সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ ধারাবাহিক
------- সুমনা দাম
(আগের পর্বের পরে)
মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেব শিল্প, সাহিত্য, গান, বাজনা, স্থাপত্য সবকিছুর প্রতি বিরূপ ছিলেন। এমনকি নিজের সমাধি তৈরিতেও তিনি অর্থ ব্যয় করতে চাননি। একমাত্র দিল্লি দুর্গের মতি মসজিদ তিনি তৈরি করেছিলেন।
আওরঙ্গজেবের এক অবিবাহিতা কন্যা জিনাতউন্নেসা, জিনাত মসজিদ বা কুমারী মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন, যা দরিয়াগঞ্জের কাছে যমুনার তীরে অবস্থিত (এটি ঘাটা মসজিদ নামেও বর্তমানে খ্যাত)। শাহজাহানের কন্যা রোশেনারার তৈরি উদ্যান (রোশনারা উদ্যান) আরেকটি মুঘল রাজকন্যার তৈরি দর্শনীয় স্থান। শাহজাহানের পুত্র দারার প্রাসাদ দেখার মত ছিল। সেই প্রাসাদে পরে দিল্লির কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
দিল্লির রাজপুরুষ বা অভিজাতদের অনেকের সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ছিল দিল্লিতে। জয়পুরের রাজা জয় সিং যন্তর মন্তর তৈরি করেছিলেন দিল্লিতে, যা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার স্থান, যেরকম বেনারসের মান মন্দির আর লখনৌ-এর তারা কোঠি। দিল্লি আর আগ্রার মাঝামাঝি স্থানে, তাজমহলের ধাঁচে যে বিশাল সৌধটি রয়েছে সেটি সফদরজঙের মাজার বা সমাধি (সফদরজং ছিলেন অযোধ্যার নবাব)। শ্বেত পাথর ও লাল ও গোলাপি বেলে পাথরের তৈরি সৌধটি তাঁর পুত্র অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার তৈরি। এর পাশেই এক মুঘল অভিজাত ব্যক্তি গাজী উদ্দীন খানের সমাধি রয়েছে। গাজী উদ্দিন খানের নামাঙ্কিত একটি মাদ্রাসা আজমিরি গেটের কাছে বহু বছর ছিল।
এর পরবর্তীকালে নাদির শাহের ভারত আক্রমণের ঘটনা ঘটে। সেই লুণ্ঠন, ধ্বংসলীলা চলে ৫৮ দিন ধরে, ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে, যা কয়েক'শ বছরের সৃষ্টিকে তছনছ করে দিল। তারপর আহমদ শাহ দুরানি ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট আটবার ভারত আক্রমণ করেন। তারপর আফগান নেতা গোলাম কাদির ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাদশা শাহ আলমকে পদচ্যুত করে ও অন্ধ করে আড়াই মাস যাবত দিল্লি দখল করে রাখেন ও লুণ্ঠন চালান। ফলে মুঘল স্থাপত্য আর নতুন করে সৃষ্টিও হয় না, পুরনো কিছু স্থাপত্যও অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়।
এবার লেখক দিল্লি ইনস্টিটিউট (এই বাড়িটির বর্তমান নাম জানতে পারা যায় না বা আদৌ এটির অস্তিত্ব আছে কিনা তাও জানা যায়নি) দেখতে গেলেন। ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই বাড়িতে বহির্গাত্র লাল পাথরের গুঁড়ো দিয়ে সজ্জিত, যাতে পাথরের মতো দেখতে লাগে। দিল্লি ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গনে স্টেশন-লাইব্রেরি, গভর্নমেন্ট কলেজ ও মিউজিয়াম অবস্থিত। লাইব্রেরী রয়েছে বাড়িটির এক তলার পশ্চিম কোণে। সিপাহী বিদ্রোহের আগে এই লাইব্রেরীতে নয় হাজার বই ছিল।
