মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

৪৭। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ১১ ভোলানাথ চন্দ্র




সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                      (আগের পর্বের পরে)

সারারাত ধরে ডাকগাড়ি চলল। সকালবেলা গঙ্গার ওপারে দেখা গেল পান্ডবদের পূর্বপুরুষ পুরোরবার রাজধানী (যার নাম ছিল 'প্রতিষ্ঠান'), পুরানের প্রয়াগ আর আকবরের এলাহাবাদ। 


গঙ্গায় ভাসমান নৌকার পুল তখন মাঝখানে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাই নৌকায় গঙ্গা পার হলেন লেখক ও সঙ্গীরা। প্রথমেই প্রয়াগ অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমস্থল দেখতে গেলেন তাঁরা। সঙ্গমের দৃশ্য অতি সুন্দর। হিন্দুদের প্রয়াগে এলেই চুল দাড়ি এমনকি ভুরু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়। এই ক্ষৌরকর্মে যতগুলি চুল বিসর্জন দেওয়া হবে তত বছর নাকি স্বর্গবাস হবে। নারীরাও কেশকর্তনে সমান উৎসাহী এখানে। 


এমনিতে প্রতিদিন এলাহাবাদের গঙ্গার ঘাটগুলি পূজা-তর্পণরত মানুষের ভিড়ে ভর্তি থাকে, তবে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের পূর্ণিমাতে মাঘী প্রয়াগী নামে এক মহামেলা বসে। সেই বিশাল জনসমাগমের মেলা প্রায় দু মাস ব্যাপী চলে। দূরদুরান্ত থেকে এসে তাঁবুতে থাকে, অস্থায়ী দোকান বসায়। পুণ্যার্থী, ভিক্ষুক, ব্যবসায়ী ভ্রমণার্থীতে স্থানটি ভরে যায়। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে দূর্গের প্রাচীরের সংলগ্ন স্থানে এই মেলা হতে দেওয়া হচ্ছে না। আগে প্রায় ১৫০০ পান্ডার পরিবার এখানে ছিল। তারা কেউ কেউ এই বিদ্রোহে সাহেবদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বিদ্রোহের পর তারা হয় পালিয়ে গেছে অন্য শহরে বা জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছে। তীর্থযাত্রীদের অবশ্য এতে সুবিধা হয়েছে। 


বেনারসের পরে এলাহাবাদ দেখলে সবকিছু সামান্য ও দীনহীন মনে হয় এবং বোঝা যায় এলাহাবাদের ডাকনাম ফকিরাবাদ কেন হয়েছে। কিন্তু ক্রমে শহরটি ভালো লেগে যায়। এখানকার বাড়ির সংখ্যা কম ও সেগুলি অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। রাস্তা চওড়া আর পুরনো বড় বড় গাছের ছায়াযুক্ত। 


হিন্দু পুরাণ অনুসারে এই স্থানে ত্রিবেণী সঙ্গম অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গম হয়েছে। কিন্তু  সরস্বতী নদী দৃশ্যমান নয়। বলা হয় তিনি আসার পথে দানবদের হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দিল্লির উত্তর পূর্বে বালির তলায় অন্তর্হিত হয়েছেন। তারপরের পথ তিনি অন্তঃসলিলা অর্থাৎ মাটির তলা দিয়ে বহমান হয়ে প্রয়াগ এসে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গে মিশেছেন। সম্ভবত সরস্বতী বা ঘাগ্গার নদী এক প্রচন্ড ভূমিকম্পের ফলে ভূগর্ভে চলে যায়। সেই ভূকম্পের শব্দকে দানবের হুংকার বলে বলা হয়েছে। 


এলাহাবাদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় স্নান হল দূর্গ, যা গঙ্গা যমুনার জল থেকে উপরে উঠে গেছে। এই দুর্গ কবে তৈরি হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে হিন্দু যুগের এই দুর্গ বহু শক্তির উত্থান পতনের সাক্ষী। বাদশাহ আকবর মুসলমান শাসনকালে এই দুর্গে সংস্কার করেন ও এই স্থানের নাম দেন এলাহাবাদ। হিন্দুরা একটি কাহিনীতে বিশ্বাস করে। আকবর আগের জন্মে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন তার নাম ছিল মুকুন্দ। মুকুন্দের বাসনা ছিল ভারতের সম্রাট হওয়ার। মুকুন্দ দেবতার কৃপায় বর লাভ করেন যে পরের জীবনে তাঁর এই স্বাদ পূর্ণ হবে। সেই জীবনে যা কিছু তিনি পরের জীবনে মনে রাখতে চান তা তাম্রলিপিতে লিখে একস্থানে তিনি পুঁতে রাখেন। মুকুন্দ প্রয়াগে সেই তাম্রলিপি মাটিতে পুঁতে আগুনে আত্মাহুতি দেন। এরপর তিনি আকবর হিসেবে জন্ম নিয়ে সেই স্থানটি খুঁজে তাম্রলিপিটি পাঠ করেন। মুসলমানদের থেকে এখন দূর্গটি ইংরেজদের অধীনস্থ হয়েছে। উন্নত অস্ত্র ও যুদ্ধনীতির কারণে এই সময় দূর্গ নতুন ভাবে সজ্জিত হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দূর্গটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি সুন্দর ময়দান পেরিয়ে দূর্গে ঢোকার তোরণ দ্বার। সেখানে সিপাহীরা, কালো চামড়ার মানুষদের দুর্গে প্রবেশের কাগজ দেখাতে না পারলে আটকে দেয়। ভিতরে আকবর তৈরি ২৭২ ফুট লম্বা রাজকীয় হল রয়েছে। হিন্দু রাজাদের আমলে স্থাপত্য চারিদিকে বিদ্যমান। দূর্গের ঠিক নীচ দিয়ে যমুনা বয়ে চলেছে। একটা খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা পাথরের সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে, সেখান দিয়ে মোগল রাজপরিবারের মহিলারা যমুনার ঘাটে স্নান করতে যেত। 


দূর্গের মধ্যে একটা সুড়ঙ্গের মতো স্থান আছে মাটির নীচে, যেটিতে এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ব্রিটিশ সৈন্যরা সেটি গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছে। আগে যারা এখানে এসেছে তারা ভিতরে ঢুকেছে। ভেতরটা ভিজে, ঠান্ডা, অদ্ভুত গন্ধযুক্ত। সুড়ঙ্গের শেষে একটা চাতাল আছে। তার উপর একটা ৭ ফুট উঁচু মন্দির আছে। মন্দিরে শিবলিঙ্গ আছে, শিবের চারপাশে আরও দেব দেবীর মূর্তি আছে। একটি মৃত গাছের গুঁড়ি আছে, যেটি কয়েকশো বছরের পুরনো। একে অক্ষয় বট বলে, এর নাকি মৃত্যু নেই। আরো বহু আগে নাকি এই সুড়ঙ্গ পথের অন্যদিক সঙ্গম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লেখক বলেন গুহা মন্দির তৈরিতে যেহেতু বৌদ্ধরা পারদর্শী ছিল হয়তো এই গুহা মন্দির একসময় বৌদ্ধদের ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দুরা তার দখল নেয়। হয়তো এককালে এই মন্দিরটি মাটির উপরে ছিল গঙ্গা-যমুনার পলি সঞ্চারের ফলে কোনভাবে এটি এখন পাতালপুরীতে পরিণত হয়েছে। দূর্গে সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো ভীমের গদা বা লাট বা দন্ড। এটি এক পাথরে তৈরি মাটি থেকে ৩৫ ফুট উঁচু বহু প্রাচীন একটি স্তম্ভ। বস্তুতঃ এটি সম্রাট অশোকের অনুশাসনের প্রচারের স্তম্ভ (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি)। এই স্তম্ভটিতে পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্রগুপ্তের কীর্তি খোদিত হয়। শেষে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এই স্তম্ভে জাহাঙ্গীরের নাম বংশ পরিচয় ইত্যাদি খোদিত হয়েছে। 


