বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৫৮। ইউরোপে তিন বছর ৪ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - নরওয়ে, সুইডেন।

১৮৮৬ এর ২২ শে জুলাই লেখক তাঁর কিছু বন্ধুর সঙ্গে লন্ডন থেকে নরওয়েসুইডেন বেড়াতে যান। লন্ডন থেকে রেলে হাল বন্দরে এসে তাঁরা স্টিমারে করে সমুদ্রপথে (নর্থ সী) নরওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। 

২৪ শে জুলাই রাত ১০:৩০ পর্যন্ত তিনি স্টিমারের ডেকে বসে বই পড়লেন কারণ তখনও যথেষ্ট সূর্যের আলো ছিল। পরদিন সকালে অ্যালেসুন্ড নামক ছোট বন্দরে অল্পক্ষণ থেকে স্টিমার আবার চলল। শীতল উত্তরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। দুপুরে ক্রিস্টিয়ান্সুন্ড নামক ছবির মত সুন্দর শহর এল। নরওয়ের বৈশিষ্ট্য অনুসারে ঘরবাড়িগুলি পরিষ্কার, সুন্দর এবং কাঠের তৈরি। সন্ধ্যায় স্টিমার পৌঁছায় ড্রন্থাইমে। সেখান থেকে রাতে নর্থকেপের উদ্দেশ্যে নতুন স্টিমারে উঠলেন তাঁরা। গভীর রাত হলেও স্টিমার যখন ছাড়লো সূর্যের আলো রয়েছে। (নরওয়েকে নিশীথ সূর্যের দেশ বলা হয়)। মেরুসাগর থেকে আসা হাওয়ার প্রচন্ড ঠান্ডা পরিবেশ। তাছাড়া দিনটি মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। অসংখ্য দ্বীপ আর খাড়ি দেখা যেতে লাগল স্টিমারের দুদিকে। বেশিরভাগ জায়গার জমি এখানে নিষ্ফলা, দু এক জায়গায় অল্প কৃষি হয়েছে। এখানে কড আর হেরিং মাছ ধরা হয়। এই দুটি নরওয়ের একমাত্র রপ্তানির দ্রব্য। বিকেলে টরঘাট্টেন নামের একটা ছোট দ্বীপে নেমে দুধ আর লেমোনেড খেলেন তাঁরা। সেভেন সিস্টার্স অফ এলস্টেনো নামে সাতটি সুউচ্চ শৃঙ্গ সমুদ্র থেকে উপরে উঠেছে এখানে। তাদের মাথায় বরফের চূড়ায় কুয়াশার ঘোমটা টানা। সেদিন মধ্যরাতে লেখক মেরু রেখা পার করে মেরু প্রদেশে পৌঁছালেন। সকালে ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জল আবহাওয়া পেলেন তাঁরা। বোডো শহর পেরিয়ে নরওয়ের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের দ্বীপপুঞ্জ দেখতে দেখতে তাঁরা  রাফটারসুন্ডে এলেন। অসাধারণ সুন্দর পাহাড়, উপত্যকা, খাড়ি চোখে পড়ল। হিমশৈল আর পাহাড়ের উপরের অপরূপ বরফের দৃশ্য দেখতে দেখতে রাত দশটায় যখন ঘুমোলেন তখনও পাহাড়ের উপর সূর্যের আলো রয়েছে। 

