বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

১৩। রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত


 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কুন্তলিনী প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। 

রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) একজন ভারতীয় চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, বাগ্মী। তিনি বেশ কিছু অনুবাদ ও স্বতন্ত্র রচনা করেছেন। বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ঋষি অরবিন্দ ঘোষ তাঁর দৌহিত্র। 

এই আত্মজীবনীটি অসমাপ্তভাবে লেখার পরে তিনি আরো ২৪-২৫ বছর বেঁচে ছিলেন অর্থাৎ ১৮৭৫ সাল নাগাদ এটি লেখা হয়। এই লেখায় শুধুমাত্র ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য এই আত্মচরিত থেকে নেওয়া হল। 

১৮৪০-এ তিনি হেয়ার স্কুল থেকে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময়, ১৮৪৩ সালে রামগোপাল ঘোষের (ইয়াং বেঙ্গল গ্রুপের নেতা, ব্যবসায়ী, বাগ্মী, সমাজ সংস্কারক {জন্ম ১৮১৫ - মৃত্যু ১৮৬৮}। তিনি হিন্দু কলেজে পড়েছিলেন এবং সেখানকার ছাত্রদের নেত্রী স্থানীয় ছিলেন) সঙ্গে আলাপ হয়। রাজনারায়ণ বসু সেই বছর পুজোর সময় রামগোপাল ঘোষের সুন্দর ছোট স্টিমার 'লোটাস'- এ করে রাজমহল ও গৌড়ের ভগ্নাবশেষ দেখতে যান। রামগোপাল ঘোষ এর আগে ল্যান্ডর, মুসৌরি প্রভৃতি স্থানে গেছিলেন, যা তখনকার পক্ষে বীরপুরুষের কাজ। এই দুঃসাহসিক যাত্রায় ছেলে অংশ নেবে জানলে মা যেতে দেবেন না বলে রাজনারায়ণ বসু তাঁকে বলেন রামগোপালবাবুর দেশের বাড়ি বাঘাটিতে যাচ্ছেন। পরে পিতা মাকে সত্যি জানাবেন এই পরিকল্পনা ছিল। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে তাঁরা রামগোপাল বাবুর বাড়ি উপস্থিত হলেন ব্যাগ তখনও ব্যবহার হতো না। তাঁরা প্রত্যেকে এক একটি কাপড়ের মোট নিয়ে স্টিমারে উঠে ত্রিবেনী পৌঁছলেন। আগে ত্রিবেণী, বলাগড়, শান্তিপুর প্রভৃতি স্থান খুব স্বাস্থ্যকর ছিল। লোকে কলকাতা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন করার জন্য সেখানে যেত কিন্তু এখন সেগুলি ম্যালেরিয়ার আখড়া হয়েছে বলে লেখক আফশোস করেছেন। বাঘাটি ত্রিবেনীর কাছের একটি গ্রাম। সেখানে ক'দিন গ্রাম্য দুর্গাপূজা দেখে কাটালেন তাঁরা। তারপর মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করা হলো। দিনগুলি খুব ভালো কাটতো সকালে উঠে চা-বিস্কুট, ডিম। দুপুরে বাঙালি মতে ডাল, ভাত, মাছের ঝোল আর রাতে ইংরেজি বা হিন্দুস্তানি মতে আহার হত। সকাল বিকাল দুই বেলা তাঁরা তীরে নেমে পাখি মারতেন বন্দুক দিয়ে। বঙ্গদেশের অক্সফোর্ড নবদ্বীপ পেরিয়ে বিল্বগ্রামে মদনমোহন তর্কালঙ্কার (কবি, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক, স্ত্রীশিক্ষার জন্য অনেক কাজ করেছেন) এসে যোগ দিলেন। তাঁরা মুর্শিদাবাদের ঘাটে পৌঁছালে সেখানে তাঁদের স্টিমারকে নবাবের মাল বোঝাই বড় নৌকা ধাক্কা মারলে তাঁদের ছোট স্টিমারের ক্ষতি হল। এর ফলে যে বিবাদ, মারামারি হয় তার ফল স্বরূপ মুর্শিদাবাদে থাকা তাঁরা নিরাপদ মনে করলেন না নিরাপদ মনে করলেন না। তখন তাঁরা রাজমহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। রাজমহলে মুসলমান নবাবদের নির্মিত অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ দর্শন করেন। কাল পাথরের সিংহ দালান, যা নবাবের দরবার ছিল সেটি প্রধান দর্শনীয়। পরে যখন রাজমহল পর্যন্ত রেল হয় তখন এইসব স্থাপত্য বিনষ্ট হয়েছে। তারপর স্টিমারে রাজমহলের পাহাড়ের দিকে গঙ্গার যে খাঁড়ি গেছে তার ভিতরে কিছুদূর গিয়ে পাহাড়িদের নাচ গান উপভোগ করেন। তাঁরা তারপর রাজমহল থেকে মহানন্দা ও পদ্মা নদী দুটি সংগ্রাম সঙ্গমের দিকে যান। রাজমহল থেকে এই পথে জলদস্যুর ভয়ে তাঁরা স্টিমারের ডেকে বসে রাতে পাহারা দিতেন তরোয়াল হাতে। মহানন্দা নদীতে যখন স্টিমার এল গ্রামবাসীরা দল বেঁধে স্টিমার দেখতে এল কারণ তারা আগে কখনো তা দেখেনি। লেখকরা যখন কেউ গ্রামে কিছু জিনিস কিনতে যেতেন তখন গ্রামবাসীরা তাঁদের দেখে ভয়ে পালিয়ে যেত। একদিন মহানন্দার তীরে রাতে নোঙর করে থাকার সময় বাঘের ডাক শোনা গেল। ভোলাহাটে তাঁরা একটি কড়কড়ে পানিতে (ঘূর্ণি বা rapid) পড়ে অনেক কষ্টে উদ্ধার পেলেন। মালদায় পৌঁছে তাঁরা আট ক্রোশ নানা হিংস্র জন্তুতে পরিপূর্ণ নিবিড় বনের মধ্যে দিয়ে হাতির পিঠে করে বন্দুক হাতে নিয়ে চললেন গৌড়নগর-এর ভগ্নাবশেষ দেখতে। গৌড়ে তাঁরা কোতোয়ালীর ভগ্নাবশেষ, দেওয়ানখানার ভগ্নাবশেষ দেখলেন। ভাগ্যক্রমে বাঘ বা কোন হিংস্র জন্তু তাঁদের সম্মুখীন হয়নি। প্রকান্ড কয়েকটি পুস্করিণী দেখলেন, তাতে বড় বড় কুমির ভাসছে। একটি মনুমেন্টের মতো উঁচু মিনার দেখলেন। শুনলেন রাজজ্যোতিষীরা এখান থেকে অনেক আগে নক্ষত্র দেখতেন। 

