন যাত্রার বর্ণনা তিনি সরস ভঙ্গিতে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন কিভাবে সত্যেন্দ্রনাথ অন্য বাঙালি ও ইংরেজদের সেই কামরায় ওঠা আটকে ছিলেন। রেলে জালনা দিয়ে প্রথমবার পাহাড় দেখে তাঁর ছেলে মেয়ে আনন্দে বিভোর হয়েছিল। স্বর্ণকুমারী দেবী একবার গল্প করেছিলেন তাঁর প্রথমবার রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা। তিনি পালকি থেকে সরাসরি রেলে উঠেছিলেন সেটি শুনে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব অদ্ভুত লাগে এবং তিনি মনে করেন সকলের সামনে প্লাটফর্মে পালকি নিয়ে আসা খুব লজ্জার ও হাসির কথা। স্বর্ণকুমারী দেবীর আগে ধারণা ছিল লোকের মধ্যেই লজ্জা, জনতার মধ্যে স্টেশনে নামাটাই লজ্জার, পালকি চড়ে গাড়িতে চড়ায় লজ্জা নেই। তারপরেও যে রাতে জনতার মধ্যেই তিনি স্টেশনে নামেন তখন তিনি প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করেন, বেড়ানোর সব সুখ লোপ পায়। এখনো স্টেশনে জনতার মধ্যে রেলে চড়তে তাঁর খুব অস্বস্তি হয় জানিয়েছেন।  কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের কথা শোনার পরে তাঁর মনে সংশয় দেখা দেয়। তিনি লিখেছেন "দেখিতে দেখিতে সমাজে কি পরিবর্তন কে জানে। দিন কত পরে আরো কি হইবে।" পরদিন বেলা ১১ টায় ট্রেন দানাপুর এল। এখানে গাড়ি আধঘন্টা থাকে। তাঁদের জন্য স্টেশনে ভাত তরকারী বলা ছিল। দাদা ছেলেকে নিয়ে স্টেশনে স্নান করতে নামলেন। জানালা দরজা সব বন্ধ ছিল তবু মনে হতে লাগল যদি কেউ এসে পড়ে। একজন ইংরাজ কামরায় ঢোকার চেষ্টা করে "জেনানা জেনানা" বলে চলে গেল। এরপর বক্সার এল। বক্সার ইংরাজ সরকারের বাংলার সীমা। এরপর চুনার বা চন্ডালপুর, মৃজাপুর প্রভৃতি হয়ে যমুনার পুল পেরিয়ে এলাহাবাদ এল। 

প্রয়াগে প্রবল ঠান্ডা সত্ত্বেও তিনি একদিন গঙ্গাস্নান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শুনলেন পান্ডাদের কিছু দিয়ে মাথা না মুড়ালে শুধু গঙ্গাস্নানে ফল হয় না। মাথা মুড়াতে একেবারে রাজি না হওয়ায় তিনি গঙ্গাস্নানের ইচ্ছা ত্যাগ করেন। নৌকা করে তিনি ত্রিবেণী সঙ্গম দর্শনে যান। যমুনার কালো জলে যমুনা পুলের তলা দিয়ে নৌকা দুর্গের কাছে এল। দুর্গের ঠিক নীচে একটা ধ্বজা পোঁতা আছে। ধ্বজার নীচে নাকি একটি কূপে সরস্বতী নদী বিরাজিত। সঙ্গমের দিকে গঙ্গা ও যমুনা যেন দুই সতীন স্বামীর কাছে কে আগে পৌঁছাবে এই বিবাদে উন্মত্ত হয়ে ভীমবেগে চলেছে। সঙ্গম স্থানটি দেখলে কৃষ্ণের মোহিনী মূর্তি মনে পড়ে। 

গঙ্গার অপর পাড়ে উঁচু নীচু পাহাড়ময় স্থান - ঝুসি। সেখানে কয়েকটি কেল্লার ভগ্নাংশ দেখা যায়। গঙ্গার বেণীঘাটে পান্ডারা নিশান পুঁতে নিজের নিজের এলাকা নির্ধারণ করেছে। এখানে সবাই গঙ্গাস্নান করে, নানান দেবদেবীর মূর্তিকে দক্ষিণা দেয়। বর্ষায় এই ঘাট জলে ডুবে যায়। 

