মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৩৮। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ২ ভোলানাথ চন্দ্র


সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

হুগলির পূর্বে বাংলার রাজকীয় বন্দর ছিল সাতগাঁ বা সপ্তগ্রাম। গঙ্গা আগে এখান থেকে প্রবাহিত হয়ে আন্দুলের দিকে যেত। কালক্রমে জমে যাওয়া মাটি সরালে এখনো এই অবরুদ্ধ প্রবাহ বরাবর কিছু ধ্বংস হওয়া নৌযান খুঁজে পাওয়া যাবে। সাতগাঁর প্রাচীন ঐতিহ্য এতোটাই ছিল যে রোমানরা তার নাম দিয়েছিল Ganges Regia (গঙ্গা রিদি?)। এটি এক বিশাল রাজকীয় শহর ছিল ও রাজাদের রাজধানী ছিল। প্রথম যে ইউরোপীয়রা বাংলায় এসেছিল তারা দুটি বন্দরের কথা বলেছে - একটি চট্টগ্রাম আর একটি সাতগাঁ। গত শতাব্দীতে (অষ্টাদশ শতাব্দীতে) এখানে অনেকগুলি গ্রামীণ উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। গঙ্গার স্রোত পরিবর্তন এই বাণিজ্য উপনিবেশের পতনের কারণ। হুগলি বন্দরকে প্রধান বন্দর হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টাও ক্রমে বিফল হয়। এরপর সেটি পূর্ব গৌরব হারিয়ে একটি সামান্য স্থানে পরিণত হয়। আক্ষরিক অর্থে সপ্তগ্রাম সাতটি গ্রাম নিয়ে তৈরি ছিল। পূর্বে কলকাতার মল্লিক পরিবার সেখানে থাকতেন। পরে তাঁরা হুগলি ও তারও পরে কলকাতায় যান। 


এরপর আসে ত্রিবেণী। তিন নদীর সংযোগস্থল এলাহাবাদের প্রয়াগের মতোই পবিত্র স্থান এই ত্রিবেণী। এখানে প্রতিবছর মার্চ মাসে স্নানের মেলা হয়। পূর্বে কলকাতার বাবুরা ত্রিবেণী পেরিয়ে মফস্বলে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারত না। ত্রিবেণী এতটাই পুরনো জায়গা যে প্লিনি, টলেমি (রোমান ভূগোলবিদ) এর কথা লিখেছেন। এই স্থান সংস্কৃতের একটি পীঠস্থান। এখানে মহাপন্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের বাড়ি, যিনি স্যার উইলিয়াম জোন্সের সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন এবং লর্ড কর্নওয়ালিসের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু আইন সংকলন করেছিলেন। তাঁর অভূতপূর্ব স্মৃতিশক্তি ছিল। এই সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে যে একবার স্নান সেরে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর একজন কাফের ও একজন চীনা ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তারা ঝগড়া মারামারি করছিল। পুলিশের কাছে এই মামলা যাওয়াতে পুলিশ তাঁকে সাক্ষ্য দিতে ডাকে। তিনি বলেন যে তিনি ওই কাফের ও চীনা কারো ভাষা জানেন না কিন্তু তারা কী কী শব্দ উচ্চারণ করেছিল তা সম্পূর্ণ বলতে পারবেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিতে সবাই হতচকিত হয়ে জান।  ত্রিবেণীর পরে শুরু হয় সাধারণ গ্রাম বাংলা। ইঁটের বাড়ি এখানে খুব কম দেখা যায়। ঘাট আর মন্দির অনেক দূরে দূরে দেখা যায়। নদী এখানে আরো চওড়া, কিন্তু স্রোত কম কারণ মাঝে মাঝে চরের বাঁধা আছে। 


