বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

৪৩। দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ৭ ভোলানাথ চন্দ্র

 

      

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম



                  (আগের পর্বের পরে)

লেখকের পরবর্তী ভ্রমণ কাহিনী শুরু হচ্ছে উনিশে অক্টোবর, ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে।এবার হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে বসলেন লেখক ও তাঁর তিন সঙ্গী। 

লেখক এখানে ভারতের রেলপথের সূচনাকে ভগীরথের মর্তে গঙ্গা আনয়নের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভারতীয়রা রেলকে কি বিষ্ময়ের চোখে দেখে তা বলেছেন লেখক। এও বলেছেন যে রেল যেন ভারতবর্ষের পুনর্জাগরনের একটি নতুন রূপ। বাঙালিরা স্বভাবত ঘরকুনো। কলকাতার বাবুরা চিৎপুর রোডকে ভারতের শ্রেষ্ঠ পথ ভাবতে ভালোবাসেন। কিন্তু রেলের প্রসার তাঁদের বাইরের জগতে পা রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। হাওড়া থেকে বালি এখন পাঁচ মিনিটে পৌঁছানো যায়, দশ মিনিটে সেখান থেকে শ্রীরামপুর। পরবর্তী স্টেশনগুলো চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলি। বোঝাই যাচ্ছে মধ্যবর্তী বর্তমান অনেকগুলো স্টেশনের তখন অস্তিত্ব ছিল না। সারা রাস্তায় গ্রামবাসীরা অবোধ বিষ্ময়ে রেলগাড়ি দেখতে থাকে। 

এই রাস্তার অনেকটা পর্যন্ত বর্ণনা আগেই দেওয়া হয়েছে বলে লেখক এবার পান্ডুয়া (বর্তমান হুগলি জেলার) থেকে বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক পূর্বে পান্ডুয়া হিন্দু রাজাদের রাজধানী ছিল। শহরের পাঁচ মাইল পরিধি পরিখা ও প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এখন পান্ডুয়া একটি সাধারণ গ্রাম। আগের দুর্গের সামান্য অবশিষ্ট উপলব্ধি করা যায় কোন কোন স্থানে। একটি ১২০ ফুট লম্বা মিনার চোখে পড়ে। এটি বাংলার প্রাচীনতম স্থাপত্যের নমুনা। ৫০০ বছর ধরে টিকে আছে এই ইঁটের তৈরি সৌধটি এই স্থানের রোদ জল সহ্য করে। হিন্দু রাজার তৈরি এই সৌধ আজও দাঁড়িয়ে আছে বেশ ভালো অবস্থায়। (উইকিপিডিয়া অনুসারে অবশ্য বলা হচ্ছে শাহ সুফিউদ্দিন পান্ডুয়া ও মহানদ এলাকার হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে এই বিজয় স্তম্ভটি তৈরি করেছিলেন)। গোরু নিয়ে এখানে এক বিশাল অশান্তি হয়েছিল ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন হিন্দু রাজার বহু আকাঙ্ক্ষিত পুত্রের জন্ম উপলক্ষে এক উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। রাজার একজন পারসি সভাসদ (মুন্সি) ছিলেন। মুসলমানদের উৎসবে গো হত্যা অবশ্যই হতো। মুন্সি গোহত্যা করেন ও গরুর দেহাবশেষ গোপনে শহরের ফাঁকা জায়গায় পুঁতে ফেলেন। রাতে শেয়ালরা মাটি খুঁড়ে সেই অবশেষ বের করে খায়। সকালে তাদের ভুক্তাবশেষ এক ব্যক্তির চোখে পড়ে। হিন্দুরা ক্ষেপে উঠে ও হত্যার ফলে যে পাপ হয়েছে তা দূর করতে নবজাতক শিশুকে প্রথমে বলি দেওয়া হয়। তারপর মুন্সির ওপর সকলের রাগ পড়ে। মুন্সি পালিয়ে যান কিন্তু হিন্দু রাজার ক্ষতিসাধনের জন্য প্রচেষ্টা করতে থাকেন। এই ঘৃণা ও শত্রুতা বহু বছর ধরে চলে ও শেষে হিন্দু রাজত্বের পতন হয়। এরকম শোনা যায় যে একটি পবিত্র জলাশয়ের জল যতদিন রক্ষা করা যাবে ততদিন হিন্দুরা রক্ষা পাবে বলে কথিত ছিল। মুসলমানেরা মৃত গরুর দেহাংশ ফেলে জলাশয় অপবিত্র করে দেয়। ফলে হিন্দুরা সেই জলস্পর্শ করতে না পেরে দুর্বল হয়ে ক্রমে পরাজিত হয়। এই জলাশয়টি শহরের পশ্চিমদিকে এখনো আছে। যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে রেলের কাজ করতে গিয়ে খনন কালে অনেক মানুষের হাড় ও খুলি পাওয়া গেছে। মিনারটি মুসলমান রাজার বিজয় ঘোষিত করে। এর মধ্যে দিয়ে চূড়া পর্যন্ত যে লোহার দণ্ড উঠে গেছে সেটি নাকি এই যুদ্ধের নায়ক শাহ সুফির ছড়ি। পান্ডুয়ার মসজিদটি সুন্দর। ২০০ ফুট লম্বা, ৬০ টি ডোমযুক্ত। 