লেখিকা একদিন দুর্গের মধ্যে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে অক্ষয় বট দেখলেন। এই দুর্গের নির্মাণশৈলী অত্যন্ত উন্নত। দুর্গের অস্ত্রাগারে পাস নিয়ে ঢুকে নানা রকম বন্দুক, তরবারি দেখলেন। তৃতীয় দ্বার পার হয়ে বাগানে অশোক স্তম্ভ দেখলেন। সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রস্তর মূর্তি দেখিয়ে পান্ডা বলল ত্রিবেণীমাধবের মূর্তি। দুর্গের স্থানে নাকি পূর্বে গঙ্গার জল পূর্ণ ছিল। আকবর নাকি ত্রিবেণীমাধবকে বলেন ৫০০ বছরের জন্য গঙ্গা যেন কিছুটা সরে যায়। বেনীমাধব তুষ্ট হয়ে হাজার হাজার বছরের জন্য গঙ্গাকে সরিয়ে দেন ও আকবর তাঁর দুর্গ নির্মাণ করেন। সুড়ঙ্গটি ২৫-৩০ হাত লম্বা। দুপাশের দেওয়ালে অনেক কুলঙ্গি আছে, সেখানে পাথরে নানা দেবমূর্তি আছে। অক্ষয় বটের কাছে সুড়ঙ্গর মেঝেতে কয়েকটি পাথরের শিব লিঙ্গ, তার একটি কিছুটি ভাঙ্গা। পান্ডা বলল ঔরঙ্গজেব নাকি সেটি ভেঙে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রক্তে সুরঙ্গ ভেসে গেছিল। অক্ষয় বট দেখে লেখিকা আশ্চর্য হলেন। রোদ বায়ুবিহীন বদ্ধ এলাকায় সেই গাছে অল্প হলেও নতুন পাতা মঞ্জুরিত হয়েছে, গাছটি জীবন্ত। দেখে তাঁর মনে হল অক্ষয় বটটি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হওয়া উচিত। এই সুড়ঙ্গের শেষ একেবারে বন্ধ নয়, একজন মানুষের যাওয়ার মতো ফাঁক আছে। পান্ডা বলল ওই সুড়ঙ্গ নাকি কাশী পর্যন্ত গেছে। পান্ডা আকবরের আগের জন্মের মুকুন্দ সন্ন্যাসী রূপের কথা বলল (যে কাহিনী এর আগে যদুনাথ সর্ব্বাধিকারীর লেখায় বর্ণিত হয়েছে)। লেখিকা লিখেছেন এই কাহিনী থেকে আকবরের প্রতি দেশের লোকে কী রূপ সন্তুষ্ট তা বোঝা যায়। পান্ডা বলল আকবরই নাকি অক্ষয় বটের এই সুড়ঙ্গ তৈরি করে দেন। ইংরাজ দুর্গ অধিকার করার পর সকালে বিকালে কয়েক ঘন্টা অক্ষয় বট দেখার অনুমতি আছে। 

জাহাঙ্গীরের পুত্র খসরুর তৈরি খসরু বাগ এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানে তাঁর সমাধিও আছে। বাগানে মখমলের মতো ঘাস ও বিচিত্র ফুলের বাগান। বিশেষত গোলাপের যে প্রাচুর্য তা লেখিকা আর কোথাও দেখেননি। খসরুর সমাধি ছাড়াও তাঁর মা, স্ত্রী ও দুই বালক পুত্রের সমাধি এখানে আছে। খসরুর সহোদর শাহজাহান নাকি খসরু এবং তাঁর দুই পুত্রকে হত্যা করান। যে ফকির সমাধি দেখালেন তিনি এই কাহিনী বলেন ও সমাধি মন্দিরের গাত্রে ফার্সি ভাষায় লেখা কিছু কবিতা পড়ে শোনান। যেমন - ধনের জন্য কি না হয়, পুত্র পিতার অবাধ্য হয়ে পড়ে, ভাই ভাইকে নিধন করে.... ইত্যাদি। 