পরদিন ট্রোমোসো শহরে স্টিমার নোঙর করল। তাঁরা ট্রোমোসো ডেল-এ পায়ে হেঁটে বেড়ালেন। তাঁরা এখন নরওয়ের ল্যাপল্যান্ডে এসেছেন, যেখানে একসময় শুধু ল্যাপ উপজাতির মানুষের বসবাস ছিল। ল্যাপেরা খর্বকায় হয় এবং তারা বলগা হরিণের চামড়ার পোশাক পরে। বার্চ গাছের ছাল ও ঘাস দিয়ে কুঁড়েঘর বানায়। ঘরের মাথায় গর্ত থাকে আলো ঢোকার ও ধোঁয়া বেরোবার জন্য। বাচ্চারা কুঁড়েঘরে চামড়ার দোলায় শক্ত করে বাঁধা থাকে, তারা হাত-পা নাড়াতে পারে না কারণ শুধুমাত্র মুখটা বাইরে থাকে। ল্যাপদের চোয়ালের হাড় বেশ উঁচু। বলগা হরিণ তাদের একমাত্র সম্পত্তি। তারা ভ্রমণার্থীদের এখন হাড়ের তৈরি চামচ-ছুরি, চামড়ার ব্যাগ-জুতো বিক্রি করে। ট্রোমোসোর রাস্তায় বেশ কিছু মেরু অঞ্চলের পশুর লোম ও চামড়া বিক্রি হতে দেখলেন লেখক। স্টাফড ভাল্লুক, মেরু নেকড়ে, সাদা শেয়াল, তিমি, হাঙর, ওয়ালরাস, ঈগল, সীগাল প্রভৃতিও বিক্রি হতে দেখলেন। 

ট্রোমোসো ছেড়ে সন্ধ্যায় আবার স্টিমার যাত্রা শুরু হল। পথে একটি অসাধারণ হিমশৈল দেখলেন। পরদিন হ্যামারফেস্ট (যেটি পৃথিবীর উত্তরতম শহর) শহরে গেলেন লেখক। কিছু কুঁড়েঘর আর গির্জা আছে সেখানে শুধু। শীতকালে বরফে ঢাকা থাকে। স্লেজ গাড়ি একমাত্র যানবাহন। হ্যামারফেস্ট-এ মাছ ধরা আর মাছের প্রক্রিয়াকরণ হয়। হ্যামারফেস্ট ছেড়ে সমুদ্রে বার্ডস রক নামক এক স্থানে তারা অগণিত সীগাল দেখলেন। স্টিমার থেকে কামানের গোলার আওয়াজ করা হলে পাখিরা উড়তে শুরু করল চক্রাকারে। তাদের ওড়ার সময় মনে হচ্ছিল মেঘ। এত পাখি পৃথিবীর কোথাও একসঙ্গে তিনি দেখেননি। 

দু'ঘণ্টা পরে স্টিমার এল নর্থ কেপে। নর্থ কেপ সমুদ্র থেকে সোজা হাজার ফুট উপরে উঠে গেছে। এখানে ইউরোপ শেষ। এরপরের মেরু সাগর যে মেরু প্রদেশে গেছে তা কোন মানুষ কখনো দেখেনি (নরওয়ের অভিযাত্রী ১৯২৬ -এ প্রথম উত্তর মেরু গেছিলেন)। তাঁদের স্টিমার দক্ষিণ দিকে ফিরতি পথে চলতে শুরু করল। হ্যামারফেস্টের পরে এল লিঙ্গেন খাড়ি। নরওয়ের অন্যান্য সমুদ্রের খাড়ির মতো এখানেও সমুদ্রের জল ৩০-৪০ মাইল স্থলভাগের মধ্যে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হয় সুন্দর হ্রদ, যার দুপাশে খাড়াভাবে হাজার ফুট উঁচু পাহাড় উঠে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় ৩০০০-৪০০০ ফুট উঁচু পাহাড় রয়েছে আবার কোথাও কোথাও পাথরগুলো পিছনে সরে অববাহিকা তৈরি করেছে। সেখানে ছোট ছোট ঝরনা চারপাশ থেকে এসে একত্রিত হয়েছে। প্রতিটি খানাখন্দে বরফের বিশাল বিশাল চাই জমে রয়েছে। পাহাড়ের গা দিয়ে রূপালী ঝরনা নামছে আর নামছে হিমবাহ। হিমবাহের গতি এত মন্থর যে চোখে তার গতি ধরা পড়ে না। এই বৈচিত্র্যময় নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে তাঁরা মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে কাটালেন। 