পান্ডুয়ার পীরপুকুর ৫০০ বছরের পুরনো ৪০ ফুট গভীর বিরাট জলাশয়। এটি ইমামবাড়া ও কবরস্থানের পাশে অবস্থিত। এই পুকুরের বৈশিষ্ট্য হল যে এখানে ফটিক খান নামের এক পোষা কুমির থাকে। যাকে ফকির ডাকলেই সে জলের উপরে ভেসে ওঠে। 


এবার ট্রেন পেরোলো বৈঁচি স্টেশন, অনেক ঘর বাড়ি নিয়ে জনবহুল গ্রাম। পরের স্টেশন বাটকা (?), যেখান থেকে ছয় মাইল ডানে গেলে দেবীপুর (এখন দেবীপুরই স্টেশন)। এখানে সাত ফুট লম্বা ভয়াল দেবী মূর্তি স্থানীয় সিংহ পরিবারের মন্দিরে বিরাজমানা (কিন্তু মন্দিরে লক্ষী নারায়ণ মূর্তি বিদ্যমান)। মেমারি পেরোয় ট্রেন। অনেক পাকা বাড়ি ও একটি সুন্দর নবরত্ন মন্দির চোখে পড়ে (লেখক কি সাত দেউল মন্দিরের কথা বলেছেন? কিন্তু এটি তো নবরত্ন মন্দির নয়)। 


বর্ধমান জেলা সম্পদ উর্বরতা, স্বচ্ছলতা, সভ্যতায় বাংলার মধ্যে খুব বিশিষ্ট স্থানে আছে। বর্ধমান, বীরভূমকে সাধারণভাবে রাঢ় বলা হয়। বর্ধমান জেলা বাংলার মধ্যে সবথেকে বেশি রাজস্ব দেয় সরকারকে। এবার ট্রেন পৌঁছায় বর্ধমান। (হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ, বর্ধমান মেন লাইন হয়ে ট্রেন প্রথম যাত্রা শুরু করে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে)। রেলের কল্যাণে তিন দিনের পথ তিন ঘন্টায় পৌঁছলেন। 


শহরের মধ্যে দিয়ে ক্ষীণকায়া বাঁকা নদী বয়ে চলেছে। লেখক ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ধমান স্থানের উল্লেখের কথা ও এখানে নুরজাহানের বসবাসের কথা স্মরণ করেছেন। বিদ্যাপত্যা নামক স্থানের নাম বিদ্যার সেখানে বসবাসের প্রমাণ বলেছেন লেখক। মৌন সরোবর নাকি বিদ্যা যে পুকুর ব্যবহার করতেন সেটি। বর্তমান দুর্লভা কালীমন্দিরই সেই মশান, লেখক বলেছেন, যেখানে সুন্দরকে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিদ্যাসুন্দর কাব্যে। 


পুরনো বর্ধমানকে এখন নবাবহাট বলা হয়। এখানে প্রাচীন হিন্দু রাজারা, মুসলমান শাসকরা, রাজা মানসিংহ প্রমুখ রাজকার্য চালিয়েছেন। এখানকার ১০৮ টি শিব মন্দির দুটি বৃহৎ চক্রাকারে (একটির মধ্যে অপরটি) অবস্থিত। এরকম শোনা যায় যে অনেক ধনরত্ন নাকি মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে এখানকার মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। এক রাজা খননকার্য চালিয়েও কিছু পাননি। 


