বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

৫৯। ইউরোপে তিন বছর ৫ রমেশ চন্দ্র দত্ত

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


                (আগের পর্বের পরে)


এই পর্বে সংশ্লিষ্ট দেশ - বেলজিয়াম, হল্যান্ড।

২ নভেম্বর ১৮৮৬ লেখক পরিবারকে ইংল্যান্ডে রেখে একা জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি প্রভৃতি বারোটা দেশে দেড় মাসের জন্য ভ্রমণ করেন। লন্ডনের হোয়াইট ক্লিফ অফ ডোবার থেকে লেখকের স্টিমার যাত্রা শুরু হয়। 

জলপথে বেলজিয়ামের প্রথম শহর এল ওস্টেন্ড। এখানে বেলজিয়ামের রাজপ্রাসাদ রয়েছে। এখানেই ইউরোপের একটি জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত রয়েছে। এরপর এল প্রাচীন শহর ব্রুগেস, যেটি একসময় ইউরোপের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। এখানকার নত্র ডাম অনেক প্রাচীন এবং সুউচ্চ। এখানে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির সমাধি, বিভিন্ন মূল্যবান, পেন্টিং প্রভৃতি রয়েছে। এখানকার বেল ফ্রী অর্থাৎ ঐতিহাসিক ঘন্টাঘর, যা বেলজিয়ামের শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে, তা দর্শনীয়। আর রয়েছে হোটেল দি ভিল, চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত বিখ্যাত বাজার এলাকা। এর পরবর্তী শহর ঘেন্ট। এখানে দর্শনীয় ক্যাথিড্রাল, বেলফ্রি, হোটেল দি ভিল (সিটি হল), বাজার, কাউন্ট ফ্ল্যান্ডার্স-এর প্রাচীন প্রাসাদ। 

পরবর্তী শহর ব্রাসেলস, যা প্যারিসের মতো দৃষ্টি নন্দন শহর। এখানে বুলেভার্ড আছে প্যারিসের মতো। এখানকার প্যালস দি জাস্টিস (বিচারালয়), কাউন্ট এগমন্ট ও কাউন্ট হুরন- এর মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, রাজ, ক্যাথিড্রল, হোটেল দি ভিল, কংগ্রেস কলাম দর্শণীয়। 

ব্রাসেলস থেকে ওয়াটারলু যুদ্ধক্ষেত্র (যেখানে ১৮১৫ তে হওয়া যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের পতন হয়) মাত্র ৪০ মিনিটের পথ রেলে। শাতো অফ হুগম নামক স্থানে লেখক দেওয়ালে গুলির চিহ্ন দেখলেন। 

অ্যান্টওয়ার্প এখন বেলজিয়ামের সামরিক কেন্দ্র। তাছাড়া প্রখ্যাত চিত্রকর রুবেন্স, ভ্যান ডাইকের জন্য বিখ্যাত। এখানকার ক্যাথিড্রালটি নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গথিক স্থাপত্য। এছাড়া হোটেল দি ভিল, মিউজিয়াম রয়েছে। 


অ্যান্টওয়ার্প থেকে লেখক হল্যান্ডের রটারডামে গেলেন ট্রেনে। এই পথে ট্রেন বিখ্যাত হল্যান্ডইচ ডিপ নদীর উপর ব্রিজ পার হল রেল। রটারডামে শহরের উপর দিয়ে লোহার ব্রিজ বা ভায়াডাক্ট ( সেই সময় নদীর ওপর দিয়ে ব্রিজ ও শহরের ওপর দিয়ে ওভার ব্রিজ ট্রেন যাওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রশংসনীয়) রয়েছে, যার উপর দিয়ে আর্মস্টারডাম গামী ট্রেন যায়। এমনিতে এটি একটি সাধারণ ডাচ শহর কিন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। 

