সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
সুমনা দাম
শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) দেশে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। তিনি নিজে কোনো ভ্রমণকাহিনী লেখেন নি কিন্তু বিভিন্ন জনকে লেখা তাঁর কিছু চিঠিপত্র পাওয়া গেছে এবং কিছু চিঠিপত্র তৎকালীন 'ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পশ্চিম সফরে বেরিয়েছিলেন। তিনি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে ঘোড়ার গাড়িতে গেছিলেন। সঙ্গে বন্যপ্রাণী ও ডাকাতের আশঙ্কায় অনেক সশস্ত্র পাইক-বরকন্দাজ এবং চাকর, বেয়ারা, খানসামা, বাঙালি কবিরাজ, ইংরেজ ডাক্তার নিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যের জন্য বাজার দেখতে যাওয়া।
প্রথমে তিনি রানীগঞ্জের কয়লা খনি দেখেন ও ১৮৩৪ সালে সেটি কিনে নেন। তারপর তিনি গেলেন কাশী, সেখানে এমন ব্যবস্থা করলেন যে কাশীর জরি দেওয়া সব বস্ত্র কলকাতা হয়ে ইউরোপীয় নানা দেশের রপ্তানি হতে থাকল। সেখান থেকে তিনি যান এলাহাবাদ, তারপর আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন। এই পর্বের তাঁর ভ্রমণ সংক্রান্ত খবর খুবই কম পাওয়া যায় চিঠিপত্রের অভাবে।
১৮৩৮ ও ১৮৪০-'৪১ এ তিনি আবার উত্তর-পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করেছিলেন মূলত স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। শুধু জানা যায় তীর্থস্থানগুলিতে তিনি অনেক দানধ্যান করেছিলেন।
ইউরোপ যাত্রায় তাঁর উৎসাহের কারণ হাওয়া বদল স্বাস্থ্যের কারণে, নতুন দৃশ্য দেখা, ব্যবসার উন্নতির জন্য জনসংযোগ। ১৮৪২ -এর ৯ জানুয়ারি তাঁর নিজস্ব জাহাজ 'ইন্ডিয়া' করে তিনি বিলাত যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিল ভাগ্নে চন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায়, এক ইংরেজ ডাক্তার, এক সচিব, তিনজন ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। তিনি এই সময় ডায়েরি রাখতেন, যার থেকে তাঁর জীবনীকার কিশোরী চাঁদ মিত্র অনেক তথ্য ব্যবহার করেছেন তাঁর বইয়ে। কিন্তু সেই ডায়েরী পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সিংহলে তিনি পাহাড়, গাছপালা শোভিত উপত্যকা, নারকেল গাছের শ্রেণী দেখে অত্যন্ত তৃপ্ত হন এবং স্বর্ণলঙ্কা নামের সার্থকতা উপলব্ধি করেন জমির উর্বরতার কারণে। সিংহলের পয়েন্ট দ্য গালে নোঙর করে স্থলভাগে নেমে তিনি ঘুরে দেখেন। দূরে দেখতে পান আদমের শিখর, যার উপর লোকে বলে কুড়ি ফুট লম্বা পায়ের চিহ্ন আছে। গালে দুর্গ, পোতাশ্রয় দেখেন। তাঁদের জাহাজ নোঙর করতেই সিংহলবাসী ছুটে এল পণ্যদ্রব্য ও ফলমূল বিক্রয়ের জন্য। এই দেশের ঘাট, প্রাসাদ সুন্দর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফল বাংলাদেশের তুলনায় বড় এবং রসালো। ফুলের রং বেশি উজ্জ্বল।
এরপর 'ইন্ডিয়া' জাহাজ সুয়েজ বন্দরে এল। দ্বারকানাথ ও সঙ্গীরা বন্দরে নামলেন, জাহাজ কলকাতায় ফিরে গেল। ঘোড়ার গাড়িতে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনি মরীচিকা দেখলেন। মরুভূমির মধ্যে মধ্যে পান্থনিবাস ছিল, যেখানে তাঁরা আশ্রয় নেন। এই দীর্ঘ পথে হাট বাজার, দুর্গ, মসজিদ, প্রাসাদ, উদ্যান, হামাম, পিরামিড প্রভৃতি দেখলেন। সুব্রা হয়ে কায়রো গেলেন তিনি। তারপর স্টিমারে চললেন আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে নীলনদ হয়ে।
আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি দেখেন দেশীয় বসতিগুলি নোংরা ও ঘিঞ্জি। কিন্তু যে অঞ্চলে ইউরোপীয়দের বাস সেটি খুব সুন্দর। হোটেল আরামদায়ক ইউরোপীয় মানের। পাশার নতুন প্রাসাদ (১৮১৪ -তে তৈরি মিশরের শাসক ও আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ আলী পাশার প্রাসাদ) দেখে তিনি মুগ্ধ হন। প্রাসাদের খুব কাছে সমুদ্র তীরে একটি স্নানের জায়গা আছে। সেই ঘরে প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত সমুদ্রের জল ঢুকে গেছে। ৪ ফুট গভীর সমচতুর্ভুজ একটি ৪০ ফুট চৌবাচ্চায় সর্বক্ষণ সমুদ্রের জল এসে পড়ে তিনদিক থেকে।
মালটায় তাঁদের কোয়ারেনটিনে থাকতে হল। সমুদ্রের ধারে আরামদায়ক হোটেলে পূর্ণ বিশ্রাম আর পায়ে হেঁটে শহর ঘুরে দেখতে তাঁর ভালই লাগছিল। মালটা থেকে ভালেত্তা গেলেন। সেখানকার গির্জা, ক্যাথিড্রাল অপূর্ব সাজসজ্জা দেখে মুগ্ধ হন, যদিও তিনি জানতেন রোমের স্টেন্ট পিটার্স গির্জার তুলনায় এই সেন্ট জন ক্যাথিড্রল কিছুই নয়। ভারতবর্ষের মন্দির, মসজিদ, চার্চগুলি ইউরোপের এই ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এখানে তিনি অপেরা দেখেন। তারপর ব্রিটিশ রণতরী 'কুইন' দেখে আসেন। একটি শিশু বিদ্যালয় দেখে মনে করেন এই শিক্ষা পদ্ধতি অত্যন্ত উন্নত কারণ শিশুদের সেখানে আটকে রাখা হয়নি, তারা নিজেরাই সেখানে থাকতে ভালোবাসছে। মালটা দ্বীপের সর্বোচ্চ স্থান থেকে বহুদূর পর্যন্ত এমনকি সিসিলি দ্বীপের মাউন্ট এটনা পর্যন্ত দেখা যায়।
এরপর সিসিলি দ্বীপে মাউন্ট এটনা, সুন্দর শহর মেসসিনা, এওলিয়ান দ্বীপ, স্ট্রম্বেলি আগ্নেয়গিরি দেখে তিনি নেপলস গেলেন। এই শহরে সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হলেন। খুব চওড়া রাস্তা, ধুলোবালি নেই, রাতে গ্যাসের আলোয় দোকান আলোকিত বলে রাস্তা ঝলমল করে, কফি হাউসগুলি খুব সুন্দর করে সাজান। সান কার্লো থিয়েটার হল ইউরোপের সবথেকে বড় থিয়েটার, তার অভ্যন্তরীণ সাজ সজ্জা অনবদ্য।
এবার তিনি চললেন রোমে। এই যাত্রা করেছিলেন নিজের চার ঘোড়ার গাড়িতে, যার ঘোড়া প্রতি দশ মাইল অন্তর পরিবর্তন করার ব্যবস্থা ছিল। দ্বারকানাথ কখনো হিমালয়ে যাননি। পাহাড়ি পথ পেরতে তিনি রোমাঞ্চিত, আনন্দিত ও অল্প শঙ্কিত হচ্ছিলেন। রোম শহরের সৌন্দর্য নিজে চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় বলেছেন তিনি। সেন্ট পিটার্স চার্চের বিশালত্ব, সাজসজ্জা, বৈচিত্র্য, শিল্প, স্থাপত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তাছাড়া আরো অনেক প্রদর্শনশালা, চিত্রকলা, ফোয়ারা, গ্রন্থাগার প্রভৃতি দেখেন। সেখানকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া তিনি খুব উপভোগ করেন। তিনি এবার পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পোপের প্রাসাদে। প্রথম একজন ভারতীয়কে দর্শন করে আনন্দ প্রকাশ করেন। তাঁদের সাক্ষাৎ হয় একটি গ্রন্থাগারে, সেটি এত বড় যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখা শক্ত। তিনি শুনেছিলেন পোপের প্রাসাদে বারো হাজার ঘর আছে, সেগুলি মহান শিল্পীদের চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে সুসজ্জিত।
এরপর ফ্লোরেন্স, বোলোনা, পাদুয়া হয়ে তিনি ভেনিসে গেলেন। ভেনিসে রাস্তায় সর্বত্র জল দেখে অবাক হলেন। আল্পসের সৌন্দর্যে মোহিত হলেন।
জার্মানির মধ্যে দিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঘোড়ার গাড়িতে চললেন। জার্মানির শিক্ষার মান দেখে প্রশংসা করেছেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে রেলে মেনটস গেলেন। সেখান থেকে ভাসমান সেতুতে রাইন নদী পার হয়ে স্টিমারে কোলন যান। সেখানকার ক্যাথিড্রাল ভালো লাগে তাঁর।
এরপর রেইনবো নামের স্টিমারে ইংলিশ চ্যানেল পার হন তাঁরা। ডোভার ও ক্যান্টারবেরি হয়ে তিনি ১০ জুন (কলকাতা ছাড়ার পাঁচ মাস দুই দিন পর) লন্ডনে পৌঁছান।