বর্ধমানে লেখক-এর সময়ও মহারাজা আছেন। তিনি বাংলার ধনীতম রাজা। তাঁর বিশাল প্রাসাদ আয়না, ঝাড়লন্ঠন দিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো। তাঁর গ্রীষ্মকালীন বাড়ি রাজকীয়ভাবে সজ্জিত। মহারাজের ভান্ডারে অনেক মণি মানিক্য, সোনা রুপার বাসন, দামি শাল, সোনা রুপার কাজ করা পোষাক ইত্যাদি রয়েছে। তাঁর ঐশ্বর্যের ছটা দেখা যায় জন্মদিন ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। রাজার হাতিশালা, আস্তাবল, গবাদি পশুর আবাসস্থল ও পাখিরালয় আছে। বর্তমান রাজার প্রিয় শখ হল স্থাপত্য আর বাগান করা। তাঁর মাইনে করা স্থপতিরা সারা বছর বাড়ি গঠন ও পুনর্গঠনে ব্যস্ত থাকে। নতুন নতুন সাজে বাড়ি সাজানো হয়। সর্বদা তাঁর গায়ক, সুরকারেরা নতুন সুরসৃষ্টিতে ব্যাস্ত থাকে। খাদ্যের ব্যাপারেও এখানে নতুন নতুন পরীক্ষা চলে। শহরে অজস্র কৃত্রিম দিঘী পুকুর আছে বৃহত্তম দিঘী কৃষ্ণসায়র এর পাড় উঁচু করে বাঁধানো, তার উপরে দুটি কামান বসানো আছে। বিকালে সময় কাটানোর জন্য আছে মনোরম দিলখুশ বাগ। এখানে একটি ছোট চিড়িয়াখানা আছে, সেখানে একজোড়া সিংহ আছে। মহারাজা তাঁর আয়ের অর্ধেকের বেশি দেবসেবা ও তার মাধ্যমে দরিদ্রসেবায় নিয়োজিত করেন। 


পরদিন লেখক রেলপথে বর্ধমান থেকে রানীগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে মানকর পরে, যা তখন একটি সামান্য গ্রাম। বর্ধমান থেকে বীরভূম জেলায় প্রবেশ করেন। প্রথমে চারপাশে দৃশ্য একই রকম থাকলেও পানাগড়ের পর জঙ্গল শুরু হল। তার সঙ্গে ভূমিরূপ উঁচু নীচু হতে থাকে। আস্তে আস্তে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বাড়তে বাড়তে এই জঙ্গল রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর মধ্যে শৈবদের এক তীর্থস্থান আছে, বৈজনাথ (বৈদ্যনাথ, দেওঘর)। রাবণ রাজা শিব ঠাকুরকে কৈলাস থেকে কাঁধে নিয়ে লঙ্কায় যাচ্ছিলেন। একটানা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বরুন দেবতার ছলনায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে রাবন বর্তমান দেওঘরে শিবকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে বাধ্য হন। ফলে শিব বৈদ্যনাথ বা বৈদ্যনাথেই থেকে যান। 


ট্রেন থেকে ছাতনা (শুশুনিয়া পাহাড়) ও বিহারীনাথ পাহাড় দেখা গেল। খয়রাশোল থেকে কয়লা খনি এলাকা শুরু হল। খনি, চিমনি, হাট বাজার, ঘর বাড়ি দেখা গেল। এসে গেল রানীগঞ্জ। লেখক আবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে রেল প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত মানুষ আর পণ্যদ্রব্যকে এত দূরে পাহাড়ের তলদেশে নিয়ে এলো। রানীগঞ্জে এবার রেলগাড়ি ধুয়ে মুছে আগামীকালের পুনর্যাত্রার জন্য তৈরি করা হবে। 


