মঙ্গলবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৪

২৩। তীর্থ ভ্রমণ ৮ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 

      সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ    ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী লিখেছেন "ফাল্গুনী পৌর্ণমাসীতে শ্রীবৃন্দাবনে ফুলদোলের সময় কুম্ভের মেলা হয়। এই মেলা দ্বাদশ বছর অন্তর হয়। প্রথমে ফুলদোলে শ্রীবৃন্দাবন পরিক্রমের মেলা অন্তে হরিদ্বার গমন করে।"


যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী মহাশয় ১২৬১ সালের চৈত্র মাসে অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বৃন্দাবন থেকে হরিদ্বারে কুম্ভ মেলায় স্নানের জন্য যাত্রা করলেন। ১৫ই চৈত্র ১২৬১ সালে তিনি হরিদ্বারে পৌঁছলেন এবং ২১ থেকে ৩০ চৈত্র কুম্ভ মেলা দর্শন করলেন। অর্থাৎ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে হরিদ্বারে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি আরো বলেছেন দ্বাদশ কুম্ভের পর যে কুম্ভ হয় তাকে মহাকুম্ভ বলে। কুম্ভ বলার কারণ হলো এই যে বৃহস্পতি কুম্ভরাশিস্থ যে বছর হন, ওই কুম্ভরাশিস্থ বৃহস্পতিতে  মহাবিষুব সংক্রান্তির সঞ্চার যে সময় হয় সেই সময় হরিদ্বারে হর কি পৌরী ঘাটে স্নান হয়। উল্লেখ্য যে সেই সময় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বহাল ছিল।


হরিদ্বারের মহাকুম্ভ মেলাতে সেবার বহু দেশের মানুষের একত্র মিলন হয়েছে। প্রায় দেড় ক্রোর মানুষ এসেছে। চারদিকে তিন ক্রোশ পর্যন্ত মানুষের বসতি ও বাজার হয়েছে। স্থানাভাব এত হয়েছে যে সব মানুষ মাথা গোঁজার জায়গা পায়নি। পথ চলতে গেলে ঠেলাঠেলিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। কোম্পানি বাহাদুর এই বন্দোবস্ত করেছিলেন যে, যে পথে লোক একবার যাবে সে পথে আর সে ফিরতে পারবে না। এই বন্দোবস্ত দেখার জন্য স্থানে স্থানে রক্ষীরা লাঠি হাতে ঘুরছিল। গঙ্গার উপর দুটি নৌকার পুল হয়েছিল। একটি নীলপর্বতের সামনে, অপরটি হর কি পৌরী ঘাটের কাছে। একটি দিয়ে পশ্চিমপাড় থেকে পূর্বপাড় ও অপরটি দিয়ে পূর্বপাড় থেকে পশ্চিম পাড়ে যাওয়া যাবে।


মেলায় দোকানপাট অজস্র। মনোহারী দোকান, সাল-জামিয়ার-রেজাই-কম্বল ইত্যাদির দোকান, কাশ্মীর-অমৃতসর-লুধিয়ানা ইত্যাদির পশমিনার দোকান, পিতল-কাঁসা-তামা-লোহার দ্রব্যাদির দোকান, তুলসী-বিল্ব-পলার দোকান, শ্বেতপাথরের বাসন-আসবাবের দোকান, খেলনার দোকান প্রভৃতি। কাবুল-কান্দাহার-কাশ্মীর থেকে মোগল উটের পিঠে বোঝাই করে আনা আনার-আঙ্গুর-সেউ-বিহি-কিসমিস-বাদাম-পেস্তা প্রভৃতি মেওয়া, নানা রকম আচার, নানা জাতীয় মসলার পসরা, পান-তামাকের দোকান, মাটি-কাঠ-পিতল-কাঁসা-নারকেল-পাথর প্রভৃতির নানার বস্তু দিয়ে তৈরী হুঁকার দোকান। এক মাত্র পটল ছাড়া যাবতীয় রকম তরি তরকারির দোকান, কী নেই। আচারের দোকান শত শত ছিল। পাঞ্জাব, লাহোর ও দিল্লির আচারের দোকানে কত রকম যে জিনিসের আচার পাওয়া যেত তা বলার নয়। কয়েকটি অভিনব উপকরণ - আলু, করলা, পেঁপে, সজনে ফুল, সজনে ডাঁটা, বকফুল, ঝিঙে ফুল, বাসক ফুল, কুমড়ো ফুল, কচু, লাউ, কুমড়ো, তুঁত পাতা, আকন্দ পাতা, পদ্মডাঁটা, পদ্মমূল  প্রভৃতি। মোরব্বাওয়ালারা নানা রঙের নানা রকম মোরব্বা - আম, আমলকি, হরতকি, কিসমিস, লেবু ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছে। মিঠাইওয়ালা বা হালওয়াইরা লাহোর, লুধিয়ানা, অমৃতসর, দিল্লি, মিরাট, আগ্রা, মথুরা ইত্যাদি বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে এসেছে। মুগের, উরুদের, মেথির, বেসনের, মগধের, মতিচুরের লাড্ডু, অমৃতি, জিলাপি, রসবড়া, ক্ষুরমা, বরফি, পেড়া, গুজিয়া প্রভৃতি নানা মিঠাই বিক্রি হচ্ছে। গোয়ালারা ক্ষীর, দুধ, দই, রাবড়ি, মাখন, মালাই দিয়ে দোকান সাজিয়েছে। ভারওয়ালা অর্থাৎ ভুনাওয়ালারা খই, মুড়ি, চানা, মকাই, মটর, জোয়ার, বাজরা ইত্যাদির ভাজা নিয়ে বসেছে। তাদের বিক্রি খুব বেশি। দরিদ্র মানুষেরা এক পয়সার এইসব ভাজা কিনে খেয়ে পেট ভরিয়ে তারপর গঙ্গা জল পান করে নিচ্ছে। নানা জাতীয় উদ্ভিজ্জ ওষুধপত্র ও চন্দন, চামর ইত্যাদি পূজার দ্রব্যের দোকানও বসেছে। ডোমদের বানানো বাঁশের লাঠি, সাজি, টুকরির দোকান  বসেছে। অনেক তীর্থযাত্রী ঘটিতে গঙ্গাজল ভরে তার মুখ টিনের চাকতি দিয়ে আটকে গালা দিয়ে বন্ধ করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। তাই টিনের চাকতি আর গালাও বিক্রি হচ্ছে অনেক। মেলার বিভিন্ন স্থানে দোলা (নাগরদোলা) বসেছে। এক এক পয়সায় তিন তিন পাক খাওয়া যাচ্ছে।