ত্রিবেণীর চার মাইল উত্তরে ডুমুরদা বা ডুমুরদহ খুব সামান্য গ্রাম কিন্তু ডাকাত আর জলদস্যুর জন্য কুখ্যাত। এখনো সূর্যাস্তের পরে এই জায়গা কোনো নৌকা পেরোয় না। দিনের বেলায়ও এখানকার ঘাটে কোনো নৌকা নোঙর করতে সাহস পায় না। ব্যবসায়ীরা নিজের সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এই স্থান পেরোতে ডাকাতি ও খুনের আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকে। একবার কিছু লোক পূজার ডাকাতেরা হয় নৌকা ফুটো করে দেয়, নয় নৌকা থেকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ডাকাতের সরকার বিশ্বনাথবাবু (বিশে ডাকাত) এখানে থাকতো ৬০ বছর আগে অর্থাৎ আনুমানিক ১৭৮৫ নাগাদ। অন্য এক প্রথা ছিল পথিককে আশ্রয় দেওয়া, খাতির যত্ন করা এবং মাঝরাতে তাকে মেরে সর্বস্ব লুটে নেওয়া। বিশে ডাকাতের আক্রমণের গন্ডি বর্তমান যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সে ওস্তাদ ছিল। একবার তার দলের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে জঙ্গলে তাকে ফাঁসি দিয়ে মারে। গঙ্গার ধারে তার দোতলা তৈরি বাড়ি এখনো (লেখকের ভ্রমনের সময়) আছে। এখানকার অধিবাসীরা অধিকাংশ মাঝি আর জেলে। এদের অনেকে আবার রাতে ডাকাত। 


এরপর এলো সুকসাগর। তখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সুকসাগরে অনেক অভিজাত পরিবার বাস করত। লর্ড কর্নওয়ালিস অনেক সময় এখানে গ্রীষ্মকাল কাটাতে আসতেন। এখন যেমন ভাইসরয়রা সিমলা যান ব্যারাকপুরের গ্রীষ্মাবাস তৈরী হওয়ার আগে এখানে ছিল তাঁদের গ্রীষ্মের ঠিকানা। এখানে রেভিনিউ বোর্ডও স্থাপিত হয়েছিল তা মুর্শিদাবাদ চলে যাওয়ার আগে। গঙ্গা গতিপথ পরিবর্তন করায় এর অনেক অংশ গঙ্গাবক্ষে বিলীন হয়েছে। পরে সেইসব বাড়ির চিহ্ন নেই। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্লাবনে ওই এলাকা প্রচন্ডরকম প্লাবিত হয়েছিল। 


চাকদা, চাকদহ বা চক্রদহ পরবর্তী স্থান। কথিত আছে যে ভগীরথের রথের চাকার আঘাতে মাটিতে একটি সুগভীর খাতের সৃষ্টি হয়ে এই স্থান তৈরি হয়েছে। চাকদা একটা বাণিজ্য কেন্দ্র এখানে আশেপাশের জেলাগুলি থেকে কৃষিজ দ্রব্য আসে বিক্রির জন্য। অন্য সব বড় ভারতীয় বাজারের মতো এখানে অনেক গুদাম আর পতিতালয় আছে। ঘাটে অনেক নৌকা নোঙর করা থাকে। 


অপর পারে বলাগড়, বৈষ্ণব গোঁসাই আর কুলীন-বৈদ্যদের স্বর্গ। তারপর গুপ্তিপাড়া। এখানকার ব্রাহ্মণরা তাঁদের বিদ্যাচর্চার জন্য বিখ্যাত। এখানকার বাঁদরের সংখ্যা প্রচুর এবং তাদের বাঁদরামি সীমা নেই। শোনা যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নাকি গুপ্তিপাড়া থেকে বাঁদর আনিয়ে কৃষ্ণনগরে তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন বিশাল ধুমধাম করে। সেই বিয়ের খরচ হয়েছিল অর্ধ লক্ষ টাকা। কথায় আছে কাউকে নাকি সে গুপ্তিপাড়া থেকে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করা অর্থ হলো তাকে বাঁদর বলা। 


