শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

১১। রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ

 

সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ                ধারাবাহিক 


                   -------  সুমনা দাম


নবযুগের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ - ১৮৩৩) তাঁর জীবনকালে বেশ কিছু ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু তিনি কোন ভ্রমণ কাহিনী লেখেন নি। তবে তাঁর লেখা চিঠিপত্র থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং তাঁর জীবনীকারেরাও সেই সব তথ্য দিয়ে গেছেন। তাই রাজা রামমোহন রায়ের ভ্রমণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য না পাওয়া গেলেও কিছু তথ্য পাওয়া যায় যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। 

মাত্র ষোলো বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায় "হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী" নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই উপলক্ষে পিতার সঙ্গে তাঁর সংঘাত হয়েছিল এবং তিনি গৃহত্যাগ করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। এই দেশভ্রমণ কালে তিনি সেইসব স্থানের ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার জন্য বিভিন্ন ভাষা শিখেছিলেন। এর আগে তিনি সংস্কৃত ও পারসী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। ভারতের ঠিক কোথায় কোথায় তিনি গিয়েছিলেন তা জানা যায় না। 


অবশেষে সেই কিশোর বয়সে কিশোর রামমোহন হিমালয় পার হয়ে তিব্বতে যান। প্রধানত বিদেশী শাসকের প্রতি ঘৃণার কারণে ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে তিনি তিব্বত গেছিলেন। নিঃসম্বল কিশোরটি কী অসম্ভব কষ্ট করে, এতদিন পূর্বে, কত দুর্গম পথ অতিক্রম করে তিব্বতে পৌঁছেছিল তা অভাবনীয়। তিব্বতে গিয়ে তিনি দেখেন লামারা সেখানে অবতারের স্থান নিয়েছেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম পৌত্তলিকতা ও অন্য নানা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে পড়েছে। তিনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেখানকার মানুষদের বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোমল হৃদয় মহিলারা তাঁকে বারবার উদ্ধার করেছেন। তিনি পরে বলেন যে তিব্বতি মহিলাদের এই সস্নেহ ব্যবহার তাঁকে নারীদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল করেছিল। তাঁর এই কিশোর বয়েসের ভ্রমণ সম্পর্কে তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'সংবাদ কৌমুদী' পত্রিকায় তিনি পরে লিখেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সব লেখা পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 



ইউরোপীয়দের ধর্ম, রাজনীতি, আচার ব্যবহার স্বচক্ষে দেখে জ্ঞানলাভ করার জন্য বিলাত যাত্রায় রামমোহন আগ্রহী ছিলেন। কিন্ত বিলেত যাত্রার প্রয়োজনীয় অর্থ তাঁর ছিল না। সেই অর্থসমস্যা সমাধান হয় যখন দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় আকবর শাহ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কিছু অধিকার থেকে চ্যুত হওয়াতে ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে আবেদন করার জন্য রামমোহন রায়কে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করতে চান। এছাড়া তাঁর বিলাত যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন সনদের বিচারে উপস্থিত থাকা। এই সনদের দ্বারা ভারতবর্ষে আগামী দিনে দীর্ঘ কালের জন্য ভারতীয়দের প্রতি ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ হবে। সতীদাহ বিষয়ক প্রিভি কাউন্সিলে আপিলের শুনানি হওয়ারও কথা ছিল। রামমোহন রায়ের বিদেশ যাত্রার পূর্বেই তাঁর কীর্তির খ্যাতি ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংল্যান্ড যাত্রার পূর্বে বাদশা আকবর শাহ্ (দ্বিতীয়) তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন।   


১৮৩০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজা রামমোহন রায় তাঁর পালিত পুত্র ১২ বছরের রাজা রাম এবং ভৃত্যদ্বয় রামরত্ন মুখোপাধ্যায় ও রামহরি দাসকে নিয়ে অ্যালবিয়ান নামক জাহাজে বিলাত যাত্রা করেন। দুধপানের সুবিধার জন্য সুবিধার জন্য জাহাজে তিনি দুটি দুগ্ধবতী গাভী নিয়ে যান। কোন সমুদ্র পীড়া তাঁর হয়নি কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি পথে উত্তমাশা অন্তরীপে নেমেছিলেন। 


১৮৩১ সালের ৮ ই এপ্রিল চার মাস তেইশ দিনে জাহাজ গন্তব্য লিভারপুলে পৌঁছায়। এপ্রিল মাসের শেষে তিনি রেলপথে লিভারপুল থেকে লন্ডনে যান। পথে সুন্দর বাড়ি ঘর, উদ্যান, সেতু, কৃত্রিম হ্রদ-খাল প্রভৃতি দেখে বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় তিনি খুব আনন্দ পান এবং ভারতবর্ষের দারিদ্র্যের কারণ উপলব্ধি করেন। পথে তিনি ম্যানচেস্টার শহরে যান এবং সেখানকার কারখানা দেখে ও কারখানায় নারী পুরুষকে কাজ করতে দেখে আনন্দিত হন। দরিদ্র স্ত্রী পুরুষরা ভারতের রাজা এসেছে শুনে কাজ ছেড়ে তাঁকে দেখতে ভিড় জমায়। 


ইংল্যান্ডের সর্বত্র ও লন্ডনে বিখ্যাত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেন। তাঁর বিপুল খ্যাতি আরো সুদূর প্রসারী হয়। লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর সম্মানে ভোজসভা অনুষ্ঠিত করেছিল। 

১৮৩২ এর শরৎকালে তিনি ফ্রান্সে যান। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট মানবহিতৈষী ডেভিড হেয়ারের এক ভাই। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে আমন্ত্রণ করে একত্রে ভোজন করেছিলেন। 


১৮৩৩ -এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ব্রিষ্টল আসেন। লন্ডনের তুলনায় শান্ত শহরটিতে এসে তাঁর ভালো লেগেছিল। কিন্তু অসুস্থ হয়ে সেখানেই ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ তিনি দেহত্যাগ করেন।
স্টেপলটন গ্রোভের কাছে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়েছিল। তাঁর বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর পরে বিলেতে গিয়ে সেই হতশ্রী সমাধি থেকে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করেন আর্নোস ভেলে এবং ভারতীয় স্থাপত্যে সুন্দর সমাধিটি তৈরি করিয়ে দেন।

তথ্য সূত্র: মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (১৮৮২)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

২। গোড়ার কথা

    সেকালের বাঙালিদের ভ্রমণ   ধারাবাহিক                         ---- সুমনা দাম   বাঙালির ভ্রমণ-প্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ঠিক কখন থেকে বাঙাল...