রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

৭৮। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ৩ - রসিককৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
               (আগের পর্বের পরে)

পুরীতে অবস্থিত অজস্র মন্দিরের বর্ণনা দিতে হলে আরেকটি পৃথক বই লেখা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন লেখক। বিশেষ কিছু মন্দিরের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। পুরী মহর্ষি মার্কন্ডেয়ের অবস্থানস্থল ছিল। এখন সেখানে মার্কেন্ডেশ্বর নামে শিব ও মার্কন্ড পুষ্করিণী নামক সরোবর আছে। পুরীতে সাতশো মঠ আছে। দেবসেবা ও ভোগদানের যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সম্পন্ন ব্যক্তিরা এই মঠগুলি নির্মাণ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। মঠাধ্যক্ষদের বিলাসিতায় সেই অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে বলে লেখক জানিয়েছেন। পুরীর পশ্চিমাংশে লোকনাথ নামে এক স্বয়ংভূ শিবের মন্দির আছে। এই মহাদেব মন্দিরের মধ্যে গহ্বরে অবস্থিত। এই গহ্বর প্রায়ই জলে পূর্ণ থাকে, কেবল শিবরাত্রির সময় পান্ডারা অনেক চেষ্টায় জল নিকাশ করে মূর্তি বার করে। পুরীর বাসিন্দারা এই শিবের ওপর অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। পুরীর মন্দিরের প্রাঙ্গণের মধ্যে বিমলা দেবীর মন্দির অবস্থিত। যদিও জগন্নাথ মন্দিরে বৈষ্ণব মতে নিরামিষ ভোগ হয়, তিথিবিশেষে বিমলা মাতার মন্দিরে আমিষ ভোগও হয়ে থাকে। আবার জগন্নাথকে বিমলার ভৈরব বলে উল্লেখ করাও হয়ে থাকে। বিমলাদেবী ও জগন্নাথদেবের সামঞ্জস্য স্থাপন অতীব দুরুহ ব্যাপার। হরচন্ডী সহিতে অর্থাৎ পল্লীতে হরচন্ডী নামে এক দেবী আছেন। তাঁর পূজা ও বলিদান খুব ধুমধাম করে হয়। পুরীর সমুদ্রতীরে যেখানে যাত্রীগণকে স্নান করান হয় সেটিকে স্বর্গদ্বার বলে। এর অদূরে অনেকগুলি মঠ আছে, তার মধ্যে কবীর নানকের মঠ আছে। কিছু পশ্চিমাংশে শ্রীচৈতন্যের সমাধিস্থান (সেটি কি সত্যিই তখন ছিল উক্ত স্থানে?)। সমুদ্রকুল বালুকাময় কিন্তু এই বালিতেই মঠধারীরা নানা বৃক্ষ লাগিয়েছেন। সমুদ্রতীরে নানক, কবীর, দত্তাত্রেয়, শঙ্করাচার্য, তুলসীদাস, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ সকলেই শেষকাল যাপন করেছেন (কিন্তু বাস্তবে একমাত্র শ্রীচৈতন্যদেবেরই পুরীতে ভবলীলা শেষ হয়েছিল। অন্যান্যরা পুরীতে কিছুকাল কাটিয়েছেন বলে জানা যায়)। মহর্ষি দত্তাত্রেয়র আসন পুরীর স্বর্গদ্বারের বাম দিকে। শংকর স্বামীর (শঙ্করাচার্যের) মঠ সমুদ্র তীরে। এই মঠে অনেক প্রাচীন পুস্তক সংরক্ষিত আছে। এখানকার অধ্যক্ষ দামোদর তীর্থ স্বামী গভীর শাস্ত্রজ্ঞ। অন্যদিকে পুরীর পান্ডারা ধনী কিন্তু অশিক্ষিত। পুরী শহরটি আয়তনে দীর্ঘ। সাতটি সাই বা পল্লীতে বিভক্ত। বিভিন্ন পল্লীগুলিতে একটি বা দুটি বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয়। দশমীতে পুরীর সিংহ দরজার সামনে সারা শহরের প্রতিমা একত্র করে প্রদর্শন করা হয়, একে ভেট বলে। 