মেলায় নানা জায়গা থেকে নানারূপ বেশ ধরে নানা চোর ও জুয়াচোর এসেছে। অন্যমনস্ক কাউকে পেলে তার জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। জলের তলা দিয়ে এসে স্ত্রীর ধনী স্ত্রীলোকদের অলংকার পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানে স্থানে পুলিশ ঘুরছে। শত শত চোরকে ধরে চৌকিতে বন্দী করে রেখেছে। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের বড় কর্তাদের জন্য অস্থায়ী ছাউনি তৈরী হয়েছে মেলার জন্য। ঘাটের তদারকি করার জন্য হাতির ওপর আসীন পুলিশ আধিকারিকরা আছেন হর কি পৌরী ঘাটে। ঘাটে খুব ভিড়। বেশিক্ষণ কারো জলে থাকার বা দু-তিন ফুটের বেশি জলে যাওয়ার অনুমতি নেই। মেলা উপলক্ষে প্রায় দুই লক্ষ জন্তু (গরু, হাতি, ঘোড়া, উট) এসেছে। সর্বদা গ্রাম থেকে তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য আসছে।


কংখলে বিভিন্ন আখড়া আছে। সেখানে আখড়াধারি গোস্বামীরা বা মোহন্তরা শিষ্যদের সঙ্গে দরিদ্র অভূক্ত ব্যক্তিদেরও আহার করান। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সাধুরা কেউ এক পায়ে, কেউ ঊর্ধ্ববাহু হয়ে, কেউ লোহার কাঁটার উপর দাঁড়িয়ে, কেউ আগুনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন কেউ মৌনি, কেউ শুধু ফলাহারি, কেউ গাঁজা-চরসে মগ্ন, কেউ ছাই মাখা। আখড়ার মোহন্তদের সঙ্গে আগে অস্ত্রধারী নাগা সৈন্য থাকতো। এই মোহন্তদের মধ্যে কে আগে স্নানের অধিকার পাবে এই নিয়ে পূর্বে বিবাদ হয়ে প্রাণ পর্যন্ত যেত। তাই সেই বার কোম্পানি বাহাদুর নিয়ম করেছেন যে কোনো অস্ত্র নিয়ে স্নানে যাওয়া যাবে না। কোম্পানির সৈন্যরা এইসব মোহন্তদের স্নানের সময় চার পাশে ঘিরে রইল। এছাড়া বাঁশ দিয়ে পথ ঘিরে এমন ব্যবস্থা করল যাতে পদস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা না যায়। একেক জন গোস্বামীর সঙ্গে চল্লিশটি উট, একশ ঘোড়া, বারটি সুসজ্জিত হাতি। আগে আগে বাদ্যধ্বনি করে হাজার শিষ্য, দুইশ পরমহংস, একশ দন্ডী ও নানা অভ্যাগত নিয়ে এক একজন গোস্বামীর শোভাযাত্রা। মোহান্তদের স্নান শেষ হলে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের স্নান শুরু হল। তাঁদেরও রাজা ও ধনী শিষ্য আছেন। তাঁদের সঙ্গেও হাতি-ঘোড়া-উট আছে। তাঁদের স্নান সমাপ্ত হলে বিকানীরের রাজার স্নান হল। রাজার সঙ্গে তিরিশ হাজার লোক। ঐশ্বর্যের অসম্ভব প্রদর্শন ও অজস্র দানের মধ্যে দিয়ে বিকানীরের রাজার স্নান শেষ হলে অন্যান্য রাজাদের স্নান হল। রাত একটা পর্যন্ত স্নান সমানে চলেছিল সংক্রান্তির দিন। রাজপুরুষ অর্থাৎ কোম্পানির আধিকারিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে প্রাণহানির ঘটে নি। সর্দিগর্মি হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়েছিল। তাদের সঙ্গেসঙ্গে সেই স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লোক ছিল এবং চিকিৎসার জন্যে ডাক্তারের ব্যবস্থা ছিল। সংক্রান্তির স্নানের পরেও মেলা আরো দিন সাতেক রইল। তারপর মেলার অস্থায়ী ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মেলা ভঙ্গ করা হলো।

                       (চলছে)

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ২১ চৈত্র ১২৬১ (৪ এপ্রিল ১৮৫৫) থেকে ৩০ চৈত্র ১২৬১ (১৩ এপ্রিল ১৮৫৫)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. মেলার বিবরণীতে চোখের সামনেই যেন এক মেলার দৃশ্যের সাক্ষাৎ হইলো ।চোরেদের জলের তলায় ঢুব দিয়ে চুরির বর্ননা তে বেশ অবাক লাগল চোরের বুদ্ধি দেখে 😄
    শিউলি

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...