লন্ডনের নগরজীবনের প্রাণচাঞ্চল্য, যানবাহন, দোকান এবং শহরের মানুষরা তাঁকে আলোড়িত করেছিল। রাজপরিবার ও অভিজাতরা তাঁর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন। এখানকার অভিজাতদের বাগান দেখে নিজের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ির বাগান সম্পর্কে তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক তিনি আমন্ত্রিত হন তিনি। সেখানকার জগৎ বিখ্যাত সাহিত্যিক ওয়াল্টার স্কট, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়।
এরপর তিনি স্কটল্যান্ড বেড়াতে গেলেন। সেখানকার গ্লাসগো, এডিনবরা দেখলেন। ইংল্যান্ডের লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, শেফিল্ড গেলেন। এইসব স্থানের শিল্পপ্রযুক্তির বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন।
এবার তিনি গেলেন ব্রিষ্টল এবং রাজা রামমোহন রায়ের জঙ্গলাকীর্ণ সমাধি থেকে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করে আর্নোস ভেলে ভারতীয় স্থাপত্যে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।
১৫ই অক্টোবর ১৮৪২ জাহাজে উঠে তিন দিন পরে তাঁরা প্যারিস পৌঁছান। তিনি প্যারিসকে সৌন্দর্য ও প্রাণোচ্ছলতায় পূর্ণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার তীর্থ হিসেবে বর্ণনা করলেন তিনি। প্যারিসের প্রবেশপথ এবং প্যারিসের আলোকোজ্জ্বল সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ হন। ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে আপ্যায়ন করেছিলেন।
১৮৪২ -র ৯ অক্টোবর স্বদেশে ফেরার জন্য দ্বারকানাথ মার্সেই থেকে রওনা দেন। কলকাতায় এসে পৌঁছান ডিসেম্বর মাসে, প্রায় এগারো মাস বিদেশে কাটানোর পরে।
দ্বারকানাথের দ্বিতীয়বার বিদেশ সফর শুরু হয় ১৮৪৫ এর ৮ই মার্চ কলকাতা থেকে 'বেন্টিংক' জাহাজে। এবার সঙ্গে ছিল ১৬ বছর বয়েসি কনিষ্ঠ পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ব্যক্তিগত ইংরেজ চিকিৎসক, প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনজন ভৃত্য।
এবার কায়রোতে ওটোমান সাম্রাজ্যের ভাইসরয় ও মিশরের শাসক মোহম্মদ আলী পাশা তাঁকে খুব সমাদর করেন।
নেপলস্ বন্দরে তাঁর জাহাজ পৌঁছালে তাঁকে তোপধ্বনিতে আহ্বান জানান হয়। এরপর পিসা, জেনোয়া হয়ে প্যারিস যান তিনি।
ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ প্রায়ই তাঁকে রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ করতেন। লন্ডনে তিনি রানীর কাছে আমন্ত্রণ পান এবারও। পরে প্যারিসে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে লন্ডন ফেরেন।
উশৃঙ্খল আমোদপ্রমোদময় জীবনযাপন ও বিশ্রামের অভাবে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে।
অবশেষে, ১ আগস্ট ১৮৪৬ -এ লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হোটেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ভারতীয় রাজকীয় পোশাক আর অসম্ভব দানশীলতা তাঁকে প্রিন্স হিসেবে লন্ডন ও প্যারিসবাসীর মধ্যে পরিচিত করেছিল। কেনসাল গ্রীনের সমাধিক্ষেত্রে তাঁর দেহ সমাহিত হয় যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে। যদিও তাঁর সমাধিটি তাঁর বর্ণময় জীবনের তুলনায় অত্যন্ত সাধারণ।
তথ্যসূত্র: Memoir of Dwarakanath Tagore - কিশোরীচাঁদ মিত্র (১৮৭০)
কিশোরী চাঁদ মিত্রের লেখায় দ্বারকানাথের ভ্রমণ বর্ননা থেকে দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে ও দেশ-বিদেশের অনেক তথ্য জানলাম ।শিউলি
উত্তরমুছুনধন্যবাদ 🙏
উত্তরমুছুন