পুরীতে গ্রীষ্মের শেষ থেকে হেমন্তের প্রথম পর্যন্ত কাটিয়ে পুরী ত্যাগ করে বঙ্গোপসাগরের তীর ধরে দক্ষিণ দিকে রওনা দিলেন লেখক। দশ মাইল অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে হরচন্ডী দেবীর মন্দির দর্শন করলেন। প্রবাদ রামচন্দ্র বনবাস কালে এই মূর্তি স্থাপন করে পূজা করেন। এরপর দুই মাইল গিয়ে কাঁটাকুরিতে রাত্রিবাস। এখান থেকে চিল্কা হ্রদ শুরু। স্থানটিতে অতি সামান্য তিনটি মুদীর দোকান আছে মাত্র। চিল্কায় যাত্রীদের যাতায়াতের নৌকা এখান থেকে পাওয়া যায়। লেখক পরদিন নৌকায় চিল্কাযাত্রা করলেন। চিল্কার জল লবণাক্ত। লেখক পিপাসার্ত হয়ে নাবিকের কাছে জল চাইতে পাড়ে এক জায়গায় দুই ফুট গর্ত হাত দিয়ে খুঁড়ে লেখককে খেতে বলল এক যাত্রী। সেই জল মিষ্টি। নৌকা থেকে ডান পাড়ে জল দেখা যায় আর বাঁ দিকে বালুস্তর। জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে, কোথাও তীরে মাছ শুকাচ্ছে রোদে দিয়ে। এক চড়ে এলেন তাঁরা। এই চড়টি দৈর্ঘ্যে প্রায় তিন মাইল। এটি পারিকুদ রাজ্যের রাজধানী। চড়ের মধ্যে রাজার বাড়ি, চারপাশে প্রজাদের বাস ও কৃষি জমি। রাজবাড়িতে দুদিন থেকে রাজার সঙ্গে আলাপে লেখক সুখী হলেন। তারপর চিল্কায় নৌকায় আবার চললেন উৎকল ও মাদ্রাজ বিভাগের সঙ্গমস্থলে। (তখন অন্ধ্রপ্রদেশ ছিল না। মাদ্রাজ হল বর্তমান তামিলনাড়ু)। চিল্কার বুক থেকেই তীরে পাহাড়ের শ্রেণী দেখা যায়। কূলে উঠলে মাদ্রাজ যাওয়ার গিরি সংকুল পথ দেখা যায়। এই গিরি সংকটের মধ্যে খালিকোট (খাল্লিকোট) নামক রাজ্যের রাজধানী। রাজবাড়িটি তিন দিন পর্বতের মধ্যে যেন আত্মরক্ষার্থে লুকিয়ে আছে। এই রাজ্যে শাসনব্যবস্থা ভালো নয়, রাজা অত্যাচারী। 


এরপর লেখক উৎকলের জঙ্গলমহল বা করদ রাজ্য ভ্রমণে গেলেন। পূর্বের গিরি সংকট থেকে যে রাজপথ উৎকলের জঙ্গলমহলের দিকে গেছে সেই পথে পূর্ব দিকে দশ মাইল গিয়ে বানপুর নামক স্থানে এলেন। এটি আগে রাজধানী ছিল, এখন শুধু পুরনো মন্দির দু-একটি আছে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে জঙ্গলের পথে ৬ মাইল গিয়ে একটি আউটপোস্ট পেলেন, যেটি নয়াগড়, খালিকোট ও খাস মহল এই তিন রাজ্যের সীমানা। এই পথে সন্ধ্যার পর কেউ চলাচল করে না, বাঘ ভাল্লুক এই পথে বিচরণ করে।। লেখক ওই আউটপোস্টে রাতে থাকলেন। হেড কনস্টেবল সতর্ক করলেন রাতে বাইরে যাওয়ার দরকার হলে কনস্টেবল ও পাইককে ডাকতে। তারা দুজন আগুন জ্বালান কাঠ সমেত সঙ্গে না গেলে বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। পরদিন সকালে জঙ্গলের এক অধিবাসীর সঙ্গে জঙ্গলে প্রায় আট মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে গিয়ে রাতে একটি গ্রামে থেকে পরদিন দুই ক্রোশ যাওয়ার পর প্রায় দুই মাইল একটি পাহাড় পাড় হতে হল। সেই পাহাড় থেকে নামার পথ পিচ্ছিল ও বিপদজনক। তারপর পাঁচ মাইল পথ গিয়ে একটি গ্রামের ভগবত পাঠের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করা হল। পরদিন যাত্রা করে দুপুরে নয়াগড়ের রাজধানীতে এলেন তাঁরা। সেখানকার তরুণ রাজার সঙ্গে আলাপ হল। রাজধানীর দুই পাশে দুই পর্বত। নয়াগড় থেকে এরপর লেখক গেলেন দশ মাইল দূরে খন্ডপাড়া।  এখানে একটি ক্ষুদ্র পর্বতের ওপর কন্টিলোতে নীলমাধবের মূর্তি রয়েছে। স্থানটি খুব মনোরম। মাঘী পূর্ণিমার দিন নীলমাধবের মন্দিরে একটি মেলা দেখলেন। প্রায় দশ হাজার যাত্রী সমাগমে মেলা বসে। মহানদীর অপর পাড়ে নৃসিংহপুর ও দশপালা রাজ্য। কন্টিলো থেকে লেখক দশপালা, রামচন্দ্রপুর, বোমরাজ্য, কন্দমাল প্রভৃতি রাজ্য দর্শন করলেন। কন্দমালে কন্দ বা খন্দ জাতির বাস। তারা কিছুদিন আগেও নরবলি দিত, ব্রিটিশ সেটি বন্ধ করেছে। এরপর হিন্দোল ও অঙ্গুল (আঙ্গুল) নামক রাজ্য ঘুরে এলেন। অঙ্গুলের কমলালেবু অত্যন্ত মিষ্টি। এই কমলালেবু কেউ চাষ করে না, বন্য প্রকৃতিতে এমনি জন্মায়, বন্য আদিবাসীরা এই ফল সংগ্রহ করে খায় ও বিক্রি করে। এরপর তাঁরা মহানদীতে নৌকা করে কন্টিলো থেকে কটকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন চার দিনের পথে। কটক থেকে স্টিমারে ভদ্রকে ও তারপর বালেশ্বর পৌঁছলেন। বালেশ্বর থেকে আবার তাঁরা ময়ূরভঞ্জে ফিরে যান প্রায় এক বছর পরে। 