গত শতাব্দীতে (অষ্টদশ শতাব্দীতে) গঙ্গা শান্তিপুরের একেবারে পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল। কিন্তু এখন শান্তিপুর শহরের পাশে বিস্তীর্ণ বালির পাড়। শান্তিপুর সম্ভবত বহু প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ভাগিরথীতে সবথেকে পুরনো নৌযাত্রার কথা জানা যায় সম্রাট অশোকের সময়। তাঁর পুত্র মহেন্দ্র বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রীলঙ্কা গেছিলেন। এই নৌযাত্রা বিষয়ে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন এই পথে সমুদ্রযাত্রা করে নিজের দেশে ফেরেন। পঞ্চম শতাব্দীতে চাঁদ সদাগর (মনসামঙ্গল) ও শ্রীমন্ত-দের (চন্ডীমঙ্গলে) যাত্রা যেহেতু কাহিনী থেকে পাওয়া তার মধ্যে ইতিহাস ও কল্প কাহিনীকে আলাদা করা অসম্ভব। চৈতন্য জীবনীতে শান্তিপুরের উল্লেখ পাওয়া যায়। অদ্বৈতের জন্ম ও সাধনভূমি ছিল এই শান্তিপুর। একসময় শান্তিপুর বড় জনবহুল স্থান ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল শান্তিপুর। লর্ড ওয়েলেসলি এখানে দুদিন থেকেছিলেন। যে বাড়িতে তিনি থেকে ছিলেন সেটি এক লক্ষ টাকায় তৈরি করা হয়েছিল। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে এখানে অত্যন্ত অন্তত কুড়ি হাজার ইঁটের বাড়ি ছিল বলে জানা যায় কিন্তু এখন সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। তবে মিহি সুতোর কাপড়ের জন্য ঢাকার পরেই এর খ্যাতি। অন্তত দশ হাজার তাঁতি পরিবার আছে এখানে। অদ্বৈতের বংশধরেরা এখানে গোঁসাই। এখানকার প্রধান দেবতা শ্যামচাঁদ। এখানে এখনো অনেক টোল আছে। কোন ব্রাহ্মন অবশ্য এখন একশো স্ত্রী রাখে না, বিধবাকে সতী হতে হয় না বরং বিধবাবিবাহ হতে পারে। বারোয়ারি পূজা যা খুব ধুমধাম করে হতো তা এখন হয় না। কোন একবার বারোয়ারী কালীপুজোয় মদ খেয়ে ব্রাহ্মণরা নেশার ঘোরে এক ব্রাহ্মণকে ছাগলের বদলে বলি দিয়ে দিয়েছিলেন বলে লিখেছেন লেখক। শান্তিপুরের নারীরা পাতলা গড়নের, অভিজাত, কোমল দেশীয় সুন্দরী। বিদ্যাসুন্দর যেমন বলেছেন তেমনি এই নারীরা খুব সুন্দর ভাবে চুল বাঁধতে পারে। শান্তিপুরের নারীরা বুদ্ধিমত্তা ও প্রাণবন্ত কথাবার্তায় বিশিষ্ট।


কালনা শহর যদিও শান্তিপুরের মতো আকারে বড় নয় কিন্তু অনেক বেশি অভিজাত ও পরিচ্ছন্ন। এর রাস্তা, বাজার আরো ভালো। আগে গঙ্গানদী বর্তমান শহরের পিছন দিক দিয়ে বইত। এখনকার পুরনো কালনা শহর যেদিকে আছে সেদিকে। এখনকার কালনা বর্ধমানের রাজার তৈরি। রাজা রানীদের নিয়ে তীর্থস্নান করতে আসেন এখানে। বর্ধমান ও কালনার বড় রাস্তা দিয়ে জোড়া, তার প্রতি আট মাইলে বাংলো, আস্তাবল, পুকুর আছে। গঙ্গা এখন আবার নতুন কালনার দিকে সরে যাচ্ছে ফলে এখনকার বাণিজ্যে ভাঁটা পড়েছে। কালনার প্রথমে দেখার জিনিস হল বর্তমান রাজার রাজবাড়ী। এখানে অনেক অভিজাত বাড়ি আর বৃহৎ মন্দির আছে। একটা বিশাল স্থানে দুটি চক্রাকারে (একটির মধ্যে আরেকটি) মন্দিরগুলি রয়েছে। মন্দির খুব কারুকার্যময়। ভিখারিদের খাওয়ানোর জায়গা আছে এখানে। এরপরে দ্রষ্টব্য সমাজ বাড়ি অর্থাৎ রাজার পরিবারের মৃতদের সমাধি। রাজা ক্ষত্রিয় বংশের এবং তাঁরা মৃতদেহের ভষ্ম সংরক্ষণ করে থাকেন। হয়তো তিনি এই প্রথাটা রাজপুতানার রাজাদের বা অন্য কোন উৎস থেকে নিয়েছেন কারণ এমন কোন সংস্থান হিন্দু শাস্ত্রে নেই। এখানে প্রাক্তন রাজার অস্থি রাখা আছে দামি কাপড়ে মুড়ে মখমলের মসনদে রাখা, সঙ্গে রুপার তামাক সেবনের হুঁকা, গোলাপ জল, আলবোলা সব রাখা আছে ঠিক কেমন ভাবে রাজা পূর্বে সিংহাসনে বসতেন।


