বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৬১। ইউরোপে তিন বছর ৭ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)

  এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - ইতালি ।

২৫ শে নভেম্বর ১৮৮৬ ইতালির ভেরোনা শহর ঘুরে দেখলেন রমেশ চন্দ্র দত্ত। সরু কিন্তু পরিচ্ছন্ন রাস্তায় ঘোরার সময় তাঁর কখনো কখনো মনে হচ্ছিল তিনি কোনো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভারতীয় শহরে রয়েছে। বাড়িগুলোর মধ্যে ভারতীয় ধাঁচের বড় চৌকো উঠোন আছে। অনুকূল আবহাওয়া আর উর্বর মাটি ভারত আর ইতালিতে প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল, যখন পৃথিবীর অধিকাংশ অন্য দেশে সভ্যতার চিহ্নমাত্র ছিল না। দশম শতাব্দীর পরে ভারত আর ইতালি দুটি দেশই বৈদেশিক শক্তির আক্রমণে জর্জরিত হয়েছে। প্রাচীন রোমান সভ্যতার কিছু নিদর্শন এখনো ভেরোনায় রয়েছে। অ্যারেনা বা আম্ফিথিয়েটার তার মধ্যে প্রধান। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে সম্পূর্ণ মার্বেলে তৈরি এই অ্যারেনাতে ২২ হাজার মানুষ একত্রে বসে সেকালের রোমের হিংস্র খেলাগুলি দেখত। রয়েছে পোর্তা দেই বর্সারি - রোমান আমলের নগরের প্রবেশদ্বার। শহরের কেন্দ্রে রয়েছে প্যালেস অফ কাউন্সিল ও বর্তমান ইতালির শ্রেষ্ঠ কবি দান্তের মর্মর মূর্তি। এছাড়া রোমিও জুলিয়েটের রোমিওর বাড়ি বলে প্রচলিত মধ্যযুগীয় প্রাসাদ এখানে দর্শনীয়। 


সেদিন সন্ধ্যায় তিনি ভেরোনা ত্যাগ করে ফ্লোরেন্স আর রোমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সে রাতে তিনি মন্টুয়া হয়ে বোলোগ্না শহরে এলেন। বোলোগ্না শহর আরকেডে বা আর্চে ঢাকা পথে পূর্ণ। এখানকার ভিক্টর ইমানুয়েল স্কোয়ারে নেপচুনের মূর্তি, চার্চ এবং কিছু প্রাচীন প্রাসাদ রয়েছে। কাছে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেশ কিছু প্রাচীন গির্জা। এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হল দুটি হেলান টাওয়ার, যা দ্বাদশ শতাব্দীর ইঁটের তৈরি। ২৭২ ফুট ও ১৩০ ফুট উঁচু মিনার দুটি মাটি থেকে লম্বভাবে না থেকে কিছুটা ঝুঁকে রয়েছে, দেখে মনে হয় পড়ে যাবে। ইটালিয়ান শিল্পী ভাতৃদ্বয় রেনী আর ক্যারাক্সির জন্ম বোলোগ্নাতে হয়েছিল। এই শিল্পীদের আঁকা মূল্যবান ছবি এখানকার একাডেমিতে আছে। এখানকার সমাধিক্ষেত্র কাম্পো সান্তো ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর সমাধিস্থল। এখানে অনেক প্রসিদ্ধ মানুষের সমাধি, তাঁদের মূর্তি রয়েছে যা দর্শনীয়। 