লেখক এবার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের অঙ্গীকার করে এই বইটি শেষ করেন কিন্তু আমরা জানতে পারি না সেইসব ভ্রমণ কাহিনী সত্যি লেখা হয়েছিল কিনা, প্রকাশিত হয়েছিল কিনা কারণ বইগুলো কোথাও পাওয়া যায়নি। অতএব যদিও লেখক বইয়ের সূচনায় বলেছিলেন যে এটি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের বিভিন্ন জেলার বর্ণনা থাকবে কিন্তু শুধুমাত্র তৎকালীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বর্ণনাতেই এই গ্রন্থটি শেষ হয়

৭৭। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ২ - রসিককৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

           
              (আগের পর্বের পরে)

ময়ূরভঞ্জ ব্রিটিশ সরকারের একটি করদ রাজ্য। ময়ূরভঞ্জে থাকাকালীন লেখক দেখলেন সপার্ষদ ব্রিটিশ কমিশনার সাহেবের আগমন উপলক্ষে রাজার করা ধুমধাম, আপ্যায়ন ও শিকারের আয়োজন। শেষে বৃটিশ কমিশনার ময়ূরভঞ্জের নাবালক রাজাকে তাঁর অভিভাবক ও প্রজাদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জোর করে কটকে নিয়ে গেলেন ইংরেজি মতে শিক্ষাদানের জন্য। {মহারাজা শ্রী রামচন্দ্র ভঞ্জ দত্ত (১৮৭০ থেকে ১৯০২) হলেন এই নাবালক রাজা।} ময়ূরভঞ্জ একটি পর্বত ও জঙ্গলময় রাজ্য। প্রচলিত আছে ময়ূরভঞ্জ রাজ্য কীচকের (মহাভারতের বিরাট রাজার শ্যালক) শাসনাধীন ছিল। এখানে কিচকেশ্বরী নামে এক দেবীর মন্দির আছে (খিচিং-এ অবস্থিত মন্দির)। ময়ূরভঞ্জে পুরীর অনুকরণে এক জগন্নাথ মন্দির আছে। এখানে রথযাত্রা সমারোহে পালিত হয়। এই মন্দিরে একটি বটগাছ আছে যার পাতা গোকর্ণ অর্থাৎ গরুর কানের মত। তাই একে গোকর্ণ বট বলে। (হরি বলদেব জীউ বিজে নামে জগন্নাথ মন্দির, বারিপদা)। 


এরপর লেখক বালেশ্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বারিপদা থেকে দক্ষিণে ৩২ মাইল জঙ্গলময় রাস্তায় গিয়ে বুড়িবালাম নদী পায়ে হেঁটে পার হলেন। এই রাস্তায় ৮ থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পানীয় জল পাওয়া যায় না। কটক রোড ধরে এক মাইল গেলে বালেশ্বর শহর এল। বালেশ্বর জেলার সীমানায় বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। কলকাতা থেকে জলযান যাত্রী ও বাণিজ্য দ্রব্য নিয়ে প্রতি আট ঘণ্টা অন্তর এখান থেকে যাতায়াত করে। এই জলপথে যাত্রীরা অল্প সময় যাতায়াত করে কিন্তু জলযানের কর্মচারীদের অভদ্রতার জন্য যাত্রীরা অনেক কষ্ট ভোগ করে। 


বালেশ্বর থেকে  চাঁদবালি নামক সমুদ্র-তীরস্থ বন্দরে (কিন্তু এটি বৈতরণী নদীর বন্দর) যাওয়ার প্রশস্ত রাজপথ আছে। পশ্চিমে একটি রাস্তা, রেবুনা (রেমুনা এখন বন্দর নয়) নামক বন্দরে গেছে। রেমুনায় ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির প্রসিদ্ধ। প্রবাদ আছে গোপীনাথ এক ব্রাহ্মণের থেকে ক্ষীর চুরি করে খেয়েছিলেন তাই তাঁকে সবাই ক্ষীর ভোগ দেয়। বালেশ্বর শহর থেকে একটি রাস্তা নীলগিরি নামক করদ রাজ্যে গেছে। এই রাজ্যের রাজধানী রাজনীলগিরি (এখন নীলাগিরি) বালেশ্বর থেকে মাত্র ৮ মাইল দূরে অবস্থিত। 