কলকাতার বাবুদের জন্য রানীগঞ্জে এখনো থাকার ভালো জায়গা তৈরি হয়নি। একটি রেলের হোটেল আছে। কিন্তু একজন দেশীয় যতই শেক্সপিয়ার, বেকন পড়ুক, ধর্মীয় কুসংস্কার বর্জন করুক, রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করুক আর আইন সভায় আসন পাওয়ার স্বপ্ন দেখুক না কেন, তিনি ইংরেজি হোটেলে থাকার কথা ভাবতে পারেন না কারণ তিনি অন্যান্য ব্যাপারে ইংরাজদের মতো হয়ে উঠলেও তার চিন্তা স্বভাব কাজকর্ম অনুভব দৃষ্টিভঙ্গিতকে ইংরাজ সুলভ করে তুলতে পারেন না। সৌভাগ্যক্রমে লেখকদের এক দেশীয় ব্যক্তি থাকার ব্যবস্থা করে দেন তাঁর বাড়িতে। 


রানীগঞ্জ সভ্য জগতের শেষ সীমায় অবস্থিত এর পরই জঙ্গল আর বর্বরতার শুরু। কিন্তু সুন্দর ছবির মত স্থান ও আছে এখানে। বাম দিকে বিন্ধ্য পর্বত দেখতে পাওয়া যায় আর ডান দিকে জঙ্গল একেবারে গঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। গুদাম, দোকান, খনি নিয়ে ব্যস্তসমস্ত শহর। কিন্তু শহরের বাইরের এলাকার প্রকৃতি সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। রানীগঞ্জ নতুন শহর। এই শহরের স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে গড়ে ওঠা দরকার। ভারতীয়দের সুন্দরভাবে শহর গড়ে তোলা শেখা উচিত। কিন্তু এই শহরের রাস্তা সরু, বাঁকাচোরা, নোংরা। দোকানগুলি এলোমেলো, ভিড়। কোন বাড়ির নাম নেই। ছোট দোকানদার, মজুর, কুলিরাই এলাকার বাসিন্দা। উচ্চতর সমাজের কেউ এখানে পাকাপাকিভাবে থাকে না। সাঁওতাল মেয়ে বউরা এখানে নুন, কাপড়, সাজের জিনিস কিনতে আসে। গ্রামের লোকেরা গাছের তলায় দোকান দিয়ে বসে। 



তবে ভালুক, চিতার আস্তানা জঙ্গল থেকে এখন যে বার্ষিক এক মিলিয়নের চতুর্থাংশ ভাগ আয় করা শিল্প নগরীতে পরিণত হয়েছে রানীগঞ্জ এই অনেক। রেলের সুবাদেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। ভারতে এখনো রানিগঞ্জ একমাত্র স্থান যেখান থেকে সারা ভারতে খনিজ দ্রব্য যাচ্ছে, কয়লা যাচ্ছে, যে কয়লা গঙ্গায় স্টিমার চলা, সমুদ্রের জাহাজ চলা সম্ভব করছে। এরকম আরো শহর ভারতের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠবে ভারতকে উন্নত করে তুলতে। ভারতের প্রধান আয়ের উৎস কৃষি ঠিকই কিন্তু ভারতের বিপুল খনিজ ভান্ডার অবহেলা করা উচিত নয়। ভারতের প্রাচীন পূর্বজরা প্রথম কৃষিকাজে সূচনা করেছিলেন তাই নয়, তারা দ্রব্য উৎপাদন ও বাণিজ্যতেও পৃথিবীতে প্রথম ছিলেন। ভারতের রেশম, মসলিন একসময় রোমান সাম্রাজ্যকে রপ্তানি করতে হতো। ভারতের থেকে ইস্পাত রপ্তানির কথা পেরিপ্লাস ( প্রাচীন গ্রীক নৌযাত্রার রচনা) থেকে জানা যায়। যদিও এখন লোহা থেকে ভারতে ইস্পাত খুব কমই হয়, সবই ইংল্যান্ড থেকে আমদানি হয়। বর্ধমানের উত্তর-পশ্চিমে বনপাস গ্রামে ভালো কাঁটা-চামচ তৈরি হতো কিন্তু এখন কামাররা হয় মারা গেছে, নয় বাইরে চলে গেছে। আমাদের দেশের শিল্পের এই বিদেশের হাতে চলে যাওয়া উন্নততর বুদ্ধি আর সম্পদের সঙ্গে অসফল প্রতিযোগিতার ফল। ভারত ছিল বিশ্বের শস্য ভান্ডার। তখন বিশ্বের তিন চতুর্থাংশ অংশ জঙ্গল ছিল আর জমি ব্যবহার্য ছিল না, আফ্রিকার মত নানা স্থানে। পরবর্তী কালে পৃথিবীতে অনেক নতুন স্থানে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে (আমেরিকা, আফ্রিকা, মরিশাস, ব্রাজিল, রাশিয়া)। ফলে ভারতের সেই দিক থেকে গুরুত্ব কমেছে। দুইশ বছর আগে ইংল্যান্ডের বয়ন শিল্প ভারতীয় বয়ন শিল্পের কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে যেত। আর এখন ভারতীয় বয়ন শিল্পীদের বাজার থেকে উৎখাত করা হয়েছে। এখন দেশীয় ম্যানচেস্টারের বস্ত্র, বার্মিংহামের যন্ত্রাংশ ছাড়া অন্য কিছু কেনার কথা ভাবতে পারা যায় না। আমরা আশা করব যে আমাদের পুত্র, পৌত্ররা প্রতিটি ধুতি, শার্ট, পাগড়ি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের থেকে ক্রয় করবে। বর্তমান ভারতীয়রা শুধু চাষবাস করছে কারণ তার কাছে পুঁজি নেই, নতুন কোন বুদ্ধি (প্রযুক্তি) নেই। কিন্তু ভারতীয়রা জ্ঞান, শক্তি, ধনবৃদ্ধি করে বিংশ বা একবিংশ শতকে কৃষি ও উৎপাদনশিল্পে উন্নতি করবে, খনি শিল্পে উন্নতি করবে এবং নিজেদের জাহাজে পণ্য পাঠাবে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় - এই আশা করেছেন লেখক। 