একদিন যমুনা নদীতে নৌকায় করে ভ্রমণ কালে যমুনা বক্ষে একটি পাহাড়ের দ্বীপে গেলেন তাঁরা। দ্বীপটির নাম সুজান দ্বীপ। পাহাড়ের চূড়ায় একটি শিব মন্দির। নীচ থেকে মন্দির পর্যন্ত সিঁড়ি উঠেছে। মন্দিরে জনমানব নেই। মন্দিরের দেওয়ালে ফার্সি লেখা দেখে লেখিকা অবাক হলেন। সুজান দ্বীপের সামনে জলের মধ্যে আরেকটি পাহাড়। সেই পাহাড়ের উপর দুটি মন্দির, একটি কৃষ্ণ-রাধার আর একটি শিবের। এই পাহাড়ে লোকজনের বাস আছে। পুরোহিতের কাছে শুনলেন নবাব শাহ সুজা, তাঁর এক প্রিয় হিন্দু কর্মচারীর অনুরোধে এই দ্বীপ-মন্দিরগুলি নির্মাণ করিয়ে দেন ও নিজের নামে এই মন্দির ও দ্বীপের নামকরণ করেন,। তখন লেখিকা বুঝলেন মন্দিরের ফার্সি ভাষায় লেখা কেন রয়েছে। 

লেখিকা ভরদ্বাজ আশ্রম মন্দির দেখতে যান। রামচন্দ্র বনে যাওয়ার সময় এখানে তিন দিন বাস করেছিলেন। কিন্তু সেই নির্জনতা নেই, লোকজনের গন্ডগোল ও অপরিষ্কার পরিবেশ কয়েকজন স্ত্রী পান্ডার হাঁক ডাকে তাঁরা সন্ত্রস্ত হলেন। শহরের মধ্যে এক রাজার মন্দির দেখলেন, যার চূড়াগুলি স্বর্ণমণ্ডিত। এছাড়া গঙ্গাতীরে বাসুকীর মন্দির ও শিবকোটির মন্দির দর্শন করলেন। 


১৩২০ ভাদ্র মাসে ভারতীতে প্রকাশিত "সমুদ্রে" শিরোনামে স্বর্ণকুমারী দেবীর রচনায় তাঁর স্টিমার যাত্রার কথা জানা যায়। ৬ই মে (১৯১৩?) ডুনেরা নামক ইউরোপগামী বড় স্টিমারে তাঁরা উঠলেন। ১২ বছর আগে তিনি তিন দিনের সমুদ্রপথে বোম্বে থেকে কারোয়ার গেছিলেন। এবার নীলগিরি গন্তব্য। এই জাহাজে উঠে লেখিকার বিলাত যাওয়ার ভারী ইচ্ছা করছিল। জাহাজে খাবারের ব্যবস্থা রাজকীয়। সকালে ছোট হাজরি অর্থাৎ রুটি, মাখন, চা, কফি প্রভৃতি। সকাল সাড়ে নটায় বড় হাজরি বা প্রাতরাশ মাছ ভাজা, পরিজ, মাংসের ২-৩ রকম, রুটি, মাখন, জ্যাম, ফল প্রভৃতি। বেলা একটা সময় মধ্যাহ্নভোজন - সকালের সব খাবার সঙ্গে সুপ। সান্ধ্যভোজনে  সকাল ও দুপুরের সবকিছু পদ পরিজ ছাড়া, শেষে দুই রকম পুডিং। চা, কফি, মদের যথেচ্ছ ব্যবস্থা। ইংরেজরা বিনা পরিশ্রমে এত বিপুল খাদ্য কিভাবে গ্রহণ করে এতে লেখিকা অবাক হন। জাহাজে সর্বত্র বিদ্যুতের আলো। কলকাতার ঘরে ঘরে পথে ঘাটে কবে এইরকম বিদ্যুতের আলো জ্বলবে লিখেছে লেখিকা। ৭ই মে সকালে জাহাজ খিদিরপুর ছাড়ল, ডায়মন্ড হারবারে রাতে নোঙর করল। পরদিন ডায়মন্ড হারবার ছেড়ে জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করল। 

