মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০২৪

১৯। তীর্থ ভ্রমণ ৪ যদুনাথ সর্ব্বাধিকারী

 সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক 

                  -------  সুমনা দাম


                 (আগের পর্বের পরে)

সেকেন্দ্রার থেকে বেউরগ্রাম(?), বিগরাই-এর বাজার সরাই (বিঘ্রাই, উত্তরপ্রদেশ) মিঠেপুর (মিঠেপুর), শকুয়াবাদ (শিকোহাবাদ), রাজার টাল (রাজা কা টাল), উশানী (ইন্দানী) হয়ে খাঁদানি (?) পৌঁছানো হলো পঞ্চম দিনে। সেখানে দুজন বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী লেখকদের সঙ্গী হলেন। লেখক শুনেছিলেন যে কাশীর কেশেল, প্রয়াগের প্রয়াগী আর বৃন্দাবনের কুঞ্জবাসী তিন সমান। তারা যাত্রীদের প্রায় ডাকাতি করে অর্থ হরণ করে। লেখক তাদের বললেন যে তাঁরা প্রথমে আগ্রা যাবেন। সঙ্গের টাকা শেষ, আগ্রায় গিয়ে টাকা সংগ্রহ করবেন, তারপর বৃন্দাবন যাবেন। বৃন্দাবনে কুঞ্জবাসীর কুঞ্জে থাকবেন না, বাড়ি ভাড়া করে থাকবেন। এই কথায় তারা বুঝল যে লেখকের কী অভিপ্রায়। তখন তারা বলল কুঞ্জবাসীর অর্থ লোভের কাহিনী মিথ্যা নয় কিন্তু তারা যে সেরকম নয় তা পরীক্ষা করে দেখুন লেখক। তাছাড়া তারা লেখকের জন্য অর্থের বন্দোবস্ত করে দেবেন। ফলে তারা লেখকের সঙ্গে চলল। 

খাঁদানি থেকে বৃন্দাবন, মথুরা যাওয়ার দুটি পথ। একটি পথ পশ্চিম দিকে ডাকের যাতায়াতের, আগ্রা হয়ে আর এক পথ বলদেব হয়ে। লেখকেরা বলদেব হয়ে গেলেন। বলদেবের দর্শন হলো। এখানকার পান্ডারা নিষ্ঠুর ও ভীষণ আকৃতির। মাখন মিছরি ভোগ দিয়ে দর্শন করে পুরি কচুরি প্রসাদ পেয়ে সেখানে রাত্রি বাস। ব্রহ্মাণ্ড ঘাট দর্শনে গেলেন পরদিন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ মৃত্তিকা ভোজন করেছিলেন। লেখক বলেন সেখানকার মৃত্তিকা খেতে সুস্বাদু, ওই ঘাটে যমুনাতে স্নান তর্পণ করে গোকুল মহাবন পরিক্রমা করে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি, সূতিকা গৃহ, ষষ্ঠী পূজার ঘর, দধি মন্থনের স্থান, পুতনাবধ স্থান, গেন্দ খেলার আঙিনা, বন্ধন। ধূলা়খেলার স্থান ইত্যাদি দেখলেন।



সিকান্দার রাও থেকে বৃন্দাবন (বর্তমান গুগল ম্যাপে পায়ে হেঁটে)

 পরদিন গোকুল মহাবন থেকে নতুন গোকুল গেলেন ও দর্শন করলেন। তারপর যমুনা পার হয়ে মথুরা পৌছলেন। সেখানে বিশ্রাম ঘাটে স্নান, মুকুট দর্শনাদি করে, মথুরা মন্ডল দর্শন করে তিন ক্রোশ গিয়ে শ্রী বৃন্দাবন ধামে প্রবেশ করে দর্শন করলেন গোবিন্দ, গোপীনাথ, মদন মোহন এই প্রধান তিন মন্দির।মথুরায় যমুনার তীরে অনেক ঘাট পাকা বাঁধানো আছে আর অনেক ঘাটে শিব স্থাপিত আছেন। প্রধান ঘাট চব্বিশটি তাছাড়াও ধনীদের বাঁধানো আরও অনেক ঘাট আছে। মথুরা নগরে উত্তরদ্বার জয় সিংহপুরী, দক্ষিণ দ্বার কোগ্রাম। 