এর পরে কিছু অংশে গঙ্গার গভীরতা এত কম যে লেখক ও সঙ্গীরা পাড় ধরে হেঁটে চললেন আর নৌকা দড়ির সাহায্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। মৃজাপুরের কাছে একটি খাল কেটে সেখান থেকে রাজমহল পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিলিটারি বোর্ডের দ্বারা, কুড়ি বছর আগে। 


অনেক ঘন্টা নদীর পাড় ধরে হাঁটার পর দূরে নদীয়া (নবদ্বীপ) দেখতে পাওয়া গেল। হিন্দুধর্মে নদীয়াকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়। সংস্কৃত শিক্ষা পীঠস্থান ও চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হিসেবে নদীয়ার অবদান অশেষ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশ হতে হয় নদীয়ার অবস্থা দেখে। নবদ্বীপে কিন্তু প্রাচীন ভগ্নপ্রায় মন্দির, বসতবাড়ি তেমন দেখা যায় না, পুরনো শহরের কাছে যা আশা করা যায় তার মত। অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতও চোখে পড়ে না। বরং একটা ছোট মফস্বল শহর আর খেটে খাওয়া ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় দেখা যায়। পুরনো নদীয়া গঙ্গার তলায় তলিয়ে গেছে। পুরনো নদীয়া কৃষ্ণনগরের দিকের পাড়ে ছিল। নদীয়ার সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীগুলির একটি হলো বিল্লগ্রাম ও ধাত্রীগ্রাম নামে দুই সাধু এখানে থাকতেন, গভীর জঙ্গলে নির্জনে জ্ঞান চর্চার জন্য। জ্ঞানের অন্বেষণে বহু মানুষ তাঁদের কাছে শিক্ষা লাভ করতে আসতেন। জ্ঞানচর্চায় খুশি হয়ে দেবী সরস্বতী এই সাধুদের দেখা দিতেন। অন্য একটি কাহিনী হলো কাশীনাথ নামে এক রাজা প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নদীয়া এলেন। এই স্থান তখন জঙ্গলে ঢাকা লোক চক্ষুর আড়ালে ছিল। কিন্তু রাজার এই স্থান এত ভালো লেগে যায় যে তিনি এখানে রাজধানী তৈরি করা মনস্থ করলেন। তারপর জঙ্গল কেটে রাজধানী গড়ে উঠলো, প্রজাপত্তন হলো। তবে নদীয়ায় ঠিক কবে থেকে এবং কিভাবে গড়ে উঠেছিল তার কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। এমনও শোনা যায় সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণসেনের রাজধানী ছিল নদীয়া। বক্তিয়ার খিলজী যখন বাংলা আক্রমণ করেন তখন তার সৈন্যরা নদীয়া ধ্বংস করে ও গৌড়ে রাজধানী তৈরি হয়। এরপর থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত নদীয়ার বিষয়ে আর কিছু জানা যায় না। তবে সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নিশ্চয়ই নদীয়ার মান অব্যাহত ছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে আবার নবদ্বীপ জনমানসে জাগরূক হল। শ্রীচৈতন্যের মন্দির ছাড়া নদীয়ায় কালীসাধক আগম বাগীশের র বাড়ির ভগ্নাবশেষ আছে। তিনিই প্রথম কালীমূর্তি তৈরি করেন তাঁর মনের কল্পনা থেকে। এরকম ধারণা আছে যে আদিবাসীদের দেবী ছিলেন কালী আর পূর্ববর্তী যুগে তাঁর পূজা হতো। কিন্তু হিন্দু ধর্মের ইতিহাস পাঠ করে বোঝা যায় যে কালীর বিদেশি উৎস আছে। শক্তির উপাসনা মনে হয় মিশরীয় ও আসিরিয় সভ্যতায় ছিল। কালী মূর্তির পূজা কিন্তু হিন্দুদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।কালীপুজো থেকে আসে তন্ত্রসাধনা। তবে আগম বাগীশ ঠিক কোন সময়কার এবং সত্যিই তাঁর বাড়ি বলে যা রয়েছে সেটি তার বাড়ি কিনা বা তাঁর বাড়ি গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের সময় ডুবে গেছে কিনা তা সঠিক জানা যায় না। পোড়া মাঈ নামক দেবী, যা একটু এক টুকরো কালো পাথরের উপর লাল গৈরিকমাটি মাখানো একটি অতিবৃদ্ধ বটগাছের তলায় বসানো। নদীয়ার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছিলেন রাজা কাশীনাথের লোকেরা জঙ্গলে আগুন লাগিয়েছিল। সেই আগুনে তিনি পুরে কালো হয়ে যান। বটগাছটি পুরাতন সেটি দেখে বোঝা যায়। নদীয়ার এই অংশ গঙ্গার তলায় তলিয়ে যায়নি। পোড়া মায়ের বটগাছের কাছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একটি বড় কালী মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। লেখকের পর কিছু টোল দেখতে গেলেন। ৫০ টির বেশি টোল আছে নবদ্বীপে। সবচেয়ে বড় পন্ডিত শ্রীরাম শিরোমণি। তাঁর চল্লিশটি ছাত্র। তার মধ্যে একজন আসাম, আরেকজন কালীঘাট, আরেকজন তেলেঙ্গানা থেকে এসেছে। নদীয়ার সাধারণ মানুষ এমনকি মহিলারাও কিছুটা কিছুটা সংস্কৃত শ্লোক বলতে পারেন। তবে ব্রাহ্মণরাই টোলের শিক্ষক ও ছাত্র হয় সেই প্রাচীনকালের মত। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের চক্র, আধিপত্য বন্ধ হয়েছে। স্যার উইলিয়াম জোন্স, ডক্টর কেরি প্রমুখ প্রাচ্যবিদ্যার পন্ডিতরা সবাই নদীয়ায় এসেছিলেন। নদীয়াতে লেখক একজন যোগীকে দেখেছিলেন। ব্যক্তিটিকে দেখে মনে হয় ৪০ বছর বয়স, খুব ফর্সা, কালো চুল। তিনি খান না, জলপান করেন না, কথা একটুও বলেন না, পা মুড়ে একই ভঙ্গিতে ধ্যানে বসে আছেন। উপোসের কোন প্রভাব তাঁর চেহারায় পড়েনি। দেশীয় ও ইউরোপীয়রা অনেকে তাঁকে দেখতে আসেন। তাঁর ধ্যান ভাঙ্গানোর জন্য নানা রকম প্রচেষ্টা হয়েছে কিন্তু সেটি সফল হয়নি। 