১১ই মে সকালে জাহাজ মাদ্রাজ বন্দরে লাগল। জাহাজ থেকে মাদ্রাজ উপকূল সুন্দর দেখায়। উচ্চতর ভূমিতে হাইকোর্ট, কলেজ প্রকৃতি বড় বড় বাড়ি শোভা পাচ্ছে। কিন্তু এখানে জেটি নেই, জাহাজ থেকে নৌকায় নেমে তীরে উঠতে হয়। শহরের মধ্যে ভালো বাড়ি দেখতে পেলেন না, রাস্তা ধুলিময়। কলকাতা ও বোম্বের তুলনায় মাদ্রাজকে তাঁর সামান্য মনে হল। 
১৩১৯ আশ্বিনে ভারতী পত্রিকায় লেখিকার পুরী নিয়ে একটি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। লেখিকা এখানে পুরীর সমুদ্র, বালিরাশি, সমুদ্র স্নানের কথা লিখেছেন। এখানকার মৎস্যজীবী সমুদ্র নাবিকদের নুড়িয়া বলে। স্নানের সময় তাদের একজনকে সঙ্গে রাখলে ভয় থাকে না। এজন্য তাদের দুই আনা করে পারিশ্রমিক দিতে হয়। তাদের সাহস দেখে লেখিকা মুগ্ধ হন। তিনি লিখেছেন নুড়িয়া অর্থ ন-উড়িয়া, মানে তারা উড়িয়া নয়, এরা মাদ্রাজি তৈলঙ্গী। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডাদের আতিশয্যের কথা তিনি বলেছেন। 

পুরীর জগন্নাথ মন্দির দেখে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করেছেন। প্রাচীরের মধ্যে ছোট বড় ১২০ টি মন্দির আছে। প্রাচীরের চারদিকে চারটি তোর। পূর্ব তোরণটি সিংহদ্বার, এখানে দুটি সিংহ মূর্তি বিরাজিত। দক্ষিণদ্বার অশ্বদ্বার।উত্তরে হস্তিদ্বার। পশ্চিম তোরণ রক্ষক মূর্তিহীন, এর নাম খাঞ্জাদ্বার। শোনা যায় জগন্নাথ মন্দিরের সম্মুখস্থ অরুণস্তম্ভ কোনারকের সূর্য মন্দির থেকে এনে এখানে প্রোথিত হয়েছে। জগন্নাথজির ভোগমন্ডপের দরজার ওপরে যে নবগ্রহ মূর্তি আছে তাও নাকি কোনারকের সূর্য মন্দিরের অংশ। জগন্নাথ মূর্তি দেখে তাঁর মনে হয় সৌন্দর্যের আড়ম্বরহীন এই মূর্তি যেন নিরকারের ব্যাঞ্জক। তাই ভক্ত এর মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রূপ দেখেন। চৈতন্য এই রূপ দেখেই পাগল হয়েছিলেন। এখানকার একজন পান্ডা বলল জগন্নাথ বুদ্ধদেবের অবতার, তিনি নিরাকার। মন্দিরের ভিতরে অন্ধকারে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা বিরাজিত, শুধুমাত্র প্রদীপের আলোয় আলোকিত। শ্রীক্ষেত্রের অন্নছত্রের দৃশ্য দেখে তিনি আনন্দিত হন। হিন্দু আচার প্লাবিত দেশে বুদ্ধদেবের উদার ধর্মের মহিমা দেখা যায় এই ভোগ দান পদ্ধতিতে, যাতে আচারবিচার জাতিভেদ নেই। চৈতন্যদেব বহু চেষ্টায় জাতিভেদ উঠাতে পারেননি। এমন কি ভক্ত মুসলমানকে জগন্নাথ মন্দিরের নিয়ে যেতে সফল হননি। এই আক্ষেপে তিনি (?) মন্দির চূড়ায় (?) জগন্নাথ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট এই মূর্তি প্রকাশিত। 

পুরীতে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। গুঞ্জোবাড়ি, জগন্নাথ দেবের গ্রীষ্মাবাস মন্দির। রথযাত্রাকালে এইখানে ত্রিমূর্তির অধিষ্ঠান হয়। আঠার নালা একটি সেতুর নাম, এই সেতু বিনা খিলানে নির্মিত। আঠারোটি নালার প্রত্যেকটি স্তম্ভ চূড়ায় তির্যকভাবে সজ্জিত পাথরের সারির উপর এই সেতু স্থাপিত। চন্দন সরোবরের জল অতিশয় নির্মল। এর বুকে একটি কৃত্রিম দ্বীপ আছে এবং চারদিকে বাঁধানো ঘাট রয়েছে