নগরের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ঘর রয়েছে। ছয় হাজার ঘর মুসলমান, বাকিরা হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যে চৌবের সংখ্যা অধিক। যেসব যাত্রী মথুরা বৃন্দাবনে আসে চৌবেরা তাদের মথুরা পরিক্রমা স্নান দান শ্রাদ্ধ দর্শন করিয়ে জীবন যাপন করে। এরা লেখাপড়া করে না আর দিনে চার বেলা সিদ্ধি খায়। মথুরায় নানা দেশের (সুরাট, বোম্বাই, গুজরাট, জয়পুর, বিকানীর, মাড়োয়ার, দিল্লি প্রভৃতি) ধনী সেঠেদের বাস। 


দ্বারকাধীশের  মন্দিরের সম্পত্তির পরিমাণ অতুল। মনি মুক্তার গহনা, বস্ত্র, ঝুলনের হিন্দোলা প্রভৃতির অমূল্য সম্ভার। প্রতিদিন তিনবার নতুন পোশাকে শৃঙ্গার হয়। দেবালয়ে মানুষ প্রতিদিন উত্তম আহার পায়। নিকটে রয়েছে কংস টীলা যেখানে কংস রাজার কেল্লা ছিল। 


শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমিকে মধুপুরি বলে। তার চারিদিকে চার দ্বারে চার অনাদি শিব আছেন। পূর্বদ্বারে পিঁপুড়েশ্বর, দক্ষিণদ্বারে রঙ্গেশ্বর, পশ্চিমদ্বারে ভূতেশ্বর ও উত্তরদ্বারে গোকর্ণেশ্বর। পশ্চিম দ্বারে মহেশ্বরী দেবীর মহাপীঠ, এখানে ভগবতীর অঙ্গ পতন হয়েছিল। এখানে দর্শনীয় রয়েছে ধ্রুবটীলা, সপ্তর্ষিটীলা বলিটীলা, কংশটীলা, মহাবিদ্যা দেবী। রয়েছে বলদেব জিউয়ের মন্দির, সেখানে স্বর্ণরৌপ্যের বড় আধিক্য। বড় বড় ধনী শিষ্য। সাধারণ মানুষের দর্শন করা কঠিন। শহরের মধ্যে কুব্জানাথের মন্দির।তার কাছে রাধা গোবিন্দজীউর মন্দির, রাধাকান্তজীউর মন্দির। এইসব মন্দিরে ১৫ দিন ব্যাপী ঝুলন হয়। দ্বারকাধীশের মন্দিরে একমাস ধরে ঝুলন হয়। 


মথুরায় ২৫ টি ঘাট ও তীর্থ। মধ্যখানে বিশ্রান্ত ঘাট যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলদেব কংশকে বধ করে বসে বিশ্রাম করেছিলেন। তার উত্তরে ১২ টি ও দক্ষিণে ১২ টি ঘাট। অগ্রহায়ন মাসে শুক্লা দশমীতে ওই স্থানে কংসবধ লীলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশাল মেলাও হয়।