বোলোগ্না থেকে যাত্রা করে রেনো নদী পেরিয়ে, অনেক টানেল পার হয়ে পিসতোজা (যেখানে প্রথম পিস্তল তৈরি হয়েছিল) হয়ে ফ্লোরেন্সে পৌঁছলেন লেখক। আর্নো নদীর তীরে ফ্লোরেন্স খুব সুন্দর শহর। চারদিক ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা ফ্লোরেন্স ইউরোপে তথা পৃথিবীকে প্রাচীন যুগের অবসান ঘটিয়ে মধ্যযুগের আলো দেখিয়েছিল। এই শহর কবিতা, সাহিত্য, শিল্প, ভাস্কর্য, বিজ্ঞানে যে চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল তার তুলনা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। গ্যালিলিও, দান্তে, পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো প্রমুখ সকলের জন্মস্থান এই ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্সের উফিজি ও পিত্তি এই দুটি আর্ট গ্যালারির সংগ্রহ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাছাড়া ক্যাথিড্রাল, বেল ফ্রী এবং ব্যাপটিস্ট্রি অবশ্যই দর্শণীয়। মেদিচিয়ানে চ্যাপেল একটি অপূর্ব স্থাপত্য, যার ভেতরের দেওয়ালগুলি ১৮ রকম মার্বেল ও নানা রকম মূল্যবান দ্রব্য দিয়ে তৈরি। মেদিচি পরিবারের এই সৌধে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর তৈরি কিছু ভাস্কর্য এখানে রয়েছে। যেমন দিন, রাত, ভোর, গোধূলি; যেগুলি রেনেসাঁ যুগের শিল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিছু অসমাপ্ত কাজও রয়েছে কারণ মাইকেল এঞ্জেলো এরপর রোমে চলে যান। (মেদিচি ইতালির একটি ধনী পরিবার, যাঁরা রেনেসাঁ যুগে ফ্লোরেন্সের শাসন করতেন। তাঁরা শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই পরিবারের সদস্যরা অনেকে পোপ এবং বিভিন্ন স্থানের শাসক ছিলেন)। এবার লেখক দেখলেন সান ক্রোচে গির্জা, সেখানে তিনি বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর সমাধি দেখলেন এবং তাঁর স্মরণে তৈরি টেলিস্কোপ হাতে তাঁর মূর্তি দেখলেন। মাইকেল এঞ্জেলোর সমাধি দেখলেন, সঙ্গে তিনজন নারীর মূর্তি যারা চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের প্রতীক। রাজনীতিবিদ ম্যাকিয়াভেলির সমাধিও দেখলেন। কবি দান্তের সমাধি এখানে না থাকলেও তাঁর ১৮ ফুট উঁচু মূর্তি রয়েছে যেটি ২২ ফুট উঁচু বেদির উপর বসানো রয়েছে। 