৮১। স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ ১

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) অন্যতম প্রথম বাঙালি মহিলা কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার। তিনি প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি কোনো পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা সহোদরা। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর "ভারতী" নামের পত্রিকা প্রচলন করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে এই পত্রিকার সম্পাদক পদে স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত হন। তারপরে তিনি দুটি পর্যায়ে মোট ১৮ বছর ভারতী পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করেছেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৬ সালে অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যের জন্য তিনি "সখী সমিতি" স্থাপন করেছিলেন। তাঁর লেখা দীপনির্বাণ, ছিন্নমুকুল, হুগলির ইমামবাড়ি, ফুলের মালা প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনেক কাব্যগ্রন্থ ও নাটক রয়েছে। তিনশোর বেশি গান তিনি রচনা করেছেন। তিনি জগৎতারিনী স্বর্ণপদক পেয়েছেন। 


স্বর্ণকুমারী দেবীর ভ্রমণ পর্বের প্রথম খবর পাওয়া যায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কারোয়ার যাত্রায়। তিনি মেজদাদা আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল বোম্বাই প্রদেশের কারোয়ার গেছিলেন। সঙ্গী ছিলেন ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ,রবীন্দ্রনাথ, ভগ্নি সৌদামিনী। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই ভ্রমণ সংক্রান্ত। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীর নিজের কোন রচনা পাওয়া যায়নি। 


এরপর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দেই স্বর্ণকুমারী দেবী বোলপুর যান সপরিবারে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরী দেবীও তাঁর সঙ্গে যান। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবীর লেখা থেকে এই বোলপুর ভ্রমণ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। 


১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী দার্জিলিং ভ্রমণে যান। সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর পত্নী মৃণালিনী দেবী, তাঁর শিশু কন্যা বেলা, ভগ্নি সৌদামিনী দেবী ও স্বর্ণকুমারী দেবীর দুই কন্যা ১৩৯৫-এর ভারতী পত্রিকায় বৈশাখ থেকে ভাদ্র ও কার্তিক সংখ্যায় দার্জিলিঙ পত্র নামে ধারাবাহিকভাবে এই লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথমে তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পড়ার মজলিস হত, সেটাই তিনি উপভোগ করতেন। লেফট্যানেন্ট গভর্নরের পুরনো বাড়ি ক্যাসেলটন হাউসে ছিলেন তাঁরা। সেই বাড়ির দক্ষিণে মল রোড, অবজারভেটরি হিল বলে একটা ৫০০ ফুট উঁচু পাহাড় বেষ্টন করে এই বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে। এই রাস্তার মতো সমতল সুখে বেড়ানোর জায়গা আর নেই। এখানে গাছপালার জঙ্গল নেই, কলকাতার রাস্তার মতো পথের ধারে এক একটি ফুলে ভরা গাছ। রাস্তার পশ্চিম ধারে অল্প খাড়াই ঢালু তৃণময় স্থানে ফার্ন আর গোলাপের ঝোপঝাড়। এই ঢালু স্থানের পর পশ্চিমে রাস্তার কিছু নীচে ইংরেজদের সুসজ্জিত দোকান। পাহাড়ের সবুজ গায়ে সাদা সুন্দর বাড়িগুলি স্তরে স্তরে উঠেছে। রোদ পড়ে কাঁচের মতো ঝলমল করে বাড়িগুলি। রাতে বাড়ির আলোগুলি নক্ষত্রের মতো পাহাড়ের গায়ে ফুটে থাকে। মল রোডের বিপরীত দিকটা , লেখিকা যাকে পার্ক বলেছেন, ইংরেজরা শহর হওয়ার আগে দার্জিলিং যেমন জঙ্গল ছিল তার কিছু কিছু চিহ্ন রেখে দিয়েছে। চওড়া রাস্তার দু'ধারে পুরনো জঙ্গল বজায় আছে। একদিন তিনি পার্কে যাওয়ার পথে রাস্তা ভুল করে অন্যত্র চলে গেছিলেন। 