বালেশ্বর ত্যাগ করে দক্ষিণ দিকে কটক রোড ধরে ৪২ মাইল যাওয়ার পর লেখক ভদ্রক নামক স্থানে এলেন। সম্প্রতি ভদ্রক থেকে একটি ক্যানাল প্রস্তুত হয়েছে যা ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদী হয়ে কটকের নীচে মহানদীতে মিলিত হয়েছে। ভদ্রকে কিছুদিন থেকে লেখক স্টিমারে উঠে সেই ক্যানাল দিয়ে কটক অভিমুখে রওনা দিলেন। এই খাল ছাড়াও চাঁদবালি বন্দর থেকে কটক পর্যন্ত আর একটি কৃত্রিম ক্যানেল তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট-এর হাতে, যদিও এই যাতায়াত ব্যবস্থা কষ্টকর স্টিমারের অব্যবস্থার জন্য। পথে এক বাঙালি পরিবারকে সাহায্য করার জন্য ব্রাহ্মণী ও বৈতরণী নদী পার হয়ে স্টিমার থেকে নেমে গরুর গাড়িতে নেউলপুর নামক স্থানের কাছে কোঙয়াপাল নামক স্থানে গেলেন লেখক। সেখান থেকে নয়াগ্রাম নামক স্থানে কিছু পুরা কীর্তি দর্শন করলেন। শুক্লেশ্বর নামক শিবের পুরাতন মন্দির (মহঙ্গা, উড়িষ্যা), রাজার কুলদেবী ভগবতী নামক ষড়ভুজা সিংহবাহিনী দেবীর মন্দির সেখানে রয়েছে। মানিকেশ্বর নামক জনৈক রাজা এই স্থানে রাজধানী নির্মাণ করেন এবং ওই মন্দিরগুলি স্থাপন করেন। মানিকেশ্বর শিবের মন্দির ভগ্নাবশেষে পরিণত। মূর্তি গহ্বরে প্রবেশ করেছে। গড়বেষ্টিত জঙ্গলময় পুরাতন রাজধানী চোখে পড়ে। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন গৌড় থেকে তাড়িত হয়ে উৎকলে এসে নাকি মানিকেশ্বর গড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাকি সব কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে শুধু দেবীর (মানিকেশ্বর মন্দির, মহঙ্গা) পূজা আজও হয়। 


সেখান থেকে গরুর গাড়িতে লেখক কটক রওনা দিলেন কটক রোড হয়ে। কটক শহর উৎকলের হিন্দু রাজাদের, মুঘল, পাঠান এবং মারাঠাদেরও শাসনাধীন ছিল। বিভিন্ন রাজাদের কালে এখানে বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে কাটযুড়ি নদীর পাড় মহারাষ্ট্রীয় শাসকরা পাথরে বাঁধিয়ে দিয়েছিল প্রায় দেড়শ বছর আগে। সেই পাথরের প্রাচীরের মধ্যে নানা দেব দেবীর মূর্তি খোদিত আছে। কটকে কটক চিন্তাই পুরাতন মন্দির (কটক চন্ডী মন্দির)। কটকে অনেক বাঙালি বাস করে। এই শহরের লোকেরা পাখি পুষতে ভালোবাসে, জমিদার মহাশয়ের বাড়িও পাখিতে পরিপূর্ণ। 


কদিন পরে লেখক পুরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বারো মাইল যাওয়ার পর বালিহন্তা নামক নদীর তীরে রাতে থাকলেন। তার পরদিন পুরী রোড ত্যাগ করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে জঙ্গলময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বেলায় ভুবনেশ্বর পৌঁছলেন পান্ডাদের সঙ্গে। ভুবনেশ্বর পৌঁছে অনেক সুদৃশ্য মন্দির দেখলেন। কিন্তু পান্ডা জানাল সেগুলো ভুবনেশ্বরের বিখ্যাত মন্দির নয়। বিন্দু সাগর নামক সরোবর দেখলেন কিন্তু তার জল খুব দূষিত হয়ে পড়েছে। তারপর ভুবনেশ্বর মন্দির দর্শন করলেন। সেই মন্দিরের সুদৃশ্য দেউল দেখে মুগ্ধ হলেন। শিব পুরাণে ভুবনেশ্বর নগরকে গুপ্তকাশি বলা হয়েছে। এখানে প্রতি ব্যক্তির বাড়িতে মন্দির আছে। ভুবনেশ্বরের রথযাত্রা বৈশাখ পূর্ণিমায় হয়।


পরদিন তাঁরা সাক্ষীগোপালে উপস্থিত হলেন। এই দেব মূর্তি কাঞ্চি রাজের সম্পত্তি। উৎকলের রাজা কাঞ্চি রাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাঁর অভীষ্ট দেব গোপাল ও গণেশ এনে সাক্ষীগোপাল ও পুরীতে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে লেখক বৈশাখ মাসে উড়িষ্যাবাসীদের রাসলীলা দেখলেন। কয়েকটি মাটির মূর্তি একটি ঘরে স্থাপন করে একটি ম্যারাপ নারকেল পাতা দিয়ে ছেয়ে তার তলায় প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত নাচতামাশা সহ এই পরব হল। কয়েকটি বালক নানা রকম সেজে উড়িষ্যার ভাষায় গান গাইল। সাক্ষী গোপালের সম্পর্কে সাক্ষ্য দান করার যে কাহিনি প্রচলিত আছে সে বিষয় লেখক বলেছেন যে তার কোন ভিত্তি নেই। 