এবার ট্রোমোসো হয়ে লোফাডেন দ্বীপপুঞ্জের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অস্তমিত সূর্যের সোনালী আলোতে কী যে অপার্থিব রূপ ধারণ দেখলেন তা বলার নয়। রাত ১১ টায় সূর্যাস্ত শেষ হল। ঘুম আসতে রাত দুটো হল, কিন্তু তখন পূর্ব আকাশে সূর্যোদয় শুরু হল। এরপর তাঁরা সার্টিসেন নামক ইউরোপীয় বৃহত্তম হিমবাহটি দেখলেন, যেটি আশি মাইলের বেশি লম্বা। তাঁরা হিমবাহের উপরে কিছুটা হাঁটলেন। ২ আগস্ট ১৯৮৬, এই স্টিমারে আট দিন ভ্রমণ করার পর তাঁরা ট্রন্ডজেম শহরে এলেন। 


এই কদিনে তাঁরা ৬৩ ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমাংশ থেকে ৭১ ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমাংশ ঘুরে এলেন। ট্রন্ডজেমে সেন্ট ওলাফের (ইনি সুইডেনকে নরওয়ের থেকে স্বাধীন করেন ও প্রথম সুইডেনের রাজা) সমাধির ওপর অনেক শতাব্দি প্রাচীন ক্যাথিড্রল রয়েছে। 


৩ আগস্ট তাঁরা ৫৩০ মাইল দূরে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের উদ্দেশ্যে রেলপথের রওনা দিলেন। নরওয়ে ও সুইডেনে সীমান্তে থাকা কিওনলেন পর্বত পেরিয়ে স্টোরলিন এল, যা এ পথের প্রথম সুইডেনের শহর। ঘন সবুজ পাইনে ঢাকা পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, মনোরম হ্রদের অনুপম দৃশ্য চোখে পড়তে থাকল ট্রেনে জালনা দিয়ে। জনসংখ্যা খুব কম। গ্রামের ছোট কাঠের বাড়ি কিছু দেখা গেল। আরেসস্কুটান পাহাড়ের নীচে অবস্থিত আরে, ডালেফ,  ক্রিলবো ইত্যাদি হয়ে ট্রেন এল সালাতে। এরপর দেশের ভূপ্রকৃতি সমতল হতে শুরু করল। ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর উপসালাতে ট্রেন বদল করে কিছুক্ষণ কাটালেন। গথিক স্টাইলে তৈরি প্রাচীন ক্যাথিড্রাল, গুস্তাভা ভাসার সমাধি, বিজ্ঞানী চার্লস লিনিয়াসের সমাধি ও সৌধ, বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরী দেখলেন। লাইব্রেরিতে পার্চমেন্ট পেপারে সোনা ও রুপার হরফে লেখা প্রাচীন গথিক ভাষার পুঁথি রয়েছে। 


এরপর ট্রেনে চড়ে তাঁরা রাতে স্টকহোম পৌঁছালেন। স্টকহোমের জনঘনত্ব বেশ কম কিন্তু এটি পৃথিবীর একটি সুন্দরতম শহর। লেক মালারেন ও বালটিক সাগরের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বেশ কিছু দ্বীপ দিয়ে গঠিত এই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরিসীম। শহরটি সমুদ্রের উত্তর উপকূলে নরমালমেন ও দক্ষিণ উপকূলে সডারমালমেন নামে পরিচিত। মূল ভূখণ্ড স্টাডেন ও অন্যান্য দ্বীপ নিয়ে তৈরী। ব্রিজ দিয়ে নরমালমেন থেকে স্টাডেন দ্বীপে এসে রাজপ্রাসাদ, বলরুম, গ্যালারি, চার্চ, সমাধিক্ষেত্র দেখা হল। সডারমালমেনে শহর উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত। লিফটের সাহায্যে মুহূর্তে নীচ থেকে উপরে পৌঁছানো যায়। উপর থেকে বালটিক সাগর ও সেখানে নোঙর করা অসংখ্য স্টিমারের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখায়। নরমালমেনের দৃশ্যও দেখা যায়। 