এরপর লেখক হেগ গেলেন। এটি রটারডামের থেকে ঐতিহাসিক ও সৌন্দর্যগতভাবে উল্লেখযোগ্য স্থান। এখানে রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট ও হল্যান্ডের সরকারের প্রধান কার্যালয়গুলি আছে। হেগের বিনেনহফ একটি মধ্যযুগীয় দুর্গ, যার চারপাশে পরিখা আছে। বুইটেনহফ এক ঐতিহাসিক প্রাসাদ, যেখানে ডাচ পার্লামেন্ট ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি অবস্থিত। এছাড়া আছে টাউন হল, পিকচার গ্যালারী। 

হেগের পর লেখক গেলেন হল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় নগরী লেইডেনে। এই শহরকে জ্ঞানচর্চার জন্য 'এথেন্স অফ টি ওয়েস্ট' বলা হয়। এখানকার মিউজিয়ামটি অবশ্য দর্শনীয়। এখানে ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, গনেশ, দুর্গা প্রভৃতি ভারতীয় দেবদেবীর প্রাচীন মূর্তি রয়েছে। এগুলি ডাচদের জাভা উপনিবেশ থেকে আনা। ভারতীয় ধর্মের জাভায় প্রচলন প্রমাণ করে যে বর্তমানে (লেখকের সময়) কালাপানি পার হওয়া নিয়ে যে হিন্দু কুসংস্কার প্রচলিত তা সুদূর অতীতে ছিল না। 

এবার লেখক হারলেম হয়ে রাজধানী আর্মস্টারডাম গেলেন। একাদশ শতকে আর্মস্টেলের লর্ড আর্মস্টেল নদীতে একটি ড্যাম বা বাঁধ তৈরি করেন, সেই থেকে নাম হয় আর্মস্টার্ডাম। এই শহরের আশ্চর্য বিষয়টি হল এই শহরটি অসংখ্য খালের দ্বারা ৯০ টি দ্বীপে বিভক্ত ও দ্বীপগুলি প্রায় ৩০০ টি ব্রিজ দিয়ে যুক্ত। তাছাড়া শয়ে শয়ে নৌকাও শহরের সর্বত্র যাতায়াত করে। খালগুলির দুপাশে সারি দিয়ে কাঠের তৈরী বাড়িগুলি 'পাইলস অফ উড' বা কাঠের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ এখানকার দোয়াশ মাটিতে ইঁটের ভিত টেকসই হয় না।  রাজপ্রাসাদ, পার্লামেন্ট সবেতেই একই ব্যবস্থা। চার্চ, মিউজিয়াম দর্শনীয়। 
এখান থেকে লেখক উত্তর হল্যান্ডের হেল্ডার ঘুরে এলেন। 

আর্মস্টার্ডম ছেড়ে লেখক ঐতিহাসিক শহর জানডামে এলেন ও অনেক জঙ্গল, উইন্ডমিল দেখতে পেলেন। তারপরের স্থান আলকমার, এখানে মূলত চিজ-এর ব্যবসা হয়। এরপর এল হেলডার, যা একটি মৎস্যজীবীদের গ্রাম। হল্যান্ডে লেখকের শেষ গন্তব্য ছিল সমুদ্র সৈকত জুইডার জী, যেখানে তিনি স্টিম ট্রামে করে গেলেন। এটি একটি ইনল্যান্ড সী বা অভ্যন্তরীণ সাগর। তিনি শুনলেন এই সমুদ্রকে কৃষি ও পশুচারণের স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বিংশ শতাব্দীতে তাই করা হয়েছে, যা ডাচ ইঞ্জিনিয়ারিং -এর একটি অন্যতম আশ্চর্য নিদর্শন। 

                           (চলছে)

                      

২টি মন্তব্য:

  1. লেখকের ভ্রমণের কাহিনী পড়তে পড়তে নিজের ও যেন হল্যান্ড- বেলজিয়াম হল্যান্ডের "এথেন্স অফ টি ওয়েস্ট "ও রাজধানী আর্মস্ট্রারডাম আর আর্মস্ট্রারডামে খালের দুধারের কাঠের তৈরি বাড়ির সুন্দর বর্ননা পড়ে ঐসব স্থানের ভ্রমণ করে ফেললাম যেন।
    শিউলি

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...