এখান থেকে ৫ মাইল দূরে পুরী। সকালে পুরী রোডে যেতেই পাণ্ডারা বিরক্ত করতে লাগল। আঠারো নালা পেরিয়ে তিনি চন্দন তালাও এলেন, যেটি পুরীর বৃহত্তম সরোবর। নরেন্দ্র নামধারী এক ব্যক্তি এটি খনন করে দেন বলে এর নাম নরেন্দ্র পুষ্করিণী। এই জলাশয়ে জগন্নাথদেবের চন্দন যাত্রা হয়। সমগ্র বৈশাখ মাস চন্দন যাত্রার নির্দিষ্ট সময়। পুষ্করিনীর পাশে চন্দন যাত্রা উপলক্ষে নানা দোকান বসেছে। তৃতীয় প্রহরের পর পুরী থেকে মদন গোপাল জীউ এখানে আগমন করেন। 

পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সামনে দিয়ে নির্গত হয়েছে পুরীর প্রধান রাজপথ। গুঞ্জবাটি পর্যন্ত এই রাস্তায় রথ চলে। রাস্তাটি প্রায় ১০০ ফুট চওড়া। এই রাস্তায় জগন্নাথদেবের মন্দির অভিমুখে গেলে বামদিকে উৎকল রাজের আবাস পড়ে। রাস্তার অপর পাড়ে দোকান ও পাণ্ডাদের ঘরবাড়ি। এক পান্ডার বাড়িতে রাত্রিবাস হল পুরীতে চন্দন যাত্রা দেখার পর। সেই পান্ডার সঙ্গে পরদিন শ্রীক্ষেত্র (পুরীর জগন্নাথ মন্দির) দর্শন ও প্রসাদ লাভ হল। পুরীর মহারাজের দেওয়ানের সঙ্গে এরপর দেখা করলেন লেখক। তিনি বাঙালি। এরপর প্রায় এক মাসকাল পুরীতে সেই দেওয়ানের বাড়িতে লেখক ও তাঁর সঙ্গীরা সুখে শান্তিতে রইলেন। 


জগন্নাথ দেবের বাটির (মন্দিরের) পরিধি প্রায় ২ মাইল হবে, পাথরের প্রাচীরে ঘেরা চারদিকে চারটি তোরণ। পূর্ব তোরণকে সিংহদ্বার বলে। এই দ্বারের সামনে একটি প্রস্তরখন্ডের প্রায় ৩০ ফুট দীর্ঘ স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভটি আগে কোনারক মন্দিরের সামনে ছিল। কোনারক মন্দির ভেঙে যাওয়ার পর ওই স্তম্ভ এখানে এনে স্থাপিত হয়েছে। তোরণের সামনে প্রবেশের সময় এক জগন্নাথ মূর্তি খোদিত আছে, তাঁর নাম পতিতপাবন। যেসব জাতির মন্দিরে প্রবেশের অধিকার নেই তারা পতিতপাবন মূর্তি দর্শন করে। এই মূর্তি আগে ছিল না। পুরীর এক রাজা ঘটনাবশতঃ পতিত হয়ে মন্দিরে প্রবেশের অধিকার হারান। তখন রাজার দর্শনের জন্য এই পতিতপাবন মূর্তি স্থাপন করা হয়। সিংহদ্বার অতিক্রম করে ২২ সোপান পেরিয়ে দ্বিতীয় তোরণ আসে। এটি নতুন করে প্রস্তুত করেছেন একজন সন্ন্যাসী ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করে। সিঁড়ির দুই পাশে ও উপরে তোরণের সামনে মিষ্টান্ন প্রসাদের বাজার। এই তোরণের দক্ষিণে একটি দ্বার আছে, তার মধ্যে অন্নের বাজার বসে, যার নাম আনন্দ বাজার। দ্বিতীয় তোরণের ভিতরে প্রথমে ভোগ মন্দির অবস্থিত। রাজার দেওয়া ভোগ মন্দিরের ভেতরে যায়। অন্য ভক্তদের প্রদত্ত ভোগ ঐ ভোগ-মন্দিরে উপস্থিত হয়। তারপর সুপ্রশস্ত নাট্যমন্দির (নাট মন্দির)। তারপর শ্রীমন্দির। মন্দিরের হর্ম্য সুউচ্চ কিন্তু ভুবনেশ্বরের মন্দিরের মতো শিল্পকলা এখানে নেই। কিছু অশ্লীল মূর্তি মন্দিরের মধ্যে রয়েছে, যা লজ্জাকর। তবে সম্ভবত এগুলি তান্ত্রিক উপাসনার অঙ্গ। শ্রীমন্দিরের চারপাশে নানা দেবদেবীর মন্দির উপস্থিত। 