এবার তাঁরা বালটিক সাগরে স্টিমারে করে গুস্তাভবার্গ নামক স্থানে ঘুরে এলেন। এই যাত্রায় তাঁরা অপূর্ব প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দিত গ্রামীণ জীবনের ছবি দেখে এলেন। সুইডেন ও নরওয়ের মানুষ সরল ভদ্র ও হাসি খুশি। তাদের আনন্দিত মুখে ইংরেজ সুলভ অহংকার ছাপ নেই। এরা খুব উপকারী। স্টকহোমে লেখক পার্লামেন্ট, ন্যাশনাল লাইব্রেরী, ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেখলেন। 


এরপর তাঁরা স্টিমারে বালটিক সাগর ও নর্থ সী হয়ে গোটেনবার্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পরদিন স্টিমারে রোসেন লেকে এল। এরপর স্টিমার ১৫ টি লেক পার হল এবং ১৫০ ফুট উপরে উঠল। মাত্র ৮ মাইল দূরত্বে ১৫০ ফুট উপরে ওঠা খুব আকর্ষণীয় বিষয়। একটার পর একটা গেট সামনের দিকে খুলে গেল ও পিছনে বন্ধ হল এবং প্রতি বার স্টিমার দশ ফুট করে উপরে উঠে গেল। শেষে তাঁরা লেক বোরেনে এলেন। সেখান থেকে ভেটের্ন লেক, ভাইকেন লেক, ভেনার্ন লেক দেখতে দেখতে ট্রোলহাট্টান জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছলেন। গোটা নামের নদীতে স্টিমারে করে নীচে গোটেনবার্গ এলেন। এই বন্দর নগরী একটি বাণিজ্য কেন্দ্র। লেখক যখন গেলেন তখন সেখানে বার্ষিক মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। 


পরবর্তী গন্তব্য ক্রিস্টিয়ানা। গোটা নদী হয়ে বালটিক সমুদ্রে পড়ে স্টিমার এবার চলতে থাকল। অশান্ত সমুদ্র আর ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে প্রাচীন ভাইকিং -দের নৌযাত্রার জায়গায় এই অস্থির স্টিমার যাত্রায় তাঁরা শঙ্কিত হলে উঠলেন। (ভাইকিংরা ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের সামুদ্রিক যোদ্ধা, যারা ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের বিভিন্ন স্থান আক্রমণ ও বসতি স্থাপন করেছিল)। (১৯২৫ -এ ক্রিস্টিয়ানা নাম পরিবর্তন হয়ে নাম হয়েছে অসলো, এটি নরওয়ের রাজধানী)। 

অবশেষে ১৩ আগস্ট স্টিমার ক্রিস্টিয়ানা পৌঁছাল। সেখানে তাঁরা রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয় দেখলেন। এখানে লেখক সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যা দেখলেন তা দুটি ভাইকিংদের ব্যবহৃত জলযান, যা সম্ভবত নবম শতাব্দীর। ভাইকিং যোদ্ধাদের কবর খুঁড়ে এদুটি সম্প্রতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এরপর লেখক স্টিমারে করে ইংল্যান্ড প্রত্যাবর্তন করলেন।

                        (চলছে)

২টি মন্তব্য:

  1. পর্বটিতে লেখকের নরওয়ে ও সুইডেনের নানান স্থানের এক মনোরম যাত্রার বর্ননা পড়লাম। সেভেন সিস্টার অফ এলস্টেনোর সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে মাথার উপর বরফের চূড়ায় কুয়াশার ঘোমটার দৃশ্য কল্পনাতে হৃদয় শিহরিত হলো।সার্টিসেন নামক ইউরোপীয় বৃহত্তম হিমবাহর উপর দিয়ে হাঁটার লেখকের এক অভূত অভিজ্ঞতায় আকর্ষিত হলাম। সুন্দর পর্বটি।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...