রানীগঞ্জের খনিতে দেখার জিনিস অনেক আছে। খনিশিল্প ভারতীয়দের কাছে নতুন। ষোলশোর বেশি শ্রমিক এখানে খনিতে কাজ করে। মাটির ১৩৫ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করে কাজ হচ্ছে। খনির তিন মাইল গভীর পর্যন্ত টর্চ লাইট ব্যবহার করে একজন দর্শনার্থী দেখে আসতে পারেন। 


দামোদর নদ তার উদ্যাম গতিবেগে পাড় ভাসিয়ে শয়ে শয়ে গ্রাম শহরে বন্যা ঘটায়। তাই একে নদী না বলে নদ বলে। আর তাই এর নাম দামোদর অর্থাৎ অতৃপ্ত গ্রাসকারী, যদিও রানীগঞ্জে এই নদী শান্তভাবে বয়ে যাচ্ছে। 


এরপর লেখক দুটি ডাক গাড়ি ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করার জন্য ডাকওয়ালাদের কাছে গেলেন। কিন্তু অনেকে বেড়াতে বেরিয়েছে বলে গাড়ি পাওয়া গেল না। মুসলমানের বাদশাহরা পত্রবাহক রানারের জায়গায় ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এখন সেটি মানুষকে বহন করে সুদুরে নিয়ে যাচ্ছে। পালকি ছেড়ে এখন ঘোড়ার গাড়ির উপর মানুষ নির্ভর করতে পারছে। কয়েক বছর পরে রেল এই যাতায়াতের প্রধান পথ হয়ে উঠবে। কলকাতার বাবুদের ভ্রমণ এর ফলে শতগুন বৃদ্ধি পাবে। স্রোতের মতো মানুষ একঘেয়েমি কাটাতে আর ছুটির সদ্ব্যবহার করার জন্য ছুটবে। ইতিহাসে, গাঁথায় শোনা স্থানগুলিতে পৌঁছানোর আগ্রহে, প্রকৃতিকে দেখার উৎসাহে মানুষ অনেক বেশি ভ্রমণ করবে। মানুষকে ভ্রমণমুখী করে তুলতে রেলের ভূমিকা অবশ্যই অপরিসীম।

                       (চলছে)

প্রিয় পাঠক: আপনার মতামত আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! অনুগ্রহ করে একটি মন্তব্য করুন এবং এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা শেয়ার করুন। আমি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আগ্রহী!

২টি মন্তব্য:

  1. ভারতে রেলপথের সুচনার কথা পড়লাম আর রেল আবিষ্কারের ফলে মানুষের যাত্রার সুবিধার সুচনার কথা জানলাম। শিল্প নগরী রানিগঞ্জের গল্প জানলাম বৈদ্যনাথ ধামের অজানা কাহিনীর সাথে পরিচিত হলাম। পর্ব টি বেশ লাগল। শিউলি

    উত্তরমুছুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...