জগন্নাথ দেবের মন্দিরের সমস্ত সেবা ও ভোগের জন্য প্রাত্যহিক আড়াইশো টাকার বেশি খরচ হয় বলে লেখক লিখেছেন। প্রতিদিন জগন্নাথ দেবের তিন প্রকার বেশ (পরিধান) হয়। বিভিন্ন তিথিতে বিভিন্ন বেশ হয়। রথযাত্রায় তিনটি নতুন রথ নির্মাণ করা হয়। একটি পুস্তকে লেখা নিয়ম অনুসারে রথ তৈরি হয়। কত দৈর্ঘ্য, প্রস্থ হবে, কবে রথ তৈরী শুরু ও শেষ হবে প্রভৃতি সেই পুস্তকে লেখা আছে। উৎকলের গড়জাত মহলের দশপালার রাজা রথের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের যোগান দেন। এর জন্য তিনি একটি মহল জায়গীর লাভ করেছেন। সেই জঙ্গলের কাঠ কাটিয়ে নদী তীরে পৌঁছে দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। পুরী রাজার কর্মচারীরা সেই কাঠ নদীতে ভাসিয়ে পুরীতে নিয়ে আসে। পুরীর মন্দির থেকে গুঞ্জবাটিতে রথ পৌঁছতে পাঁচ ছয় দিন লাগে। এই সময় দেবতাদের মূর্তি রথেই থাকে। নয়দিনের মধ্যে গুঞ্জবাটিতে পৌঁছে, নবম দিনে রথ পুনরায় পুরীর মন্দিরে ফেরার জন্য যাত্রা করে।

                       (চলছে)

৭৬। ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত ১ - রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম

         
          (আগের পর্বের পরে)

"ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত" বইটি ১২৯৪ বঙ্গাব্দে (১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনামে লেখা আছে - "ভ্রমণকারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত অর্থাৎ বাঙ্গালা, বেহার, উড়িষ্যা, আসাম প্রভৃতি প্রত্যেক জেলার সংক্ষেপ বিবরণ। রসিক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংগৃহীত, রচিত ও প্রকাশিত।" বইটির ভ্রমণকাল ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ।

লেখক রসিককৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। উৎসর্গ পর্বে "উপহার" শিরোনামে তিনি শ্রীযুক্ত বনমালী রায়চৌধুরী তড়াসদি অধিপতি বাহাদুর সজ্জন প্রতিপালকেষু-কে "পরম কল্যাণীয়" সম্বোধনে লিখেছেন "বনমালী রায়চৌধুরী নবাবী আমলের পুরাতন জমিদার ও লেখকের কল্যাণকারী"। এই যাত্রাকালে তিনি বিভিন্ন জমিদার, রাজা ও রাজকর্মচারীদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। 

১২৯১ সালের হেমন্তের শুরুতে ছোটনাগপুর ও উৎকল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে লেখক পথে বেরোলেন। লেখকের সঙ্গে কিছু সঙ্গী ছিল তা লেখা পড়ে বোঝা যায় কিন্তু লেখক কখনও তাদের নাম বা পরিচয় উল্লেখ করেন নি। কলকাতা থেকে বজবজ হয়ে হুগলি জেলার উলুবেড়িয়ার মহিষরেখায় আসেন। (তখন হাওড়ার নয়, হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল এই দুটি স্থান)। আলিপুর থেকে দশ মাইল বজবজ রোড এসে, বজবজ থেকে ৬ মাইল উলুবেড়িয়া রোড এবং উলুবেড়িয়া থেকে ক্রমাগত দক্ষিণ মুখে উড়িষ্যার কটক রোডে যাওয়া যায়। এই কটক রোড মেদিনীপুর ভেদ করে বালেশ্বর, কটক প্রভৃতি অতিক্রম করে পুরী পর্যন্ত গেছে। রূপনারায়ণের উত্তর পাড় হুগলি জেলার আর দক্ষিণ পাড় মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। যে স্থানে রূপনারায়ণ পার হলেন, সেটিকে কোলার ঘাট (কোলাঘাট) বলে। কটক রোড ধরে তিনি হুগলি জেলা ছেড়ে নদী পার হয়ে মেদিনীপুর জেলায় এলেন। কোলার ঘাটে নদীর ওপর একটি চটি, আউটপোস্ট ও পোস্টঅফিস আছে। সেখান থেকে ১৬ মাইল পথ পেরিয়ে আসে কংসাবতী নদী। এই স্থানের নাম পাঁশকুড়া। এখানে বড় বাজার, পুলিশ স্টেশন, ক্যানাল জলকর আদায় অফিস, ইংরাজদের রেশম কুঠি আছে। এখানকার বাজারে দুধ, মাছ, সবজি খুব সস্তা। আরও ২৪ মাইল গেলে মেদিনীপুর, আবার কংসাবতী নদী পার হয়ে। এরপর আরও ১৮ মাইল পরে পাথরা নামক গ্রামে অনেকগুলি বাড়িঘর দেখা গেল। মেদিনীপুর জেলায় বিচারালয়, হাইস্কুল, মেদিনীপুর সংবাদপত্র ও প্রেস, মিশনারীদের প্রেস আছে। 