১৮৪৬ সালে পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তিনি উলুবেড়িয়া হয়ে দামোদর দিয়ে নৌকায় বর্ধমানে যান। এই ঘটনা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী পর্বে বর্ণিত হয়েছে। 

১৮৪৭ সালের পুজোর সময় আবার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকায় রাজনারায়ণ বসু যাত্রা করেন। দেবেন্দ্রনাথের পরিবারও সেবার সঙ্গে ছিল। নবদ্বীপ ও চুপি পার হয়ে পাটুলির কাছে সন্ধ্যায় অস্বাভাবিক এক ঝড় এল। এর মধ্যে ডিঙ্গি করে পত্রযোগে খবর এল দ্বারকানাথ ঠাকুরের ইংল্যান্ডে মৃত্যু হয়েছে। 

১৮৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আসাম প্রদেশ দেখতে যাওয়ার জন্য স্টিমারে গঙ্গাসাগর, বড় সুন্দরবন হয়ে যাত্রা করেন রাজনারায়ণ। সুন্দরবনের খাল দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা স্টীমার থেকে দূরবীনে পাড়ে হরিণ চড়তে দেখতেন। এক রাতে বাঘের ডাক শুনেছিলেন। তিনি খাদ্যাভ্যাসে বাঙালি ছিলেন। বিজাতীয় খাবার খেতে খেতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে তিনি ঢাকায় পৌঁছে দেবেন্দ্রনাথের থেকে অনুনয়-বিনয় করে ছাড়া পেয়ে ঢাকার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে মাছ ভাত খেলেন। 

পরবর্তীকালে ১৮৬০ সালে পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি রাজমহল যাত্রা করেন। তখন রেলপথ খুলেছে কিন্তু তাঁরা নৌকায় যান। কালো পাথরের সিংহদালান (যা রেলের অফিস রূপে ব্যবহৃত হচ্ছিল) ছাড়া আর কোন পুরাকীর্তি অবশিষ্ট ছিল না। 

দেওঘরে পরবর্তীকালে রাজনারায়ণ বসুর পশ্চিমের বাসগৃহ ছিল। ১৮৬৭ সাল থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন কাজে সূত্রে বারংবার গিয়ে তিনি ভাগলপুর, এলাহাবাদ, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, কানপুর প্রভৃতি জায়গায় যান। আগ্রায় তাজমহল দর্শন করেন। কানপুরে বিঠুর গ্রামের বাল্মিকী তপোবনে যান। অবশ্য তিনি এই সমস্ত জায়গার কোনো ভ্রমণের বর্ণনা দিয়ে যাননি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...