এরপর লেখকের গন্তব্য রোম, যা লেখকের মতে ভালো করে দেখতে অন্তত এক মাস সময় দরকার। লেখক এখানে চার দিন কাটিয়েছিলেন। রোমের উপর একটি আস্ত বই লেখা যায় বলেছেন লেখক, তবে তিনি শুধু সারমর্ম টুকু লিখেছেন বলে জানিয়েছেন। রোম দেখা শুরু হয় ফোরাম থেকে। রোমের ফোরাম ছিল প্রাচীন রোমের জনসাধারণের প্লাজা এবং শহরের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এটি প্যালাটিন পাহাড় ও ক্যাম্পিডোগলিও পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত। ফোরাম রোমের প্রাচীন সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবার ভায়া সাকরা নামক পথ ধরে দর্শনীয় স্থান দেখতে শুরু করলেন লেখক। এই রাস্তাটি রোমের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, যা রোমের ফোরাম থেকে ক্যালিনিন পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো এবং রোমান বিজয়ীদের পদচারনার পথ ছিল। প্রথম এল ট্যাবুলারিয়াম, যেখানে টেবিলস অফ ল লিখিত ছিল (১২ টি টেবিল যাতে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান আইনকানুন জনগণের জন্য প্রদর্শিত ছিল)। এরপর দেখা যায় সেভেরাসের আর্চ নামক স্মৃতিসৌধ। ভেস্পাসিয়ান মন্দিরের ভগ্নাবশেষ রয়েছে এরপরে। আছে স্যাটার্ন মন্দিরের কিছু স্তম্ভ। তারপর দেখা গেল বেসিলিকা জুলিয়ার ভগ্নাবশেষ, যা জুলিয়াস সিজারের শুরু করা ও উত্তরসূরীদের শেষ করা। এটি প্রধানত আইনগত ও বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে ব্যবহৃত হতো। এরপর কাস্টর এবং পলুস্ক মন্দিরের কোরিনথিয়ান পিলার চোখে পড়ে। এরপর এল রেগিয়া যেখানে জুলিয়াস সিজার মৃত্যুকাল পর্যন্ত ছিলেন। এরপর  ভেস্টার মন্দির, যেখানে পবিত্র অগ্নি রাখা থাকত এবং ভেস্টার কুমারীরা থাকতেন সেখানে সেই আগুন রক্ষা ও সর্বদা প্রচলিত রাখার জন্য। ভেস্টার কুমারীদের থাকার প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। এরপর টেম্পল অফ ফস্টিনার দশটি সুন্দর স্তম্ভ এখনো রয়েছে। তারপর সম্রাট ভেস্পাশিয়ানের নির্মিত সুবিশাল ব্যাসিলিকা অফ কনস্ট্যানটাইনের ধ্বংসাবশেষ। এবার আসে টিটাসের আর্চ, এটি প্রায় অক্ষত আছে। ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের বিজয়ের স্মরণে এটি তৈরি। আর্চের ভাস্কর্যে রোমান সামরিক বিজয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি ভেনাসের মন্দির। এরপর মেটা সুডানস নামের ফোয়ারা, যাতে হাত-পা ধুয়ে গ্ল্যাডিয়েটাররা কলোসিয়ামে প্রবেশ করত। আর্চ অফ কনস্ট্যান্টিন পেরিয়ে বিশাল কলোসিয়াম দাঁড়িয়ে আছে। এটি অতি বৃহৎ অ্যাম্ফিথিয়েটার যেখানে গ্লাডিয়েটরের যুদ্ধ, প্রাণী ও মানুষ নিধন, জনসাধারণের বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হতো। সম্রাট ভেসপিয়ান এটির নির্মাণ শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র টিটাস এটি শেষ করেন ৮০ খ্রিস্টাব্দে। এখানে এক লাখ দর্শক বসে দেখতে পারত অনুষ্ঠান। পাঁচ হাজার বন্য পশু, দশ হাজার বন্দী মানুষ এই কলোসিয়ামের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে টিটাস কর্তৃক বলিপ্রদত্ত হয়। পরে পূর্ব-পশ্চিমের অনেক বন্দী, খ্রিস্টান, গ্ল্যাডিয়েটরকে এখানে হত্যা করা হয়েছে সাহসী ও নিষ্ঠুর রোমবাসীর উত্তেজিত দৃষ্টির সামনে। পরবর্তীকালে এখানকার পাথর ইত্যাদি অনেকাংশে রোমের অনেক ঘরবাড়ি রাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে, এখন তাই কলোসিয়াম অনেক অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত। অন্যদিকে প্যালাটাইন পাহাড়ের উপরে সুপ্রাচীন রোমান রাজা টারকুইনের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, জুপিটার স্টাররের মন্দির আর রোমের কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা রমুলাসের তৈরি (বলে প্রচলিত) সৌধের প্রাচীন দেওয়াল রয়েছে। এর কাছে রয়েছে ভেসপিয়ানের তৈরি প্রাসাদ, অগাস্টাসের তৈরি প্রাসাদের প্রায় বিলুপ্ত অংশ। এরপরের দর্শনীয় স্থান কারাকাল্লার স্নানাগার, যা সম্রাট কারাকাল্লার শাসনকালে তৈরি প্রাচীন জন স্নানাগার। এটি স্নান, ব্যায়াম ছাড়াও নানা বিনোদনমূলক কাজে ও সকলের মেলামেশা স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়া রোমে ডায়োক্লেশনের স্নানাগার নামে আরেকটি প্রাচীন স্নানাগার আছে। এই স্নানাগারের একটি অংশ মাইকেলেঞ্জেলো একটি চার্চে রূপান্তরিত করেন। রোমের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল প্যান্থিয়ন। প্যান্থিওন রোমের একটি প্রাচীন মন্দির যা সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের তৈরি। বর্তমানে এটি গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্যান্থিয়ান তার বিশাল গম্বুজের জন্য বিখ্যাত। প্রখ্যাত শিল্পী রাফায়েল এখানে সমাহিত আছেন। পিলার অফ ট্রাজান সম্রাট ট্রাজানের যুদ্ধবিজয়ের স্মরণসৌধ। পিলার অফ অ্যান্টনিনাস সম্রাট অ্যান্টনিনাসের স্মরণে তৈরি। রোমের প্রাচীন সভ্যতার আরেকটি দর্শনীয় নিদর্শন হল অ্যাকুই ডাক্ট, যা প্রাচীন রোমের জল সরবরাহ ব্যবস্থা। এটি সাধারণত একাধিক পিলারের উপর নির্মিত একটি কাঠামো, যা দূরবর্তী জলের উৎস থেকে শহরের ভিতর জল আনত। উন্নত জল প্রকল্প ছাড়াও প্রাচীন রোমে উন্নত জলনিকাশি ব্যবস্থা ছিল, একে ক্লোয়াকা মাক্সিমা বলা হতো। এই দুটি উন্নত প্রযুক্তির উদাহরণ বর্তমানে দর্শনীয় স্থান বলে বিবেচিত। রোমে তিনশোর বেশি গির্জা আছে, তার মধ্যে বেশ কিছু দর্শনীয়। সেন্ট পলস চার্চ, সেন্ট জন ল্যাটেরান চার্চ, সেন্ট মারিয়া, মাগিওর চার্চ প্রভৃতি। লেখক এবার দেখলেন ক্যাটাকম অফ সেন্ট ক্যালিক্টাস। এটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরি খ্রিস্টীয় কবরখানা ও ধর্মীয় স্থান। এখানে প্রথম যুগের খ্রিস্টানেরা গোপনে প্রার্থনা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান করত। সেন্ট সিবাস্টিয়ান চার্চ ক্যাটাকমের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে অনেক খ্রিস্টান শহীদ সমাহিত ছিলেন। রোমের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলি প্রাচীন রোমান ধর্মের বিনাশ আর ক্যাটাকমগুলি নতুন খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশের প্রতীক।
 
                          (চলছে)

২টি মন্তব্য:

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...