মেদিনীপুর থেকে কটক রোড যেমন পুরী গেছে, তেমন এই পথেরই শাখা সম্বলপুর ও মাদ্রাজ অবধি বিস্তৃত হয়েছে। এই রাস্তা জেলার সীমা পর্যন্ত গিয়ে সিংভূমের রাজপথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর রয়েছে উত্তর-পশ্চিমে রানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা, উত্তরে গড়বেতা, বগড়ী, রানীগঞ্জ যাওয়ার রাস্তা। উত্তরে গড়বেতা হয়ে বাঁকুড়ার রাজপথে মিলিত হয়েছে আরেকটি রাস্তা। পাঁশকুড়ার পূর্ব দক্ষিণাংশে ১২ মাইল একটি শাখা গিয়ে তমলুকে পৌঁছেছে। আবার তমলুক থেকে আরেকটি শাখা ৩০ মাইল দক্ষিণে গিয়ে হিজলি কাঁথি উপবিভাগে পৌঁছেছে। সেই রাস্তাটি কাঁচা। পথে তেরপেকে ও কালিনগরের নদী নামের দুটি ছোট নদী পার হতে হয়। আবার মেদিনীপুর থেকে কটক রোডে কুড়ি মাইল গিয়ে বেলদা থেকে পূর্ব দক্ষিণে ২০ মাইল গেলে কাঁথি যাওয়া যায়। উত্তরে গড়বেতা ভেদ করে যে রাস্তা গেছে তাতে ১২ মাইল গেলে কেশপুর নামক স্থান আসে। সেখান থেকে পূর্বে যে শাখা বেরিয়েছে তাতে ৩২ মাইল গেলে ঘাটাল মহকুমা আসে। এই রাস্তা পুরনো কিন্তু বন্যার ভয়ে মজবুত করে তৈরি নয়। তারপর দক্ষিণে ২১ মাইল গেলে মেদিনীপুর জেলা শেষ হয়। সুবর্ণরেখা নদী মেদিনীপুর ও উড়িষ্যাকে পৃথক করেছে। এখানে সুবর্ণরেখার পারঘাটকে রাজঘাট বলে। বর্ষায় এই নদী ভয়াবহ রূপ নেয় তাই বাংলায় প্রবাদ আছে 'যদি গেলে সুবর্ণরেখা/ ঘুচল মা বাপের দেখা'। 


একটি ক্যানাল মেদিনীপুর পর্যন্ত কটক রোডের পাশে পাশে গেছে। এই জলপথে ছোট ছোট স্টিমার ও নৌকায় মানুষ ও পণ্যের আদান-প্রদান হয়। পথে দুই তিনটি নদী থাকা সত্ত্বেও এই খাল পথ উন্নত কৌশলে তৈরি হয়েছে বলে যাতায়াতে বাধা হয় না। নদীতে লকগেট তৈরি করে জল আটকানো ও জল ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করে এই মেদিনীপুর ক্যানালে নৌ চলাচল হয়। 

এরপর লেখক মেদিনীপুর জেলার প্রাকৃতিক অবস্থা, উৎপন্ন দ্রব্য, জাতিভিত্তিক জনগণ প্রভৃতি বিষয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। মেদিনীপুর জেলায় অনেক প্রসিদ্ধ জমিদার আছেন, তাঁরা সকলে রাজা উপাধিধারী ও তাঁদের আবাসস্থলকে গড় বলা হয়। যেমন ময়না গড়, গড় পদুবাসান, মহিষাদলের গড়, নারায়নগড়, রামগড়, লালগড়। ময়নার গড়টি সুদৃশ্য পরিখা দ্বারা ঘেরা, স্থলভাগে বন আছে, তাতে ময়ূর হরিণ প্রভৃতি বিদ্যমান। তারপর একটি প্রশস্ত খাল পেরিয়ে রাজবাড়িতে যাওয়া যায়। নৌকায় চড়ে ছাড়া রাজবাড়ীতে যাওয়া যায় না। তমলুকের পূর্ব নাম তাম্রলিপ্ত ছিল। এই বন্দর দিয়ে পূর্বে বঙ্গদেশীয়রা সমুদ্র যাত্রা করত। এখন তমলুকের সেই সমৃদ্ধি নেই। তবে এখানে বর্গভীমা নামক মহাপীঠ ও শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মন্দির আছে। কাঁথির রাজার বাসস্থান নাজনা গড়। কাঁথির ৬ মাইল দূরত্বে গড় বাসুদেবপুর অবস্থিত। গোপগড়ে মহাভারত খ্যাত বিরাট রাজার গোশালা ছিল বলে প্রবাদ আছে। এখানে একটি স্বল্প উচ্চতার ধিপির ওপর একটি অট্টালিকা আছে। কিন্তু সেটি তত প্রাচীন নয়। বরং কাঁথির ৩ মাইল উত্তরে কাঁথির রাজাদের এলাকায় কয়েকটি প্রাচীন শিব মন্দির আছে, যেগুলি অতি প্রাচীন বলে মনে হয়। এরপর লেখক মেদিনীপুর জেলার শিক্ষার উন্নত অবস্থা ও বহুলাংশে মামলা করার প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন। লেখক দেখেছেন যদিও মেদিনীপুর তখন বাংলার অন্তর্গত কিন্তু সেখানে উড়িষ্যার আমলের সন প্রচলিত। যেমন ভাদ্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীর দিন থেকে সালের গণনা শুরু হয়। 