কাটোয়া রোডে অবস্থিত নদীয়া থেকে চার মাইল পশ্চিমে জহ্নুনগরে (নবদ্বীপ-কাটোয়া রোডে অবস্থিত) জহ্নুমুণীর ছোট প্রাচীন মন্দির। এই মুণী গঙ্গাকে পান করেছিলেন, শেষে কর্ণকুহর পথে গঙ্গাকে আবার মুক্ত করেছিলেন। এই মন্দিরের নীচেই পুরনো নদীখাত। এখানে লেখক শোনেন এই  নগরের এক জমিদার খাজনা দিতে না পারায় পিঁপড়ের ঘরে রেখে শাস্তি দিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাবরা নাকি পোকা ভর্তি ঘরে রেখে মানুষদের শাস্তি দিত। নিকটস্থ ব্রহ্মাদিতলায় এক দুর্গা মন্দির রয়েছে। এখানে আগে নরবলি হত বলে লেখক শোনেন। এখন সেখানে জুলাই মাসে বড় মেলা হয়। এই মেলার বড় আকর্ষণ সাপ খেলা, সাপ ধরা, সাপের বিষ ছাড়ানো ইত্যাদি

                      (চলছে)



প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. এই পর্বের ভ্রমণ বৃত্তান্ত আর কিছু স্থানের অজানা কিছু তথ্য সম্পর্কে অবগত হয়ে ঋদ্ধ হলাম। শিউলি

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...