লেখকেরা এবার মিউজিয়ামে গেলেন, যেটি পাশের একটি হলে রয়েছে। হলে ঢোকার পথে দুটি লাল পাথরের ভাঙ্গা মূর্তি চোখে পড়ে। মূর্তি দুটির কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত রয়েছে। তার মধ্যে একটি মাথা নেই, অপরটির নাক ভাঙ্গা। লেখকের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই দুটি সেই জয়মল ও পুত্তের মূর্তি। জিজ্ঞাসা করে গাইডের কাছে জানলেন মূর্তি দুটি হাতির পিঠে বসানো ছিল। হিন্দু পোশাক ও রাজপুত পাগড়ী দেখেও মূর্তি দুটি কাদের অনুমান করা যাচ্ছিল। যে মূর্তির মাথা রয়েছে সেটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের। তাই লেখক বুঝতে পারেন সেটি জয়মলের। কারণ চিতোর দুর্গ অবরোধের সময় পুত্তের বয়স ছিল মাত্র ষোলো। (উইকিমিডিয়া থেকে পাওয়া যায় একটি ছবি যেটি এখানে দেওয়া হল। সেটি উনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে জোসেফ ডেভিড বেগলারের তোলা। ছবিটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কালেকশন থেকে পাওয়া। একটি অজ্ঞাত পরিচয় বাড়ির দরজার সামনে পাথরের মূর্তি দুটি রয়েছে। অর্থাৎ এই সেই দুটি মূর্তি যা লেখক দেখেছিলেন। লেখক যখন দেখেছিলেন তখন একটি মূর্তির মাথা শরীরে ছিল না। উইকিমিডিয়ায় পাওয়া ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে একটি মূর্তির মাথা পরবর্তীকালে লাগানো হয়, যেটি পুত্তের মূর্তি। তারপরে ওই দুটি মূর্তি কোথায় গেছে তা জানা যায়নি। হাতির মূর্তি দুটি লালকেল্লার দিল্লি দরওয়াজাতে লর্ড কার্জন বসিয়েছিলেন, সে দুটি সেখানেই আছে)।
মিউজিয়ামের ভিতরের গ্যালারিতে ব্রিটিশ ভারতের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির ছবি রয়েছে। একজন হিন্দু রাজার ছবি ছিল যিনি সিপাহী বিদ্রোহের জন্য বিখ্যাত। সেই কালো মারাঠা রাজার মনি মুক্ত খচিত সাজ পোশাকে সজ্জিত ছবি রয়েছে গ্যালারিতে (এটি নিঃসন্দেহে নানা সাহেবের ছবি)। মিউজিয়ামে কৃষি, প্রাণিবিদ্যা, প্রত্নবিদ্যা, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিভাগ আছে। বিভিন্ন সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ আছে। অনেক আরবি ফারসি পাণ্ডুলিপিও দেখলেন। দু-একটি পান্ডুলিপিতে সোনার হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। দিল্লি ইনস্টিটিউটের পূর্ব দিকে সরকারি কলেজ অবস্থিত। লেখক এবার তাঁর অভিমত দেন যে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে, জনমত গঠনের দিক থেকে, জনসভা-বক্তৃতা-সংবাদপত্রে সামাজিক সংস্কারের যে প্রভাব কলকাতায় পড়েছে, তার থেকে দিল্লি অনেক পিছিয়ে আছে। এমনকি দিল্লির কলেজের অঙ্ক বিভাগের বাঙালি অধ্যাপককেই আগামী দরবারে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
ইনস্টিটিউট সংলগ্ন অংশে রয়েছে রানীর (ইংল্যান্ডের রানীর) উদ্যান। উদ্যান খুব বড় না হলেও তা ইউরোপীয় রুচি ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দেয়। উদ্যানে মোগল যুগের একটি লম্বাটে শ্বেত পাথরের স্নানে চৌবাচ্চা দেখলেন যেখানে হাঁসের বাচ্চারা খেলা করে। এখানকার দরজার কাছে, জয়মলের হাতিটি রাখা আছে (যেটি পরবর্তী কালে দিল্লি গেটে বসানো হয় আর একটি সঙ্গে)। বাগানের মধ্যে দিয়ে আলীমর্দানের (এক মুঘল প্রাদেশিক শাসক) তৈরী খাল বয়ে গেছে। এই খাল থেকে দিল্লী বাসীরা, পানীয় ও বাগানে দেওয়ার জল পায়।