এরপর লেখক মেদিনীপুরের পশ্চিমে সিংভূম যাওয়ার রাস্তায় চললেন কংসাবতী পার হয়ে। শেষে একটি ক্ষুদ্র নদী (পলপলা?) পায়ে হেঁটে পার হয়ে সিংভূমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। এখানে পাকা রাস্তা নেই। এক ফুট গভীর ধুলোর মধ্যে দিয়ে পথ চলা। ধুলোর জন্য হাঁটতে না পেরে শেষে গরুর গাড়িতে চললেন তাঁরা। ১২ মাইল যাওয়ার পর একটি হাট দেখলেন। সেই গ্রামে একটি গৃহস্থ বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, এছাড়া থাকার জন্য সেখানে কোন চটি নেই। পরদিন গরুর গাড়িতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকলেন। মাঝে মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক একটা বসতি। সেখানে আশ্রয় পাওয়ার আশা নেই। সারাদিনে ১২ মাইল অতিক্রম করে নৃসিংহ গড় নামক স্থানে পৌঁছালেন। এখানে একসময় ধলভূমের রাজার শাসন ছিল। সেখানে একটি দোকানে লেখক রাত কাটিয়ে পরদিন আবার রওনা হলেন ও ৬ মাইল অতিক্রম করে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে এলেন। এই নদীর বালুতে অতি অল্প পরিমাণে স্বর্ণ রেণু থাকে। সেজন্য এর পাড়ের অধিবাসীরা বালি থেকে স্বর্ণরেণু বেছে বের করে। কিন্তু সেই স্বর্ণের পরিমাণ এত কম যে বহু পরিশ্রমে কোন শ্রমিক চার-পাঁচ আনার বেশি দৈনিক উপার্জন করতে পারেনা। কোথা থেকে এই সোনা আসে সেই অনুসন্ধান এখনো করা যায়নি। সুবর্ণরেখার কূল অত্যন্ত মনোরম প্রকৃতির শোভাময়। কোথাও বিশাল শালবন, কোথাও নানা রকম বৃক্ষলতায় পথিকের আশ্রয়স্থল রচনা করেছে। কোথাও আবার বিস্তীর্ণ গিরি মালা। এখানে সুবর্ণরেখার পারঘাটের বাঁপাশে ধলেশ্বরী দেবীর (যাঁর অপর নাম রঙ্কিনী দেবী) মন্দির। ধলভূমের রাজার প্রতিষ্ঠিত দেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয় শারদীয় মহাষ্টমীর দিন। তীরবিদ্ধ করে মহিষ বধ করে বলি দেওয়া হয়। নিকটে রাজবাড়ি। লেখক রাজার সঙ্গে দেখা করলেন ও কয়েকদিন তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করলেন। 


ধলভূম থেকে ৪২ মাইল জঙ্গলময় পথ অতিক্রম করলে সিংভূম জেলায় পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে শতাধিক মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে রাঁচি। রাঁচি যাওয়ার আরেকটি পথ আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের কর্ড লাইনে সীতারামপুর স্টেশনে গিয়ে সেখান থেকে বরাকর পর্যন্ত শাখা লাইনে বরাকরে নেমে প্রথমে মানভূম বা পুরুলিয়া জেলা পৌঁছে সেখান থেকে সিংভূম হয়ে রাঁচি যাওয়া যায়। রাঁচি বিভাগটি পর্বত ও জঙ্গলময়। পূর্বে এই বিভাগ উৎকল সম্রাটের শাসনাধীন ছিল। ব্রিটিশের অধীন হয়ে এখন পর্যন্ত বেবন্দোবস্ত অবস্থায় আছে। 

অন্যদিকে রাজঘাটে সুবর্ণরেখা পার হয়ে ৩২ মাইল অতিক্রম করলে বালেশ্বর জেলা আসে। বুড় ভলং (বুড়ী বালাম) নামক নদীর ধারে বালেশ্বর বন্দর ও জেলা অবস্থিত। বর্ষায় এই নদীতে প্রবল স্রোত কিন্তু গ্রীষ্মে পায়ে হেটে পার হওয়া যায়। মেদিনীপুর থেকে বালেশ্বর আসার কটক রোডই প্রধান রাস্তা। তাছাড়া মেদিনীপুর থেকে ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বালেশ্বর যাওয়ার একটি পথ আছে। সেটি মেদিনীপুরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে মহাপাল পর্যন্ত ২২ মাইল গিয়ে সেখানে সুবর্ণরেখা নদী পায়ে হেঁটে পার হয়ে ৬ মাইল গিয়ে গোপীবল্লভপুর নামক স্থানে (এটি মেদিনীপুরের শেষ সীমা) আসা যায়। এখানে পুলিশ থানা, পোস্ট অফিস আছে। এক সঙ্গতিপূর্ণ বৈষ্ণব বাড়িতে গোপীনাথ নামে কৃষ্ণের পাথরের মূর্তি স্থাপনা হয়েছে। তাঁদের বংশ গোঁসাই উপাধিধারী। গোপীবল্লভপুর থেকে ২৪ দক্ষিণ পশ্চিম অভিমুখে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে লেখক ময়ূরভঞ্জের রাজধানী বারী পোদা (বারিপদা) পৌঁছলেন।

                        (চলছে)

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...