দার্জিলিং-এর শোভা দার্জিলিং পৌঁছানোর পথের থেকে শুরু হয়েছে। জলপাইগুড়ির অল্প পরে শিলিগুড়ি, যেটি দার্জিলিং-এর উপত্যকা। সেখান থেকে পাহাড়ে রেলগাড়িতে উঠতে হয়। এই রেলগাড়ি কলকাতার ঘোড়ায় টানা ট্রামের থেকেও ছোট। গাড়ি চড়ে রাস্তার ধারে দুই পাশের গাছপালা অনায়াসে হাত দিয়ে ধরা যায়। 


সুস্থ হওয়ার পর লেখিকা সবসময়ই বাইরে ঘুরে দার্জিলিং এর মুক্ত দৃশ্য দেখতে চাইতেন। তাঁরা ২-৩ দিন ভিক্টোরিয়া ওয়াটার ফলস বা কাকঝোরা দেখতে গেছিলেন। তাঁরা অবজারভেটরি হিলের উপরে উঠেছিলেন। সেখান থেকে চারদিকে দৃশ্য দারুন দেখা যায়। তাছাড়া দুর্জয় লিং দেবতার অধিষ্ঠান সেখানে। অনেকে বলে দুর্জয় লিং বা লিঙ্গ থেকে দার্জিলিং শব্দ এসেছে। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাস (দ্রষ্টব্য: তিব্বত অভিযান) যিনি তিব্বতে গেছিলেন তিনি বলেছেন দর্জিলিং তিব্বতি শব্দ। দরজি থেকে দার্জিলিং হয়েছে। দরজি কথার অর্থ বজ্র। তিব্বতি ভাষায় বজ্র শ্রেষ্ঠ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ দার্জিলিং মানে শ্রেষ্ঠ স্থান। শরৎ চন্দ্র দাস বলেছেন বর্ধমানের রাজা এসে এখানে দুর্জয় লিং প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে এরকম কোন দেবতা এখানে ছিলেন না। কিন্তু লেখিকার মতে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের পিতা (রামলোচন ঘোষ, যিনি পাথুরিয়াঘাটার প্রাচীন প্রাসাদ তৈরি করেন এবং যিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান হয়েছিলেন) এখানে এসেছিলেন। পথঘাট তখন প্রায় ছিল না, তখনও তিনি দুর্জয় লিং দেখে গিয়েছিলেন। 


এরপর লেখিকা দার্জিলিং শহরের কিছু নীচে ভুটিয়াদের প্রধান আবাসস্থল ভুটিয়া বস্তিতে গোল গম্বুজাকৃতি মন্দির দেখলেন। এখানে একজন লামার স্মরণে তাঁর দাঁত ও নখ রাখা আছে। আর আছে এক গুম্ফা, যার বারান্দায় বড় বড় মন্ত্রচক্র আছে। চক্র যত ঘোরে, মন্ত্র তত ঘোরে ও তত পাপ ক্ষয় হয়। গুম্ফার মধ্যে মহাকাল ও মহাকালীর মূর্তি আছে। মন্দিরের আসল দেবতা হিসেবে একটি বুদ্ধ ও কালীর মূর্তি আছে। তৃতীয় প্রধান দেবতার নাম তাঁরা বারবার জিজ্ঞাসা করেও বুঝতে পারেননি। তিব্বতের মতো এখানকার বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের সঙ্গে মিশ্রিত। অহিংসা এখানে পরম ধর্ম নয়। লামাদের মদ মাংস নিষিদ্ধ নয়। এরপর তিনি দার্জিলিং-এর মেঘ রৌদ্রের খেলার কথা লিখেছেন। 