লেখকেরা ভালো সময় দিল্লি এসেছিলেন কারণ সামনে ছিল দেওয়ালি। ঝকমকে দোকানবাজার, লাল-নীল-সবুজ লন্ঠন, প্রদীপ, কাঁচের বাতিদান, মোম ইত্যাদির আলোতে সাজানো শহরে, নতুন পোশাকে সজ্জিত মানুষজন সবাই নাচে, গানে, আমোদে মেতে উঠল। দিল্লি শহরে দিল্লিকা লাড্ডু ছাড়াও নানা রকম মিষ্টি বিক্রি হতে থাকলো। মিষ্টির দোকানে মন্দির, মসজিদ এমনকি মিষ্টির তৈরি দুর্গ বিক্রি হচ্ছে দেখলেন লেখক। নানা রকম পুতুল আর খেলনাও বিক্রি হচ্ছিল। মুসলমানেরা হিন্দুদের উৎসব পুরো দমে উপভোগ করছিল। এখানকার হিন্দুরা লক্ষ্মী পূজা করে সেদিন বাংলার মতো। মহিলারা নিগমবোধ ঘাটে গঙ্গাস্থানে যায়। চাঁদনী চকের বাড়ির বারান্দায় উজ্জ্বল ভাবে সজ্জিত বাইজিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তাঁরা।
এরপর এল তৎকালীন ভাইসরয়ের আগ্রা দরবার অনুষ্ঠান, যেটি আগ্রা দুর্গে অনুষ্ঠিত হবে। লেখক আগ্রাতে গিয়ে সেটি দর্শন করেন। মুঘল দরবারের অনুকরণে এটি সংঘটিত হবে। দরবার কক্ষ সাজানো হয়েছে দামি কানাত, পর্দা, চাকচিক্যময় সামিয়ানা, সাজসজ্জা, নরম পারস্যের গালিচা দিয়ে। লেখক ভাইসরয়ের দরবারের সঙ্গে প্রাচীন হিন্দু রাজাদের রাজসূয় যজ্ঞের তুলনা করেছেন। এখানে দেশীয় রাজারা, নবাবরা, প্রাদেশিক ইংরাজ শাসনকর্তারা, সামরিক ও অসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সাংবাদিকরা এবং জ্ঞানীগুণী মানুষজন নিমন্ত্রিত হয়েছেন। জয়পুরের রাজা, সিন্ধিয়ারাজ, ভরতপুরের রাজা, ভূপালের বেগম উপস্থিত ছিলেন। বৃত্তাকার জমিতে হাজার হাজার মানুষ, হাতি, ঘোড়া, উট, মহিষ, গাড়ি, এক্কা জমা হয়েছে। অস্থায়ী খাবারের দোকান হয়েছে প্রচুর। কুড়ি টাকা মাসিক ভাড়ার ঘরের এখন ভাড়া হয়েছে ৩০০ টাকা। একদিনে একটি ঘরের ভাড়া লাগছে পাঁচ টাকা করে। গাড়ি পাওয়াও দুষ্কর হয়েছে।
ভাইসরয় লর্ড জন লরেন্সের আগমন দেখার মত। রাস্তার দু'পাশের বাড়িগুলির জানলা, বারান্দা, ছাদ দর্শকে ভরে গেছে। পুলিশ ভিড় সামলাচ্ছে। সেনাবাহিনী নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। গভর্নর জেনারেল ট্রেনে এসে দিল্লী পৌঁছলেন। সেখানে নৌকার পুল রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে পার হয়ে, তিনি ঘোড়ার পিঠে আগ্রায় এলেন। লেডি লরেন্স নৌকায় আগ্রায় গেলেন। ভাইসরয়-কে আগ্রা দুর্গের প্রাচীর থেকে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট দেওয়া হল। একপাশে একজন কমান্ডার-ইন-চিফ ও অন্য পাশে একজন মহারাজাকে নিয়ে তিনি দরবার প্রাঙ্গনে যান।
সাত দিন ধরে দরবার সংক্রান্ত মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে ভাইসরয় নাইটহুড প্রদান করেন। বিভিন্ন রাজাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেন। এক সন্ধায় তাজে আলো দিয়ে সাজানো হয়। হাজার হাজার রঙবেরঙের লন্ঠনের আলোয় আর ফোয়ারায় সজ্জিত রাতের তাজ অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে। পাঁচ হাজারের বেশি বিশিষ্ট মানুষ উজ্জ্বল, সুরচিকর পোশাকে সজ্জিত হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যমুনা নদীর পাড় আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। দু-তিন মাইল ব্যাপী নদীর জলে আলোর প্রতিফলন পড়ে মনে হচ্ছিল সমুদ্রে তারার ছায়া পড়েছে। ২০ নভেম্বর, ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভাইসরয়ের আগ্রা দরবার অনুষ্ঠিত হয়।
এই ঐতিহাসিক দরবার দর্শনের সঙ্গেই শেষ হয় লেখক ভোলানাথচন্দ্রের ভ্রমণ এবং শেষ হয় তাঁর দুই খন্ডে লেখা বই "দি ট্রাভেলস অফ আ হিন্দু ইন ভেরিয়াস পার্টস অফ বেঙ্গল এন্ড আপার ইন্ডিয়া"।

প্রতিটি পর্বের মতোই এটিও উপভোগ করলাম অনেক পুরাতন তথ্য সংগ্রহ মারফত।
উত্তরমুছুনশিউলি
ধন্যবাদ! এবার নতুন কাহিনী পড়ুন!
উত্তরমুছুন