এলাহাবাদ শহর ঘুরে দেখার সময় লেখক যমুনা নদীর দরিয়া ঘাট দেখলেন। এটি একটি পুণ্যস্থান। শোনা যায় বনবাসে যাওয়ার সময় সীতা ও লক্ষণসহ রাম এখানে নদী পার হয়ে বন্ধু গুহক চন্ডালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর নিকটে বেনারসের রাজার প্রাসাদ আছে। যমুনার ওপর ব্রিজ তৈরির কাজ চলছে দুই বছর ধরে। জলের তলায় ডুবে কাজ করতে গিয়ে তিন চারজন প্রাণ হারিয়েছে (১৮৬৬ তে এই ব্রিজ সম্পন্ন হয়)। লেখক জুম্মা মসজিদ, ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম, বরাহ মন্দির (লক্ষীবরাহ মন্দির) দেখলেন। 


এবার লেখক এলেন মোগলদের তৈরি বাগান খসরু বাগে রয়েছে খুব সুন্দর ফুল-ফল-সবজি বাগান আর গাছপালা দিয়ে তৈরি ছোট ছোট গোলক ধাঁধা। বাগানের মধ্যস্থলে খসরু, পারভেজ ও জাহাঙ্গীরের মারোয়ারি বেগমের সুন্দর কারুকার্য করার সমাধি দেখলেন। (খসরু জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে, পারভেজ জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র ও জাহাঙ্গীরের মারওয়ারি বেগমের নাম শাহ বেগম)। বাগানের সংলগ্ন অংশে একটি বড় সরাই আছে, যা মোগলদের জনস্বার্থমূলক কাজের একটা উদাহরণ। সরাইতে একটা সুগভীর কূপ আছে, যার মধ্যে নামার জন্য সিঁড়ি আছে। 


এলাহাবাদ স্টেশন হাওড়া স্টেশনের অর্ধেকের থেকেও ছোট। এখানে ট্রেন চালাতে কয়লার বদলে কাঠ ব্যবহার করা হয়। এই জ্বলন্ত কাঠের টুকরো হাওয়ায় উড়ে কামরায় ঢুকে কখনো কখনো অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। গাড়ির হিন্দু যাত্রীরা অনেকে রঙিন পাগড়ী পড়ে থাকায় গাড়ির ভেতরটা বেশ উজ্জ্বল দেখতে লাগে। ট্রেনে এলাহাবাদ থেকে কানপুর যাওয়ার পথে ট্রেনে জানালা দিয়ে ঐতিহাসিক ও সুন্দর দোয়াব উপত্যকা দেখতে দেখতে যান লেখক। বেরহামপুর (এখানে এই নামে কোন স্টেশন এখন নেই), ফতেপুর স্টেশন হয়ে ট্রেন এসে পৌঁছায় কানপুর

                       
                         (চলছে)

৩টি মন্তব্য:

  1. প্রয়াগে চুল,দাড়ি,ভুরু বিসর্জনের যে প্রথা আর সেই প্রথার নেপথ্যের লোক প্রচলিত গল্প বেশ হাস্যকর লাগলো। যাদের মাথায় চুল নেই তারা কি তবে স্বর্গ লাভ থেকে বঞ্চিত থাকতো 😃😃
    যাই হোক এটা মন হালকা করার জন্য মজা করলাম মাত্র 😊

    উত্তরমুছুন
  2. হিন্দু পুরাণ অনুসারে ত্রিবেদী সঙ্গমের উৎপত্তি ইতিহাস জানলাম পর্ব টি থেকে।আকবরের সম্রাট হওয়ার পেছনে তার পূর্ব জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত গল্প জানলাম। এলাহাবাদের কিছু স্থানের অস্তিত্ব আজও একই রকম আছে। সব মিলিয়ে পর্বটি বেশ উপভোগ করলাম।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...