মথুরায় স্থানে স্থানে বাজার আছে। হালওয়া পট্টি, কাপড়ের দোকান, গন্ধিদের দোকান, বিলাতি দ্রব্য সবই পাওয়া যায়। রাস্তার দুই পাশে উচু উঁচু বাড়ি, তার নিচে দোকান। একটি ভালো মসজিদ আছে, সেখানে মুসলমানেরা ঘটনা করে। এখানে কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, সদর আমিন, সদর আলার কাছারী আছে। সৈন্য ও সৈনাধ্যক্ষদের ছাওনি আছে। বাঙ্গালীঘাটাতে বাঙালিদের বাস। সাহেব আছে জন পঁচিশ। মথুরায় কেউ দুঃখী বা অভাবী নয়। স্ত্রী লোকেরা শ্রীসম্পন্না। তারা ঘাগড়া কাঁচলি, উড়ানি পড়ে। চৌবের স্ত্রী লোকেরা শাড়ি, উড়ানি পরে। এত ভালো দই লেখক আর কোথায় দেখেননি। এ ছাড়া খাজা, প্যাড়া, কুমড়ার মিঠাই, খাস্তা কচুরি, মগধের লাড্ডুও ভালো পাওয়া যায়। পশম বা উলের কাপড়ের অনেক দোকান আছে। কাবুলিওয়ালাদের আনা আনার, বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি পাওয়া যায়। বৃন্দাবন ধামে নানা দেশের ধনী ও সাধারণ মানুষের বাস। নানা দেবালয় স্থাপনা করে, দেব সেবা, সদাব্রত, ধর্মশালা, জলসত্র, দরিদ্র ভোজন, এমনকি বানর কচ্ছপ ময়ূর প্রভৃতি পশুপাখিদেরও খাদ্য বিতরণ প্রভৃতি চলেছে। নৃত্য গীত মহোৎসব শ্রীমৎ ভাগবত পাঠ প্রভৃতিও সর্বক্ষণ চলেছে। 


বৃন্দাবনের যমুনাতে দ্বাদশঘাট আছে, যথা কালিদহ, গোপাল ঘাট, আবির ঘাট, সিঙ্গার ঘাট প্রভৃতি। প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা কাহিনী যুক্ত। এছাড়া কেবার বন বা কেতকি বন, অটল বন, বিশ্রাম বাগ, রাধা বন, বংশী বট, গোপীশ্বর মহাদেব, পুলিন, নিধুবন, নিকুঞ্জ বন, লোটন বন প্রভৃতি অসংখ্য ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে। লেখক একে একে সব দর্শন করেন। প্রতিটি স্থানের মাহাত্ম্য তিনি সংক্ষেপে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন। 


এবার তিনি ব্রজভূমিতে চারিদেব অর্থাৎ বলদেব, হরদেব, কেশবদেব ও গোবিন্দদেব দর্শন করেন। এই স্থানগুলি বৃন্দাবন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত। লেখক এখানে তাঁর দুএকটি নিরীক্ষণ জানিয়েছেন। যেমন - মন্দিরগুলিতে যে ব্যক্তি যে রকম ভেট দেয়, সেই অনুসারে দর্শনের সুবিধা, সেই প্রসাদ শিরবস্ত্র প্রভৃতি পায়। ভেট না পেলে বিশেষত বাঙ্গালীদের ক্ষেত্রে দর্শনে বিশেষ ব্যাঘাত করা হয় কিন্তু অন্য দেশীয়রা যা দেয় তাই গ্রহণ করা হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য সনাতন গোস্বামী মথুরায় সাধনভজন কালে দৈববাণীতে মদনমোহনজীউ-এর মূর্তি লাভ করেন। সেই মূর্তি কালক্রমে বর্তমান মদনমোহনজীউ-এর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত। শ্রীচৈতন্যদেব এখানে এসেছিলেন এবং সনাতন গোস্বামীর ভজনাগারে মহাপ্রভুর পদচিহ্ন বর্তমান আছে।

                   ( চলছে )

এই পর্বে রোজনামচার সময়কাল ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৬১ (৩১ মে ১৮৫৪) থেকে ৬ আষাঢ় ১২৬১ (২০ জুন ১৮৫৪)


প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

৪টি মন্তব্য:

  1. মথুরা বৃন্দাবনের বিস্তৃত বিবরণের সহায়তায় এই স্থানের বহু অজানা বা ভুলে যাওয়া জায়গার বিষয়ে অবগত হলাম। সাধুবাদ জানাই লেখিকাকে 🙏
    শিউলি

    উত্তরমুছুন
  2. অনেক অজানা তথ্য জেনে সমৃদ্ধ হলাম

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...