সিঞ্চল দার্জিলিং থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু। এখানে আগে সেনা নিবাস ছিল ইংরাজের। কিন্তু এখানকার শীত সেনারা সহ্য করতে না পারায় তাদের ব্যারাক জলাপাহাড়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। শত শত চিমনি ও ভাঙা দেওয়াল নিয়ে সিঞ্চল এখন শহরের ভগ্নাবশেষ মাত্র। টাইগার হিল সিঞ্চল থেকে ৫০০ ফুট উঁচু, এখান থেকে ধবলগিরির (মাউন্ট এভারেস্ট) কিছু অংশ দেখা যায়। টাইগার হিলের পথ অতি খারাপ, এখানে ডান্ডি উঠে না। ছোট সংকীর্ণ পথে অতি সাবধানে হেঁটে উঠতে হয়। চুড়ায় পৌঁছে অপূর্ব দৃশ্যে মন ভরে গেল। ধবলগিরির চূড়া সেদিন দেখা গেল না কারণ সেদিক মেঘে আচ্ছন্ন। কাঞ্চনজঙ্ঘা শ্রেণী বেশ ভাল দেখা গেল। 


লেখিকা ও সঙ্গীরা একদিন রঙ্গিতে গেছিলেন। রঙ্গিত সিকিমের একটি নদীর নাম। চারপাশের নামও নদীর নামের রঙ্গিত হয়েছে। এটি দার্জিলিং থেকে ১১ মাইল নীচে। নদীর ওপারে স্বাধীন সিকিম রাজ্য। ডান্ডিতে করে জঙ্গলময় পথে কাঞ্চনজঙ্গা দেখতে দেখতে তাঁরা পৌঁছলেন নদীর কাছে। এই নদীর জল সবুজ। পথে ফার্ন, বুনো ফুল, পরগাছা, বড় গাছ যত আছে তা দার্জিলিংয়ে নেই। ডান্ডি করে সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা মল রোড হয়ে বাসায় ফিরলেন। মল রোড তখন ইংরাজ স্ত্রী পুরুষে ভর্তি, ব্যান্ড বাজছে, চারদিক গমগম করছে। ইংরাজ সরকার যখন স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য বসতি প্রস্তুত করার জন্য সিকিমের রাজার থেকে করের বিনিময়ে এই স্থান গ্রহণ করেছিল তখন দার্জিলিং জঙ্গল এলাকা ছিল, বাংলা থেকে আসার পথঘাট কিছুই ছিল না। সম্প্রতি মেকলের তিব্বত মিশনে যাওয়ার পর সিকিমের রাজাকে এই কর দেওয়া ইংরেজ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে।

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী গাজিপুরে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছুদিন সস্ত্রীক সেখানে অবস্থান করেন। ১২৯৬-এ ভারতীতে "গাজিপুর পত্র" প্রকাশিত হয়। এখানে হাওড়া থেকে রেল যাত্রা সহ যাত্রাপথের অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কৌতুক এবং আরো নানারকম সরস আলোচনা করেছেন লেখিকা। গাজিপুর থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি কাশী ঘুরে এসেছিলেন।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী পুনা, সোলাপুর এইসব মহারাষ্ট্রের স্থান ভ্রমন করেন। এখানেও তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ম উপলক্ষে থাকতেন। ১২৯৮ সালে ভারতী পত্রিকায় তিনি এই ভ্রমণ সম্পর্কে লিখেছেন "পত্র" শিরোনামে। পুনা, সোলাপুরে চিত্রশালা, শিল্পপ্রদর্শনী দর্শন, ইংরাজদের ফ্যান্সি ড্রেস বল, ঘোড়দৌড়, বিভিন্ন ক্রীড়া প্রদর্শনী দেখা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন। এই সময় তিনি পান্ডারপুরআকোলকোট ঘুরে এসেছেন ট্রেনে। আকোলকোট স্টেশনে এসে সেখানকার রাজার পাঠানো গাড়িতে তাঁরা রাজপ্রাসাদে গেলেন। রানী অত্যন্ত রুচিশীলা, তিনি সুন্দর ভাবে গৃহসজ্জা করেছেন। রাজা নিজে তাঁদের রাজপ্রাসাদ, দূর্গ, বিচারালয়, স্কুল, রাজ বাজার, ভান্ডার গৃহ, মহামূল্য হস্তি সিংহাসন রাখার হাওদাখানা সব দেখালেন। এই রাজা ইংরেজের আনুকূল্যে রাজ্যাভিষিক্ত হয়েছেন এবং ইংরেজদের সন্তুষ্ট রাখতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন।

                       (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...